#স্বপ্নছায়া
#২৯তম_পর্ব
রাত আটটা,
বদরুল সাহেবের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিউ। দুপুরের খাবারের পর থেকে নীলাদ্রির দেখা মিলে নি আর। মামার সাথে কিছু একটা কানাগোসা করছিলো সে। তারপর হনহনিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছে। ফোনটাও বন্ধ। দুবার ফোন দেবার পর ও নট রিচেবেল দেখিয়েছে। তাই পিউকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। একটু পর ও বাড়ি থেকে ফোন আসবে। ওরা হ্যা বলে দেবার আগেই মামাকে সব খুলে বলা জরুরি। বুকে ফু দিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করবে, তখন ই তার কানে এলো,
– আরিফ ভাই ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার ছেলের সাথে আমি আমার ভাগ্নীর বিয়ে দিতে চাই না। আমার ভাগ্নী এ বিয়েতে রাজী নয়। আমার তাড়া আছে ঠিক ই, কিন্তু এতোটাও নেই যে তার অমতে আমি তার বিয়ে দিবো।
-………….
– আশ্চর্য তো! আপনাদের ছেলেকে আমাদের ভালো লাগে নি। তাই বিয়েটা কেঁচে দিচ্ছি। এতে এতোটা অভিমান করার কি আছে ভাই?
-……….
– ভালো ছেলের অভাব নেই! আপনার ছেলের সাথে বিয়ে না হলে আমার ভাগ্নীর বিয়ে হবে না এটা কেমন কথা! আর বিয়ে না হলে তো আরোও ভালো,, আমি আমার ভাগ্নীকে আমার কাছে রেখে দিবো। এটা ভালো নয় কি!
বদরুল সাহেবের কথায় হয়তো আরিফ সাহেব চটে গেছেন। তিনি ফোন রেখে দিয়েছেন হয়তো খট করে। বদরুল সাহেব তার ফোনটি রেখে গা এলিয়ে দিলেন বিছানাতে। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকালেন। পিউ এতোক্ষন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে তার আরিফ সাহেবের সাথে পুরো কথোপকথনটা শুনেছে। তার মাথায় ঢুকছে না বদরুল সাহেব তার অপছন্দের ব্যাপারটা জানলেন কি করে! খানিকটা ইতস্ততবোধ ও হচ্ছে। দ্বিধা হচ্ছে এখন ভেতরে যাওয়া টি ঠিক হবে নাকি!
– বাইরে দাঁড়িয়ে নখ না কেটে ভেতরে আয়
বদরুল সাহেবের বাজখাই কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো পিউ। ধীর পায়ে সুরসুর করে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে পিউ। তাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বদরুল সাহেব আবারো বলে উঠেন,
– আকাম করার সময় মনে থাকে না? এখন মাথা নিচু করে রাখসিস কেনো?
– সরি মামু
– তোর সরি দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো আমি? চেয়ারটা টেনে বয়।
পিউ ছোট্ট করে “হু” বলে চেয়ারটা টেনে বদরুল সাহেবের সামনে বসে। লজ্জায় মামুর দিকে তাকাতে পারছে না সে। বুকের ভেতর একটা অশান্তি কাজ করছে। হয়তো এটা অপরাধবোধের কারণে হচ্ছে। মামুর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে সে। বদরুল সাহেব পিউ এর নত মস্তক দেখে হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
– নাম কি ছেলেটার?
– হ্যা?
– যাকে ভালোবাসিস বলে দাবী করছিলি, নাম কি?
– তুমি রাগ করবে না তো?
– আমাকে দেখলে কি তোর জল্লাদ মনে হয়? বল নাম কি সেই ছেলের!
– নীলাদ্রি আহসান।
– নীলাদ্রি মানে আমাদের নীলাদ্রি?
পিউ মাথা নাড়ালো। বদরুল সাহেবের ভ্রু খানিকটা কুঞ্চিত হলো। তিনি চিন্তায় পড়ে গেছেন। পিউ আড়চোখে তার মুখভঙি অবলোকন করতে লাগলো। মামার মনে কি চলছে সেটা জানার ব্যার্থ চেষ্টা লাগালো। নিস্তব্ধতা ভর করলো রুমে। বদরুল সাহেবের মুখ থেকে একটা শব্দ ও বের হলো না। এদিকে পিউ এখনো চেয়ারেই বসে রয়েছে। অপেক্ষা করছে মামার প্রতিক্রিয়ার। হয়তো তার মামু এতোটাই হতবাক হয়েছেন যে কি প্রতিক্রিয়া দিবেন ভুলে গেছেন।
নীলাদ্রি যখন বাসায় ফিরলো তখন রাত বারোটা। দরজা খুলতেই আতকে উঠলো ঐন্দ্রিলা। তার মনে হলো তার সামনে কোনো বিধ্বস্ত, পরাজিত মানব দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তার শার্ট টা কুচকে আছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বললো,
– ভাইয়া কি হয়েছে?
নীলাদ্রি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। ঐন্দ্রিলাকে পাশ৷ কাটিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বললো,
– এক গ্লাস লেবুর শরবত দে তো। গলা টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ঐন্দ্রিলা হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেলো। মিনিট দশেক পর এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে ফিরে গেলো। গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
– কি হয়েছে এবার তো বল! এরকম বিধ্বস্ত লাগছে কেনো তোকে? তুই কি মারপিট করে এসেছিস? তুই পারভেজ কে মেরেছিস তাই না? কথা বলছিস না কেনো?
– চেঁচাচ্ছিস কেনো? একসাথে এতো গুলো প্রশ্ন করলে আমি কেনো কেউ ই উত্তর দিতে পারবে না।
– ভাই সত্যি করে বল, কি আকাম করে এসেছিস তুই!
– আমাকে কি গুন্ডা মনে হয়? আমি কি শুধু মারপিট ই করি?
– তাহলে কোথায় ছিলি এতোক্ষন! সেই বিকেলে বের হয়েছিস! তারপর থেকে তোর ফোন অফ! জানিস কতোটা চিন্তা হচ্ছিলো!
– অহ! ফোনটা ভেঙ্গে গেছে! তাই হয়তো বন্ধ ছিলো!
– ফোনটা ভাঙ্গলো কিভাবে?
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হচ্ছে নীলাদ্রি। তার একেবারেই ভালো লাগছে না, অহেতুক প্রশ্নোত্তরের খেলা খেলতে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
– প্যান প্যান শেষ হয়েছে তোর? আর তুই এতো জেরা করছিস কেনো রে? আমি তোর বড় ভাই ভুলে যাস না! ভালো লাগে না যতসব। আমি রুমে গেলাম, আমাকে আর জ্বালাতে আসবি না বলে দিলাম।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। ঐন্দ্রিলা দৃষ্টি সরু করে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে। কেনো যেনো আজকে নীলাদ্রিকে অন্যরকম লাগছে। জীবনের উপর যেনো তার বিতৃষ্ণা জেগেছে। রুমের দিকে যেতে যেতে থেমে গেলো সে। নিচু গলায় বললো,
– দিশাকে বলিস, বিয়েটা ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই। যেটা যেমন চলছে, চলুক।
বলেই নিজের রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা দিয়ে দিলো নীলাদ্রি। ঐন্দ্রিলা হতবাক দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। নীলাদ্রি কি এতো তাড়াতাড়ি হার মেনে নিলো! সে কি নিজের ভালোবাসাকে মাঝপথেই ছেড়ে দিবে!
সুগাঢ় অন্ধকারে বসে রয়েছে নীলাদ্রি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে সিগারেটের ধোয় মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের অস্থিরতা, যন্ত্রণাগুলো গলা অবধি এসে দলা পাকাচ্ছে। ভালোবাসার বিষাক্ত অমৃত পান করেছে সে! এমনটা তো হবার ই ছিলো। যতদিন এই ভালোবাসাটা সুপ্ত ছিলো ভালোই ছিলো, কোনো আকাঙখা ছিলো না। হৃদয়টা লোভী ছিলো না। কিন্তু এই ক দিনে সেটা অত্যধিক লোভী হয়ে উঠেছে, স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। এজন্যই তো পিউ এর সুখের দিকে তার নজর ই গেলো না। নীলাদ্রির নিজেকে আজ পরাজিত মনে হচ্ছে, নিজের ব্যর্থতা তাকে জানান দিচ্ছে তুমি পিউ এর যোগ্য নও। বিকেলে এক ফাঁকে বদরুল সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ পারভেজকে দেখিয়ে বলেছিলেন,
– ছেলেটাকে কেমন লাগলো তোমার? পিউ এর সাথে মানাবে না? আমার কিন্তু বেশ পছন্দ৷ ভালো চাকরি করে, বাইরে স্যাটেল লাইফ। পিউ কে সুখে রাখবে। আর কি চাই বলো! অনাথ ভাগ্নীটা আমার এবার সকল দিক থেকে সুখী হবে। তাই না?
বদরুল সাহেবের চোখ চকচক করছিলো। নীলাদ্রি কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সত্যি ই তো পারভেজের তুলনায় সে কিছুই না। আজকাল ভালোবাসা দিয়ে আর যাই হোক ঘর চলে না। নীলাদ্রি বেতন পয়ত্রিশ হাজার টাকা। এভারেজ বাঙ্গালীর আদর্শ বেতন, চলার জন্য যথেষ্ট থেকে উপরে। কিন্তু পারভেজের তুলনায় সেটা নগন্য। নীলাদ্রির বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাবার চিকিৎসাতে। বাকি যা থাকে তা নিয়ে তাদের মাসটা চলে যায়। নিজেদের বাসা হওয়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তাকে। কিন্তু পিউকে সে সকল ধরনের আর্থিক সুখ দিতে পারবে না। পিউ কে কষ্ট করতে হবে, হয়তো চাকরিও করতে হতে পারে। তবে মেয়েটিকে সে প্রচুর ভালোবাসা দিতে পারবে। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে পারবে সে মেয়েটিকে। হয়তো প্রতিদিন মাংসভাত খাওয়ানো সম্ভব হবে না তার জন্য। তবে মোমের আলোতে ভর্তাভাত খাওয়াতে খুব একটা অসুবিধাও হবে না। হয়তো গাড়িতে চড়াতে পারবে না। কিন্তু সিএনজিতে করে কোথাও নিয়ে যেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না তার। ঈদে চাঁদে ভালো পোশাক কিনে দিতে পারবে সে, মাসে একবার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে, এভাবেই জীবন পিউকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু পারভেজের ক্ষেত্রে এই কমপ্রোমাইজ গুলো পিউ কে করতে হবে না। বরং তার জীবনে বিলাসিতার অভাব হবে না। পিউ আর্থিক ভাবে সুখী হবে। পিউ কষ্টবিহীন জীবন কাটাবে। এটা কি ভালো নয়! ভালোবাসা দিয়ে আর যাই হোক পেট তো ভরে না! কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে নীলাদ্রির। এতোবছরের ভালোবাসাটা শেষমেশ অপূর্ণই থেকে যাবে! ভাগ্য এতোটা নির্মম কেন হয়! কেনো আমরা যা চাই সেটা পাই না! নীলাদ্রি সিগারেটে টান দিলো। চোখ থেকে বিষাধ সিন্ধুর একটা স্রোত নেমে এলো_______________
মাথার উপর ভনভন করে ফ্যানটা ঘুরছে। কিন্তু তাতে গরম হার মানছে না। ভাদ্র মাসের চরা গরম শরীর যেনো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহাশ বসে আছে তার রুমে। একমাস হয়েছে কলেজে চাকরি নিয়েছে। জীবনটাকে বেশ চমৎকার করে সাজিয়ে নিয়েছে সে। আজকাল জীবনটাকে ভালোবাসতে লেগেছে। শওকত সাহেবের সাথে সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়ে উঠেছে৷ এখন আর শওকত সাহেব তাকে এড়িয়ে চলেন না। ঐন্দ্রিলার সাথে সম্পর্কটা ঠিক না হলেও খুব একটা খারাপ ও নেই। সেদিন মেয়েটা শারমিন বেগমের সাথে দেখা করতে এসেছিলো। তার কাজিনের বিয়ে তাই সেখানে তাকে থাকতে হচ্ছে। তখন তার সাথে আহাশের দেখা হয়েছিলো। মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে মিষ্টি করে বলেছিলো,
– ভালো আছো?
উত্তরে আহাশ ও বলেছিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ।
এইটুকুই কথা হয়েছিলো তাদের মাঝে। বিকেলে চলে যাবার সময় তাকে বলেছিলো,
“আসি”
আহাশের জড়তা খানিকটা হলেও কেটে গিয়েছিলো। অতীত নিয়ে ঐন্দ্রিলা তার সময় নষ্ট করছে না। বরং অভ্রের সাথে একটা সুন্দর জীবন বেঁছে নিয়েছে সে। তাহলে আহাশের ও উচিত নিজেকে জড়তার মধ্যে না রাখা। সে যা করেছে তা ক্ষমার যোগ্য নয়, কিন্তু ঐন্দ্রিলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তাকে মুক্ত করে দিয়েছে। সুতরাং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবার অধিকার তার ও আছে। সেটাই করছে সে। নিজেকে পালটে ফেলার অদম্য চেষ্টা তাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না। বাবা-ভাইয়ের উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করা ছেড়ে দিয়েছে সে। এখন আহাশ মুক্ত।
বিকেল ৫টা,
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হলদে রোদ পিউ এর গায়ে আছড়ে পড়ছে। নীলাদ্রির দৃষ্টি শুন্যের দিকে। আর পিউ এর অগ্নিদৃষ্টি তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। নীলাদ্রি তার অগ্নিদৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললো,
– বিয়েটা করে নাও পিউ। তোমার জন্য ভালো হবে……….
চলবে
[ ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল বিকেলে পোস্ট করবো। অনুগ্রহ পূর্বক কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি