পানপাতার ঘর? পর্ব ১৭+১৮

0
594

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১৭+১৮
লেখা – Mahfuza_Monira

১০ দিন কেটে যায়।
মিশি এই দশদিনের একটা সেকেন্ডও নষ্ট করেনি। গভীর মনোযোগ আর একনিষ্ঠতা দিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে অংক।
আর উদয় তো ছিলই। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা,উদয় নিয়ম করে মিশি কে পড়িয়েছে। যেগুলো যেগুলো থেকে আসার গভীর সম্ভাবনা সেখান থেকেই পড়িয়েছে। কোচিং এ গেলে সময় নষ্ট হবে ভেবে কোচিং এও যায়নি তারা।
মিশির বিশ্বাস সে পারবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
.
আজ বাদে কাল পরীক্ষা।
প্রথমেই ম্যাথ পরীক্ষা রুটিনে। যাতে করে শিক্ষার্থী রা ভালো ভাবে প্রিপারেশন নিয়ে আসতে পারে।
মিশিও ভালো প্রিপারেশন নিয়েছে। তবুও ভয় হচ্ছে তার। উদয় দুপুরে বাসায় গিয়েছিল,সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনো আসার নাম নেই।
মিশি তার অপেক্ষায় উশখুশ করছে।
শেষে সে হাসিব চাচাকে বলেই ফেলে-

– হাসিব চাচা,উদয় কে ডেকে নিয়া আসেন।

হাসিব চাচা বকর মোল্লার কোনো দরকারি ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন। সে মিশির দিকে তাকিয়ে স্মিত কণ্ঠে বলেন-
– মা,এখন তো যাওয়া সম্ভব না। খুব দরকারি কাজ করছি। তুমি একটু অপেক্ষা করে নাও। ও চলে আসবে হয়তো।

মিশি আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু অপেক্ষা করতেও মন চাইছে না তার। ছেলেটা কোথায়! এত দেড়ি তো করে না।

মিশির মাথায় নানান খারাপ চিন্তারা ভীড় জমায়। মিশি শেষমেশ বই খাতা ব্যাগে এটে বকর মোল্লার কাছে গিয়ে করুণ গলায় বলে-
– বাবা,আমি কি উদয় দের বাসায় যেতে পারি? পড়াশোনার জন্য? ও এখনো আসছে না। আর সবসময় তো আমাদের বাসায় বসেই পড়ি! আজকে না হয় ওদের বাসায় গিয়ে…গাড়িতে করে যাবো,গাড়িতে করেই চলে আসবো। যাই?

বকর মোল্লা হাতের পত্রিকা নামিয়ে শান্ত গলায় বলেন-
– তোমার পরীক্ষা কালকে থেকে না?

– হুম বাবা।

– প্রথমেই কোন সাবজেক্ট?

মিশু নিচু গলায় বলে-
– গণিত।

বকর মোল্লা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন-
– কি মনে হয়? এবার কি কিছু একটা হবে? নাকি তোমার মা যা চান,তাই হবে?

মিশি নিজেও জানে না সে কেমন ফলাফল করতে পারে বা কেমনই পরীক্ষা দেবে। সে চিন্তিত গলায় বলে-
– আমি আমার পুরো চেষ্টা করছি বাবা। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

বকর মোল্লা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
মিশির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে বলেন-
– আচ্ছা যাও,ভালো ভাবে পড়ো। রাত ১০ টার ভিতর চলে আইসো। গাড়ি নিয়ে যেও। আমি আব্দুল (ড্রাইভার) কে বলবো,সে যেন তোমাকে নিয়েই ফিরে আসে একদম। সে ওখানেই থাকবে না হয়।

মিশি ঘাড় অব্দি মাথা কাত করে বলে-
– আচ্ছা বাবা। থ্যাংকস।

.
মিশিদের বাসা থেকে উদয় দের বাসায় যেতে মিনিট ১৫ লাগে মাত্র। সেখানে গাড়িতে করে গেলে ব্যাপার টা ৫-৭ মিনিট হয়ে যায়। বা তারও কম।
তবুও এই ৫-৭ মিনিট আজ মিশির কাছে বড্ড লম্বা মনে হচ্ছে। উদয় তো দুপুরেও তার সাথে ছিল। মাত্র কয়েক ঘন্টাই না হয় দেখা হয়নি দুজুনের,তাতেই মিশির এত ছটফটানি!
নিজের মনেই হাসে মিশি। নিজেই নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বিরবির করে বলে-
– মিশি পাগলি,এত বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিস ছেলেটার উপরে? এত বেশিও দুর্বল হস না। পরে যদি ও তোকে ফাকি দিয়ে চলে যায়,থাকবি কি করে?

পরমুহূর্তেই মিশিই নিজের জিহবায় কামড় দেয়। বলে-
– ধ্যাত! কিসব আবোল তাবোল ভাবছি। উদয় কেন আমাকে ছেড়ে যাবে! আজব!!

মিশির উল্টো পাল্টা ভাবনা শেষ হতে না হতেই গাড়ি এসে উদয়ের বাড়ির সামনে থামে।
মিশি দ্রুত নামে। আব্দুল বলে-
– মামণি,আমি কি গাড়ির ভেতরেই থাকবো?
মিশি ব্যাগ কাধে চড়াতে চড়াতে বলে-
– ভেতরে আসুন। ২-৩ ঘন্টার মতো থাকবো এখানে। আপনি এতক্ষন একা একা গাড়িতে থাকবেন কি করে! মইনুল আংকেলের সঙ্গে গল্প গুজব করবেন তার চেয়ে। আসুন,চলুন আমার সাথে।

মিশির পিছু পিছু আব্দুল ও ভেতরে প্রবেশ করে।
.
.
উদয় দের বাসা টা বেশ বড়। প্রায় ৬ টি রুম,আবার ডায়নিং,ড্রয়িং।
কিন্তু এত বড় বাসায়,থাকে মাত্র দুজন। উদয় এবং তার বাবা মইনুল সাহেব।
একজন বুয়া আছে অবশ্য। তবে সে শুধু সকালে আসে,সব কাজ টাজ করে বিকেল নাগাদ চলে যায়।
.
মিশি সদর দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে যায়। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে উঁচু গলায় ডাকতে শুরু করে।

– মইনুল আংকেল…উদয়…কই সবাই?

মইনুল সাহেব,কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের নামাজ টা পড়ে চুলোয় চা বসিয়েছে। তার আবার চায়ের উপর এক্সপেরিমেন্ট করার বাতিক আছে। একেক দিন একেক ভাবে চা বানায় সে। এরপর নিজেই টেস্ট করে দেখে কোনটা বেশি ভালো লাগে,কোনটা না।

মইনুল সাহেব রান্নাঘর থেকে গামছায় হাত মুছতে মুছতে বের হন। এই অসময়ে মিশি কে দেখে তিনি অবাক হন।
অপ্রস্তুত হয়ে বলে –
– আরেহ! মিশি যে। এই সময়ে? আমার ছেলে আবার কিছু করেছে?

মিশি একবার আব্দুল এর দিকে তাকায়। তারপর মইনুলের দিকে তাকিয়ে বলে-
– হ্যাঁ করেছে। বিরাট কান্ড করেছে। কই তোমার সাত রাজার ধন টা? আমাকে তার অংক করানোর কথা। কাল পরীক্ষা। অথচ,এখনো বাসায় যায়নি ও। তাই আমিই চলে আসলাম। কি ভালো করেছি না?

মইনুল সাহেব একগাল হেসে বলে-

– খুব ভালো করেছিস রে। এবার তুই আর আমি মিলে উদয় কে এমন জব্দ করবো না…! আচ্ছা আজকে নতুন কিছু করবো ওর সাথে বুঝলি? নো বাধা ফাদা,নো সিগারেট এর ফোসকা দেওয়া। আজকে ওর দুই পা উপরে করে ঝোলাবো। একদম বাদুরের মতো। তারপর ওকে ঐ অবস্থায় চা খেতে বলবো। যদি এক ফোটা চা নিচে পড়ে,তাহলে মাইর। কোনো কথা হবে না। শুধু মাইর। আফটার অল,ও আমার মিশি মামণি কে অপেক্ষা করিয়েছে। সাহস কত ওর!!

মিশি হেসে ফেলে মইনুলের কথা শুনে।
হাসি নিয়েই বলে-
– সে কই?

মইনুল সাহেব হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝান যে সে তার রুমে।
মিশি কাধ থেকে ব্যাগ খুলে সোফার উপর রাখে। তারপর মইনুল সাহেব কে চোখ টিপ মেরে সেদিকে আগায়।
মইনুল সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিশির দুষ্টমি ভরা মুখ টা দেখতে থাকে।

মিশি উদয়ের রুমের ভেতর চলে যেতেই মইনুল সাহেব এর খেয়াল হয় যে এখানে আরো একজন আছে। সে আব্দুলের দিকে তাকিয়ে বলে-

– আপনাকে চিনলাম না ভাই।

আব্দুল আমতাআমতা করে বলে-
– আমি আব্দুল। মিশি মামণিদের নতুন ড্রাইভার।
– ও আচ্ছা! বসুন বসুন। আমি চা বানাচ্ছি। আমি নিয়ে আসছি, বসুন আপনি।

মইনুল সাহেব রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবে,যাক একজন কে পাওয়া গেলো অবশেষে তার চা টেস্ট করার জন্য…
.
.
.
মিশি উদয়ের রুমে ঢুকতেই দেখে উদয় ঘুমে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা।
উদয়ের ঘুমোন্ত ফেস টা দেখে মিশির হৃদয় কোনো এক অজানা শান্তিতে ভরে যায়। মিশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

সে ধীর পায়ে উদয়ের মাথার কাছে বসে। কি সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা।
আচ্ছা ছেলেরা তো উল্টো পাল্টা হয়ে ঘুমায়। কিন্তু উদয় কত পরিপাটি! তার ঘুমের সময়টাও সে কত সুন্দর করে ঘুমায়!
মিশির ইচ্ছে করে উদয়ের কপালে তার ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিতে।
মিশি দরজার দিকে তাকায় একবার। এখন এদিকে কেউ আসবে বলে মনে হয়না।
মিশি এই মুহুর্ত টা হাতছাড়া করতে চায়না। সে নিচু হয়ে চট করে একটা চুমু খেয়ে নেয়।
এরপর উদয়ের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে উদয় কে ডাকতে থাকে।
.
উদয় এর কান ভীষণ পাতলা।।একটা ডাক দিতেই উদয় চোখ খুলে ফেলে। মিশি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।

উদয় মিশিকে দেখে চমকে যায়।
লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। মিশি হাসে।
উদয় নিজের হাতে নিজেই চিমটি কেটে দেখে এটা স্বপ্ন নাকি মিথ্যা…

মিশি বলে-
– আমি স্বপ্ন না জনাব! আমি সত্যিই এসেছি।

উদয় নির্লিপ্ত গলায় বলে-
– ওওওও…

মিশি ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
– কেন? আমি আসায় খুশি হওনি?

উদয় এক মিনিট চুপ করে থাকে। এরপর হুট করে মিশিকে জড়িয়ে ধরে বলে-
– আমি জানিনা সংসার মানে কী!
কিন্তু জানি রোজ সকাল,বিকাল ঘুম থেকে উঠে তোমায় পাওয়া। একদম বউ বউ লাগছে তোমাকে গো…

উদয়ের কণ্ঠে কি যেন এক মাদকতা। মিশি লজ্জা পায়। উদয়ের বুকে মিশে যেতে যেতে বলে-
– তুমি চুপ হও প্লিজ। আমি কি যেন এক নেশায় ডুবে যাচ্ছি!
.
.
.
পরেরদিন..
সকাল ১০ টায় পরীক্ষা।
এখন ৯ টা বাজে। হাতে একটা টিফিন বক্স নিয়ে মিশি উদয়ের বাড়ি যায়। উদয় তখন গুরুত্বপূর্ণ অংক গুলোয় আরেক নজর চোখ বুলাতে ব্যস্ত।
মিশি এসে তার পাশে বসে। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে বলে-
– উদু…কিছু এনেছিলাম তোমার জন্য!

উদয় খাতার ভেতরেই চোখ রেখে বলে-
– কী?

মিশি টিফিন বক্স থেকে ডিম সিদ্ধ বের করে উদয়ের মুখের সামনে ধরে বলে-
– এই নাও,খাও এটা।

উদয় ডিম দেখে লাফিয়ে উঠে পড়ে।

– এটা কি আনছো?

মিশি অবাক হয়ে বলে-
– কেন ডিম আনছি! ডিম এটা।

– উঁহু আমি খাবো না।

মিশি আরো অবাক হয়ে বলে-
– কেন?
– ডিম খেলে পরীক্ষায় ডিম পায়। জানোনা?

মিশি হেসে ফেলে। উদয়ের কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে বলে-
– ওরে আমার বোকারাম রে! বাল হয় ডিম খেলে। শুনছো? যতসব কুসংস্কার!! খাও এটা…

উদয় দূরে সরে যায়।
– প্লিজ না! খাবো না মিশি। অন্য কিছু নিয়ে আসো!

মিশিও জেদ দেখায়।
– না এটাই খেতে হবে। হা করো। হা করো বলছি।

উদয় নাছোরবান্দা। সে খাবে না মানে খাবেই না।
মিশিও নাছোড়বান্দি। সে খাইয়েই ছাড়বে।
মিশি উঠে এসে উদয়ের মুখ চেপে ধরে। উদয় বাধ্য হয় হা করতে। তারপর মুখের ভিতর ডিম ঢুকিয়ে দেয়। উদয় না চাইতেও গিলে নেয় কিছুটা।

মিশি বলে-
– ভালো করে বললাম,গায়ে লাগলো না! এখন হলো তো?

তারপর উদয়ের হাতে ডিমের বাকি অংশ ধরিয়ে দিয়ে বলে-
– এবার বাকিটাও খাও। আমার অংক রিভাইস করা হয়নি এখনো।

উদয় বিরবির করে বলে-
– দস্যি মেয়ে।

মিশি চোখ পাকিয়ে বলে-
– কিছু বললা?

উদয় ডিমে কামড় দিয়ে বলে-
– না না,এই দেখো। আমি ডিম খাচ্ছি।

মিশি ফিক করে হেসে দিয়ে বলে-
– গুড বয়!
.
.
.

মেঘের মা বেশ তোড়জোড় লাগিয়েছেন, মেঘের বিয়ের জন্য। তিনি ৪-৫ দিনের ভেতরেই বিয়ে করাতে চান মেঘের।
সকাল সকাল সোহেলা বেগম এর ডাকে ঘুম ভাঙে মেঘের।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে।
বিরক্তির গলায় বলে-
– কি হয়েছে? ডেকে ডেকে মাথা খাচ্ছো কেন?
সোহেলা বেগম শান্ত গলায় বলেন-
– তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার ছিল। তাই ডেকে তুলেছি।
মেঘের ভীষণ বিরক্তিকর লাগে,এই বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে। তবুও সে স্বাভাবিক গলায় বলে-
– বলো,কি বলবা বলো।
সোহেলা বেগম আনন্দে ডগমগ হয়ে বলেন-
– ৪-৫ দিনের ভেতরেই বিয়ে টা সেরে ফেললে কেমন হয়? বেয়াই সাব জানতে চাইলেন। তুই রাজী তো?

মেঘ চটে যায়। বলে-
– ৪-৫ দিনের ভেতরে মানে! অসম্ভব। পেছাও। এত দ্রুত বিয়ে করবো না আমি। আর মিশি উদয়ের পরীক্ষা না শেষ হওয়া পর্যন্ত তো করবোই না।

সোহেলা বেগম ভ্রু কুঁচকান।
– কতদিন পেছাবো?

মেঘ একটু চিন্তা করে বলে-
– কম হলেও ১৭ দিন। ওদের পরীক্ষা শেষ হতে ১৬ দিন লাগবে। আজকেই বোধহয় শুরু হলো।

সোহেলা বেগম এর চোখ কপালে উঠে যায় যেন।
– এতদিন!! এটা কি ভাবে হয় মেঘ?বেয়াই সাহেব কে কিভাবে কি বলে…
মেঘ তার মায়ের কথায় বাধা দিয়ে বলে-
– সেটা আমি জানিনা। আমি তোমার কথা মতো,তোমারি পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি। এটাই বেশি না? এবার বিয়ে হবে তো আমার পছন্দের তারিখে। এর আগে হলে আমি করবো না।

সোহেলা বেগম আর কথা বাড়ান না। পরে যদি মেঘ বিয়েটা একদম নাকোচ করে দেয় তখন! তাই না চাইতেও তিনি রাজী হয়ে যান ১৭ দিন পরেই মেঘের বিয়ে করানোর জন্য….

চলবে….

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১৮
লেখা – Mahfuza_Monira

এক্সাম শেষ হতেই মিশি আর উদয় দেখে মেঘ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। মিশি আর উদয় কে বের হতে দেখে মেঘ ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উদয় খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে-
– আরেহ মেঘ ভাইয়া! তুমি এখানে?
মেঘ স্মিত হেসে বলে-
– কেমন আছিস তোরা?
– ভালো আছি ভাইয়া। তুমি?
মেঘ শুকনো হাসি হেসে বলে-
– খুব ভালো আছি রে!

মিশি চুপ করে থাকে। তা দেখে মেঘ মিশিকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– তুই কি আমার উপর রাগ করে আছিস মিশি?

মিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-
– রাগ করে থাকলে কি সব সমাধান হয়ে যেতো ভাইয়া? মাঝে মাঝে নিয়তি আর পরিস্থিতি একজোট হয়ে আমাদের এমন সব সিচুয়েশনে ফেলে দেয়,যা মেনে নেওয়া মুশকিল। তবুও মেনে নিতে হয়। আমি তোমায় বুঝতে পারি মেঘ ভাইয়া। রাগ নেই তোমার উপর।

মেঘ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে-
– তাহলে বিয়েটায় আসবি?

উদয় মিশির দিকে তাকায়। মিশি উদয়ের দিকে। দুজনের চোখেই একই প্রশ্ন,যাবে কিনা তারা।
মিশি জবাব দেয়-
– ভাইয়া,লিমা আমার বান্ধবী। তার ভালোবাসার বিয়ে অন্য কারো সাথে। আর তার বিয়েতে কীনা আমি..!

মেঘ বাধা দেয়। বলে-
– আয় না রে তোরা। তোদের দেখে যদি দুঃখ ভুলে থাকতে পারি!
.
মিশি চুপ করে ভাবতে থাকে কি জবাব দেওয়া যায়। যাবে কী না.!

তখনি সেখানে এসে লিমা দাঁড়ায়।
লিমা মূলত মিশির কাছে এসেছিল,তার পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে। কিন্তু এসে যে মেঘ কেও দেখতে পারবে,তা ভাবতে পারেনি।
মেঘ লিমা কে হুট করে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লিমা একবার মেঘের দিকে তাকায়। তারপর চলে যেতে নেয়।

মেঘ লিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– পরীক্ষা কেমন হলো তোমার?

লিমা থমকে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে-
– ভালো।

– তুমি কেমন আছো?

– ভালো।

– শুকিয়ে যাচ্ছো কেন? খাওয়া দাওয়া করো না কেন ঠিকমতো?

লিমার গলা ধরে আসে।
কোনোমতে বলে-
– পরীক্ষার টেনশনে খাওয়া হয়না। আসি।

লিমা আর একটুও দাঁড়ায় না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়।
মেঘ তার যাওয়ার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
.
.
উদয় মেঘের চোখের দিকে তাকায়।
সে চোখে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা, বুক ফাটানো আর্তনাদ…
উদয় করুণ গলায় বলে-
– ভাইয়া,তুমি তো ভালো চাকরি করো। লিমা কে নিয়ে পালিয়ে যাও না কেন?

মেঘ উত্তর দেওয়ার আগেই মিশি বলে-
– কারন সে চায় না লিমা কে কেউ খারাপ বলুক। কেউ লিমাকে আজে বাজে ভাষায় কিছু বলুক। অথচ সে লিমা কে আজীবনের জন্য কষ্ট দিয়ে দিতে চায়।

মেঘ চুপ করে থাকে।
মিশি আবারো বলে-
– একটা বারও ভাবলে না ভাইয়া,তুমি তো অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে। কিন্তু,লিমা? ও কি পারবে ওর জীবনে অন্য কোনো পুরুষ কে এক্সেপ্ট করতে? ওর জীবন তো বোধহয় থমকে গেলো একদমই। শুধু তোমার কারনে! পালিয়ে গেলে কয়দিন লোকে কি বলতো? সমাজের ভয়ে যাচ্ছো না,কিন্তু এই সমাজই তোমাদের আলাদা করে দিচ্ছে। দিচ্ছে না? সেই সমাজ নিয়েই এত কেন পরোয়া তোমার?? লোকে একদিন সব কিছুই ভুলে যাবে, শুধু আজীবনের মতো কষ্ট পেয়ে যাবে তোমরা ভাইয়া।

উদয় বলে-
– হুম ভাইয়া। মিশি ঠিক বলছে। আমার মনে হয় তোমরা পালিয়েই যাও।

মেঘ নিচু কণ্ঠে বলে-
– তাহলে আম্মু..?

মিশি বাজখাঁই গলায় বলে-
– যে মা,তার সন্তানের কষ্ট বুঝে না,তাকে নিয়ে এর কিসের চিন্তা তোমার? সে তো তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে না,একপ্রকার নিলামে চড়াচ্ছে। বিয়ে মানে দুটো আত্মার মিল,মনের মিল,পরিবারের মিল। তোমার ক্ষেত্রে দুটো পরিবারেরই মিল হচ্ছে,মন বা আত্মা কারোরই কোনো মিল হচ্ছে না। তাহলে এইরকম বিয়ে টা কেন হবে ভাইয়া? তুমি পালিয়েই যাওনা..!

মেঘ যেন বুঝতে পারে কিছু। সে খুশি হয়ে বলে-
– তোমরা বলছো? তাহলে যাবো। কিন্তু একটা শর্ত। যদি লিমাও যেতে চায় তবে,অন্যথায় ওকে জোর করে নিয়ে যাবো না আমি।

মিশি হাতে তুরি বাজিয়ে বলে-
– সেটা আমি দেখছি কিভাবে ওকে রাজী করানো যায়। তুমি শুধু পালিয়ে যাওয়ার সকল বন্দোবস্ত করে রাখো ভাইয়া।

মেঘ চোখ টিপ মেরে বলে-
– আচ্ছা, আর এদিকে আমার যে বিয়ে সেখানে আসবে তো তোমরা?

মিশি আর উদয় হেসে বলে-
– আসবো না মানি! অবশ্যই আসবো।
.
.

১৭ দিন কেটে যায়।
মিশি পরীক্ষা গুলো ভালোই দিয়েছে।
খুব ভালো না,তবে আগের থেকে ভালো।
.
আজকে শেষ পরীক্ষা।
লিমাকে স্কুলে ঢুকতে দেখেই মিশি তার পথ আটকে দাঁড়ায়।
লিমা বলে-
– দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। ছাড়, পরীক্ষা দিবি না?
– দিবো। তার আগে কথা আছে।
– কি এমন কথা? যে এখনি বলতে হবে?
– খুব ইম্পর্ট্যান্ট।

লিমা হাত ঘড়িতে তাকায় একবার। পরীক্ষা শুরু হতে এখনো ৫ মিনিট বাকি।
লিমা বলে-
– আচ্ছা বল,কি কথা।

মিশি ইনিয়ে বিনিয়ে বলে-
– মেঘ ভাইয়া বলছিল,তার সাথে পালিয়ে যাবি তুই?

লিমার চোখ বড়বড় হয়ে যায়।

– পালিয়ে যাবো? কই পালিয়ে যাবো?
– ভাইয়া তোকে নিয়ে দূরে কোথাও যাবে। তোরা বিয়ে করবি। কয়েকদিন পর আসবি,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই মেনে নিবে তখন।

লিমা হাসে। হেসে বলে-
– সব কিছুকে সিনেমা ভাবিস না। এসব সিনেমাতেই হয়।

মিশি জোর গলায় বলে-
– বাস্তবেও হয়। একবার চেষ্টাই করে দেখ।

লিমা মিশিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে-
– পরীক্ষা দিতে চল। মাথা খাইস না আমার।

মিশি নাছোরবান্দা। সে লিমাকে ছাড়বে না।

মিশি লিমার কাধ ধরে বলে-
– এভাবে মরে যাবি তিলে তিলে? তার চেয়ে বরং চলে যা। কি এমন হবে লিমা?

লিমা শান্ত গলায় বলে-
– পরিবারের বদনাম হবে সমাজে। যদি আমার জায়গায় থাকতি তাহলে বুঝতি।

মিশি আহত গলায় বলে-
– তাহলে যাবি না?

লিমা শান্ত গলায় বলে-
– নাহ।

মিশি আর কিছু বলে না।
লিমা মিশির পাশ কাটিয়ে চলে যায় পরীক্ষার হলে।
মিশি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। তার মাথায় খারাল চিন্তা রা হানা দিচ্ছে।
তাহলে কি লিমা আর মেঘের মিল হবে না?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here