পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ২৯+৩০
লেখা – Mahfuza_Monira
আলী মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন-
——– কি ব্যাপার! বসেই থাকবি? এসে খাতা টা নে!
মিশি ধমক খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। খুব দুর্বল লাগছে তার। শরীরে একফোঁটা শক্তি নেই যেন। দুর্বল শরীর টাকে টেনে নিয়ে চলে মাস্টারের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে খাতা টা নিয়ে আবার এসে বেঞ্চে বসে।
লিমা মিশির শরীরে হাত দিয়ে দেখে পুরো শরীর ঠান্ডা। লিমা আৎকে উঠে। নিচু গলায় বলে-
——- তুই চিন্তা করিস না। আমাকে খাতা টা দে। আমি গুনে দেখি নাম্বার কোথাও কম দিলো কিনা!
লিমা মিশির হাত থেকে অংক খাতা টা নিয়ে নেয়। মিশি একটা টু শব্দ ও করে না। নিথর হয়ে বসে আছে সে।
লিমা পৃষ্ঠা উল্টায় একটা একটা করে। নাম্বার গুনে। ৬৯ এ এসেই ঠেকে যায়। আর বাড়ে না। লিমাও ঘামছে এবার।
স্যার খাতা দিয়ে চলে যায়। স্যার চলে যেতেই উদয় আসে। লিমার থেকে খাতা টা নিয়ে তাড়াতাড়ি গুনা শুরু করে। কিন্তু না,বাড়ছে না। কোনোদিক থেকেই বাড়ছে না। সেই একই জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছে নাম্বার।
উদয় অসহায় চোখে মিশির দিকে তাকায়। মিশির চোখের পাতাও পড়ছে না। সে চুপচাপ স্থির হয়ে বসে আছে শুধু।
উদয় দুর্বল গলায় ডাকে-
—— মিশি।
মিশি নড়ে উঠে। আহত গলায় বলে-
——- বাড়ছে না নাম্বার?
উদয় লিমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কেউ কোনো জবাব দেয় না।
মিশি আতংকিত বোধ করে। উদয়ের শার্ট খামচে ধরে কেঁদে উঠে নিঃশব্দে। উদয় থ বনে যায়। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না তার। লিমা উঠে এসে মিশিকে জড়িয়ে ধরে। স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই তার। তবুও বোঝায় মিশিকে। কিচ্ছু হবেনা,কিচ্ছু হবে না…
.
.
বাসায় ফিরে নিজের নিথর দেহ টাকে বিছানায় এলিয়ে দেয় মিশি। প্রতিদিন বাড়ি এসে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেয় মিশি। হাসি মজাতে মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়ি। আর আজ!
বকর মোল্লা চিন্তিত হন। নতুবা কে উদ্দেশ্য করে বলেন-
——– এত চুপচাপ কেন আজ ও! কি হলো মিশির!
নতুবা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন-
——— বোধহয় এবারেও ফেইল মেরেছে!! খুব তো বড়বড় গলায় বলেছিল ৭০ এর বেশি পাবে! এবার আমার পছন্দ মতো ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। আর তোমাকেও বলে দিচ্ছি,তুমি কিন্তু বাধা দিতে পারবে না কোনো। তুমি কথা দিয়েছো কিন্তু আমায়।
বকর মোল্লা আর কথা বাড়ান না। মেয়ের কি হলো তা নিয়ে একটুও মাথা ব্যথা নেই তার। সে আছে মিশিকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে। যতসব!!
বকর মোল্লা উঠে যান। একবার মিশির রুমে গিয়ে দেখে আসতে হয় তাকে…!
.
.
মিশিকে কপালের উপর হাত রেখে শুয়ে থাকতে দেখে বকর মোল্লা আতংক বোধ করেন। তাহলে কি নতুবাই ঠিক বললো!
বকর মোল্লা মিশির সিথানের কাছে এসে বসেন। পরম মমতায় মিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মিশি চোখ খুলে বাবাকে দেখতে পেয়ে উঠে বসে। বকর মোল্লা নরম গলায় বলেন-
——- কি হয়েছে মা?
মিশি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে-
——- কই কিছু হয়নি তো বাবা।
——- বাবার থেকে কিছু লুকোতে নেই। বলো আমাকে,কি হয়েছে?
মিশি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। বকর মোল্লা নির্বাক হয়ে পড়েন। গভীর মমতায় মেয়েকে বুকের ভিতর আবদ্ধ করে নেন একহাতে। মিশি ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে-
——– ৬৯ পেয়েছি বাবা। আর ১ এর জন্যে ৭০ পেলাম না।
বকর মোল্লা অবাক হন।
প্রচুর অবাক হন। যেই মেয়ের পাশ নিয়েই টানাটানি ছিল,সে নিজ প্রচেষ্টায় আজ ৬৯ পেয়েছে। তাও টেস্টে!!
বকর মোল্লা শান্ত গলায় বলে-
—— তাহলে এভাবে কাঁদছিস কেন? সবাই তো বুঝবে এবারো ফেইল মেরেছে আমার মেয়ে!
——— কিন্তু বাবা,আম্মুর সাথে তো বাজী হেরে গেলাম। আমাকে এবার বিয়ে দিয়েই দিবে সে!!
বকর মোল্লা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে-
——- খাতার নাম্বার গুনেছিলে ভালো করে? কোথা থেকে এক নাম্বার বাড়ানো গেলো না?
মিশি বাবার মুখের দিকে চেয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকায়। এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায় সে।
বকর মোল্লা আবারও চুপ হয়ে থাকেন। তারপর মিশির দিকে ফিরে,মিশির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেন-
——- খাতা টা কই,আমাকে দেখাও তো।
মিশি উঠে গিয়ে খাতা টা নিয়ে আসে। বকর মোল্লা সেটা নিয়ে উঠে দাড়ান। বলেন-
——- আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। তোমার আম্মুকে কিচ্ছু বলতে হবে না রেজাল্টের ব্যাপারে। আমি আসি আগে,তখন যা বলার আমিই বলবো। ঠিক আছে?
মিশি একটু অবাক হয়।
পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে-
—— হুম আচ্ছা।
বকর মোল্লা বেড়িয়ে যেতে নেন। মিশি আবারো ডাকে।
বকর মোল্লা পিছনে ঘুরে বলেন-
—— কিছু বলবে?
মিশি মাথা দুলায়। বকর মোল্লা এগিয়ে এসে মিশির বিছানার উপর বসে।
মিশি তার পাশে গিয়ে চুপ করে থাকে।
বকর মোল্লা বলেন-
——— কি বলবে! বলো।
মিশি ইতস্তত বোধ করে। বলাটা ঠিক হবে নাকি হবে না ভাবতে থাকে সে।
বকর মোল্লা আবারো বলে উঠেন-
——— কি ব্যাপার? বলো।
মিশি থতমত খেয়ে বলে-
——– কিছুনা বাবা। যাও তুমি।
বকর মোল্লা বুঝেন কিছু একটা মনের ভিতর খোচাচ্ছে মিশিকে। সে পরম স্নেহের চোখে তাকায় মিশির দিকে। শান্ত গলায় বলে-
——— বাবার থেকে কোনো কিছু লুকাতে নেই। বল আমায়!
মিশি নিচু গলায় বলে-
——– বাবা,আমি যদি কখনো কাউকে ভালোবাসি,তুমি কি মেনে নিবে তাকে? যদি সে আমারই সমবয়সী হয়?
বকর মোল্লা খুব অবাক হন।
মিশি পা দিয়ে ফ্লোর খোচাচ্ছে তখন। বকর মোল্লা মৃদু হেসে বলেন-
—— যদি উদয় হয় তবে মেনে নিবো।
মিশি চমকে তাকায় বকর মোল্লার দিকে। আনন্দে ডগমগ হয়ে বলে-
——- বাবা সত্যি?
বকর মোল্লা স্মিত হেসে বলেন-
——- হুট হাট উদয়ের বাসায় যাওয়ার বায়না করা,উদয় কে সারাদিন ডেকে ডেকে নিজের কাছে রাখা, একে অন্যের প্রতি এত ফিলিংস,এত কেয়ার। আমি কি কিছুই বুঝিনা? অনেক আগেই বুঝেছি যে তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস। শুধু তোর মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন যখন বলেই ফেললি,তখন আর কী! আমিও আমার মনের কথা বলে ফেললাম। উদয় কে বরাবরই আমার খুব পছন্দ মিশি।
মিশি খুশিই হয়। বকর মোল্লার হাত ধরে বলে-
——- আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে তুমি মেনে নিলা! আমি তো ভাবছিলাম…. যাইহোক,বাবা একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। বলে ফেলি?
বকর মোল্লা মৃদু হেসে বলেন-
——– বলে ফেলো।
——- বাবা,আমাদের সমাজে,সেইম এইজ রিলেশন খুব কমই সার্থক হয়। সেখানে তুমি মেনে নিচ্ছো! তাও একজন চেয়ারম্যান হয়ে। তুমি চাইলেই আমাকে একটা ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারতে! তাহলে এই মেনে নেওয়ার কারন কী??
বকর মোল্লা এবার খুব জোরেই হেসে উঠেন। মিশি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে তিনি বলেন-
——- আগেই বলেছি,বাবা মা হলো একটি সন্তানের বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই সন্তান কে পুরোপুরি বুঝতে হবে আমাদের। বাবা মা চাইলেই তার সন্তান কে তাদের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। এতে কী হয় জানিস? এতে সন্তান রা পালিয়ে যাওয়ার মতো স্টেপ তুলে নেয়,বাবা মাকে খুন করার মতো স্টেপ তুলে নেয়। বাবা মায়ের উচিত সন্তান কে বোঝানো যদি ছেলে খারাপ হয় তাহলে,আর ছেলে যদি ভালো হয় তবে মেনে নেওয়া। কেননা,আল্লাহই সবার জুটি মিলিয়ে রেখেছেন। শুধু শুধু ছেলে মেনে না নিয়ে সন্তানের কাছে খারাপ হয়ে লাভ কী? এতে সন্তান আর বাবা মায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় মামণি। আর উদয়,তোমার বয়সী হলেও খুব টেলেন্টেড সে। আর তোমরা তো এখনি বিয়ে করছো না! আরো বড় হয়ে করবা। এখন,একে অপরের জন্যে হলেও দুজনে ভালো করে পড়াশোনা করবা,নিজের পায়ে দাড়ানোর চেষ্টা করবা। তো? আমার মূল কথা এটাই যে,যদি ছেলে খারাপ হতো আমি তোমাকে বুঝাতাম। তোমাকে সময় দিতাম। তুমি ঠিক একটা সময় গিয়ে বুঝে নিজেই ফিরে আসতা। কিন্তু ছেলে যেহেতু ভালো, তাই মেনে নিচ্ছি। এতে তোমরা না পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাববা,না আমার আর তোমার মধ্যে মুখ কালাকালি,দূরত্ব এসব বাড়বে! উল্টো তুমি আর উদয় একে অপরকে পাওয়ার জন্য আরো জমিয়ে পড়াশোনা করবা,নিজেদের পায়ে দাড়ানোর চেষ্টা করবা। আর আমি তো আছিই।তোমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য,তোমাদের সাহায্য করার জন্য। বুঝেছো??
মিশি মুগ্ধ হয়ে শুনছিল তার বাবার কথা। সে গর্ব বোধ করে এরকম একজন বাবা পাওয়ার জন্য। ঈশ! যদি সবার বাবা মা এভাবে তার সন্তান কে বুঝতো,তবে আজ দেশ টা অন্যরকম হতো।
বকর মোল্লা উঠে দাঁড়ায়।
——- মনে থাকে যেন,আমি না আসা অব্দি তোমার মাকে কোনো কথার জবাব দিবা না। আমি জলদিই ফিরে আসবো।
——- আচ্ছা বাবা।
বকর মোল্লা বেরিয়ে যায়। মিশির মনের সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে যায় এক নিমিষেই। এক নতুন আশা,নতুন প্রশান্তি বুক ভরে যায় তার। একটা নতুন শক্তি জোগ হয়ে শরীরে,যে শক্তি টা তার বাবা তাকে দিয়েছে….
চলবে……
পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ৩০
লেখা – Mahfuza_Monira
মেঘের পায়ের ব্যথা নেই বললেই চলে। তবুও গুনে গুনে পা ফেলতে হয়। নয়তো ভিতর থেকে ব্যথা অনুভব করে একটা।
লিমা গরম তেলের বাটি হাতে এগিয়ে আসে মেঘের দিকে। মেঘ শুয়ে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল। লিমাকে আসতে দেখে উঠে বসে সে।
———- এটা কী আনছো? বাটিতে?
———- গরম সরিষার তেলের সাথে রসুন।
মেঘ নাকমুখ কুঁচকে বলে-
———- কেন আনছো এটা?
———- তোমাকে খাওয়াবো বলে। দেখি ওদিকে সরে বসো।
মেঘের পাশ ঘেঁষে বসে লিমা। যত্ন সহকারে মেঘের পা টা নিজের কোলের উপর তুলে নেয়। তারপর একটু একটু করে গরম তেল লাগাতে শুরু করে সেখানে। মেঘ আরাম বোধ করে।
আহ্লাদী কণ্ঠে বলে-
———- এরকম বউ পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার গো! কত্ত ভালো আমার বউটা।
লিমা মুখ বাকায়। বলে-
———— পাম মারতে হবে না। পাম মারায় একদম ওস্তাদ আপনি!
মেঘের মুখ ছোট হয়ে যায়। সে গম্ভীর গলায় বলে-
———- কারো প্রশংসা করাও পাম! ধুর,করলাম না কারো তারিফ। কি আসবে যাবে তাতে!
লিমা কিছু বলে না। সে চুপচাপ তার কাজ করে যায়।
প্রকৃতিতে হালকা শীতের জানান দিয়েছে। উত্তরা বাতাস এসে পুরো শহর টাকে শীতের চাদর পড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মেঘ একটু কেঁপে উঠে।
বলে-
———- কাথা টা দাও লিমা। শীত করছে।
লিমা এক নজর তাকায় মেঘের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। আলমারির পাশের ছোট টেবিলের উপর কাথা কম্বল রাশি মেরে রাখা। সেখান থেকে একটা কাথা নিয়ে গায়ে মুড়িয়ে দেয় মেঘের । মেঘ আরামে চোখ বন্ধ করে নেয়।
লিমা আবার তাকে তেল লাগানো শুরু করে।
কিছুক্ষণ কেটে যায়।
মেঘ শান্ত গলায় বলে-
——— কিছু কথা ছিল তোমার সাথে লিমু।
লিমা ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
——– বলে ফেলো। আমি কি তোমাকে আটকে রাখছি!
মেঘ কাথার ভেতর কুঁজো হয়ে বসে বলে-
——– তুমি কি না কি ভাববা জানিনা! তবে যেটা আমার কাছে ঠিক লাগলো,সেটাই বলতেছি। লিমা আমি চাই তোমাকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠতে।
লিমা তেল লাগানো বন্ধ করে দেয়। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে-
———- কেন??
———- দেখো তুমি এখন বিবাহিত! আমার স্ত্রী তুমি। তোমার জায়গা এখন আমার বাড়ি। কিন্তু শশুরবাড়িতে তো এখনি তোমায় নিয়ে উঠতে পারবো না তাই বলে কী তোমার বাবার বাড়িতেই থাকবা তুমি? তাও আমি সহ! লোকে নানান কথা কইবে লিমু। তাই ভাবছিলাম,আশেপাশেই একটা বাসা দেখে উঠে পড়লে কেমন হয়?
লিমা কিছুক্ষণ ভেবে বলে-
———- আমি আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে দেখবো এই বিষয়ে।
———- আচ্ছা।
মেঘ আবারো শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে।
.
.
.
মিশি কে রুম থেকে একবারো বের হতে না দেখে নতুবা বেগম মুখ টিপে টিপে হাসেন। এক অদ্ভুত শান্তি লাগছে তার মনের ভিতর। নিশ্চয়ই মিশি ফেইল করেছে আবার!! যাক,এবার এই উছিলায় মেয়েটাকে বিদায় করা যাবে।
হাসিব চাচা কে ডেকে নতুবা বেগম বলেন-
—— ভাই একটা কাজ করতে হবে আমার।
——- জ্বি বলেন।
——- ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে মিশিকে। কিছু ফল আনাতে হবে। আমি লিস্ট করে দিচ্ছি কোন কোন ফল,আপনি এনে দিবেন শুধু।
হাসিব চাচা বিষ্ময়কর গলায় বলে-
——– মিশি মামণি কে ছেলে দেখতে আসবে? কবে??
নতুবা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে-
——— কালকে।
হাসিব চাচা আরো অবাক হন। বলেন-
——— আমি যতদূর মামণি কে চিনি,সে এখন বিয়ে করতে চাবে না। তাহলে এসবের মানে??
নতুবা বেগম তুরি বাজিয়ে বলে-
——— কাঁদায় পড়লে হাতিরও চামচিকার লাথি খেতে হয়! মিশি এবারেও ফেইল করেছে বুঝলেন ভাই। ও আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল,যদি ও ৭০ এর বেশি নাম্বার পায় তবে আমি ওকে আর বিয়ের কথা বলতে পারবো না। কিন্তু যদি কম পায়,তবে আমি যার সাথে চাইবো তার সাথেই বিয়ে করে নিতে হবে ওর। যেহেতু ফেইল ই মেরেছে সেহেতু জিতেছি আমি। এবার ওকে তাকেই বিয়ে করে নিতে হবে যাকে আমি বলবো।
হাসিব চাচা নির্বাক হয়ে পড়েন। এমন মাও কি পৃথিবীতে আছে যারা খালি মেয়ে কে বিদেয় করতে পারলেই বাঁচে!
হাসিব চাচা আফসোস করে উঠেন। তার ক্ষমতা থাকলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতেন নতুবা বেগম কে।
হাসিব চাচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন-
——– লিস্ট দিয়েন। আমি ফল গুলো নিয়ে আসবো।
হাসিব চাচা চলে যায়। নতুবা বেগম গুনগুন করতে করতে লিস্ট বানাতে চলে যান।
.
হাসিব চাচা কে মায়ের রুম থেকে বের হতে দেখে একটু অবাকই হয় মিশি। সাধারণত কোনো প্রয়োজন ছাড়া সে সেই রুমে যায় না। তবে আজ কেন!
মিশি নিচু গলায় ডাকে-
———- হাসিব চাচা…হা…
হাসিব চাচা বলে দ্বিতীয় বার ডাকার আগেই মিশির দিকে মুখ করে তাকান তিনি। মিশি হাতের ইশারায় তাকে মিশির রুমে আসতে বলে। হাসিব চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিশির রুমের দিকে যান। সে জানে,মিশি তাকে কেন ডাকছে।
হাসিব চাচা রুমে আসতেই মিশি উদ্ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করে-
———- তুমি মায়ের রুমে কি করছিলা?? আমাকে বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেছে??
হাসিব চাচা মাথা দোলান।
মিশি আবারো প্রশ্ন করে-
——— কি বলেছে??
——— তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে কাল সেটাই।
মিশি আৎকে উঠে। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-
——– সত্যিই?
——— হ্যাঁ মামণি,আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে যাবো কেন!
মিশি নিচু গলায় বলে-
——— আমার একটা কাজ করে দিবা চাচা?
——– বলো মামণি।
——– উদয় কে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে দিবা এখনি? প্লিজ।
হাসিব চাচা মুখে হাসি এনে বলে-
———- এছাড়া আমার কাছে তোমার আর কোনো কাজই থাকতে পারেনা! আমি এখুনি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মামণি। ও না আসতে চাইলেও ওকে তুলে নিয়ে আসবো। চিন্তা করো না তুমি।
মিশি মৃদু হেসে বলে-
——— ওকে তুলে আনতে হবে না। ও এমনিতেই আসবে।
হাসিব চাচা বেড়িয়ে যান। দরজার খিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মিশি। মনের ভিতর আবারো অশান্তিরা হানা দিচ্ছে। উদয় কে তার এক্ষুনি প্রয়োজন।
.
.
.
——— আমি একটু মার্কেট যাচ্ছি আম্মু।
গোলাপী কথা টা বলে বের হতে নিলেই সোহেলা বেগম বলেন-
———- তোর এত মার্কেট যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো কেন এখন! সেদিন না মার্কেট গেলি,আবার আজ!
গোলাপী থতমত খায়। মনে মনে ভাবে,এরপর থেকে আর মার্কেট যাওয়ার বাহানা দিবে না।
কিন্তু এখন কি বলে কাটিয়ে দেওয়া যায়!
সোহেলা বেগম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে-
———– কিরে,শুনতে পাচ্ছিস না যে কি বলতেছি?
গোলাপী আমতা-আমতা করে বলে-
———– সেদিন একটা জিনিস আনা বাকি ছিল আম্মু। আজ আনতে যাবো সেটা। তোমার কিছু লাগবে?
———- আমার কিছুই লাগবে না। মেঘের সাথে দেখা করা হলে দ্রুত বাসায় চলে আসিস,বাসায় অনেক কাজ আছে।
গোলাপী অবাক হয়ে যায়।
মিনমিনে গলায় বলে-
———- মেঘের সাথে দেখা করা হলে মানি!
———- তুই কি ভাবিস,আমি জানিনা যে তুই কোন মার্কেটে যাস,নাকি ঐ ডাইনির বাড়ি গিয়ে মেঘের সাথে দেখা করে আসিস!?
গোলাপী থতমত খায়।
সোহেলা বেগম আবার বলেন-
——– বোন তুই তার। আমি মানা করলেও তুই শুনবি না তাই মানাও করবো না। যা,কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে আসবি।
সোহেলা বেগম চলে যেতে নিলেই গোলাপী বলে উঠে-
——— আর তুমি তার মা লাগো না? তাহলে তোমার কী ইচ্ছে করে না তার সাথে দেখা করার জন্য??
সোহেলা বেগম কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে চলে যান। গোলাপী তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কবে যে ইনি মেনে নিবে ওদের!! সেই চিন্তাতেই বাঁচে না গোলাপী…
.
.
উদয় কে রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে রুমের দরজা আটকে দেয় মিশি। উদয় ভ্রু কুঁচকে বলে-
——— কি হলো দরজা বন্ধ করলা কেন! রেপ করবা নাকি আমার?
মিশি উদয়ের পিঠে দ্রিম করে একটা ঘুষি মেরে বলে-
——– ফাইজলামি কথা বার্তা সব সময় ভাল লাগে না উদু।
উদয় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে-
——- সেটা মুখে বললে হয়না? মেরে বলতে হয়?? ওহ মাগো….
উদয় চাপা গলায় আর্তনাদ করতে থাকে। মিশি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। আচমকাই উদয় কে জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে…
উদয় চমকে যায়।
মিশি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
উদয় আরো চমকে যায়।
উদগ্রীব কন্ঠে বলে-
——— কাঁদছো কেন? কি হয়েছে জান?
মিশি কিছু বলে না। চুপ করে কেঁদেই চলে।
উদয় মিশি কে ঠেলে উঠায় তার বুক থেকে। মিশির দু গালে দুই হাত চেঁপে বলে-
——- বলো কি হয়েছে?
মিশি ফোপাতে ফোপাতে বলে-
——— আম্মুর পছন্দ করা ছেলে কাল দেখতে আসবে নাকি আমাকে। খুব ভয় করছে আমার। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা উদু।
মিশি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। উদয় বোবা বনে যায়। কি বলে স্বান্তনা দেবে সে মিশিকে! তবুও স্বান্তনা তো দেওয়া দরকার।
উদয় মুখে হাসির রেখা টেনে বলে-
———- একদম বস্তির মেয়ে সুরাইয়া লাগতেছে। ইইই! চুপ চুপ। কাঁদলে একদম ভাল লাগে না গো তোমাকে।
মিশি চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তখনো নাক টানা বন্ধ হয়না তার।উদয় মিশির নাক টেনে বলে-
———- দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে নাকি পাগল মেয়ে! আমি আছি না,তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো দরকার পড়লে।
মিশি নাক টানা বন্ধ করে বলে-
———– পালাতে হবে না। বাবা বলেছে আমাদের কখনো পালাতে না।
উদয় অবাক হয়। চোখ বড়বড় করে বলে-
———— মানে?
———— তোমাকে বলা হয়নি। বাবাকে আমি আমাদের ব্যাপারে সব বলে দিয়েছি। বাবা মেনে নিয়েছে তোমাকে।
উদয়ের বিশ্বাস হয়না মিশির কথা। বিষ্ময়ের গলায় বলে-
——— সত্যিই?
——— হুম সত্যি। বাবা আমার অংক খাতা নিয়ে কোথায় জানি গেলো! বললো না আসা অব্দি রেজাল্টের কথা কাউকে না জানাতে।
উদয় মিশির দুগালে শক্ত করে হাত চেঁপে বলে-
——– তাহলে কাঁদছো কেন পাগলি মেয়ে?? আমার তো তোমার বাবার উপর পুরো বিশ্বাস আছে। উনি আমাদের আলাদা হতে দিবেন না। কিছুতেই না।
চলবে…….