মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি ১০

0
617

#মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি ( ১০)

অসুস্থ মায়ের হাত জড়িয়ে বসে আছে আওয়ান। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। যেন এখনি গড়িয়ে যাবে কয়েক ফোঁটা জল। তবে কোনো বিশেষ মাধ্যমে আটকে আছে সেই বিন্দু ফোঁটা। সুষমা মাথার উপরে থাকা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শ্বাস গুনছেন। তিনি খুব করে অনুভব করেছেন এই পৃথিবী তে ওনার সময় ফুরিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কেউ ম’রতে চায় না। সুষমা ও চায় না ম’রতে। এর পেছনে ও বিশেষ কারন রয়েছে। শান্তির জন্য মানুষ ম’রন চায়।তবে ওনার তো ম’রে গিয়ে ও শান্তি নেই। এই ছেলে মেয়ে দুটোর কেউ নেই যে। বাবা থাকতে ও আজ বহু দূরে। এতো দিনে হয়তো অন্য কোথাও সংসার পেতে নিয়েছে। আবার না ও হতে পারে। সুষমা চলে আসার পর পর ই নাকি দেশ ছেড়েছে এমন টাই খবর পেয়েছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য ভদ্র লোক ছেলে মেয়েদের প্রচুর ভালোবাসেন সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে টাকার প্রতি লোভ সেই ভালোবাসা তে ও খাদ নামিয়েছিলো। এসব স্মৃতি তেই কেমন ভারী হয়ে আসে বুক। মেয়েটা নিতান্ত ই ছোট মানুষ। তবে ছেলেটা বোঝদার। এক মাত্র ভরসা ওনার। অনেক সময় গেলে ও আওয়ান কথা বলছে না। নৈঃশব্দ্যে বুকে জড়িয়ে আছে মায়ের হাত। মমতাময়ী মায়ের জন্য অন্তর টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বেদনা গুলো পাল্লা ভারী করে চলেছে। এর শেষ কবে, কোথায় আর কিভাবে?
” আমি চলে গেলে কষ্ট পাবি বাবা? ”

” এমন কথা বলিও না আম্মি। আমার কষ্ট হয় খুব। ”

” একটা সময় তো যেতে হবেই তাই না। ”

আওয়ান নিরুত্তর। এই চিরন্তন সত্য কে মানতে পারছে না কিছুতেই। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। সুষমা আর কথা আগান নি। ছেলেটার ভাঙা মন কে আর ভেঙে দিতে চান না তিনি। কিছু মুহূর্ত পর খাবারের প্যাকেট নিয়ে কেবিনে এলো তিয়া। কাল রাত থেকে এখানেই পরে আছে মেয়েটা। ভাগ্যিস পরীক্ষার মাঝে চার দিনের বিশাল গ্যাপ টা পরেছে। বাটি তে স্যুপ ঢেলে নিতে নিতে আওয়ান কে বলল তিয়াশা–
” কাল থেকে না খেয়ে আছিস। যা খেয়ে নে। আমি আন্টি কে খাইয়ে দিচ্ছি।”

” তুই খাবি না? ”

” একটু পর। আন্টি কে খাইয়ে তারপর। ”

সুষমার কাছে এগোলো তিয়া। মৃদু হেসে অতি যত্নে স্যুপ টুকু বাড়িয়ে দিলো। নিজের জীবন থেকে একটি কথা বুঝেছেন সুষমা। আর সেটা হলো র’ক্তের থেকে মনের সম্পর্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে সম্পর্কে বন্ধুত্ব নেই সেটা সম্পর্ক নয় সেটা প্রয়োজন মাত্র।
টুল নিয়ে ঠায় বসে আছে আওয়ান। চোখ গুলো জানালা পেরিয়ে অদূরের সাড়ি সাড়ি পাইন গাছের দিকে। গাছপালা গুলো কেমন সজীবতায় ভরপুর। তিয়া বলল–
” খাবার টা খেয়ে রেস্ট নে একটু। ”

” তুই এলে এক সাথে খাবো। ”

তিয়াশা আর কোনো মতামত দেয় নি। সুষমা কে খাইয়ে দিয়ে অন্য প্যাকেট এর খাবার সাজাতে লাগলো। কাল রাতে শাম্মি, সানিন, সুমিতা, প্রজ্জোল, জিমাম সকলেই ছিলো এখানে। ভোরের দিকে এদের সবাই কে পাঠিয়ে দিয়েছে তিয়া। অন্য দিকে কেঁদে যা তা অবস্থা করেছে আরুশি। সুমিতা ওর সাথে করেই বাড়ি তে নিয়ে গেছে রেস্ট করানোর জন্য। মেডিসিন বক্স নিয়ে কেবিনে নার্স এলো। আওয়ান আর তিয়া কে দেখে বলল
” রোগীর রেস্ট প্রয়োজন। আপনারা থাকলে ঘুমাতে পারবে না। ”

” আচ্ছা আমরা চলে যাচ্ছি। ”

নার্স স্যালাইন বদলে দিয়ে, সাথে একটা ইনজেকশন পুস করে দিলো।
খাবার গুছিয়ে বেরিয়ে এলো তিয়া। আওয়ান তখনো বসে আছে ঘাপটি মেরে। চোখের ইশারায় ডাকলো তিয়াশা। কোনো মতে অশ্রু কনা আড়াল করে বেরিয়ে এলো আওয়ান। খাবার খেতে গিয়ে ও গলা দিয়ে নামছে না খাবার। বহু কষ্টে শুকনো রুটি গুলো চিবুচ্ছে। ওর খেতে কষ্ট হচ্ছে দেখে তিয়া আবার নিচে গিয়ে লিকুইড খাবার নিয়ে এলো। এতে যদি একটু বল পাওয়া যায় শরীরে।

দেখতে দেখতে কেঁটে গেল অনেক গুলো দিন। শেষ এক্সাম চলছে আজ। তিয়ার মন আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সেই কারনে কমন পরে নি আজ। আওয়ান চোখ পাকিয়ে বিরোধ করলো। তিয়াশার ঠোঁট উল্টানি তে বিরক্তি নিয়ে দুটো লুজ পেপার লিখে ও দিলো। মেয়েটা কে আর সাহায্য করা যাবে না। এতে করে নিজের প্রতি ভরসা হারিয়ে অন্যের উপর নির্ভর হয়ে যাবে। হল থেকে বেরিয়েই আওয়ানের হাত চেপে ধরলো তিয়া। ইশারা করে বলল আওয়ান–
” কি? ”

” দোস্ত আন্টি সুস্থ। তুই ও ঠিক আছিস। আমরা প্লিজ ঘুরতে যাবো। ”

” জী না। আমি যাচ্ছি না। ”

” সবাই খুব আশা করেছে রে। ”

” আমি পারবো না যেতে। তোরা যা সবাই।”

সামনে তাকাতেই কয়েক জোড়া চোখের রোষে পরতে হলো ওকে। অবেশেষে হার মেনেই নিলো। পার্কে যাবে সবাই এটাই মনস্থির করা হয়েছিলো। সেই অনুযায়ী পার্কের পথে অগ্রসর হলো।

*

পরীক্ষা শেষ। এবার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করা। পরীক্ষার আগে যে ভয় কাজ করে তাঁর থেকে সহস্র গুন ভয় হয় রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা কৃত সময় গুলো তে। তিয়াশা এক চপ্পর ঘুরে এসেছে মামা বাড়ি থেকে। তবে সেখানে বেশি দিন থাকা হয় নি। পরিবেশ টা ভালো লাগে নি ওর। কেমন যেন অস্বস্তিকর। মেঝে তে মাথা আর শরীর বেডে রেখে শুয়ে ছিলো। ঠিক তখনি হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করলো আওয়ান। ওর অবস্থা দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো। সেই হাসির শব্দে উঠে পরলো তিয়াশা। আওয়ানের বাহু তে চাপর মে’রে বলল
” কি হইছে তোর। আমাকে কি জোকার মনে হয়? ”

” জোকারের থেকে ও অদ্ভুত তুই। ”

” আজব কথা বলবি না তো। তা এই অসময়ে কেন এসেছিস? ”

” শুধু আমি নই দল বল সবাই এসেছে। ”

” কিন্তু কেন? ”

কিছুটা আশ্চর্য হয়েই বললো তিয়াশা। মিচকে হাসার মতো ভাব করে ঠোঁট দুটো চিকন করে সুর বাজালো
আওয়ান। এই ছেলের অযাচিত আচারণ ভালো লাগে না একদম। তাই রুম থেকে বেরিয়ে এলো ড্রয়িংএ। এক দল বাহিনী দেখে অবাক ই হলো। তবে প্রশ্ন না করে বুয়া কে বলে নাস্তা দিতে বললো। টিভি অন করে এক টা হিন্দি সিনেমার গান বাজিয়ে বসলো কাউচে। তারপর বলল—
” এই অসময়ে কেন আগমন সবার? ”

” বিয়ে। ”

” কার বিয়ে? ”

লাফিয়ে উঠলো তিয়াশা। সুমিতা চোখ দুটো গোল করে শুধালো
” তুই কি মজা করছিস? ”

” মানে। আমি কেন মজা করবো। ”

সুমিতা ইশারা করে কিছু বলছে শাম্মি কে। শাম্মি নিজে ও হতবাক। ওদের দুজনের থেকে বিরক্তির দৃষ্টি ফেলে সানিন কে বলল
” কি হয়েছে বল তো। সবাই এই অসময়ে এক সাথে। ”

” তোর বিয়ে আর তুই এই কথা বলছিস? ”

” মানে? আমার বিয়ে কে বললো তদের। ”

বোকা হাসি দিয়ে নিজেও চিন্তিত হয়ে গেল তিয়াশা।সকলে কেমন করে তাকিয়ে আছে। তাহমিদার সাথে কথা বলছে আওয়ান। ভদ্র মহিলার সাথে আওয়ানের এতো কিসের কথা কে জানে! হঠাৎ করেই এই ছেলের প্রতি রাগ উঠে গেল। চোখ দুটো কেন যেন জ্বালা করছে খুব। নিজের ঘরে গিয়ে ধপ করেই দরজা লাগিয়ে মেঝে তে বসলো তিয়াশা। কিয়ৎক্ষন বাদে নিজের আচারণ দৃশ্যমান হলো ওর নিকটে। চমকায়িত হয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে দাঁড়ালো আয়নার সম্মুখে। হালকা হাতে অবয়ব টি স্পর্শ করে বলল–
” হঠাৎ করে আমি এমন করলাম কেন! ”

তামজীদ এসেছেন অফিস থেকে। তিয়াশা কে সকলের মাঝে দেখে বললেন
” একি মামুনি এখনো রেডি হও নি কেন?”

” একটু পর যাবো আব্বু। ”

” না না এখনি যাও। সবাই এসে পরবে তো। শাম্মি ওকে নিয়ে সাজিয়ে দাও তো মামুনি। ”

” জী আঙ্কেল। ”

শাম্মি আর সানিন জোড় করেই নিয়ে গেল তিয়াশা কে। সুমিতা আর আওয়ান সাজ সজ্জার কাজ করে চলেছে। প্রজ্জোল আর জিমাম বাকি আয়োজনে ব্যস্ত। ঘরোয়া ভাবে পাকা দেখার আয়োজন চলছে। তিয়াশা একটু আগেই জানতে পারলো সেটা। দ্বিমত না করলে ও খুব বেশি মত আছে এমন ও নয়। তবে অন্তকর্ন থেকে বাঁধা প্রদান হলো না। অজান্তেই সায় জানাচ্ছে মন।

আয়োজন শেষ। ঘেমে একাকার আওয়ান। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে শার্টের দুটো বোতাম খুলে নিলো। সানিন এসে বসলো ওর পাশে। ইশারা করে বুঝালো পাশের দিকে তাকাতে। শাড়ির কুঁচি ধরে খোলা চুল মেলে আসছে তিয়াশা। চোখে মুখে সামান্য বিরক্তি ভাব। জীবনে প্রথম বারের মতো শাড়ি পরেছে কি না। তবে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। চোখ ফিরিয়ে নিলো আওয়ান। মধু প্রিয়া কল করেছে। তিয়া কাছে আসতেই হাতের ইশারা দিয়ে বোঝালো কল এসেছে। আওয়ান চলে গেল সাইটে। তিয়াশা সে দিকে এক বার তাকিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মজে গেল। এক বার হাসছে তো আরেক বার রাগি চোখে তাকাচ্ছে। যেন সব থেকে খুশি মানবী।

” আমার জন্য তোমার সময় ই নেই আওয়ান। দেখা স্বাক্ষাৎ তো বহু দূর। ”

” সকালে দু বার কল করেছি মধু। তুমিই রিসিভ করো নি। ”

” হু দেখলাম। এখন দেখা করবে কবে?”

” কাল ভারসিটি গিয়ে দেখা করে আসবো।”

” না আজ ই আসো প্লিজ। ”

” তিয়াশার বাড়ি তে আছি। আজ আসতে পারবো না। ”

” ঐ বাড়ি তে কেন? ”

” ওর বিয়ের কথা বার্তা চলবে তাই। ”

” ও আচ্ছা। রাতে কল করবে বুঝলে। আই মিস ইউ অলোয়েজ এন্ড আই লাভ ইউ জান। ”

” হুম পরে কথা হবে। লাভ ইউ টু। ”

কল কেঁটে দিয়ে থামলো আওয়ান। শ্বাস গুলো ভারী ঠেকছে এবার। মধুপ্রিয়ার প্রতি আকর্ষণ টা যেন কেমন ঘোলাটে। হঠাৎ হঠাৎ কেবলি মনে হয় তবে কি আমি ঠকাচ্ছি ওকে?

** সবাই কে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।আল্লাহ আমাদের সবার মাঝে রহমত দান করুন। সর্বশেষ সবাই কে রোজা রাখার তৌফিক দান করুক। **

#চলবে
#মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here