পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ৩৩+৩৪
লেখা – Mahfuza_Monira
সকাল ১০ টায় মিশি আর বকর মোল্লা উভয়ই আসেন উদয়ের সাথে দেখা করতে। উদয় তখন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে গরম দুধ খাচ্ছিল।
বকর মোল্লা উদয়ের পাশে বসে বলেন-
————–এখন কেমন লাগছে ইয়ং ম্যান?
উদয় মৃদু হেসে বলে-
—————আগের চেয়ে কিছুটা ব্যাটার আংকেল।
—————-তুমি খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবা দোয়া করি।
উত্তরে উদয় কোনো জবাব না দিয়ে স্মিত হাসে শুধু। বকর মোল্লা কে ইশারায় ডাকেন মইনুল সাহেব। তিনি উঠে দাঁড়ান। মিশিকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
—————তোমরা গল্প করো। আমি মইনুল ভাইয়ের হাতের চা খেয়ে আসি। উনার চা মিস করা যায়না।
মইনুল সাহেব মুখে হাসি টেনে বলে-
————–হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইজান। আসুন না..
বকর মোল্লা আর মইনুল সাহেব বেরিয়ে যান। রুমে থাকে শুধু মিশি আর উদয়।
তারা চলে যেতেই মিশি উদয়ের পাশ ঘেঁষে বসে। উদয়ের চোখে চোখ রেখে বলে-
————-সত্যিই ভালো আছো তো? নাকি বাবাকে মিথ্যে বললে!
উদয় অবাক হওয়ার ভান করে বলে-
————-মিথ্যে কেন বলতে যাবো! আমি ঠিক আছি তো। সত্যি।
মিশি উদয়ের কপালে হাত রেখে দেখে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক। মিশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎই উদয় প্রশ্ন করে-
————আচ্ছা মিশু,ধরো তোমার কাছে জীবনের শেষ কিছু মুহুর্ত বাকি আছে। আর সেই সময় টুকু তুমি আমার সাথেই কাটাচ্ছো। কি কি করবা তখন?
মিশি প্রথমে ভারি অবাক হয়। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে-
————-এটা কী ধরনের প্রশ্ন?
————–উফফো! বলোই না। ধরো এমনেই জানার জন্য করলাম।
মিশি কথা না বলে ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর বলে-
—————-আমি জানিনা আমি কি করবো। হয়তো তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। এত শক্ত করে যে আমাদের মধ্যে থেকে বাতাস ও যেতে পারবে না। হয়তো তোমার হাত ধরে থাকবো,তোমাকে বলবো আমি চলে গেলে নিজেকে সামলে নিও। হয়তো বা কাঁদবো হাউমাউ করে। হয়তো তোমাকে বারবার বলবো,আমাকে যেতে দিও না আমাকে আটকে রাখো। হয়তো বা অন্যকিছু করবো। উফ,আমি জানিনা আমি কি করবো উদু!!
উদয় হেসে ফেলে মিশির বিরক্তি দেখে। মিশি কপাল কুঁচকে বলে-
————–হেসো না তো। কিরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করছো!! নিজের মাথাতেই ঢুকতেছে না যে কি জবাব দিবো!
উদয় মিশির কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। বলে-
————–তবে আমি কি করবো জানো? আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো,আর বলবো আমার কপালে খালি চুমু খাও।
মিশি উদয়ের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে-
————–প্লিজ উল্টো পাল্টা কিছু বলো না তো। শুনতে ভাল লাগছে না।
উদয় সে কথা শুনে কিনা কে জানে। উদয় উদাসী গলায় বলে-
————-মিশু,যদি কখনো আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাই,অনেক অনেক দূরে,তুমি নিজেকে সামলে নিবা তো?
মিশি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে উদয়ের কথা শুনে। এমনিতেই ছেলেটা অসুস্থ!! তার উপর এসব উল্টো পাল্টা কথা বার্তা। মিশি ধমকে উঠে।
————তোকে আমি চুপ থাকতে বলছি কিন্তু উদু। মারবো কিন্তু। চরম মারা মারবো।
উদয় জবাব দেয়না। বদলে হাসে শুধু। সেই হাসি দেখে মিশির গা জ্বলে যায় আরো। দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে-
————–হাসবি না কুত্তা। বালের বালের কথা বলতেছিস!! বলছি না এগুলা শুনতে ভাল লাগতেছে না আমার!! তারপরেও বলতেছিস কেন?? পিঠ শুলায় তোর? দেবো দু ঘা? শুয়োর!!
উদয় মিশির দিকে তাকিয়ে বলে-
————-শুয়োর বললা,নাকি শিউর বললা?
মিশির রাগ বাড়ে আরো আর উদয়ের হাসির মাত্রা বাড়ে।
মিশি মুখ গোমড়া করে বলে-
————-মজা নিচ্ছো আমার সাথে?
মিশি মাথা নিচু করে ফেলে মন খারাপ করে। উদয় দুর্বল হাত দিয়ে মিশির চিবুক স্পর্শ করে বলে-
————–অভিমান করলে তোমায় খুব সুন্দর লাগে জানো? একদম একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো লাগে। তখন ইচ্ছে করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে রাখতে।
মিশি নিচু গলায় বলে-
————–তো জড়িয়ে রাখো। কে মানা করছে?
উদয় মুচকি হেসে একটানে মিশিকে আবদ্ধ করে ফেলে নিজের বাহুতে। মিশিও এতদিন পর উদয়ের বুক পেয়ে,তাতে গুটি মেরে ঢুকে যায়।
.
.
মইনুল সাহেব চা’য়ের কাপ বকর মোল্লার দিকে এগিয়ে দেয়। বকর মোল্লা বলেন-
————-চা তো পড়েও খাওয়া যাবে ভাই। আগে বলো কেন ডাকলা আমাকে?
মইনুল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন-
————-ভাইজান যেটা বলতে চাচ্ছি,সেটা কতটুকু সঠিক আমি জানিনা। কিন্তু আমার মনে হলো বলা টা দরকার আপনাকে।
বকর মোল্লা মইনুল সাহেব এর হাতের উপর হাত রেখে বলেন-
————–জরুরি কিছু?
মইনুল সাহেব মাথা ঝাকান।
————–সেদিন তো আপনিও ছিলেন ডাক্তারের সাথে। আপনিও তো জানেন উদয়ের ব্লাড ক্যান্সার এর কথা। এরপরেও কিভাবে মিশি কে উদয়ের সাথে মিশতে দিচ্ছেন?
বকর মোল্লা গম্ভীরমুখে বলেন-
————ক্যান্সার তো ছোঁয়াচে রোগ না,যে মিশিরও হয়ে যাবে।
————-আহা,আমি সেটা বলছি না যে মিশিরও হবে। আমি বলছি অন্য কথা।
————–ভেঙে বলো ভাই।
মইনুল সাহেব আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
———–ভাইজান,উদয়ের বাঁচার কোনো গ্যারান্টি নেই। অথচ মিশি যেভাবে পাগলের মতো ভালোবাসে উদয় কে। ও কখনো ছেড়ে যাবে না উদয় কে। আর উদয়ের মৃত্যুর পর নিজেও থেমে যাবে আজীবনের মতো। আমি মিশিকেও ভীষণ ভালোবাসি। তাই আমি চাই,আপনি মিশিকে সরিয়ে নিন উদয়ের থেকে। ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যান। আর যাই হোক,মিশির জীবন তো থেমে যাবে না। সে অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবে।
বকর মোল্লা গম্ভীর গলায় বলেন-
———আর তোমার মনে হয় যে আমি মিশিকে বললেই সে চলে যেতে চাইবে আমার সাথে? অন্য কোথাও,উদয় কে ছেড়ে?
————-সেই ব্যবস্থাও করেছি আমি। আমার এক ফুপাতো বোনের মেয়ের আছে। সে আসবে আমাদের বাসায়। উদয় এমন ভাব করবে যে উদয় সেই মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছে। এতে মিশি কষ্ট পেলেও তা সাময়িক হবে ভাইজান।
বকর মোল্লা শান্ত গলায় বলে-
———-উদয় জানে এসব ব্যাপারে?
———-ও ই বলেছে এসব করতে। ও চায় না ওর কারনে মিশির জীবন টা থেমে থাকুক ভাইজান।
বকর মোল্লার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কত ভালো ছিল ছেলে মেয়ে দুইটা!!
কোথা থেকে কি যে হয়ে গেলো!!
বকর মোল্লা ঠান্ডা হওয়া চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন-
———আচ্ছা। তুমি যেমন টা বললে ভাই,তেমন টাই করবো।
.
.
উদয় কেশে উঠতেই মিশি ছেড়ে দেয় তাকে। উদয়ের পিঠে হাত ডলতে ডলতে বলে-
———-ওষুধপত্র খাচ্ছো তো ঠিকঠাক ভাবে? কাশি টা কমছে না কেন!!
উদয় হাপাতে হাপাতে বলে-
———কমে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।
মিশি উদয়ের কথার ভ্রুক্ষেপ করে না। সে উদয় কে শুইয়ে দেয় খাটে। গায়ের উপর পাতলা কম্বল টা টেনে দেয়। তারপর উদয় কে ওয়েট করতে বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
মিশিকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে মইনুল সাহেব ও বকর মোল্লা দুজনেই অবাক হন। মইনুল সাহেব বলেন-
———কই যাচ্ছিস?
মিশি দ্রুত উত্তর দেয়-
———-রান্নাঘরে। সরিষার তেল আছে তো? উদয়ের কাশি বেড়ে গেছে আবার।
মিশি চলে যায়। মইনুল সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেন। কাঁদতে গেলেও দ্বিধায় পড়ে যেতে হচ্ছে তাকে। কতদিক নিয়ে কাঁদবেন তিনি!? তার একমাত্র ছেলে উদয়ের ক্যান্সার হওয়ার জন্য,নাকি তার মেয়ের সমান মিশির সামনে আসা কষ্টের কথা ভেবে!!
.
রসুন ছেঁচে গোল চামচে তুলে নেয় মিশি। তাতে সরিষার তেল মেশায়। তারপর চুলোর উপর ধরে। হালকা আঁচে গরম করে একটু। সেটা নিয়ে এগোয় উদয়ের ঘরের দিকে।
উদয় কে উদ্দেশ্য করে বলে-
——–তাড়াতাড়ি টি-শার্ট টা খুলো তো।
উদয় ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
——–কেন?
——–উফ খুলোই না। রেপ করবো না তোমার!!
উদয় উঠে শরীর থেকে টি-শার্ট খুলে তার। তারপর মিশি ইশারা করতেই আবার শুয়ে পড়ে।
মিশি উদয়ের পাশে বসে হাতে হালকা গরম তেল উঠিয়ে নেয়। তারপর উদয়ের উদম বুকে ডলতে থাকে তা।
উদয় আরামবোধ করে।
বলে-
————–এটা কী করছো? তবে আরাম লাগছে।
—————আরো আরাম লাগবে। আর এটা দিলে তোমার কাশি কমে যাবে আস্তে আস্তে। দেইখো।
উদয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ধীরে ধীরে। মেয়েটা এর ভালোবাসে তাকে! কিভাবে পারবে এই মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যেতে….!
চলবে….
পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ৩৪
লেখা – Mahfuza_Monira
উদয়ের গাল বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মিশির চোখ এড়ায় না তা। অবাক হয়ে সে বলে-
————–সেকী!! কাঁদছো কেন তুমি?
উদয় ভাঙা গলায় বলে-
————–কাঁদছি না। চোখে কি যেন ময়লা পড়েছে।
মিশি চুপ করে উদয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
উদয় ভ্রু কুঁচকে বলে-
————-কী?
————–তোমাকে খুব অচেনা অচেনা লাগছে জানো। কিরকম জানি পর হয়ে গেছো তুমি! সহজে একটা সত্যি কথা বলতে চাওনা!
উদয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
————–কি মিথ্যে বললাম!
————–এই যে কাঁদছো কিন্তু সেটাও এড়াচ্ছো। আচ্ছা উদু একটা সত্যি করে কথা বলবা?
—————কী?
—————-তোমার বড় কোনো কিছু হয়নি তো??
উদয় থম মেরে যায়। মিশি আবার বলে-
—————দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছো,চেহারা তো ভেঙেই গেছে,চোখের নিচে কালি জমতেছে,অথচ আমি জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলছো না। বলো না উদু,কি হইছে তোমার?
উদয় জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে-
————–ক্যান্সার হয়েছে ক্যান্সার।
কথাটা বলেই গা দুলিয়ে হাসে উদয়। মিশি উদয়ের মুখ চেঁপে ধরে বলে-
————–ফালতু কথা একদম বলবা না। ক্যান্সার আমার শুত্রও না হোক,আমিন! আর ক্যান্সার নিয়েও মজা করো না? কুত্তা। উঠো,গোসল দিবা না? আমি গরম পানি করে দিবো?
উদয় বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলে-
————দাও,রোদ থাকতে থাকতে গোসল টা সেড়েই ফেলি।
.
.
সময় প্রবহমান।
সময় নিজ গতিতে গড়িয়ে চলে। দেখতে দেখতে ১৫ দিন কেটে যায়। এই ১৫ দিনে মিশি কলেজ যায়নি,পড়ালেখা শিকেই উঠেছে তার। আঠার মতো লেগে ছিল উদয়ের সাথে শুধু। উদয়ের যা যা প্রয়োজন সব করেছে মিশি। একদম বউয়ের মতো করে খেয়াল রেখেছে তার।
উদয় মাঝে মাঝে মিশিকে দেখলে ভারী অবাক হয়। এইটুকুন একটা মেয়ে,অথচ এত বড় বড় কাজ কি করে…উদয়ের জানা নেই।
এদিকে মিশি বেশ চিন্তিত। কোনো ভাবেই উদয়ের শরীরের উন্নতি হচ্ছে না। তার উপর কিসব ভারী ভারী ওষুধ খাওয়াতে হয় তাকে। মিশি অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে ওষুধ গুলো কিসের,মইনুল সাহেব বারবার বলেছে উদয়ের দুর্বলতা আর জ্বরের কারনে।
কিন্তু মিশির সন্দেহ যায়নি।
সামান্য শরীর দুর্বল হলে মানুষ কে এত ওষুধ খাওয়াতে হয়!!
.
সকাল বেলা।
মিশি উদয়ের জন্য পরোটা ভাজছিল। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে। মইনুল সাহেব ঘরে নেই। উদয় ঘুমোচ্ছে। মিশি চুলোর আঁচ কমিয়ে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায় সে। একটা মেয়ে দাড়ানো।
————মইনুল চাচা নেই?
মিশি মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দেয়-
————-আছে।
মেয়েটা ভেতরে আসে। সোফায় বসে। মিশি দৌড়ে গিয়ে চুলোর জাল নিভিয়ে আসে।
মেয়েটা আবার বলে-
————–উদয় কোথায়?
মিশি ভ্রু কুঁচকে বলে-
—————তুমি কে??
মেয়েটা উত্তর দেওয়ার আগেই মইনুল সাহেব ভেতরে ঢোকেন। মেয়েটাকে দেখে মিশিকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
————-ও আমার ফুপাতো বোনের মেয়ে পড়ন্ত। ওর সাথেই তো উদয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছে বুঝলি মিশি? আমার বোন চাচ্ছে,এখনি আকদ টা করে রাখতে। পরে না হয় ওকে তুলে নিয়ে আসবো পড়ন্ত কে। তোর কী মতামত পড়ন্ত?
পড়ন্ত মাথায় ওড়না টেনে লাজুক কণ্ঠে বলে-
————আপনারা যা ভালো বুঝেন চাচা,আমি আর কী বলবো।
————-এখনো চাচা কী রে! বাবা বলে ডাকতে পারিস না?
পড়ন্ত নতজানু হয়ে বলে-
————–হুম বা-বা।
মিশির মাথায় বাজ পড়ে যেন। এসব কি হচ্ছে!!
মিশি চোখ বড়বড় করে বলে-
————-মইনুল কাকু,তুমি কি বলছো এসব? ওর সাথে উদয়ের বিয়ে মানে!
মইনুল সাহেব সোফায় বসে বলেন-
———–তোকে জানানো হয়নি। ওর সাথে উদয়ের বিয়ে ঠিক করে রাখা ছিল। তুই কষ্ট পাবি দেখে এতদিন তোকে জানাই নি। কিন্তু এখন না জানিয়ে আর উপায় নেই। ওর মা ভীষণ তাগাদা দিচ্ছে আকদের জন্য।
মিশি ছলছল চোখে বলে-
————আর এখন কি কষ্ট হচ্ছে না কাকু?
মইনুল সাহেব জবাব দেন না। মাথা নিচু করে বসে থাকেন।
মিশি এক দৌড়ে উদয়ের রুমে যায়। উদয় ঘুমোচ্ছিল তখন। উদয় কে টান দিয়ে খাটে উঠিয়ে বসায়। আচমকা ঘুম ভাঙায় উদয় ঘাবড়ে যায়। মিশির দিকে তাকিয়ে বলে-
————-কি ব্যাপার? কি হইছে?
মিশি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। উদয় বোবা বনে যায়।
মিশি কাঁদতে কাঁদতে বলে-
———–তোমার বাবা এসব কি শুরু করছে উদু? কোন পড়ন্ত নামের মেয়ে আসছে!! তার সাথে নাকি তোমার বিয়ে দিবে। মইনুল কাকুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি??
উদয় গম্ভীরমুখে বলে-
————কথা সত্যি মিশি।
মিশির কান্না বন্ধ হয়ে যায়। থতমত খায় যেন। অবাক হয়ে বলে-
————-কী??
————–হুম।অনেক আগে থেকেই ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে মিশি।
মিশি গলা খাকারি দিয়ে বলে-
————-তাহলে আমার সাথে কেন ভালোবেসে ছিলে?? কেন ঠকালে আমায়??
উদয় বিরক্তির গলায় বলে-
———–আস্তে মিশি। এত চেঁচামেচি করো না। বিরক্ত লাগছে।
———-এখন তো আরেকজন এসে গেছে। আমাকে তো বিরক্ত লাগবেই এখন!
———–মিশি
———–কি মিশি? আমার নাম উচ্চারণ করবে না বলে দিলাম। আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করলা এতদিন? এত বড় ধোকা কি করে দিতে পারলা উদয়??
উদয় চুপ করে থাকে।
মিশি বলেই চলে-
————আই হেট ইউ উদয়। তুমি কোনোদিন যেন সুখী না হও। আমার অভিশাপ লাগুক তোমার উপর। আল্লাহ সইবে না। দেখে নিও।
মিশি চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
মিশিকে বের হতে দেখে মইনুল সাহেব আর পড়ন্ত দুজনেই উঠে দাঁড়ায়।
মিশি তাদের উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। মিশি চলে যেতেই মইনুল সাহেব ধপ করে সোফায় বসে পড়েন। পড়ন্ত তার দিকে ফিরে বলে-
————-চাচা,সামলাও নিজেকে।
মইনুল সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে বলেন-
—————নিজের ছেলে মেয়ের এধরনের কষ্ট আমি সইতে পারছি না মা। আল্লাহ এ কী পরীক্ষা নিচ্ছে আমার!! কি পরীক্ষা নিচ্ছে আমার!!
.
.
বাসায় ফিরে বকর মোল্লার কাছে সব বলে মিশি। বকর মোল্লা আগে থেকেই জানতেন এসবের ব্যাপারে। তাই তিনি কোনো কথা বলেন না। কিন্তু নতুবা বেগম গর্জে উঠেন।
মিশিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলেন-
————-কেমন বাপ তুমি!? তোমার মেয়েকে এত বড় ধোকা দিলো আর তুমি কিছু বলছো না কেন?? ওদের তাড়িয়ে দিচ্ছো না কেন এই গ্রাম থেকে??
বকর মোল্লা কিছু না বলে চুপ করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মিশি মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। নতুবা বেগম এর চোখে জল ছাপিয়ে উঠে। এতগুলো দিন সে দেখেছে তার মেয়ের ভালোবাসা উদয়ের প্রতি। চোখের সামনে এভাবে মিশিকে কষ্ট পেতে দেখতে পারছেন না তিনি।
.
.
বকর মোল্লা কে উঠোনে দেখে মইনুল সাহেব বেরিয়ে আসেন।
দুর্বল গলায় বলে-
———-আমি জানতাম আপনি আসবেন ভাইজান।
———–উদয়ের কি অবস্থা?
———–মুখে বালিশ চেঁপে ধরে কাঁদছে ছেলেটা।
বকর মোল্লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন-
————-আমরা ভুল করছি না তো ভাই?
————-জানিনা ভাই,আমারো মন টা বেশ ছটফট করছে। মিশিকে ভালো রাখতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেলছি না তো!
বকর মোল্লা উত্তর খুঁজে পায়না।
হঠাৎ তাদের সামনে এসে একটা গাড়ি থামে। সেখান থেকে বের হয় মিশি।
বকর মোল্লা অবাক হয়ে বলে-
———-মামণি! তুমি এখানে?
মিশি কোনো উত্তর দেয়না। দ্রুত পায়ে ছোটে বাড়ির ভেতরে। মইনুল সাহেব ও মিশির পিছু ধরতে নিলে বকর মোল্লা থামায় তাকে। বলে-
————হয়তো উদয়ের সাথে শেষ কথা বলতে এসেছে। থাক,কথা বলতে দাও ওকে ভাই।
.
.
মিশি উদয়ের রুমে ঢুকে দেখে উদয় জানালার ধারে বসে আছে। উদয় খেয়াল করেনা মিশিকে। মিশিও জানান দেয়না যে সে এসেছে। আলগোছে ড্রয়ার খুলে উদয়ের ওষুধ গুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
এত তাড়াতাড়ি মিশিকে বের হতে দেখেও অবাক হয় বকর মোল্লা আর মইনুল সাহেব।
মিশি তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। গাড়িতে উঠে ড্রাইভার কে বলে হসপিটালের দিকে যেতে।
.
.
সদর হাসপাতালে মিশির পরিচিত এক ডাক্তার আংকেল আছে। মিশি দ্রুত পায়ে তার কেবিনের দিকে ছোটে।
ডাক্তার আনিস তখন রুগী দেখায় ব্যস্ত। মিশি ভেতরে ঢুকতেই তিনি অবাক হন। রুগীকে তাড়াতাড়ি দেখে ছেড়ে দিয়ে মিশির উদ্দেশ্যে বলেন-
———-মিশি মামণি,তুমি এখানে! কি হইছে?
মিশি ব্যাগ থেকে ওষুধ গুলো বের করে আনিসের সামনে রাখে। বলে-
———–এগুলো কিসের ওষুধ আংকেল?
আনিস ওষুধ গুলো ভালোভাবে দেখে বলে-
————এগুলো তো আমি উদয় কে সাজেস্ট করেছিলাম। তুমি এসব কোথাও পেলে?
————এগুলো কি শরীর দুর্বলতার ওষুধ?
————-নাহ!! শরীর দুর্বল হলে মানুষ ভিটামিন খায়। এগুলো তো ব্লাড ক্যান্সার এর লাস্ট স্টেজের ওষুধ মামণি।
মিশির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। থরথর করে হাত পা কাঁপতে শুরু করে। ব্লাড ক্যান্সার!!!!
আনিস চিন্তিত গলায় বলে-
———–মিশি আর ইউ ওকে?
মিশি কোনোমতে শুধু বলে-
———–আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে চলুন আংকেল।
.
.
দুপুর এর ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে ড্রয়ারে একটা ওষুধ ও পায় না মইনুল সাহেব।
তিনি এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। উদয় কে উচ্চ গলায় ডেকে বলে-
————উদয়,ওষুধ কই তোর?
.
————আমার কাছে।
উদয় আর মইনুল সাহেব দরজার কাছে তাকিয়ে দেখে মিশি দাঁড়িয়ে।
মিশি লম্বা লম্বা পা ফেলে উদয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।
কয়েক সেকেন্ড কেটে যায়।
মিশি ঠাস করে উদয়ের গালে চড় বসিয়ে দেয়।
মইনুল সাহেব অবাক হন। তার থেকেও বেশি অবাক হয় উদয়।
মিশি দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে-
————তোর লজ্জা করলো না আমাকে মিথ্যে বলতে? কি হতো যদি বলতি তোর ব্লাড ক্যান্সার!! ছেড়ে যেতাম তোকে??? আর কি ভাবছিস তুই পড়ন্ত না কোন বাল কে ডেকে নিয়ে এসে কাহিনী করবি,আর আমি তোর থেকে দূরে সরে যাবো? তোকে ভুলে অন্য কাউকে নিয়ে সংসার পাতবো? এতটা স্বার্থপর আমি উদয়???
চলবে……