#স্বপ্নছায়া
#১৭তম_পর্ব
নীলাদ্রির সামনে পিউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে আসমানী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা করেছে সে, তাতে বেলীফুলের মালাও গুজেছে। চোখে মোটা করে কাজলের বাহার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, আর দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। তার সাজের বাহারের কারণটা নীলাদ্রির জানা নেই। তবে পিউ এর সাজসজ্জা নীলাদ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র করে দিয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের অবস্থা প্রকাশের উপায় নেই। কারণ তার সামনে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সে পিউকে নিয়ে সকাল সকাল তাদের বাড়ি এসেছেন। নীলাদ্রি অফিসের জন্য বের ই হচ্ছিলো তখনই তাদের আগমণ। তার নাকি নীলাদ্রির সাথে কাজ, কিন্তু কখন থেকে শরীফ সাহেবের সাথে খাজুরে আলাপে লেগেছে সে। নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– খালু, আমার উঠতে হবে। অফিসে নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
– অফিসে যাবার পথে পিউমা কে একটু হাসপাতালে ড্রপ করে দিবে। ইবনে সীনা হাসপাতালের সামনে ড্রপ করে দিলেই হবে। ওর পাশেই ওর বান্ধবীর বাসা। আজ তারা বাহিরে ঘুরতে যাবে।
ইবনে সীনা হাসপাতাল শুনতেই নীলাদ্রি চোখ কুচকে তাকায় পিউ এর দিকে। পিউ এর মুখোভাব তাতে বদলালো না। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে মামুর সামনে নীলাদ্রি তাকে কিছুই বলতে পারবে না। নীলাদ্রির অগ্নিদৃষ্টিকে তাই অগ্রাহ্য করা যেতেই পারে৷ নীলাদ্রির বুকে ত্রাশ তৈরি হয়। পিউ সেজেগুজে শিহাবের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে না তো৷ কারণ এই ইবনে সীনা হাসপাতালেই শিহাব ভর্তি রয়েছে। আজ হয়তো ডিসচার্জ করিয়ে দিবে। নীলাদ্রির মুখটা ভার হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই সেদিনের আচারণটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পিউ সেদিনের পর থেকে আজ ই তার সামনে এসেছে, তাও বদরুল সাহেবের সাথে। একা হলে হয়তো কখনোই তার সামনে আসতো না। যতই সে উচ্চগলায় দাবি করুক সে পিউকে ভালোবাসে, পিউ তার প্রেমনিবেদন গ্রহন না করলে সে সব বৃথা। তখন নীলাদ্রির পরিচয় হবে কেবল একজন ব্যার্থ প্রেমিক। তাকে সমাজ ব্যর্থ প্রেমিকের নজরেই দেখবে। থাকবে না পিউ এর উপর কোনো জোর, থাকবে না কোনো অধিকার। পিউ তখন মুক্ত। যতই হোক, ভদ্র ঘরের ছেলে যে, প্রেমিকা তাকে ফিরিয়ে দিলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করার মতো নিম্মমানসিকতা না নেই। নীলাদ্রির ভার মুখটা দেখে শরীফ সাহেব জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
– কি হলো নীল, তোর মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো? শরীর ভালো নেই?
– বাবা, শরীরের কি দোষ। মনটাই আজকাল নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আমি আসছি। আমার দেরি হচ্ছে।
– পিউকে নিবি না?
– ওকে না নেবার কোনো কারণ তো নেই। খালু আদেশ করেছেন।
নীলাদ্রির কথার মর্মার্থ বদরুল সাহেব কিংবা শরীফ সাহেব বুঝলেন না। তারা হা করে শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পিউ তাদের ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখগুলোকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,
– মামু আসলাম। খালু আসি। তোমরা দুজন মনে করে ঔষধ খেয়ে নিবে। আমি দিশাকে বলে দিয়েছি যদিও। তাও তোমাদের ও বলে গেলাম৷ আসি
পিউ কথাটা বলে নীলাদ্রির পিছু পিছু ছটলো। পিউ যাবার পর বদরুল সাহেব হো হো করে হয়ে সে উঠলেন। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললেন,
– দেখেছেন দুলাভাই, মনে হয় মা শাসন করছে।
– একদম ঠিক বলেছো, ঐন্দ্রি মাও এভাবেই আমাকে শাসন করতো। যখন ওকে প্রথম কোলে নিয়ে ছিলাম আমার মনে হয়েছিলো আমার মা ছোট্ট রুপে আমার কোলে এসেছে। মেয়েটাকে দেখি না কতোদিন হয়ে গেছে। আসলে মেয়েরা হয় ই এমন। মায়ায় জড়িয়ে অন্য কারোর ঘরে চলে চায়। দেখবে পিউ আর দিশার বিয়ের পর ঘরটা একেবারেই ফাঁকা হয়ে যাবে। খা খা করবে ওদের খিলখিল হাসির জন্য। ওদের দুটো বুলির জন্য। ওদের নুপুরের গুঞ্জনের জন্য, ওদের গলার স্বরের জন্য।
শরীফ সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। বদরুল সাহেবের মনটা ও বসে গেলো। পিউ এবং দিশাকে যদি নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন কি ভালোটাই না হতো___________
ইবনে সীনা হাসপাতালের করিডোরে হাটছে পিউ এবং নীলাদ্রি৷ পুরোটা রাস্তা লোকটা একটা টু শব্দ করে নি পিউ এর সাথে। শুধু মন মরা হয়ে এক দিকে চেয়ে ছিলো। নীলের এই রুপ পিউকে ভাবাচ্ছিলো। কিন্তু সাহস করে প্রশ্ন করে উঠতে পারে নি। বলা তো যায় না, শান্ত বাঘকে জাগালে না তার ই শিকার বনে যেতে হয়। নীলাদ্রি সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিউ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শান্ত ভাবে তার কার্যক্রম দেখছে। সে রিসিপশনে শিহাবের রুমের নাম্বার যোগাড় করেছে। এখন ভিজিটিং আওয়ার হবার দরুন তাকে ভেতরে যাবার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। নীলাদ্রির হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে কিন্তু সে চুপটি করে দেখে যাচ্ছে মেয়েটির কাজ। বাসা থেকে মিথ্যে বলে, এতো সাজের বাহার দিয়ে শিহাবের সাথে দেখা করার যুক্তি খুজে বেড়াচ্ছে নীলাদ্রি৷ পিউ যখন শিহাবের রুমের বাহিরে দাঁড়ালো তখন ঘাড় ফিরিয়ে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাকে কেমন লাগছে?
– কিহ?
– বলছি আমাকে কেমন লাগছে? দেখে প্রেম প্রেম জাগছে না?
পিউ এর প্রশ্ন শুনে মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠলো নীলাদ্রির। আবার বুকের বা পাশটা হু হু করে উঠলো। পিউ কি বুঝে না, সে এমন একজনকে প্রশ্নটি করেছে যার মনে তার জন্য বাসার জামা পড়া অবস্থাতেও প্রেম প্রেম জাগে। পরীক্ষার প্রেসারে যখন তার চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, তার চুল গুলো কাকের আর বাবুই পাখির বাসার ন্যায় দেখায় তখন ও নীলাদ্রির প্রেম প্রেম জাগে। আর আজ তো সে নীলাদ্রির মতো করে সেজে রয়েছে। সুতরাং প্রেম প্রেম জাগবে এটা চিরন্তন সত্য। নীলাদ্রি ব্যাথিত কন্ঠে বললো,
– এতো সাজের বাহার কি তবে শিহাবের জন্য?
– আপনাকে বলবো কেনো? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন, আমাকে দেখে কি প্রেম প্রেম জাগছে?
নীলাদ্রি মাথাটা নামিয়ে ফেললো। তার চোখ ছলছল করছে। সে পুরুষ মানুষ তাই পিউকে এই অশ্রু দেখতে দিবে না। নীলাদ্রি আহত কন্ঠে বললো,
– তুই ভেতরে যা, আমি বাহিরে আছি
– উত্তরটা দিলেন না তো!
– তুই ও তো দিলি না।
– বেশ তবে শুনুন, আমার এই সাজের ঘটা আমার প্রেমিকের জন্য।
পিউ কথাটা বলেই সোজা শিহাবের রুমের ভেতরে চলে গেলো৷ পিউ এর কথাটা শুনে নীলাদ্রির চোখ থেকে টপ করে অশ্রুর মুক্তোদানাটা গড়িয়ে পড়লো। সে অশ্রুসিক্ত চোখে তার হৃদয়ের মহারানীর যাবার পানে চেয়ে রইলো_________
ঐন্দ্রিলার দম বন্ধ লাগছে। মন অশান্ত হয়ে রয়েছে। কোনো কিছুতে মন বসতে চাইছে না। রান্নাটা কাজের মেয়ের রাতে দিয়েই নিজ রুমে চলে আসে সে। দিশান বিছানায় ঘুমোচ্ছে। ঐন্দ্রি তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণের বাতাস ছুটেছে, আজ আকাশে মেঘ করছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর ই বৃষ্টি নামবে। কিন্তু গরমের উম্মাদনা কমে নি। চুলের গোড়া থেকে ঘামের রেখে গড়িয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রির ঘাড়ে৷ কিন্তু সেদিকে তার মোটেই খেয়াল নেই। সে চোখ বুঝে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে তার।
“তুমি আমার নওতো সুখ
তুমি সুখের বেদনা
সব স্বপ্নের রং হয় না তো
বেদনার মতো নয় রঙা ।
জীবনের সব কথা নয়
আমি জীবনটাকে বলতে চাই
হয়তো দুর্ভাগ্য নয়
সে তো ভালোবাসার কাব্য কয় ।।
আমি কবি নই
তবু কাব্যের ভাষায় বলবো আজ
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।”
কিন্তু সেটা মনেই চেপে রেখে দিলো। কারণ দিশানের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ভাববে মাম্মাম বুঝি পাগল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অনুভব করলো তার ঘাড়ের উপর কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে। ঐন্দ্রি খানিকটা কেঁপে উঠলো। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না মানুষটি কে! সে তার স্বামী। তাই ঐন্দ্রি পেছনে ফেরলো না। অভ্র ঐন্দ্রির সাঁড়া না পেয়ে তার কাঁধে থুতনিটা ঠেকিয়ে বললো,
– অতীত অতীত ই হয়। অতীতের মুখোমুখি হয়েছো বলে বর্তমান এলোমেলো হয়ে যাবে কথাটা ভুল…………
চলবে
[ ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি