পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ২৭+২৮
লেখা – Mahfuza_Monira
সকাল সকাল গোলাপী কে দেখে খুশিতে ডগমগ করে উঠে মেঘ। সে জানতো গোলাপী নিশ্চয়ই আসবে তার কাছে।
সোফায় বসতে বসতে গোলাপী বলে-
—– সরি রে,চেয়েছিলাম তোর বিয়েতেই আসতে। কিন্তু বুঝিসই তো। আজকেও এসেছি তাও মার্কেট যাওয়ার কথা বলে।
মেঘ মৃদু হেসে বলে-
—— আমি জানি তোকে ওদিক টাও সামলাতে হচ্ছে। সরি বলতে হবে না বোন। তুই এসেছিস,এতেই আমি ভীষণ খুশি।
গোলাপী এদিক ওদিক চেয়ে বলে-
—— কেউ নেই বাসায়?
—— আছে রে। মেহমান রা সব চলে গিয়েছে। আর আম্মিজান ঘুমোচ্ছে। আর আব্বিজান বাহিরে হাটাহাটি করতে গেছে। ডায়বেটিস এর রুগী তো!
গোলাপী ভ্রু কুঁচকায়। বলে-
—— আম্মিজান তো বুঝলাম। আব্বিজান কী?
মেঘ বলে-
—– শশুর আব্বা কে ভালোবেসে আব্বিজান ডাকি বুঝলি? ইউনিক নেইম আর কি!
গোলাপী হেসে উঠে।
—– বেশ অদ্ভুত নাম কিন্তু মেঘ!
—– হুম। আমিও জানি। তাই তো এটাই রেখেছি। একদম অদ্ভুত আর ইউনিক নেইম।
গোলাপী হাসি থামায়। ভেতরের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে-
—– তোর বউ কি আছে ঘরে,নাকি সেও নেই! বাহিরে গেছে?
মেঘ মাথা নাড়িয়ে বলে-
—– আছে তো। ভেতরেই আছে। আমি ডেকে আনছি। তুই বস আপু।
মেঘ উঠে চলে যায়।
লিমা হাতে ট্রে নিয়ে ঘোমটা টেনে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে আসে। ট্রে তে কয়েক পদের নাস্তা সাজানো। গোলাপী উঠে দাঁড়ায়। লিমার হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলে-
—– আরে! কে বলেছে এতসব করতে! আমি তো তোমাদেরই ঘরের লোক নাকি?
লিমা স্মিত হেসে বলে-
—– তবুও আজ প্রথম বার এলেন! তাই একটু আর কী!
গোলাপী একটু অবাক হয়। মেয়েটার বয়সই বা কত! ১৬ কী ১৭. তবুও জ্ঞান বড়দের মতোই। যেন সংসার ব্যাপারে কত কিছু জানে সে!
গোলাপী মনে মনে খুশিই হয় এমন একটা মেয়েকে তার ভাইয়ের বউ হিসেবে পাওয়ার জন্য।
লিমাকে তার পাশ ঘেঁষে বসায় গোলাপী। দু হাতে লিমার মুখ তুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।
আনন্দপূর্ন গলায় বলে-
—– মাশাল্লাহ, ভারী মিষ্টি দেখতে গো তুমি!
লিমা নতজানু হয়ে যায় লজ্জায়।
মেঘ ড্রয়িংরুমে এসে লিমা কে দেখে বলে-
—– তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজতেছিলাম!
লিমা আড়চোখে চেয়ে বলে-
—— আমি তো আপনার সামনে নিয়েই গেলাম রান্নাঘরে! আপনি দেখেন নি!
মেঘ মাথা নাড়ায়।
—– না তো!
—– তা দেখবেন কি করে! কতদিকে মন থাকে আপনার..!
মেঘ থতমত খায়। গোলাপী হেসে উঠে। লিমার থুতনিতে হাত দিয়ে বলে-
—– বিয়ের আসল মজাই এসব মিষ্টি মিষ্টি ছোট খাটো খুনশুটি গুলোয়। যাক,এসেই একটা দেখতে পারলাম। ভালো লাগলো।
মেঘ অপ্রস্তুত হয়ে হেসে উঠে। লিমা চুপ করে বসে থাকে।
গোলাপী তার ব্যাগ থেকে একজোড়া স্বর্ণের ঝুমকো বের করে। লিমার কানে পড়িয়ে দিয়ে বলে-
—– যদিও এই কাজ টা,মায়ের হয়। তবুও আমিই করলাম। তোমায় কী মিষ্টি লাগছে দেখতে ঝুমকো জোড়ায় লিমা।
লিমার মন টা খারাপ হয়ে যায়। নিচু গলায় বলে-
—– মা কি আমাদের কখনো মেনে নিবেন না?
গোলাপীর মুখ টাও ভার হয়ে যায়। কীইবা বলবে সে! এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজেরই তো অজানা।
গোলাপী মেঘের দিকে তাকায়। মেঘ মাথা নত করে বসে আছে। গোলাপী এক মিনিট সময় নিয়ে ভাবে কিছু। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে লিমার গালে হাত ছুঁইয়ে বলে-
—– কেন মানবে না? অবশ্যই মানবে। একটু অপেক্ষা করো। আমি জানি,সে তোমাদের আজ হোক বা কাল,মেনে নিবেই লিমা।
লিমা আশ্বস্ত বোধ করে গোলাপীর কথায় কিন্তু মেঘ জানে,গোলাপী তাদের খুশি করার জন্য এই কথা বলেছে।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর লিমা উঠে ভেতরে যায় তার মাকে ডেকে তুলতে। এই ফাকে গোলাপী মেঘ কে প্রশ্ন করে-
—– এখানেই থাকার প্ল্যান করেছিস? নাকি লিমাকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠবি?
মেঘ কিছু বলে না। সে আসলেই জানে না কি করবে!
গোলাপী আবার বলে-
—– লিমা এখন বিবাহিত,তোর বউ সে। তাকে এভাবে তার বাপের বাড়িতেই তুই সহ থাকলে গ্রামের লোকে নানান কথা কইবে। আমি একটা পরামর্শ দি ভাই। তুই নতুন বাসা দেখ,আমি ঠিক করে দিবোনি দরকার পড়লে। সেখানে উঠ। এটাই ভালো হয়।
মেঘ সম্মতি জানায়। বলে-
—– দুটো দিন এখানেই থাকবো। এই দুদিনের ভেতরে বের কর বাসা।তারপর নতুন বাসায় উঠবো লিমা কে নিয়ে।
গোলাপীর দায়িত্ব বেড়ে যায়।
এখন আবার মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে তাকে একটা ভালো বাসা খুঁজে বের করতেই হবে ওদের জন্য।
লিমার মা আসেন। দুটো এদিক ওদিক এর কথা বলে বিদায় নেয় গোলাপী।
.
.
কাল স্কুলে রেজাল্ট দিবে। টেস্টের রেজাল্ট। মিশি বেশ চিন্তিত। কি জানি কি হবে ফলাফল,বিশেষ করে গণিতে। যদি সে বাজী হেরে যায়! যদি তার উদয় কে হারাতে হয় তখন!
মিশি ভাবতেই পারে না উদয় বাদে অন্য কাউকে। উদয়ের জায়গায়,অন্য আরেকটি ছেলের কথা সে চিন্তাও করতে পারে না।
মিশিকে উদাসী ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বকর মোল্লা তার পাশে বসে। নরম গলায় বলে-
—– কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি মা?
হঠাৎ করে বাবার গলা পেয়ে মিশি চমকে উঠে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে-
—– না তো বাবা! কি নিয়ে চিন্তায় থাকবো আর!
বকর মোল্লা মেয়ের মুখের দিকে তাকান। সে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ।
বকর মোল্লা ঈষৎ হেসে বলেন-
—– আমি তোর নাড় কাটা দেখেছি বুঝলি? মিথ্যে বলে লাভ নেই। দ্রুত সত্যি করে বল,কি হয়েছে তোর। কোনো সমস্যা?
মিশি হেসে ফেলে। এই বাবা টা না! পারা যায় না একে নিয়ে…!
মিশি গম্ভীরমুখে বলে-
—– চিন্তা হচ্ছে বাবা। কালকে রেজাল্ট দিবে। যদি,আমি হেরে যাই। আর মা যদি আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয় তখন!
বকর মোল্লার মুখ নিমিষেই গম্ভীর হয়ে যায়। সেও তো কথা দিয়ে ফেলেছে নতুবা কে। যদি মিশি সত্যিই গণিতে ৭০ এর থেকে কম নাম্বার পায়,তাহলে তো…
বকর মোল্লা চুপ করে থাকেন। মিশি আবারো বলে-
—– আমার খুব টেনশন হচ্ছে বাবা।
বকর মোল্লা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বলেন-
—– তুই চিন্তা করিস না। আর বিয়ে দেওয়া কি এতই সোজা! আগে দেখিই না কী হয়। পরের টা পরেই দেখা যাবে।
চল,একটা ছবি দেখি দুজনে।
মিশি না চাইলেও বকর মোল্লা জোর করে টেনে নেয় ওকে। দুজনে মিলে মিস্টার বিনের একটা ফানি ছবি দেখতে বসে সিডিতে। বকর মোল্লার দেখার শখ নেই। তবুও এই উছিলায় যদি মেয়ের মন ভালো হয়!
.
.
.
দুপুরে খাবার দাবার শেষে ঘরে ঢুকতেই লিমা কে নিজের বুকে আবদ্ধ করে নেয় মেঘ। লিমা চমকে উঠে।
—– সারাটা দিন আমাকে বুকে ঠেসে রাখার ধান্দা তোমার!
—— তো কী আরেক জন কে রাখবো? ঠিক আছে। তুমি যাও,আমি অন্য কাউকে খুঁজে নিচ্ছি।
মেঘ ছেড়ে দেয় লিমা কে। লিমা চোখ গরম করে বলে-
—– ইইইইই!! সাহস কত। ঠ্যাং ভেঙে ঠোঙ্গা বানাবো। আমাকেই জড়িয়ে রাখবা। আর কাউকে না।
মেঘ হেসে লিমাকে আবার জড়িয়ে ধরে।
লিমা চুপ করে মেঘের বুকে মাথা রেখে থাকে।
মেঘ ডাকে-
—– লিমু।
——- হু।
—— সবার সামনে আপনি আপনি করো,আর একান্তে তুমি। কেন?
——– বিয়ে হলো মাত্রই কাল! আর এখনি সবার সামনে তুমি করে বললে কেমন দেখায় না! তাই আপনি করে বলে। এক দু’মাস যাক,ঠিক হয়ে যাবে।
—— হুম। আচ্ছা।
আবারো দুজনে চুপ।
মেঘ আবার ডাকে-
—— লিমু।
——- হু বলো শুনছি।
—— মন খারাপ?
লিমা আর জবাব দেয় না।
মেঘ আবার প্রশ্ন করে-
—— মন খারাপ?
লিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-
——- তোমার আম্মু কি আমাদের মেনেই নিবে না মেঘ?
মেঘের বুকের ভিতর টা মোচড় দিয়ে উঠে। সে শক্ত করে লিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে-
—— জানিনা আমি লিমু। জানিনা।
.
.
আজকে সারাদিনে একবারো উদয় মিশির বাসায় আসেনি দেখে মিশি অস্থির প্রায়। কোথায় গায়েব হয়ে গেলো ছেলেটা! সেই রাতে এলো,আর তো এলো না।
মিশি এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে হাসিব চাচা কে ডাকে।
হাসিব চাচা আসতেই বলে-
—— উদয় কে ডেকে নিয়ে আসবা চাচা?
—— আচ্ছা মামণি,এখুনি গাড়ি নিয়ে যাবো আর আসবো।
হাসিব চাচা বেরিয়ে যায়। মিশি আবারো উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করতে থাকে।
আধা ঘন্টা পর হাসিব চাচা ফিরে আসে। তার মুখ ফ্যাকাশে।
মিশি ব্যস্ত হয়ে যায় উদয় কোথায় জানতে।
—— কই উদয়? আসলো না?
হাসিব চাচা নিচু মুখে এদিক ওদিক মাথা নাড়ান। বললো-
—– উদয় বললো, সে নাকি আর আসবে না তোমার কাছে।
মিশির চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
—- কিইই!!
—- হ্যাঁ। আরো একটা কথা বললো।
মিশি হাসিব চাচার কাছে এসে বলে-
—— কি কথা?
——- বললো তুমি নাকি একটা দস্যি মেয়ে। তোমার কাছে না এসে কাঠাল গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো!
মিশির গা ঝাড়া দিয়ে রাগ উঠলেও সে হেসে ফেলে এই কথা শুনে। হাসিব চাচা কে চলে যেতে বলে সে নিজে নিজেই একগাল হেসে নেয়। কাল রাতে ওভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই রাগ করেছে উদু। মিশি বুঝতে পারে তা। ব্যাগে কিছু বই খাতা ভরে বকর মোল্লার কাছে যায় মিশি। এখুনি তাকে একবার উদয়ের বাসায় যাওয়া লাগবে।
চলবে…..
পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ২৮
লেখা – Mahfuza_Monira
উদয়দের ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই উদয়ের বাবার সামনে পড়ে মিশি। মিশি কে দেখে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই মিশি হাত দিয়ে ইশারা করে চুপ থাকতে। মইনুল সাহেব চুপ থাকেন। মিশির কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলেন-
—– তুমি এখানে! এই এখন?
—— আসলাম তোমার ছেলের সাথে দেখা করতে কাকু। সে কই?
মইনুল সাহেব হাত ইশারায় দেখান যে উদয় তার রুমে আছে। মিশি পা টিপে সেদিকে আগায়।
.
হাতে রসায়ন বই নিয়ে চুপ করে বসে আছে উদয়। মন টা খচখচ করছে তার। হাসিব চাচাকে ফিরিয়ে দিয়ে সে ভুল করলো না তো!
করলে করুক,সে কিছুতেই ঐ দস্যি মেয়ের মুখোমুখি হবে না সে আর। আনরোমান্টিক একটা!
উদয় মিশির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে বইয়ে মুখ গুঁজে। ভালো করে পড়তে হবে তার। সামনেই এস এস সি এক্সাম।
.
মিশি পা টিপে টিপে উদয়ের পিছন দিকে এসে দাঁড়ায়। উদয় পড়ায় ব্যস্ত। মিশির গা জ্বলে। সে ভেবেছিল হয়তো ছেলেটা মনমরা হয়ে থাকবে আর সে এসে বাবু সোনা বলে তার রাগ ভাঙাবে। অথচ,উদয় পড়ছে!
মিশি নিজের ব্যাগ টা দ্রিম করে উদয়ের টেবিলের উপর ছুড়ে মারে। উদয় লাফিয়ে উঠে চমকে। পিছনে তাকিয়ে মিশিকে দেখে অবাক হয়ে বলে-
—– তুমি!
মিশি রাগী গলায় বলে-
—– হ্যাঁ আমি! তো?
উদয় স্বাভাবিক গলায় বলে-
—– না কিছুনা। বসো।
—– বসবো না। তুমি পড়ো। তুমি তো পড়ায় ব্যস্ত খুব!
—– আরে না! কিসের পড়া। একটু বই ঘাটাঘাটি করছিলাম আর কী!
মিশি বিছানার উপর বসতে বসতে বলে-
—– সে তো দেখতেই পারছি! পড়তেছিলা নাকি বই ঘাটতেছিলা! আমি এসে বিরক্ত করলাম বোধহয় না? আমি তার চেয়ে বরং চলে যাই।
মিশি উঠে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগ নেয় তার। চলে যেতে নিতেই উদয় মিশির হাত ধরে। টেনে নিজের কাছে এনে বলে-
—– আমার রাগ ভাঙাতে এসেছিলে?
মিশি মাথা নিচু করে ছোট করে জবাব দেয়-
—– হু।
উদয় মিশির থুতনিতে হাত দিয়ে বলে-
—– তুমি একটা মায়াবতী মিশি। তোমার উপর রাগ করে থাকা যায়না। দেখলেই সব রাগ যেন উবে যায় একদম। আমার একটুও রাগ নেই তোমার উপর সত্যি। কিন্তু একটু অভিমান আছে।
মিশি উদয়ের চোখে চোখ রাখে। বলে-
—– কেন?
উদয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
—– একটু আদর চেয়েছিলাম তোমার থেকে! আর তুমি। বাথরুমের মগ দিয়ে আমাকে মারতে আসছো!
মিশি নিঃশব্দে হাসে উদয়ের কথা শুনে। উদয় আড়চোখে তাকায় মিশির দিকে। গোমড়া মুখে বলে-
—– হাসো হাসো। মন ভরে হাসো।
উদয় গিয়ে বিছানার উপর বসে। মিশি তার পাশে গিয়ে বসে। উদয়ের একহাতের উপর হাত রেখে বলে-
—– যদি কেউ দেখে ফেলতো কাল! তাই ওভাবে তাড়িয়ে দিয়েছি। নাহলে আমি তোমাকে ওভাবে তাড়িয়ে দিতে পারি বলো!
—– তাইতো! ওভাবে তো তুমি তাড়িয়ে দিতেই পারো না। তুমি যে মেয়ে! তাতে তোমার তো বটি হাতে আমাকে তাড়াতে আসা উচিত ছিল!!
মিশি চোখ বড়বড় করে বলে-
—– তুমি কি বলতে চাচ্ছো? আমি দস্যি মেয়ে?
উদয় মুখ বাকিয়ে বিরবির করে বলে-
—– সেটা বলতে হবে কেন! সবাই তো তোমাকে দস্যিই বলবে!
মিশি না শুনতে পেয়ে বলে-
—— কি বললে? শুনি নি।
—— না না,কিছুনা। রাত হয়েছে। বাসায় যাবা না?
মিশি উঠে উদয়ের রিডিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করতে করতে বলে-
—— হ্যাঁ যাবো তো। তার আগে এটা পড়ো।
মিশি কিছু কাগজ এগিয়ে দেয় উদয়ের কাছে। উদয় হাত বাড়িয়ে নেয় তা।
মুখে বলে-
—– কি এগুলা!
—– খুলেই দেখো।
উদয় একটা একটা করে কাগজের ভাজ গুলো খুলে। সব গুলোই এক লাইনের ছোট ছোট চিরকুট লেখা।
উদয় পড়া শুরু করে।
‘মায়াবতীর উপর রাগ করে থাকতে নেই,এতে মায়াবতীর মায়া কমে যায়। তুমি কি চাও,আমি মায়াবতী থেকে মায়াবিহীন হয়ে যাই?’
‘আমার হাসি,আমার কান্না,আমার কষ্ট,আমার সুখ,সব তো তোমার সাথেই। তাই মজা টাও না হয় তোমার সাথেই করেছি কাল!’
‘আচ্ছা যাও,চকলেট এর ভাগ দিবো তোমায়,তবুও রাগ করে থেকো না। বাম পাশের ঢিপঢিপ করা যন্ত্রটায় চিনচিনে ব্যথা হয় খুব।’
‘আই এম সরি,আই এম সরি। মাফ করা যায়না?’
‘আমি তোমাকে,এত্তগুলায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া ভালোবাসি। তুমি বাসো তো?’
শেষ কাগজের ভাজ টা খুলতেই সেখানে লেখা থাকে,
‘ আমার দিকে তাকাও উদু। সারপ্রাইজ আছে!’
উদয় কাগজ টা ভাঁজ করে মিশির দিকে তাকাতেই মিশি ক্ষেপা বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে উদয়ের বুকে। উদয়ের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে চেঁপে ধরে শক্ত করে।
গভীর চুম্বনের পর উদয়ের ঠোঁট ছেড়ে দেয় মিশি। দৌড়ে গিয়ে রিডিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। কিভাবে পারলো সে উদয়কে চুমু খেতে!!
উদয় তখনো শকে আছে। সে কল্পনাও করেনি মিশি এরকম কিছু একটা করবে!
উদয়ের সম্বিত ফিরে এলে সে মিশির দিকে তাকায়। মিশি একটা স্থিরচিত্রের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। উদয় গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে মিশির পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিশি উদয়ের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে মাটি খুঁড়ে তার ভিতর ঢুকে যাক সে! ইশ! এত লজ্জা কেন চারিদিকে…!!
উদয় হালকা গলায় বলে-
—– তুমি ঠিক আছো মিশি?
মিশি মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করে বোঝায় যে সে ঠিক আছে।
উদয় আবারো বলে-
—– বাসায় যাবে?
মিশি ছোট্ট করে বলে-
—– হু।
—– গাড়ি সাথে নিয়ে এসেছো?
—– হুম।
—– আমার যাওয়া লাগবে? নাকি তুমি পারবে যেতে?
—— আমি পারবো।
—— আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?
মিশি আর জবাব দিতে পারে না।
উদয় মিশির কাধে মুখ রাখে। মিশি শিউরে উঠে। উদয়ের গরম নিশ্বাস মিশির কানে গিয়ে ধাক্কা খায়,আর মিশিকে কাপিয়ে দেয়। উদয় নিম্নস্বরে বলে-
—– এত লজ্জা পেলে হয় কি করে? নিজেই তো চুমু খেলে,এখন আবার নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছো!
মিশির হাত পা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে সে।
উদয় বলে-
—– আচ্ছা,আমার দিকে ফিরতে হবে না। আস্তে করে চলে যাও। লজ্জা কমলে আমার সামনে এসো কাল।
মিশি মাথা কাত করে দ্রুত পায়ে ব্যাগ কাধে চাপিয়ে চলে যায়। আর এক মুহুর্ত দাড়ালে সে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতো লজ্জায়।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে করে মিশি শুধু সেই সময় টার কথাই মনে করেছে বারবার। বারবার একই প্রশ্ন করেছে নিজেকে। কি করে পারলো সে এত বেহায়া হতে,এত নির্লজ্জ হতে!
.
সারারাত মিশির ঘুম হলো না। চোখ বন্ধ করলেই সেই মুহুর্ত সামনে এসে হানা দেয় যেন। এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাত পার হলো তার।
সকাল হতেই স্কুল ছুটলো সে। আজ রেজাল্ট দিবে। মিশি আতংক আর ভয় নিয়ে চুপ করে বসে রয় বেঞ্চে। উদয় আসে,তার পাশের বেঞ্চে বসে। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে তাকে। কিন্তু তবুও মিশির যেন চিন্তা কমছেই না।
লিমাও আসে। মিশির পাশে বসে। মিশি একবারো লিমার দিকে ফিরে তাকায় না। আসলে সে লিমাকে খেয়ালই করেনি। লিমা একটু অবাক হয়। মিশি কী কোনো কারনে রাগ তার উপর!
লিমা মিশিকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলে-
—— কি করে! চিনছিসই না যেন! এত চেঞ্জ!!
মিশি লিমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড়বড় করে বলে-
—— তুই কখন এলি!
—— বাহ! আমি এসেছি সেটাই খেয়াল করিস নি। খেয়াল কই ছিল আপনার?
মিশি শুকনো করে হাসে। বলে-
—— সরি রে। সত্যিই খেয়াল করিনি। কেমন আছিস? মেঘ ভাইয়া কেমন আছে?
—— আমরা ভালো আছি। বাট তুই তো ভালো নেই। কি হয়েছে? উদয়ের সাথে কিছু?
মিশি একবার উদয়ের দিকে তাকায়। উদয় অন্য একটা ছেলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।
লিমার দিকে ফিরে মিশি বলে-
—— সবকিছু ঠিক আছে আমাদের রে। আমার চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে।
—— কি? আমাকে বল।
মিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মায়ের সাথে ধরা বাজীর কথা বলে লিমাকে। লিমা অবাক হয়ে শোনে সব।
মিশি দুর্বল গলায় বলে-
—— আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে মিশি। আমি কি পারবো উদয় কে ছাড়া থাকতে কখনো?
লিমা মিশির হাতের উপর হাত রাখে তার। নরম গলায় বলে-
—– দরকার পড়লে স্যার কে কিডন্যাপ করে নিয়ে তোকে ৭০ এর বেশি নাম্বার তুলিয়ে দিবো অংকে। তবুও তোকে আর উদয় কে আলাদা হতে দিবো না। চিন্তা করিস না তুই।
মিশি এত চিন্তার ভেতরেও লিমার কথা শুনে হেসে ফেলে। তারপর আবার হাসি থামিয়ে চুপ করে বসে সে। কোনোভাবেই চিন্তা যাচ্ছে না তার।
আলী মাস্টার আসে। এক এক করে রোল ডাকে সবার। রোলের সাথে সাথে নাম্বার ও বলে দিচ্ছে।
উদয়ের রোল ৩। সে ৮৭ পেয়েছে। মিশি শুনে খুশিই হয় বেশ। উদয় একটা বিজয়ীর হাসি দেয় মিশির দিকে তাকিয়ে।
মিশি চোখ সরিয়ে স্যারের দিকে তাকায়। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে তার।
আলী বাবু ডাকেন।
—– রোল ৩১, মিশকাত মিশি। পেয়েছে…
আলী বাবু আড়চোখে একবার মিশির দিকে তাকান। তারপর আবার বলেন-
—— পেয়েছে ৬৯। বাহ মিশি! এত নাম্বার কি করে পেলি এবার??
মিশি তার কথার জবাব দেয় না। খাতা নিতেও যায় না সে। চুপ করে বেঞ্চেই বসে থাকে। মাথায় হিসেব করছে বারবার। ৬৯ কি ৭০ এর কম নাকি বেশি!
ওহ আচ্ছা এটা তো কম।
তাহলে…
এবার কি উদয় কে ছেড়ে দেওয়ার সময় চলেই আসলো তার??
চলবে…..