পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ২১+২২
লেখা – Mahfuza_Monira
হঠাৎ শোরগোল এর শব্দ শুনে পুকুরপাড় থেকে মিশি উদয় দৌড়ে উঠোনে যায়। চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কলপাড় থেকে।
মিশি উদয়ের চোখের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকায়। উদয় চোখ দিয়েই মিশি কে আশ্বস্ত করে যে সব ঠিক আছে। কিছুই হয়নি।
এরপর তারা দুজনেও এগোয় কলপাড়ের দিকে।
মেঘ একটা টুলে বসে আছে। গোলাপী দ্রুত ফোন করে ডাক্তারের নাম্বারে। পাশেই এক ডাক্তার বাড়ি। ভাগ্যিস ডাক্তারবাবু বাসাতেই ছিলেন। তিনি জানান,পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি আসছেন।
গোসল করতে গিয়ে অতিরিক্ত শেওলা জমা জায়গায় পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেঘ। নাকে দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে তার । কিন্তু বেশি ব্যথা পেয়েছে পায়ে। বড় কিছু না হলেই হয় এখন।
পাঁচ মিনিট বললেও ডাক্তার বাবু তিন মিনিটের মাথায় হাজির হন। মেঘের পা এদিক ওদিক নাড়িয়ে চাড়িয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ করে বলে-
– পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে।
মেঘের পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই সোহেলা বেগম এর। তিনি চমকে উঠে বলে-
– তাহলে বিয়ে!
ডাক্তারও তার কথা শুনে খানিকটা বিরক্ত হন যেন। কপাল ঈষৎ কুচকিয়ে বলেন-
– পেছাতে হবে। দুটোদিন পেছান । আশা করি দুটো দিনে পুরোপুরি পা ঠিক না হলেও কিছুটা হলেও ঠিক হবে। ব্যথা কমবে। তখন না হয় বিয়ে সেড়ে ফেলিয়েন?
সোহেলা বেগম কপাল চাপড়ান। কোন কু-গ্রহের যে নজর পড়েছে এই বিয়ের উপর। সোহেলা বেগম যতই দ্রুত বিয়েটা দিতে চান,ততই যেন বিয়েটা পিছিয়ে যাচ্ছে।
সোহেলা বেগম মুখ বাকিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়।
মিশি আর উদয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠে। যাক,আরো দুটো দিন সময় তো পাওয়া গেলো। তারাও এত তাড়াতাড়িই মেঘকে আরেকটা ডাইনির সাথে দেখতে রাজী না।
.
সন্ধ্যার দিকে মিশি আর উদয় যে যার বাসায় যায়।
মিশি ঘরে ঢুকতেই হাসিব চাচা বলেন-
– মামণি তোমার বান্ধবী লিমা এসেছে। সেই বিকেল থেকে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।
মিশি প্রচন্ড অবাক হয়। লিমা কেন আসলো আবার! তাহলে কি ওর ডিসিশন চেঞ্জ করেছে!?
মিশি উপরের দিকে চেয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে যেন তাই হয়। লিমা যেন তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে।
মিশি হাসিব কে উদ্দেশ্য করে বলে-
– লিমু কোথায়?
– তোমার ঘরে মামণি।
মিশি প্রায় ছুটে ঘরের ভিতর ঢুকে।
মিশিকে আসতে দেখে লিমা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মিশি হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝায় যে উঠা লাগবে না,ওখানেই বসে থাক।
লিমা আবার বসে পড়ে।
শরীর থেকে ওড়না টা খুলে বিছানার একপাশে ছুড়ে ফেলে মিশি। তারপর সে লিমার পাশে গিয়ে বসে।
লিমার চোখ গুলো ফোলা ফোলা,নাক লাল। চোখের নিচে জমে থাকা পানিগুলো দানা পাকিয়ে আছে।
মিশি ভার গলায় বলে-
– খুব কেঁদেছিস? না?
লিমা মৃদু হাসে মিশির কথা শুনে। তারপর বলে-
– না কিছুনা। কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি! আর তুই.. আসার নামই নেই।
মিশি স্বাভাবিক গলায় বলে-
– আসলে মেঘ ভাইয়ার গায়ে হলুদের কারনেক দেড়ি..
মিশি চুপ হয়ে যায়। এই ভেবে যদি এসব শুনে লিমার খারাপ লাগে!
লিমা বুঝতে পেরে বলে-
– চুপ করে গেলি যে? আমার থেকে লুকাতে চাইছিস? কিন্তু আমি তো জানি,মেঘের আজ হলুদ ছিল। এই জন্যেই তোর কাছে আসা। কেমন হলো গায়ে হলুদ?
মিশি অবাক হয়ে বলে-
– তুই গায়ে হলুদ কেমন হলো তা জানতে এসেছিস!? আর আমি ভাবলাম..
– কি ভাবলি?
মিশি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে-
– আমি ভাবলাম হয়তো তুই তোর ডিসিশন চেঞ্জ করেছিস। তাই!
লিমা স্মিত হাসে মিশির কথা শুনে।
মিশির গায়ে জ্বালা ধরে। কঠিন গলায় বলে-
– এত হাসিস না তো!
লিমা হাসি থামায়।
ধরা গলায় বলে-
– জানিস মিশি,আমরা নারী,চাইলেই সব করতে পারি। আবার পারিনা। আমাদের কে আমাদের জন্য ভাবতে গেলেও আগে পরিবার সমাজ নামক দুটো প্রানী কে নিয়ে ভাবতে হয়। শেষে দেখা যায়,তাদের জন্যেই কিছু করতে হয়। কতকিছু বিসর্জন দিতে হয়। কতকিছু মেনে নিতে হয়। আমরা দুর্বল না,কিন্তু পরিবার ছোট বেলা থেকেই আমাদের বোঝায় যে আমরা নারী! আর সমাজ সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয় যে আমরা নারী!
মিশি করুণ চাহনি তে তাকায় লিমার দিকে।
লিমা বলেই চলে-
– মাঝে মাঝে ভাবি,ঈশ! কেন যে ছেলে হলাম না!! কত ভালো হতো ছেলে হলে তাইনা বল? এটলিস্ট নিজের মনের মতো করে একটা সিদ্ধান্ত তো নিতে পারতাম!!
মিশি লিমার হাতের উপর হাত রাখে। লিমা চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে-
– যদি পারতাম,তোর বলা লাগতো না। আমিই চলে যেতাম মেঘকে নিয়ে অনেক দূর….অন্নেক দূর…
কিন্তু পরিবার নামক হ্যান্ডকাফের দ্বারা আমার হাত বাধা,সমাজ নামক শিকল দ্বারা পা বাধা। কিভাবে যাই বল?
মিশি কি বলবে ভেবে পায়না।
লিমা মিশির গালে হাত রেখে বলে-
– আমার বুকের ভিতর টাও ঠিক অতখানিই ফেটে যাচ্ছে,যতটা ফাটছে মেঘের । কিন্তু করার কিচ্ছু নেই তো! তবে মিশি,আমি দোয়া করি,মনের গভীর থেকে দোয়া করি,তোর আর উদয়ের ভালোবাসা শেষ পরিণতি পাক। তোদের ভালোবাসা কখনো হেরে না যাক।
মিশির চোখ দিয়েও কয়েক ফোটা জল টুপ করে পড়ে যায়। লিমা সে জল গুলো মুছে দেয়।
এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ।
নিরবতা ভাঙে লিমা।
নিচু গলায় বলে-
– সে ভালো আছে তো?
লিমার গলা ধরে এসেছে।
মিশি স্পষ্ট বুঝতে পারে তা।
ভীষণ স্পষ্ট কাঁপছে লিমার গলা।
মিশি লিমার গা ঘেঁষে বসে।
বলে-
– ভাইয়া পায়ে ব্যথা পেয়েছে। গোসল করতে গিয়ে পড়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে।
লিমা চোখ বন্ধ করে নেয়।
তার ইচ্ছে করছে এখুনি একবার যাক, গিয়ে মেঘের পায়ের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে আসুক। আর জিজ্ঞেস করুক,অনেক ব্যথা পাচ্ছো কি তুমি? কোনো ব্যথা নেই,এইতো আমি আছি না!
পরক্ষণেই ভাবে,আমার তো যাওয়ার অধিকার নেই। আমিই তো সব থেকে বেশি ব্যথা টা দিয়েছি তাকে।
লিমা চোখ খুলতেই মিশি বলে-
– বিয়ে দুদিন পিছিয়েছে।
লিমা শুধু আস্তে করে বলে-
– ওহ!
এরপর উঠে পড়ে। একটা লম্বা দম নেয়। তারপর মুখে হাসির রেখা টেনে এসে মিশির দিকে ফিরে বলে-
– আসি রে। অনেক রাত হয়ে গেলো।
লিমা কয়েকপা হেটে দরজার কাছে গিয়ে থেমে যায়। আবার মিশির কাছে এসে বলে-
– মেঘের দিকে একটু খেয়াল রাখিস। ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করিস রে।
লিমা আর দাঁড়ায় না।
দ্রুত পায়ে চলে যায়।
.
.
– এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
লিমা ঘরে ঢোকা মাত্রই ফিরোজ কবির গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেন।
লিমা থতমত খায়।
নিচু গলায় বলে-
– মিশিদের বাসায় গিয়েছিলাম।
ফিরোজ কবির পুনরায় গম্ভীরমুখে বলেন-
– কালকেই তোমাকে হাসপাতাল থেকে ওরকম একটা অবস্থায় আনা হলো! আর আজকেই তোমার মিশির বাসায় যাওয়া লাগলো? কি এমন জরুরি দরকার?
লিমা চুপ করে থাকে।
কি বলবে ভেবে পায়না।
ফিরোজ কবির গলা খাকারি দিয়ে উঠেন।
– কি হলো? বলছো না কেন?
লিমা কেঁপে উঠে। রেহানা বেগম দৌড়ে ভেতর রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। আতংকিত বোধ করেন তিনি। চিন্তিত গলায় বলে-
– কি হয়েছে? চিল্লাচ্ছো কেন?
ফিরোজ কবির সে কথার কোনো জবাব দেন না।
লিমার দিকে এগিয়ে এসে বলে-
– লিমা,আমি একদম সিউর তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো আমাদের থেকে। না লুকিয়ে বলে ফেলো। এতে তোমার,আমাদের সবারই ভালো।
লিমার তখন কি হয় কে জানে।
এতদিনের চাপানো কান্না,অনুভুতি বিলাপে পরিণত হয়। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে।
রেহানা বেগম বোকা বনে যায়।
এসে দ্রুত মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বারবার প্রশ্ন করেন কি হয়েছে, কি হয়েছে।
লিমার কান্নার গতি কমে আসে। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে-
– আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি। কিন্তু ছেলেটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মা।
লিমা আবারো হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ফিরোজ কবির ধুপ করে বসে পড়েন। রেহানা বেগম লিমার থেকে একটু দূরে সরে যায়। তার ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে এক চড় মারুক এখন। নিজের মেয়ে,এইটুকুন বয়সে এসে একজন কে কিনা ভালোবেসে ফেলেছে। আবার তার জন্য কাঁদছে!!
এই শিক্ষা দিয়েছিল সে তার সন্তান কে?
রেহানা বেগম শান্ত গলায় বলে-
– ছেলেটার নাম কি?
লিমা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে-
– মেঘ।
– কত বছরের সম্পর্ক তোদের?
লিমা এবার পুরোপুরি কান্না থামিয়ে বলে-
– কয়েক মাস মা,বছর না।
রেহানা বেগম ফিরোজ কবির এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-
– দেখছো? তোমার মেয়ের কীর্তি?? দেখছো? কোথাকার কোন ছেলের জন্য সে কিভাবে উতলা হয়ে উঠেছে! আমি তো ভাবলাম না জানি কত বছরের সম্পর্ক তাদের!! এখন শুনি মাত্র কয়েকমাস? কয়েকমাসেই এত প্রেম তোর হলো কি করে??
লিমা নিচু গলায় বলে-
– মা কাউকে ভালোবাসতে দিন মাস বছর লাগে না। কয়েক মুহুর্তেও কাউকে গভীর ভাবে ভালোবাসা যায়।
ফিরোজ কবির এপর্যায়ে উঠে দাড়ান। তড়িৎ বেগে লিমার কাছে এসে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেন।
লিমা ঝোক সামলাতে না পেরে রেহানা বেগম এর গায়ের উপর পড়ে।
ফিরোজ কবির বাজখাঁই গলায় বলে-
– এই থাপ্পড়ের কথাটা মনে রাখিস।
এরপর নিজের ঘরে চলে যান। লিমা অসহায় দৃষ্টিতে রেহানা বেগম এর দিকে তাকালেও সেও চোখ ফিরিয়ে নেন। স্বামীর পিছে পিছে নিজের রুমে চলে যায়।
একা লিমা বসে থাকে ডাইনিং রুমে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
এর থেকে বোধহয় মরে যাওয়াই শ্রেয়!
.
.
মদের বোতলে শেষ চুমুক টা দিয়ে মেঘ বলে-
আমি বিরহের কবিতাই পছন্দ করি
পানসে প্রেনের কবিতা আমার পছন্দ না
আমি ভালোবাসছি,তুমি বাসোনি
আমি কাছে আসছি,তুমি আসোনি
তা দিয়ে ভয়াবহ প্রেমের কবিতা লেখা হয়না
আর পানসে প্রেমের কবিতা আমার এক্কেবারে পছন্দ নয়।
তার চেয়ে একপেশে বিরহই ভালো
“আমি তারে ভালোবাসলাম,সে আমাকে বাসলো না”
অন্তত এই রকম একটা গড়ান অনুভূতিও একফোটা বিরহবোধকে ভয়াবহ উশৃংখল করে দিতে পারে।
এই রকম একটা সস্তা অনুভূতির খাতিরেও একটা নিতান্ত ভদ্র ছেলে দাড়ি-গোঁফ-বাবরী রেখে রাস্তায় রাস্তায় বছরের পর বছর ঘুরে বেড়াতে পারে।
টানা সাত রাত সাত দিন না ঘুমিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতে পারে।
তের তলার কার্নিশে রাতের পর রাত পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারে।
অথবা মুহুর্তের সিদ্ধান্তে একটা লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে নিতে পারে-
একটা মাত্র লাফ, হ্যাঁ/না হ্যাঁ/না একটা সিদ্ধান্তের ব্যবধান মাত্র।
অথবা বিরহের চেয়েও সস্তার এক বোতল মদ কিনে এনে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে সব গিলে নিতে পারে।
লক্ষ লক্ষ দিয়াশলাই,লক্ষ লক্ষ সিগারেট
বোতলে বোতলে মদ,ব্রথেলে ব্রথেলে নারী
যাক,হ্রদপিন্ড,ফুসফুস,যকৃত সব ছারখার হয়ে যাক
যাক,চরিত্র নামের ঠুনকো বিষয়টিও নষ্ট হয়ে যাক
যাক,ভালোবাসার নথিপত্র গুলো পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক
যাক,অতি সাধারণ ছেলেটাও একদম নষ্ট হয়ে যাক
একটু একটু করে,ধীরে ধীরে অথবা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাক।
“না!না!না! সে আমাকে ভালোবাসে নি”
শুধু এই একটা বোধই কি যথেষ্ট নয়!
বিমিময়ে এক নিঃশ্বাসে পুরো পৃথিবী টাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া যায়।
তছনছ করে দেওয়া যায়,এলিয়ে টলিয়ে টালমাটাল করে দেওয়া যায়।
জগতের সব সুর ছন্দ তাল এক থাবায় ছিনিয়ে নেওয়া যায়।
মুঠো খুলে ফুঁ দিয়ে তা আবার উড়িয়ে দেওয়া যায়।
আগেই বলেছি,আমার বিরহের কবিতাই ভালো লাগে।
তাই যখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে
সমস্ত পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজে যখন কোথাও একফোঁটা ভালোবাসা পাবে না
যখন দেখবে আমি ছাড়া তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই
তোমার জন্য ফোটা একমাত্র নীল পদ্ম নিয়ে আমিই দাড়িয়ে আছি
তখন তুমক আমার কাছে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসবে
বলবে আমায় ফিরিয়ে নাও,আমায় গ্রহণ করো
আমি নিশ্চিত সেদিন তোমায় ফিরিয়ে দিবো
আমি বিরহের মানুষ বিরহেই থাকতে চাই
আমার জন্য তো নীল পদ্ম ফুটে না
কারন আমার জন্য ভালোবাসা না
ভালোবাসা না
চলবে……
পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ২২
লেখা – Mahfuza_Monira
সকাল ১০ টা বেজে গেলেও লিমা তার ঘর থেকে বের হয়না। তা দেখে রেহানা বেগম খাবার নিয়ে যান লিমার ঘরে। শত হোক,মায়ের মন তো!
লিমা তখন একপাশে হেলান দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে ছিল। তার মাকে আসতে দেখে নড়েচড়ে উঠে সে। বালিশ টা পিঠের পিছনে দিয়ে হেলান দিয়ে বসে লিমা। রেহানা বেগম লিমার সামনে এসে বসে। মুখ ভার তার। বুঝাই যাচ্ছে,এখনো রাগ মেয়ের উপর।
রাগী রাগী ভঙ্গিতেই বলে-
– খেয়ে নে।
লিমা অশান্ত গলায় বলে-
– মা ক্ষিদে নেই। খাবো না।
রেহানা বেগম এর গলা আরো কঠিন হয়ে উঠে। কঠিন গলায় বলে-
– যদি ভেবে থাকিস এভাবে না খেয়ে থাকলে আমরা তোর পাগলামি মেনে নিবো,তাহলে কিন্তু ভুল ভাবছিস। এমন মেয়ে আমাদের না থাকলেও কিছু হবে না। ছোটকালে সবাই এরকম একটু আধটু পাগলামি করে বেড়ায়।
লিমা মুচকি হাসে রেহানা বেগম এর কথা শুনে। রেহানা বেগম অবাক হয়ে বলে-
– হাসছিস কেন?হাসির কথা বলছি আমি?
লিমা সম্মতি জানিয়ে বলে-
– হুম হাসির কথাই মা। আমি এই ভয়েই তোমাদের কখনো জানাই নি আমার ভালোবাসার কথা। ভাবছি,তোমরা কখনো আমার ভেতর টা দেখবে না। কিশোরকালের পাগলামি বাচ্চামি আর আবেগ ভেবে উড়িয়ে দিবা। দেখলা! এখন সেটাই বললা তুমি।
রেহানা বেগম চুপ করে থাকেন। রাগে মাথার রগ দপদপ করছে তার। কোনোমতে ভাতের এক লোকমা লিমার মুখের সামনে তুলে ধরে বলেন-
– অনেক কথা শিখেছিস। চুপচাপ খেয়ে নে। আরো কাজ আছে আমার।
লিমা মুখ টা সরিয়ে নেয়। চিবুক ভিজে যাচ্ছে তার। টানা টানা গলায় বলে-
– খাবো না মা। আমি খাবো না।
রেহানা বেগম ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন। চট করে চড় মেরে বসেন লিমার গালে। লিমা খাটের পায়ার সাথে বাড়ি খায়। কপালের বাম পাশে খানিক মাংস থেতলে যায় তার।
রেহানা বেগম সেদিকে দেখেও দেখেন না। ভাতের প্লেট টা নিয়ে উঠে পড়েন। রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যান রুম থেকে।
লিমা কপালে হাত চেঁপে ধরে বসে থাকে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। এত কষ্ট কেন হচ্ছে! কে জানে!
লিমা উঠে দাঁড়ায়। বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করে বাথরুমের দিকে এগোয়। কপালের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
.
.
রেহানা বেগম বেরিয়ে এলে ফিরোজ কবির গম্ভীর গলায় বলে-
– খেয়েছে?
রেহানা বেগম অসহায়ের মতো এদিক ওদিক মাথা নাড়ান।
ফিরোজ কবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যান। রেহানা বেগম ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান।
.
.
বেলা ১১ টা।
উদয় এসেছে মিশিদের বাসায়। একটাবার মেঘ কে দেখতে যাওয়া উচিত তাদের। তাই সে মিশিকে নিতে এসেছে। কিন্তু এসে দেখে মিশি এখনো ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুম..
উদয় কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে মিশির দিকে। আচ্ছা,কাউকে ঘুমালেও বুঝি এত সুন্দর দেখায়!
হঠাৎ হাসিব চাচা রুমে প্রবেশ করেন।
উদয় নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলে। হাসিব চাচা উদয় কে উদ্দেশ্য করে বলেন-
– উঠছে না মামণি? আমি উঠাবো?
উদয় মাথা নাড়িয়ে বলে-
– না চাচা,থাক। ঘুমাক আরো কিছুক্ষণ। আমি পরে উঠিয়ে দিবোনি।
হাসিব চাচা উদয়ের হাতে দুধের গ্লাস ভর্তি একটা মগ ধরিয়ে দিয়ে বলে-
– মামণি উঠলে এটা খেতে দিও। মামণির আবার প্রতি সকালে দুধ না হলে চলে না।
হাসিব চাচা বেরিয়ে যান।
উদয় গ্লাস টা দ্রুত টেবিলের উপর রাখে। আরেকটু হলেই বমি বেরিয়ে যেতো তার।
কোনো এক অদ্ভুত কারনে সে দুধ জিনিস টাকে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই বমি পায়। খাওয়া তো দূরেই থাক!
উদয় মিশির সিথানের কাছে বসে। মিশির নাকের উপর একটা মশা পড়েছে। উদয় আস্তে করে হাত দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দেয়। তারপর মিশির এলো চুলের ফাকে নিজের আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় ডাকে মিশি কে।
– মিশুপাখি….জানুপাখি…ময়না।
খুব নরম সে স্বর,খুব ঠান্ডা সে গলা। মিশি ঈষৎ নড়ে উঠে। কপালের উপর কয়েকটা ভাঁজ পড়ে তার। ঠোঁট থেমে থেমে কেঁপে উঠে। মিটমিট করে চোখ খুলে উদয়ের দিকে তাকায় সে।
খাপছাড়া গলায় বলে-
– উফ! স্বপ্নেও এসেছো আমাকে জ্বালাতে তুমি? তুমি একটা খুব খারাপ উদু।
এরপর টেনে টেনে বলে-
– খু-ব খা-রা-প।
উদয় হেসে ফেলে।
উদয় এর হাসির শব্দে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে যায় মিশির। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সে। চোখ বড়বড় করে বলে-
– তুমি সতিই! তার মানে স্বপ্ন না?
উদয় হাসতে হাসতেই মাথা নাড়ায় এদিক ওদিক।
মিশি সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলে-
– ক’টা বাজে?
উদয় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে-
– ১১ঃ২৪ কেন?
মিশি বসে থেকেই আড়মোড়া ভাঙে। বলে-
– এত দেড়ি হলো আজ উঠতে! উফফো!
– সারারাত নিশ্চয়ই চুরি করতে গিয়েছিলা। নাহলে এত সকাল অব্দি ঘুমায় কেউ?
মিশি মুখ বাকিয়ে বলে-
– সব থেকে বড় জিনিস টাই চুরি করে এনেছি। আর কিছু নাই চুরি করার মতো…
উদয় ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
– কি জিনিস?
মিশি উদয়ের দিকে ঝুকে বলে-
– আপনার মন জনাব।
উদয় মৃদু হাসে মিশির কথা শুনে।
মিশিও হাসে উদয়ের দিকে তাকিয়ে।
উদয় বলে-
– তাড়াতাড়ি উঠো। ফ্রেশ হয়ে দুধ খেয়ে নাও। আমরা বের হবো।
মিশি অবাক হয়ে বলে-
– কোথায় যাবো?
– মেঘ ভাইয়ার বাড়ি। তার পায়ের কি অবস্থা! একবার দেখে আসা উচিত।
মেঘের কথা শুনতেই লিমার কথা মনে পড়ে যায় মিশির।
মিশির উদগ্রীব কন্ঠে বলে-
– তার আগে লিমাকে দেখে আসা উচিত।
উদয় ভ্রু কুঁচকে বলে-
– কেন? ওর আবার কি হলো!
মিশি গতকালের ঘটা লিমার সাথে সময়গুলোর কথা উদয় কে বলে।
লিমার প্রতিটা গম্ভীর কথা,ফোলা ফোলা চোখের কথা,লিমার কান্নাকাটি….সমস্ত কিছু একজন ভালো শ্রোতার মতো হয়ে শুনে উদয়।
সব শুনে মাথা দুলিয়ে বলে-
– আগে লিমাকেই দেখে আসা উচিত। না জানি ওর ভিতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে!
.
.
.
মিশি আর উদয় কে দেখে রেহানা বেগম এর রাগ তড়তড় করে মাথায় উঠে যায়।
তিনি বাজখাঁই গলায় মিশিকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– তোমরা জানতে যে লিমার সাথে মেঘ নামের একটা ছেলের সম্পর্ক আছে তাইনা??
মিশি আর উদয় দুজনেই দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। দুজনেই ভীষণ অবাক। রেহানা বেগম কী তাহলে সব জানতে পেরে গেছে!
মিশি আমতাআমতা করে বলে-
– না আন্টি আমরা জানতাম না তো। মেঘ কে?
রেহানা বেগম গজগজ করেন।
– তোমরা ওর ফ্রেন্ড আর তোমরা জানতে না? মশকরা করো আমার সাথে??
উদয় বিনীত গলায় বলে-
– আন্টি সত্যি আমরা জানি না এই ব্যাপারে কিছু।
রেহানা বেগম ভ্রু কুঁচকান। কিছুটা শান্ত হন তিনি।
আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে যান।
মিশি আর উদয় দ্রুত পায়ে লিমার রুমে যায়।
লিমার জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মিশি আর উদয় কে দেখে ব্যস্ত গলায় বলে-
– মেঘের কোনো খবর এনেছিস?
মিশি উদয় একজন আরেকজনের দিকে তাকায়।
মিশি নিচু গলায় বলে-
– নাহ।
লিমার মুখ টা মুহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে শুধু ধরা গলায় বলে-
– ওহ!
মিশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিমার দিকে তাকিয়ে বলে-
– তুই সবাইকে সব বলে দিয়েছিস?
লিমা নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়।
মিশি অবাক হয়। প্রচন্ড অবাক হয়। এত সাহস এলো কোথা থেকে মেয়েটার মধ্যে!
উদয় বলে-
– তোর কপালে কি হয়েছে?
লিমা আকাশ পানে মুখ করে বলে-
– মা থাপ্পর মেরেছিল। খাটের পায়ায় লেগে কেটে গেছে।
মিশি উদয় চুপ হয়ে যায়।
তারা ভেবেছিল লিমা স্বার্থপর হয়ে গেছে। কিন্তু,এখন,সত্যিই লিমার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাদের।
আচ্ছা,কোনোভাবেই কি লিমা মেঘ কে একত্র করা যাবেনা? উদয় একবার ভাবে লিমার বাবার পায়ে ধরবে দরকার পড়লে। তবুও এই দুটো ফুল কে আলাদা না করুক সে!
চলবে….