এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৫

0
2370

এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৫
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

চকচকে ঝকঝকে মেঝে।শাওয়ার নিয়ে টাওয়ালে মোড়ানো অর্ধআবৃত শরীরে বেরিয়ে এলো নিভ্রান।সাদা ফ্লোরে ভেজা পায়ের ছাপ।
শরীরে বিন্দু বিন্দু জলকণাদের রাজত্ব।উজ্জ্বল শ্যামলা রংয়ের বলিষ্ঠদেহ যেকোনো নারীকে কাবু করে ফেলতে শতভাগ সক্ষম।বয়স ত্রিশ ছুঁইবে ছ’মাস বাদে অথচ আজ অবধি ধারালো নখের আগ্রাসী আঘাত পরেনি এই পিঠে।ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।ভেজা গায়েই পাতলা টি-শার্ট জরিয়ে নিলো।সঙ্গে কালো ট্রাউজার।ফোন বাজছে।মার নামটা ভেসে উঠেছে।কালবিলম্ব না করে ফোনটা কানে তুলে নিলো নিভ্রান।
—“হ্যালো বাবা?কেমন আছিস?”

ফোনের এপাশেই মুচকি হাসলো নিভ্রান।উওর দিলো,”তোমার সাথে তো দুপুরেই কথা হলো মা।এইটুকু সময়ে আর কি খারাপ হবে বলোতো?”
মা ছেলের কথোপকোথন চললো কিছুক্ষণ।কথা শেষ হতেই ফোনটা নামিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নিভ্রান।চোখ বোজার পর কয়েকটা মূহুর্ত যেতেই বুঝতে পারলো ধীরে ধীরে চোখে ভর করছে এক সদ্যপরিচিত অন্তর্বাসিনীর হৃর্দয় শীতল করা সারল্যতা।
_________
চাঁদটা বেঁকে আছে।তবুও তার সৌন্দর্যে কোনরকমের ঘাটতি নেই।এই একলা আকাশের চাঁদের বুড়িকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে মিটমিট করা তারকারাজি গুলো।ধুলোর পরতে ঢাকা জানালাটা আজ অনেকদিন পর খুলেছে রাত্রি।সেই জানালার ফাঁক গলিয়েই চাঁদের ঝলমলে আলোতে ছেঁয়ে গেছে তার বিছানা।জানালার গ্রিলে মাথা রেখে স্হির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো রাত্রি।মোহাচ্ছন্ন ধ্যানটা কেটে গেলো কলিংবেলের তিক্ত শব্দে।কপাল কুঁচকে এলো স্বাভাবিকতই।এত রাতে এখানে কার কি দরকার?আরো কয়েকবার নিরবিচ্ছিন্নভাবে আওয়াজ হতেই দ্রুত গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজার সামনে এলো রাত্রি।ভেতরের ভয়টাকে ভেতরেই চেপে জোরালো গলায় ডাকলো,
—“কে?”

ওপাশ থেকে মধ্যবয়স্ক এক পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
—“দরজা খুলো।আমি।”

লোকটার কর্কশ গলায় প্রথমে কেঁপে উঠলেও পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো রাত্রি।কন্ঠটা বাড়িওয়ালা চাচার।তার আসার কারণটাও স্পষ্ট।এ মাসের ভাড়া দেয়া হয়নি।আজকে মাসের পনেরো তারিখ।
দরজা না খুলেই একছুটে ব্যাগ থেকে আজকেই পাওয়া টি উশনির বেতনটা নিয়ে এলো রাত্রি।দরজায় তখন তুমুল কড়াঘাত চলছে।ভাড়া দিতে দেরি হলেই কুটু কথা শোনাতে ছাড় দেয়না এরা।বাসার ভাড়া তুলনামূলক একটু কম হওয়ায় কারণে ছেড়েও যেতে পারেনা।বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দরজা খুললো রাত্রি।

—“বাসায় কি আমি ফ্রি তে থাকতে..”তার বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ঝটপট হাতের টাকাটা এগিয়ে দিলো রাত্রি।ভদ্রতার সহিত নম্র কন্ঠে বললো,”টাকাটা আংকেল।”
ভদ্রলোক সরু চোখে তাকালো।টাকাটা ‘ছোঁ’ মেরে নিয়ে গমগমে গলায় বললো,”তুমি জানোনা মাসের পাঁচ তারিখে ভাড়া দেয়ার নিয়ম?”
রাত্রি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো।চাপা রাগটাকে সংবরণ করে আগের মতোই বিনীত কন্ঠে বললো,
—“টাকাটা হাতে আসতে একটু দেরি গেছে আংকেল।”

—“এরপর থেকে যেভাবেই হোক পাঁচতারিখের ভেতরে ভাড়া দিয়ে যাবে।মনে থাকে যেন।”বলেই গটগট শব্দ তুলে চলে গেলেন ভদ্রলোক।তার যাওয়ার পানে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে দরজা আটকে দিলো রাত্রি।এই টানাপোড়েন দিন দিন বেড়েই চলেছে।যেকরেই হোক পরের মাস থেকে আরেকটা টি উশনি ধরতে হবে।তিনটে তে কিছুতেই পোষাচ্ছেনা।
_____________
মেঘ জমে জমে মেঘের পাহাড় তৈরি করেছে।খানিকবাদেই পাহাড়ধস হবে।মেঘের পাহাড় বৃষ্টিরুপে ধসে পড়বে পৃথিবীর বুকে।
রাত ন’টা।ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে নিভ্রান।রাস্তাটা অনেকটাই ফাঁকা।
নিভ্রানের পরিশ্রান্ত দৃষ্টি হঠাৎই আটকে গেলো রাস্তার ধারে।অবসন্ন চোখজোড়া ধাতস্থ হয়ে এলো।মুখ ফুটে অস্ফুস্টে বেরিয়ে এলো,”রাত”।

ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে আগাচ্ছে রাত্রি।পরণে গাঢ় বেগুনী রংয়ের সাদামাটা সুতি শাড়ি।আঁচলে পা জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।পিঠে চুল ছড়িয়ে আছে বিশৃঙ্খলভাবে।টাকার মায়া ত্যাগ করে রিকশা ডেকেছিলো কয়েকটা।কোনোটাই ওদিকে যাবেনা।আর গেলেও ভাড়া চাচ্ছে আকাশকুসুম।অসস্তিরা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
গতকাল একটা পরীক্ষা হয়েছে।আরেকটা হবে সামনের সপ্তাহে।এর মাঝেই একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিলো ভার্সিটিতে।সে যেহেতু সিনিয়র ব্যাচের এবং ক্লাস ভলেন্টিয়ার দের একজন তাই শাড়ি পরাটা একপ্রকার বাধ্যতামূলক।সবাই পরেছে সে না পরলে কেমন ছন্নছাড়া দেখায়।সেজন্যই মায়ের একটা পুরনো শাড়ি পরে গিয়েছিলো।শাড়ি সামলাতে অসুবিধা হয়না তার তবে পরপর তিনটা টি উশনির জন্য এখান থেকে ওখানে হেঁটে যাওয়া আসার কারনেই শাড়ি অনেকটা অগোছালো হয়ে গেছে।এখন তা পরে হাঁটতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।

রাস্তার ধারেই গাড়ি পার্ক করে নেমে গেলো নিভ্রান।দ্রুত পা চালিয়ে উপস্থিত হলো রাত্রির কাছাকাছি।পেছন থেকেই ভরাট গলায় ডাকলো,”রাত।”
পদচারণ থেমে গেলো রাত্রির।দাড়িয়ে পরলো সে।মাঝরাস্তায় নিজের নাম শুনে হঠাৎ করে আৎকে উঠলেও গলাটা চিনে যেতেই আকস্মিক ভয়টা কেটে গেলো।ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ঘুরার আগেই পাশাপাশি এসে দাড়ানো নিভ্রান।তার চোখ রাত্রির সর্বাঙ্গে ঘোরাফিরা করছে।চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি তবে এই মেয়েটাই?
রাত্রি সৌজন্যমূলক মুচকি হেসে বললো,
—“আপনি এখানে?”

রাত্রির ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলায় স্হির মনি সচল হলো নিভ্রানের।বারদুয়েক চোখ ঝাঁপটে সে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
—“কিছু বললেন?”

রাত্রি বোকা বোকা কন্ঠে আবার বলল,”জি বললাম যে আপনি এসময় এখানে?”

নিভ্রান সময় না নিয়ে ঝটপট উওর দিলো,”অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।”

ভ্রুজোড়ায় তীক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো রাত্রির।লোকটা যথেষ্ট বড়লোক।সে বুঝতে পারে।তার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার বিষয়টা বড্ড বেমানান লাগলো।কোনরকম সংকোচ না নিয়ে সে স্পষ্টকন্ঠে বললো,
—“আপনি হেঁটে বাড়ি ফিরেন?”

এক ভ্রু উঁচালো নিভ্রান।রাত্রির কথাটার মানেটা বুঝে নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,”গাড়িটা গতকাল সার্ভিসিং এ দিয়েছি।সেজন্যই আরকি।”
কপালের ভাঁজটা পুরোপুরি না গেলেও কিছুটা শিথিল হলো।মুখে কিছু না বললেও হাল্কা মাথা নাড়িয়ে কথায় সাড়া দিলো রাত্রি।বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে যেতেই নিভ্রান বললো,

—“আপনার হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে?”

—“না তো।”

মুখে অস্বীকার করলেও রাত্রির এলোমেলো পদক্ষেপ জানান দিচ্ছিলো সে আসলেই হাঁটতে পারছেনা।শাড়ির কুঁচি নেমে গেছে পায়ের কাছে।কোনমতে তা আঁকড়ে ধরে জবুথবু হয়ে হাঁটছে।নিভ্রান এক কদম এগিয়ে যেয়ে গম্ভীর গলায় হাঁক ছাড়লো,”এই রিকশা।থামো।”

রিকশা থেমে গেলো।নিভ্রান জায়গার নাম না বলেই রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বললো,”উঠুন,আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি,রাত হয়েছে অনেক।”

—“প্রয়োজন নেই,আমার অভ্যাস আছে।আপনার দেরি হবে শুধু শুধু।”বলে আপত্তি করে উঠলো রাত্রি।
নিভ্রান শীতল চোখে চাইলো।কঠোর গলায় বললো,”উঠতে বলেছি উঠুন।আপনার বাসা থেকে আমার বাসার দুরত্ব খুব বেশি হলে বিশ মিনিটের।একই পথেই যাচ্ছি একসাথে গেলে এমন কোন ক্ষতি হয়ে যাবেনা।”
রাত্রি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই নিভ্রান শান্ত আদেশী স্বরে বললো,”উঠুন রাত।”
কেনো যেনো মিইয়ে গেলো রাত্রি।চুপচাপ উঠে বসলো রিকশার ডানপাশে।উঠলো নিভ্রানও।রিকশা চলতে শুরু করলো।রাত্রির কোলের উপর ব্যাগ রাখা।
আকাশে তখন গুরুর গুরুম হচ্ছে।হাল্কা বৃষ্টি শুরু হতেই রাত্রি রিনরিনে কন্ঠে বললো,”মামা,হুটটা তুলে দিন।”

রিকশাওয়ালা মামা ঘুরার আগেই একটানে হুট উঠিয়ে দিলো নিভ্রান।রাত্রি আমতাআমতা করে তাকালো।নিভ্রান সোজা তাকিয়ে আছে।লোকটার চেহারা এত থমথমে লাগছে কেনো?রাত্রি ইততস্ত করে জিজ্ঞেস বললো,
—“কি হলো আপনার?”

—“কি হবে?”

চোখ নামিয়ে নিলো রাত্রি।এলোমেলো চুল কানের পিছে গুঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো,”না কিছুনা।”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।গতকালকে ফিরিয়ে দেয়া হাতের রিচব্যান্ডটা খুলে নিলো।রাত্রির হাতের কাছে ধরে বললো,”চুল বেঁধে নিন।”

—“লাগবেনা।”একবার তাকিয়ে আলতো স্বরে উওর দিলো রাত্রি।

চোখ বন্ধ করে রাগ সামলালো নিভ্রান।অত:পর নিজেই অনেকটা ঝুঁকে গেলো রাত্রির দিকে।গলার দু’পাশ দিয়ে দুহাত গলিয়ে দিতেই চমকে উঠলো রাত্রি।বললো,”আপনি..”নিভ্রান তাকে থামিয়ে দিলো।চুলগুলো গুছিয়ে মুঠোয় আনতে আনতে আবিষ্টভাবে বললো,”চুপ।”ঠোঁট কামড়ে ধরলো রাত্রি।শরীরের রক্তে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।নিভ্রানের মুখ তার ঘাড়ের খুব খুব ঘনিষ্ঠে।হাল্কা উঁচু করে ঝুটি বেঁধে দিলো নিভ্রান।সরে আসার আগে হাল্কা গলায় বললো,
—“এতো কড়া পারফিউম ব্যবহার করবেন না রাত।”

রাত্রি মিনমিনে কন্ঠে উওর দিলো,”আমি পারফিউম দেইনা।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here