আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা♥ পর্ব_১৩+১৪

0
840

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১৩+১৪

মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।
.
.
.
.
সপ্তাহখানেক হল আমি হাসপাতালে। এখন একটু সুস্থ আছি। খাওয়া দাওয়াও করতে পারছি। তবুও শরীরে জোর পাই না। ডাক্তার আজকে রিলিজ করে দেবে। আমি বসে আছি বেডে। মিষ্টি খালা এসে বলল, আজকে থেকে তুই আমাদের কাছে থাকবি। আমি মাথা নাড়লাম। উনি আবার বললেন, আজকে তাহলে আমাদের সাথে চল।

– আমি বাসায় যাবো একবার।

মিষ্টি খালা আর খালু একে অপরের দিকে তাকাল। খালু বললেন, আগে আমাদের সাথে চলো পরে একদিন না হয় ওখানে যেও।

– আমি দ্বিতীয় বার ওখানে যেতে চাই না।

– বেশ।

দুপুরের দিকে আমাকে নিয়ে বাসায় এলো। আমি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর উঠে বড় একটা লাগেজ বের করলাম। চেইন খুলে আলমারি থেকে জামা কাপড় ঢোকালাম। চেরির শার্টটা নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। তারপর ওটা একটা জামার ভেতর নিয়ে লাগেজে ঢুকালাম। আম্মুর রুম থেকে বাক্সটা এনে নিয়ে নিলাম। ডায়রী আর কিছু টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলাম। তারপর দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির সামনে দাঁড়ালাম। আমার, আব্বুর আর আম্মুর। কি সুন্দর হাসছে! আমি ছবিটা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বিড়বিড় করে বললাম, কেন এত তাড়াতাড়ি তোমাদের মেয়েকে এত বড় দুনিয়ায় ফেলে চলে গেলে? আমি ছবিটা নিজের সামনে ধরে আব্বু আম্মুকে চুমু দিলাম। তারপর লাগেজে রেখে চেইন মেরে দিলাম। রুম থেকে বের হয়ে বললাম, চলো। মিষ্টি খালা জিজ্ঞেস করল, খাবি না?

– উঁহু, একসাথে ওখানে গিয়ে খাবো।

– আচ্ছা।

খালু আমার থেকে লাগেজটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। মিষ্টি খালাকে বললাম, নিচে যাও। আমি আসছি। খালাও চলে গেল। আমি পুরো বাসাটার দিকে তাকালাম। আমার চোখের সামনে সব স্মৃতি ভেসে উঠল। আমি এদিক থেকে ওদিক ছুটছি আর আম্মু পেছন পেছন ছুটছে। আম্মু মেরেছে বলে কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর কাছে ছুটে গেছি। আব্বু আমাকে আদর করে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। প্রথম আঁকতে শিখেছি বলে পুরো বাসার দেয়াল এঁকে নষ্ট করেছি। আম্মু দেখে অনেক বকেছে। আব্বু একটা ছবি তুলেছিল। সেটা এলবামে আছে। হঠাৎ এলবামের কথা মনে পড়ল। আমি খুঁজে নিলাম এলবামটা। তারপর শেষবার তাকিয়ে তালা মারলাম দরজায়। যেতে গিয়ে চেরিফলের দরজার দিকে চোখ পড়ল। কাছে গিয়ে দরজায় হাত রাখলাম। তারপর দরজায় একটা চুমু দিয়ে বললাম, ভালো থেকো নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে। আঙ্কেল আন্টিকে সাবধানে রেখো। অনেক জ্বালিয়েছি। আমি ছিলাম তোমার জীবনে কয়দিনের অতিথি, তাই চলে যাচ্ছি বহুদূরে। আন্টির থেকে অনেক কিছু শিখেছি। থ্যাংক ইউ আন্টি। না বলে যাওয়ার জন্য সরি। আমি নেমে চলে এলাম মিষ্টি খালা আর খালুর কাছে। রওনা দিয়ে দিলাম তাদের বাড়ি।
.
.
.
.
মুনতাহা আর সানজিদা আপু অপেক্ষা করছিল। আমি যেতেই হাসি মুখে আমাকে ঘরে নিয়ে গেল। মুনতাহা আমার সমবয়সী। খালি সারাদিন পটর পটর করে। আমি যেতেই কথার ফুল ঝুঁড়ি নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুরছে। শুধু ওয়াশরুমটাই ছিল একমাত্র ওর থেকে বাঁচার উপায়। খেতে বসেও যখন বকবক শুরু করল আমি বললাম, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না তো। শান্তি মতো খেতে দে। আমার কথায় সবাই বেশ খুশিই হল। কারণ আজকে অনেকদিন পর নিজ ইচ্ছায় খাচ্ছি। খেয়ে গেলাম মুনতাহার রুমে। এখন থেকে ওখানেই থাকবো। আগে সানজিদা আপু থাকতো। এখন বিয়ে হওয়ায় অন্যরুমে শিফট করেছে। আমাকে আলমারিতে জায়গা করে দিয়ে মুনতাহা বলল, এখানে সব কাপড় চোপড় তুলে রাখ। আমি তোকে হেল্প করছি। আমি আর ও মিলে সব তুলে রাখলাম। বাক্সটা রাখতেই ও বলল, এটা কি?

– আমার জন্মদিনের গিফট।

– আমি দেখবো।

আমি খুলতেই ও বলল, ওয়াও!!!!!! কি সুন্দর শাড়ি!!!! কে দিয়েছে? আমি বললাম, জানি না। মনে মনে বললাম, একটা রাক্ষস ভ্যাম্পায়ার। শাড়ির বদলে আমার ঘাড়ে কামড় দিসে। ও সব দেখে রেখে দিল আলমারিতে।

সন্ধ্যায় সবাই আড্ডা দিতে বসল ছাদে। মিষ্টি খালাদের বাড়িটা একতালা। একটু গ্রাম সাইডে। বাড়িটার চারদিকে চারটা রুম আর মাঝে ডায়নিং। রান্নাঘর আলাদা। আমি থাকবো দক্ষিণ পশ্চিম রুমটাতে। সবাই যে যার মতো বকবক করছে। দুলাভাইও আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মুনতাহা খেয়াল করে বলল, কি রে, তারা গুনছিস নাকি?

– উঁহু, দেখছি আর ভাবছি কোনটাকে আব্বু ভাববো আর কোনটাকে আম্মু। আচ্ছা মুন, কোন দুটো উজ্জ্বল তারা আমাদের রুম থেকে দেখা যাবে?

আমার কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল। মুনতাহা কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ওই বেটি, আমি কি করে বলবো। জানো ছোঁয়া না অনেক ভালো গল্প বলতে পারে। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, কে বলল তোকে?

– কে বলবে? আমি বলছি। এখন একটা গল্প শোনা। অনেকদিন শুনি নাই।

– হ্যাঁরে বল না। দেখ ভালো লাগবে হয় তো।

সবাই জোরাজুরি করতে লাগল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলাম।

– আকাশে তো কত মেঘ। কিছু রঙ তুলির ছেটা রঙের মতো, কিছু বা জমাট। সেই জমাট বাঁধা একটা মেঘেই থাকতো ছোট্ট এক দুষ্টু পরী। সে খুব দুষ্টু ছিল। সারাক্ষণ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতো। তার বাবা মা তাকে সামলাতে হিমসিম খেতে হতো। মাঝে মধ্যে খুব শাসন করতো। কিন্তু তবুও তার দুষ্টমি কমলো না। একদিন ওদের জমাট বাঁধা মেঘে প্রচন্ড বজ্রপাত শুরু হল। পরী দেখে খুব ভয় পেল। কিন্তু ওর বাবা মা ওকে সাহস যুগিয়ে বলল, কিচ্ছু হবে না। তুমি ঘরে থাকো। পরী জিজ্ঞেস করল, তোমরা? তারা বলল, আমরা একটু পরেই চলে আসব। ছোট্ট পরী সারাদিন ঘরে বসে অপেক্ষা করল তার মা বাবার জন্য। এদিকে বজ্রপাত থেমে গেল। ছোট্ট পরী বেরিয়ে এল। কিন্তু তার বাবা মাকে খুঁজে পেল না। ওরা হারিয়ে গেল বজ্রপাতের সাথে।

দুই ফোঁটা পানি চোখ থেকে চিবুকে গিয়ে জমলো। সবাই চুপ। চারদিকের ঝিঁঝিঁ পোকার কোলাহল স্পষ্ট হয়ে জেকে বসছে কানে। মিষ্টি খালা বলল, সবাই নিচে চলো। রাত হয়ে যাচ্ছে। সবাই একে একে নিচে চলে এল। মুনতাহা পাটি গুছিয়ে নিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিল।

রাতের খাওয়া শেষে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু আর মুনতাহা লুডু খেলতে বসল। আমাকেও টেনে নিয়ে গেল। আমি মাত্র মুনতাহার গল্পের বই সংগ্রহে হামলা দিতেছিলাম। কি আর করা। বইসা পড়লাম কালো গুটি নিয়া। মুনতাহা বলল, সাফে সাফে খেলবো। আমি আর ছোঁয়া। মিষ্টি খালা ধরল আমাকে। উনি আমাকে ছাড়া কিছুতেই খেলবে না। আমি বললাম, আমার দলে থাকলে হেরে যাবে তো। তবুও আমাকে ছাড়ল না। খেলা শুরু করলাম। দর্শক খালু আর দুলাভাই। শেষ পর্যন্ত আমার কথাই ফললো। হাইরা গেলাম। মুনতাহা বলল, আরেক বার। এবার আমি আর ছোঁয়া। আবার বসলাম খেলতে। আমাদের দুইজনের তুমুল ছক্কা উঠতে লাগল। ছক্কার চোটে আমদের গুটি লাফিয়ে লাফিয়ে পেকে গেল। পথে যত গুটি পাইলাম সব কেটে সাফ। জিতে গেলাম। বেশ মজাও হল। মিষ্টি খালা দুই বার হেরে গিয়া বলল, আজ আর না। শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে। সত্যিই অনেক বাজে। যে যার ঘরে চলে গেল। আমরাও শুয়ে পড়লাম। আমার মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। মুনতাহা বলল, ছোঁয়া, আব্বু বলেছে তোকে ট্রান্সফার করে আমাদের স্কুলে নিয়ে আসবে। খুব মজা হবে তাই না?

– হুম।

– আমরা একসাথে স্কুলে যাবে। একসাথে পড়ব।

– হুম।

ও খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার চোখে ঘুম নেই। আমি তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে। ভাবছি, ইস্ যদি ছাদটা না থাকতো। আকাশের তারাগুলো দেখতে পেতাম। মনে মনে বললাম, আম্মু তুমি আর চিন্তা করো না। আজ থেকে আমি আর দুষ্টুমি করবো না। তোমাদের এই দুষ্টু পরীটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে। হঠাৎ আম্মুর ফোনে ম্যাসেজের শব্দ। আম্মুর ফোনটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। আব্বুরটা এক্সিডেন্টে ভেঙে গেছে৷ ঐ সিমটাও আম্মুর ফোনে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আমি লক খুলে ম্যাসেজটা দেখলাম।

‘ এখনও ঘুমাওনি? জেগে জেগে তারাদের কথা ভাবছো? আর ভাবতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। পালিয়ে যাওয়ার আগে তো তোমার মুখটা দেখতে দিলে না। দাঁড়াও যখন তোমার কাছে ফিরে আসবো তখন আর পালাতে দেবো না। ভালোবাসার শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখবো নিজের কাছে।
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার’

পড়ার সাথে সাথে মেজাজ খারাপ হল। তার ঐ কচু বাইটের জন্য প্রচুর চুলকানি হইসে। সবাই প্রশ্ন করে পাগল বানাই ফেলসে। কোনোমতে সামাল দিসি। তবে একটু ভয়ও হইল। জানল কি করে আমি এখন কি করতেসি, কি ভাবতেসি!? আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেইখা নিলাম। কই, কোথাও কেউ নেই। আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম, যদি সামনে আসো তবে তোমার চৌদ্দ গুষ্টির শরীরের এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট রাখবো না। সব শুষে নেবো। ব্যাটা ভ্যাম্পায়ার। মেজাজ খারাপ করে ফোনটা রাইখা দিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম। আমার ম্যাসেজটা পেয়ে কারো একজনের মুখে হাসি ফুটল।
.
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। এই নিয়ে দশবার রিং টোন বাজছে। কে যে ফোন করতেসে। ধুর বাবা। চোখ বন্ধ করে কোনোমতে হাতিয়ে ফোনটা নিলাম। ব্যাটা এখনও বাইজা বাইজা মাথা তুলি ফেলতেসে। কোনোমতে রিসিভ করে বললাম, হ্যালো৷ কে?

– এখনো ঘুমাচ্ছো। ঘুমন্ত সুন্দরী হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? যে কিস করে উঠাতে হবে।

ধমক খেয়ে আমি চোখ খুলে তাকালাম। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার। আমি আবার বললাম, কে বলছেন আপনি? আপনি হয়ত ভুল নাম্বারে……

– আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি। এখুনি ঘুম থেকে ওঠো না হলে এসে ঘাড়ে আরেকটা কামড় দিবো।

– কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!
চলবে…

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১৪

– কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!

আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। এখনো রক্ত জমাট বাঁধা দাগটা আছে। কামড়ের দাগটা রয়ে যাবে বোধহয়। জামাইরে কি কমু!!! আমার ভবিষ্যত সংসারে এখন থেইকাই আগুন লাগাইয়া দিল। ধুর! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ কইরা দিল। স্ক্রিনের আলো জ্বালাই মেজাজ আরো খারাপ হইল। মাত্র ছয়টা দুই। এত সকালে আরামের ঘুমটা মাটি কইরা দিল। ইচ্ছে করতেসে নিজের চুলগুলো একটা একটা কইরা ছিঁড়ি। না থাক। বহুত ব্যাথা পামু। তাছাড়া বিয়ের পর জামাই বলবো, বেল বৌ, আমার কাছে আসো, তোমার ফুটবল মাঠে একটু ঢুগঢুগি বাজাই। ভাইবা নিজেই ঢোক গিললাম। বেল বৌ হওয়ার শখ নাই। নাহ, মাথা ঠান্ডা করা লাগবো। ফোনটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চইলা আসলাম। মুখে ব্রাশ পুইরা দিয়া ইচ্ছা মতো ঘষতেসি আর রাগগুলো বেচারা ব্রাশের উপর ঝাড়তেসি। মুখ ধোয়া শেষে আয়নায় নিজের দাঁত দেইখা সেই লেভেলের সন্তুষ্ট হই গেলাম। একেবারে হীরার মতো জ্বলতেসে। বেঁচলে বড়লোক হই যামু একদিনে। আমি কল্পনা করলাম, আমার দাঁতগুলা হীরার দামে বেঁচতেসি। আমি দাঁতবিহীন মাড়ি বের কইরা হাইসা হাইসা বলতেসি, হীলাল ডাড লয়ে যান। দাঁতবিহীন আমারে কেমন লাগবো। নিজের অবস্থা ভাইবা নিজেই শিউরে উঠলাম। আল্লাহ গো!!! কি সব ভাবতেসি! ব্রাশের দিকে তাকাই দেখলাম বেচারার অবস্থা করুন। মান ইজ্জত কিচ্ছু রাখি নাই। কালকে মাত্র নতুন বাইর করসি৷ এখন মনে হইতেসে আজকে আরেকটা নামাইতে হবে।

আমি ফ্রেশ হইয়া বাইর হইতেই ম্যাসেজের শব্দ। ফোন খুইলা দেখি ত্রিশটা ম্যাসেজ। বাপ রে…। সিমওয়ালারাও তো এতো ম্যাসেজ দেয় না। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কে এত ম্যাসেজ দিসে। চেনা চেনা লাগতেসে। ম্যাসেজ পইড়া মেজাজ আবার বিগড়াইলো। ব্যাটার সমস্যা কি? কামড়ে আমার ঘাড়ের মাংস তুইলা নিয়া গেসে এখন ম্যাসেজ কইরা কইরা আমার মাথা খাই ফেলতেসে। সে ম্যাসেজ দিসে, জলদি নাস্তা করে নাও। আজকে না টি.সি. আনতে যাবে? সুন্দর করে শালীন হয়ে যাবে। মনে থাকবে? না হলে…
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার।

এই শালা কেমনে জানলো এতকিছু! হায়রে!!! ক্রাশের চিন্তায় আমি বেঁহুশ আসিলাম। এখন দেখি ভ্যাম্পায়ারের চিন্তায় আমি অজ্ঞান হমু। ওয়েট, বেহুঁশ আর অজ্ঞান তো একই জিনিস। ধুর ভাল্লাগে না। কি মুসিবত! সব কেমন হেডফোনের মতো জট পাকাই যাইতেসে। ক্রাশের কারনে এতদিন আধাপাগল আসিলাম। এখন মনে হয় পুরা পাগল হয়ে পাবনা যাওয়ার সময় হইসে।

আমি সাড়ে ছয়টার দিকে মুনতাহাকে ঠেইলা উঠাইলাম। বেচারি ঘুমে ঢুলতেসে। সেভাবেই অত্যাচারীদের মতো ওরে ওয়াশরুমে ঢুকাই দরজা মাইরা দিলাম। আমি ওর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতেসি। মেয়ে তো বেরই হয় না। ব্যাপার কি!!!! বিশ মিনিট হইয়া গেল। বাথরুম করতে গিয়া ঘুমাই পড়ল নাকি!!!! আমি আস্তে কইরা দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। কেউ নাই! দরজাও আটকায় নাই। অদৃশ্য হইয়া গেল নাকি! জোরে দরজা খুলতেই ধুপ কইরা কিছু পড়ার শব্দ। সাথে সাথে, ওরে বাবা গো, কোমরটা গেল মনে হয়… মুনতাহা ফ্লোরে বইসা বইসা ষাঁড়ের মতো চেঁচাইতেসে। আমি তাড়াতাড়ি আইসা কইলাম, তুই কোথা থেকে আসলি!

– আমি কি উবে গেসিলাম নাকি! এখানেই তো ছিলাম। উরে……

– এখানে কই ছিলি? দেখলাম না যে।

– দরজার পেছনে।

– ওখানে কি করতেছিলি?

– হেলান দিয়ে ঘুম তাড়াইতে ছিলাম। কিন্তু কখন ঘুমাই গেসি টের পাই নাই।

আমি হাসমু না কাঁদমু বুঝতে পারতেসি না। মুনতাহা বলল, এমন হ্যাবলার মতো দাঁড়াই থাকবি না তুলবি? আমি ওকে টাইনা তুলতে ও বলল, আজকে মাজাটা মনে হয় গেল। তোর সঙ্গে আর যাওয়া হবে না। তুই আব্বুর সাথে যাস। ওরে বাবা। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হইয়া আসলাম। ও দরজা মাইরা দিল। এই মেয়ে সামনে আমারে কি পরিমান জ্বালাইবো কে জানে! কেউ নাকি ঘোড়ার মতো দাঁড়াই দাঁড়াই ঘুমায়। তাও আবার ওয়াশরুমে! এতদিন আমি সবাইরে জ্বালাইসি এখন এ আমারে জ্বালাইবো। নাহ্, এটা তো হইতে দেওয়া যাবে না। দাঁড়া তোরে আমি টাইনা সোজা করমু। না হইলে আমার নামও গাজরের হালুয়া না। এ্যাঁ…!!!!
.
.
.
.
আমি বের হইয়া দেখলাম সবাই মোটামুটি টেবিলে উপস্থিত। শুধু আমরাই বাকি ছিলাম। আমি বইসা পড়লাম টেবিলে। মিষ্টি খালা আমাকে নাস্তা দিয়ে বলল, মুন কই?

– আসতেসে।

আমি মাত্র মুখে খাবার দিমু তখন মুনতাহা বুইড়া মানুষের মতো কোমরে হাত দিয়া আইসা চেয়ার টেনে বসল। সানজিদা আপু জিগাইল, কি হইসে তোর আবার? আমি রুটি আলুর ঝোলে চুবাইতে চুবাইতে কইলাম, ওয়াশরুমে ঘুমাইতে গিয়া পইড়া গেসে।

– ছোঁয়া……

– এসব কি মুন?

– আরে আব্বু, ও দুষ্টুমি করছে।

ও আমারে গলায় চাকু চালানোর ভঙ্গি করে বুঝাইল, কিল ইউ। আমিও ভেংচি কাইটা কইলাম, বিলাই ইউ। আমাদের কান্ড দেখে মিষ্টি খালা বলল, আসতে না আসতে চুলাচুলি শুরু করবি নাকি? মুন, আজকে স্কুলে যাবি না? ও কোমরে হাত দিয়ে বলল, আম্মু, সেই লেভেলের ব্যাথা পাইসি। আজকে না যাই?

– খালি ফাঁকির বাহানা। ছোঁয়া মা, আজকে তোমার খালুর তোমার সাথে স্কুলে যাবে। টি সি আনতে।

– আচ্ছা।……আমাদের বাসাটা কি করবে কিছু ভেবেছ?

– না। এই ব্যাপারে তুই যা বলবি তাই। আমরা তোর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না।

– বেঁচে দাও।

সবাই আমার দিকে তাকাইলো। আমি কইলাম, কি হইসে? সবাই এভাবে তাকাই আছো কেন? মিষ্টি খালা বলল, সত্যিই বেঁচে দেবো? আমি রুটির টুকরা মুখে পুরে দিয়া বললাম, আমি কি এমনি এমনি বলসি নাকি? আমি জানি তোমরা এতো বড়লোক নও যে এই পরিবার চালানোর সাথে ঐ বাসাটাও চালাইতে পারবা। দরকার কি বোঝা বাড়িয়ে? ঐ বাসাটা বিক্রি করে যা টাকা হবে সেগুলো আমার জন্য খরচ করবা। তাহলে তোমাদের উপর আমার জন্য আসা চাপটা কমবে। আমি তোমাদের উপর বোঝা হতে চাই না। আমি শেষ টুকরা মুখে পুইরা দিয়া উইঠা গেলাম। সবাই চুপচাপ খাইয়া উঠল। আমি রুমে এসে দরজাটা মাইরা পিঠ ঠেকে দাঁড়াইলাম। কিছু পানি নাকের ডগায় জমলো। আমি সামনে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকাই বললাম, সরি আব্বু আম্মু।

সাতটার মধ্যে রেডি হইয়া বের হইলাম। দরজা খুললে আগে চেরি ফলের বাসার দরজা দেখতাম। এখন একটা ফাঁকা উঠান নজরে পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি ক্যাডস পইরা বাইর হই গেলাম। এখান থেকে স্কুল যাইতে একঘন্টা লাগবে। আজকে শেষ। লেট কইরাই গেলাম। কি আর হইবো? বাসা থেকে বাইর হয়ে একটা অটোতে উইঠা গেলাম। খালু ছুটির পর আসবে। আমার সাথেই আসতে চাইছিল। আমিই বলসি আজকে সব ক্লাস করব। শেষদিন বলে কথা। স্যার ম্যাডামদের একটু প্যারা দিয়া আসি। তাই খালু বলেছে ক্লাস শেষ হলে আসবে।

আমি একঘন্টা পরে আইসা পৌঁছাইলাম। দারোয়ান চাচা গেটে আটকাইলো। আমি একটা মলিন হাসি দিলাম। চাচা কইল, এত লেটে ক্যান আসলা?

– আজকে ঢুকতে দেন, চাচা।

– উঁহু।

– এই শেষবার চাচা, আর জ্বালাবো না।

– এই কথা আগেও বলসিলা।

– আগে তো মজা করে বলসি। আজকের পর থেকে আর জ্বালাবো না, চাচা। সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি চাচা। আমি চলে যাবো।

– কই যাবা?

– এখান থেকে দূরে চাচা। আজকে শেষবার দেখতে আসছি। টিসি নিয়ে চলে যাবো চাচা। আর প্যারা দিবো না।

চাচা কিছু বললেন না। মুখ কালো করে সইরা গেলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। চাচাকে কত প্যারা দিসি। একবার আম চুরি করতে আসছিলাম স্কুলে। চাচার হাতে ধরা খাইয়া সে কি দৌঁড়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে গেলাম। সব স্মৃতি গুলা চোখে ভাসতেসে। কেউ নাই মাঠে। সবাই ক্লাসে। আমি মাঠের মাঝে গিয়া দাঁড়াইলাম। চারদিকে একবার চোখ বুলাইলাম। এতদিন বুঝতে পারি নাই ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কাকে বলে। আগে আমার জগত জুড়ে কত মানুষ ছিল আর পুরো পৃথিবীতে আজ অসহায় একা আমি।

আমি ধীরে ধীরে আমাদের ভবনে ঢুকলাম। সিঁড়ির রেলিং ছুঁয়ে উঠতে লাগলাম। দেয়ালগুলো আজ আমার দিকে তাকিয়ে হাহাকার করতেসে। জীবনের একটা ঝড় সবকিছুকে আমার থেকে এক ধাক্কায় সরাইয়া নিয়া গেল। আমি রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ঘন্টা মিস করসি। দ্বিতীয় ঘন্টার স্যার এখনো আসে নাই। কেউ কেউ বারান্দায় দাঁড়াই আছে। রিদিকেও দেখলাম। আমাকে দেইখা ও দৌঁড়ে এসে জড়াই ধরল। আমি দাঁড়াই রইলাম। ও মুখে হাসি টেনে বলল, এত দিন পর আসলি। তোকে কত মিস করসি। সেই যে দেখসি তোকে তারপর আর দেখতে পারি নাই। জানিস আজকে রেজাল্ট দিবে। একটু পরে। আমি ওর দিকে নির্জীব বস্তুর মতো তাকাই আছি। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর এখান থেকে নতুন এক জায়গায় চলে যাবো।

ও আমাকে রুমে নিয়া গেল। আমি বেঞ্চে বসতেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। সবার শুধু আমার জন্য সমবেদনার বন্যা। আমার মোটেও ভালো লাগল না। স্যার চলে এলেন একটু পরে। আমি হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। স্যারের হাতে মার্ক শিট। সবার মাঝে উত্তেজনা ছড়াই পড়ল। আমি শান্ত হইয়া বইসা আছি। স্যার কিছু কথা বইলা রেজাল্ট কার্ড দেওয়া শুরু করলেন। আমার রোল ৮ ছিল। রেজাল্ট কার্ড পাওয়ার পর রিদি বলল, তুই কত হইছিস? দেখি। আমি ওকে রেজাল্ট কার্ডটা দিয়া দিলাম। এটা দিয়া আমি আর কি করমু? ও দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, তুই প্রথম হয়েছিস!!!!! আমি মনে মনে কইলাম, ক্রেডিট আমার না। চেরি ফলের ছিল। রিদি আমার রেজাল্ট কার্ড নিয়া লাফালাফি করতেসে। আমার এটা নিয়া কোনো মাথাব্যাথা নাই। স্যারের ক্লাস শেষে টিফিন টাইম শুরু হতেই আমি নিচে চইলা আসলাম। গিয়া বসলাম দোলনায়। এই দোলনায় কত স্মৃতি জড়াই আছে। আমি দুলতেসি আর স্মৃতিগুলা হাতড়ে বেড়াইতেসি। রিদি এসে বলল, কি হইসে তোর?

– আমি চলে যাবো রিদু।

– কোথায়?

– আজকে টিসি নিতে আসছি।…… চিন্তা করিস না তোর সাথে যোগাযোগ থাকবে।

ওর মুখের দিকে তাকানোর সাহস করলাম না। উইঠা চইলা আসলাম। কখন আবার বাচ্চাদের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কইরা কাইদা দেয়। মেয়েটারে বড্ড আপন লাগে। বেস্টু বলে কথা।
.
.
.
.
টিসি নিয়া বাসায় আসলাম দেড়টার সময়। সোজা ওয়াশরুম। গোসল কইরা বাইর হতেই মুন আমারে রুবিকস কিউব সাইজের একটা মোটা খাতা দিয়া কইল, এটা তোর।

– কি এটা!?
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here