এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২০

0
1991

এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২০
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

পথের শেষ বাঁক পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও বৃষ্টি নামলোনা।এক সদ্য প্রেমে পড়া রমণীর আকুল আবেদনেও দু’ফোটা জল গড়ালোনা কিপটে আকাশ।মনটা অভিমানী হয়ে উঠলো প্রচন্ড।মাথার উপরের রংহীন বিস্তর সুবিশাল প্রাঙ্গনের দিকে একরাশ অজানা ক্ষোভ নিয়ে চেয়ে থাকার মাঝে ক্লান্ত চোখের পাতা কখন যেনো এক করে দিয়ে গেলো ঘুমপরীরা।প্রেমিকা কখন যেনো ঢলে পড়লো প্রেমিকের বুকের উপর।টের পাওয়া যায়নি।
বাতাসের তান্ডব একটু ক্ষান্ত হয়েছে।ঘুমন্ত রাত্রিকে একহাতে জড়িয়ে নিতে নিতে নিভ্রান বুঝলো,”এই মেয়েটাকে ছাড়া তার জীবনটা বৃষ্টিহীন বর্ষার মতো।পানসে শ্রাবণের মতো।মনহীন মানুষের মতোন।বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতোন।”
রাত্রি নড়ে উঠলো।বুকভরা উষ্ণতার মাঝে লুটোপুটি খেয়ে আদুরে হাতে নিভ্রানের পেট জড়িয়ে ধরলো।নিভ্রান তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে মৃদু গলায় ডাকলো,
—“চাচা?”তার হাল্কা ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো রিকশাওয়ালা চাচা।নিভ্রান মুখে হাসি ফুটিয়ে নিরালা স্বরে বললো,”একটু আস্তে চালান।ও ঘুমাচ্ছে তো।ঝাঁকি দিলে ঘুমটা ভেঙে যাবে।আমি ভাড়া বাড়িয়ে দিবোনে,আপনি একদম ধীরেধীরে চালান।”মধ্যবয়স্ক লোকটা যেনো একটু হোঁচট খেলো।সহসা রিকশায় যুবক-যুবতী উঠলে তিনি চক্ষুলজ্জায় হলেও পিছনে ফিরে তাকাননা।তার অভিজ্ঞ মন জানে পিছনে নিশ্চিত নিষিদ্ধ কাজকর্ম হচ্ছে।এই প্রথম এমন ব্যাতিক্রমি ঘটনার সাক্ষী হয়ে অজান্তেই হেসে উঠলো সে।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নিভ্রানের কথায়।

চলন্ত রিকশার চাকাদুটো থেমে গেলো একটা সময়।চাচার ডাকে হুঁশ ফিরলো নিভ্রানের।রাত্রি তখন শরীর ছেড়ে ঘুম দিয়েছে।চোখের পাপড়িগুলো বিন্দুমাত্রও নড়ছেনা।মেয়েটা যে কি পরিমাণে ক্লান্ত তা এই নির্জীব দেহটাই সশব্দে বলে দিচ্ছে।নিভ্রান কোনরকমে পকেট হাতরে মানিব্যাগ বের করলো।ভাড়া মিটিয়ে দিলো।
নির্নিমেষ চেয়ে থেকে দ্বিধাগ্রস্ত হাতে রাত্রির কাঁধ থেকে পড়ে কোলের উপর ছড়িয়ে থাকা ওড়না গলায় তুলে দিলো।গালে হাত রেখে কোমল কন্ঠে ডাকলো,”রাত,উঠুন।”
রাত্রি আধবোজা নয়নে পিটপিট করলো।মনে হচ্ছে শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যাথা।হাড়গুলো বাঁধা বাঁধা।।
নিভ্রান মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”আপনার বাসায় পৌছে গেছি।”
নিভানো গলায় “ওহ” বলে রাত্রি মাথা উঠালো বুক থেকে।নিভ্রান বাহুতে রাখা হাত সরিয়ে নিলো।
রাত্রি এলোমেলো চুল গুছিয়ে জামাকাপড় টেনে নিতেই নিভ্রান নিষ্প্রভ স্বরে বললো,”শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
রাত্রি একটু হাসার চেষ্টা করলো।মলিনগলায় বললো,
—“না,ঠি ক আছি।”

নিভ্রান নেমে গেলো রিকশা থেকে।হুট নামিয়ে দিয়ে রাত্রির পাশে যেয়ে মেজাজ করে বললো,”আপনিতো সবসময়ই ঠি ক থাকেন।আসুন।”বলে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।রাত্রি দিরুক্তি করলোনা।চুপচাপ নেমে দাড়ালো।রিকশাওয়ালা চাচা এক অদ্ভুত দায়িত্বশীল প্রেমিকের মনমাতানো যত্ন দেখে নিরবে হাসলেন।রিকশা নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতেই রাত্রি বুঝলো নিভ্রান ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।লোকটার কাছে দিনকে দিন ঋনীই হয়ে যাচ্ছে সে।প্রেমের ঋণ,যত্নের ঋণ আবার টাকার ঋণ।এত ঋণ কিভাবে মিটাবে?এখন ভাড়া প্রসঙ্গে কথা বললে লোকটা রেগে যাবে।বাড়ি যাওয়ার আগে রাগিয়ে দেয়ার দরকার নেই।আবার বড়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে।অগত্যা কিছু বলত যেয়েও থেমে গেলো সে।দৃষ্টি রাস্তায় নামিয়ে লতানো গলায় বললো,”আসি”।
নিভ্রান চেয়ে রইলো শুধু।বুকের ভেতর দাঙ্গা চলছে।এত কষ্ট হচ্ছে কেনো?আবার তো দেখা হবেই।
এই একদিনের বিচ্ছেদেই এত যন্ত্রনা তবে জীবনভর বিচ্ছেদ সে কি করে সইবে?অসম্ভব।অথচ মেয়েটা কি না তাকে সাতটা দিন ধরে এড়িয়ে চলছিলো।সে কিভাবে সয়েছে কোন ধারনা আছে?
রাত্রি গুটিগুটি পায়ে গেটের কাছাকাছি পৌছে যেতেই পেছন থেকে হাত আটকে ধরলো নিভ্রান।রাত্রি চকিতে তাকালো।নিভ্রান সেই মায়া চোখে চোখ রেখে ধারালো গলায় বললো,
—“”আমাকে আর কখনো এড়িয়ে চলবেন না রাত।কক্ষনো না।…মনে থাকবে?”

নিভ্রানের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে মূহুর্তেই চুপসে গেলো রাত্রি।লোকটা হঠাৎ এত রেগে গেলো কেনো?সে তো কিছুই করেনি।বারকয়েক আমতা আমতা করে মাথা দুলিয়ে ভীত কন্ঠে উওর দিলো সে,”থাকবে।”
নিভ্রান হাত ছেড়ে দিলো,”যান,যেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বেন।”
রাত্রি আবারো মাথা নাড়ালো।অর্থ্যাৎ,”সে ঘুমিয়ে পড়বে।”
__________________
নাহিদা বসে ছিলেন ড্রইংরুমে।প্রাণহীন চোখ থেমে আছে রংচঙা টিভি স্ক্রীনে।নওশাদ সাহেব বিকেলেই চলে গেছেন।নিশাদ আছে নিজের ঘরে।কাল তারা দুজন একসাথে বাড়ি যাবে।নিভ্রান একা থাকে।সে একাই থাকবে।এবার আর ফিরে যাওয়ার ব্যর্থ অনুরোধ টা করারও সুযোগ নেই।ছেলে তো তার সাথে কথাই বলেনা।
নাহিদার চোখ ভিজে আসলো।মেইন গেট খোলার শব্দে দ্রুত চোখ মুছলো সে।নিভ্রান এসে পড়েছে।বেল বাজায়নি কারণ তার কাছে চাবি আছে।নাহিদা মুখোমুখি সোফাটায় বসে ছিলো।না চাইতেও চোখে চোখ পড়ে গেলো।সুপ্ত অপরাধবোধটা আবারো জাপটে ধরলো নিভ্রানকে।মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করা তার মোটেও উচিত হয়নি।রাত ঠি কই বলেছে।শত হোক সে তো মা।
চোখ লুকিয়ে উল্টোপাশে ঘুরে দরজা আটকালো সে।নাহিদা উঠে দাড়ালো। টি ভিটা বন্ধ করে দিলো।নিশব্দে পা বাড়ালো রুমের দিকে।নিভ্রান দীর্ঘ-শ্বাস ফেললো।মায়ের সাথে একটু কথা বলার সুযোগও কি হবেনা?

রাতের খাওয়া একসাথেই সাড়া হলো।তবে খুব নিশ্চুপে।নিশাদ ছাড়া কেউই কোন কথা বলেনি।একপাক্ষিক কথা চালিয়ে যেতে না পেরে একপর্যায়ে নিশাদও চুপ হয়ে গেছিলো।
রাত তখন এগারোটা চব্বিশ…
ঘরের মধ্য বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে অবশেষে নাহিদার রুমে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়লো নিভ্রান।
নাহিদা চোখ খুলেই শুয়ে ছিলো।হঠাৎ নিভ্রানের আগমন বেশ অবাক করলো তাকে।উঠে বসতে বসতেই
নিভ্রান পাশে এসে আচমকাই তার হাতদুটো মুঠোবন্দি করে ফেললো।উল্টোপিঠে চুমো খেয়ে ছেলেমানুষি কন্ঠে বললো,
—“আমাকে ক্ষমা করা যায়না মা?”

নাহিদা কেঁদে উঠলো।হু হু করে চোখের জল ছেড়ে দিলো।মান অভিমান ভুলে হেঁচকি তুলে বললো,
—“আমি কি তোর খারাপ চাই?মানছি মেয়েটাকে অনেক ভুলভাল বলেছি।কিন্তু তুই কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতিনা?একবারো বলেছিস?বলেছিস যে ওকে ছাড়া তোর একেবারেই চলবেনা?বললে কি আমি আপত্তি করতাম?আমাকে কি এতই পাষাণ মনে হয়?”

নিভ্রান মুচকি হেসে আবারো চুমু খেলো হাতে।বললো,”এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি মা।”

নাহিদা শান্ত হলেননা।কেঁদে চললেন অবিশ্রাম।নিভ্রান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।হাত বাড়িয়ে গালের পানি মুছিয়ে দিয়ে মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো।বাচ্চাদের মতে শাসন করে বললো,
—“আর কেঁদোনা।তোমার মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠে যাবে।”

নাহিদা কান্না থামালেন।বুকটা হাল্কা লাগছে।আলতো করে নিভ্রানের মাথার চাঁটি মারলেন তিনি।নাক টেনে বললেন,”মায়ের এতো খেয়াল রাখতে হবেনা।”
নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,
—“একশবার হবে।..তুমি কাল যেওনা।আরো ক’টাদিন থেকে যাও।”

—“মেয়েটাকে আবার নিয়ে আসিস।ভালো করে কথা হয়নি।”

—“সে আসতেই চায়না।”হতাশ কন্ঠ নিভ্রানের।

নাহিদা হাসলেন।নিভ্রানের কপালের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বিয়ে করবি কবে?”

নিভ্রান অন্যমনষ্ক গলায় বললো,”করবোতো,সময় হোক।”
________________
ঘরে এসে বেশ কয়েকবার ফোন লাগিয়েও ওপাশ থেকে কোনরুপ সাড়া পাওয়া গেলোনা।রাগটা আবারো দপ করে জ্বলে উঠলো।মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আগ্রাসী অনুভূতি।বাকিসব ভুলে তখন কেবল রাগটাই মূখ্য হয়ে উঠলো।মেয়েটাকে বলে পর্যন্ত আসলো এড়িয়ে না চলতে অথচ দু’তিনঘন্টা না পেরোতেই আবার অবহেলা শুরু হয়ে গিয়েছে?তার একটা কথাও মান্য করা যায়না?এত অবাধ্য মেয়েকে সামলানো সম্ভব?কক্ষণো না।
নিভ্রান আবার কল দিলো।রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলোনা।একপর্যায়ে লাইন কেটে গেলো।রাগের চোটে ফোনটা সজোরে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো সে।বাউন্স করে তা ফ্লোরে ছিঁটকে পড়লো।ভাঙার শব্দ!
নাহ্,সহ্য করা যাচ্ছেনা।কাল আর কিছুতেই নরম হওয়া যাবেনা।হুমকি ধামকি না দিলে এই মেয়ে ভালো হবেনা।
মনে মনে রাত্রিকে কড়া করে কয়েকটা ধমক দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে ঘুমাতে গেলো নিভ্রান।অথচ পাগলাটে প্রেমিক মন বুঝতেই পারলোনা তার অবাধ্য প্রেয়সী যে প্রেমিকের কথা মেনে ঘরে ফিরেই বাধ্য মেয়ের মতোন ঘুমিয়ে পড়েছে।তার আর ফোন তোলার সময় কোথায়?

~চলবে~

[কাল পরীক্ষা আছে।গল্প দিতে পারবো কিনা জানিনা।তবে না দিলে বিকেলেই জানিয়ে দিবো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here