#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ৬
বিকালের মৃদু রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমি, প্রিয়ক আর আমাদের ছোট বার্ডটা। পুনম আশপাশ দেখছে আর হৈ-হুল্লোড় করছে। আমার কোলেই বসেছে ও। কতবার পিছনে বসতে বললেও শোনে নি। তাই বাধ্য হয়েই বসেছি৷ আমাদের আর মামনিদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মামনিদের বাড়ি শহরের ভিতর পড়লেও আমাদের বাড়ি পুরো গ্রামীন পরিবেশে পড়েছে। আর দূরত্বটা মাত্র ১ঘন্টার৷ প্রযুক্তির ছোয়ায় আর আধুনিক বাংলাদেশ তৈরীর কল্যানে আমাদের গ্রামের মেঠো পথ আর এখন নেই। কাঁচা পাকা মেঠো পথের পরিবর্তে তৈরী হয়েছে কনক্রিটের পাকা রাস্তা। তবুও বছর বা ঘুরতেই রুপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো রোডে। আশপাশে মোটামুটি ভালো আকারেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট৷ ক্রেতা বিক্রেতার জমে উঠেছে সেই পরিবেশ। হুট করেই গাড়িতে ব্রেক কষতেই সামনের দিকে হেলে পড়ি৷ আঘাত পাওয়ার আগেই প্রিয়ক তার হাত দিয়ে আমাদের দুজনকে ঠেকিয়ে নেয়। নয়তো ভালোই আঘাত লাগত আমাদের। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টির মানে বুঝতে ব্যর্থ আমি। শুধু এখন নয়, কলেজ থেকে আশার পর থেকেই তার দৃষ্টি আমার অচেনা লাগছে৷
“নেমে এসো, প্রিয়তা।”
হঠাৎ ডাকে ঘোর কাটে আমার। প্রিয়কের কথায় আশে পাশে তাকালাম। না এখনও তো আসিনি আমরা। তাহলে এখানে কেন নামবো? প্রিয়ক আবারও নামতে বললে নেমে আসি আমি আর পুনম। প্রিয়ক পুনমকে একটা চকলেট আইসক্রিম কিনে দিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানের সামনে এসে থামতেই সামনে তাকাই আমি। একটা ফোনের দোকান। আমাকে নিয়ে ভিতরে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে গাড়িতে চলে আসি আমি। প্রিয়ক আমার দিকে নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে ঢুকে যায়। সেই সাথে পুনম ও। প্রায় ১৫মিনিট পর এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে। আর পুনমকেও বসায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
“প্রিয়তা’স ড্রিম” লেখা বাড়িটার সামনে নামতেই মনটা কেমন করে উঠল। মনে হচ্ছে বহুবছর পর এসেছি আমি এখানে। অথচ মাত্র আড়াই দিন হয়েছে আমার এখান থেকে যাওয়ার। তাও সেখানে যেখানে আমার রোজ আশা যাওয়া হয়। তবুও মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা যেন পূরন হচ্ছে খুব গোপনীয় ভাবে। মা, চাচী আম্মু, ছোট চাচ্চু আর বড় চাচ্চু এগিয়ে আসে আমাদের দিকে৷ মাকে দেখেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ি। যেন কতদিনের অভুক্ত আমি৷ চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে কিছু তরল পদার্থ। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। একসময় চাচি আম্মুও আমাকে বোঝালেন। মা বললেন,
“পাগল মেয়ে আমার, এভাবে কাঁদে নাকি কেউ?”
“ওদেরকে ভিতরে নিয়ে বসতে দাও।”
পিছন থেকে ভারী গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলাম আব্বু এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে ছেড়ে সেদিকে ফিরতেই দেখলাম আব্বু আমাদের দিকেই আসছে। আব্বু কাছে এসে প্রিয়ককে জরিয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি আমি৷ আমাকে যেমন ওই বাসার সবাই খুব ভালোবাসে প্রিয়ককেও তেমন এবাসার সবাই খুব ভালোবাসে৷ প্রিয়ক এর মাঝেই সবার খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে। আমাদের দুজনকে আমারই রুমে পাঠিয়ে ফ্রেস হয়ে নিতে বলে। আমারই রুম! যা একসময় আমার সকল ক্লান্তি মেটানোর উৎস ছিল। কত কত স্মৃতি যে জরিয়ে আছে তা বলার বাহিরে। কত নির্ঘুম রাতের নিরব কান্নার সাক্ষী যে এই ঘর, ঘরের প্রতিটি বস্তু। ওরা যদি কথা বলতে পারত তাহলে এই মুহুর্তে প্রিয়ককে নিজেদের মাঝে আসতে দিত না। চিৎকার করে জানাতো সবাইকে। বাট আফসোস।
নিষুতি রাত। কিছু রাত জাগা পাখি ব্যতীত আর কোনো কিছুর আওয়াজ নেই। এর মাঝে খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু করুন সূর। মনে হচ্ছে কান্না করছে কেউ। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। পাশ ফিরতেই দৃষ্টি যায় প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আজও তার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ আমি। খুব সন্তর্পণে নিজেকে তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসি আমি। তৃষ্ণা মেটাতে টেবিলের উপর থাকা বোতল থেকে পানি খেয়ে নেয়৷ বোতলটা রাখার সময় চোখ যায় টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে একটি ডায়রী। প্রিয়কের ডাইরী। এর সাথেও জরিয়ে আছে একটি মধুর স্মৃতি। যা ভেসে উঠল চোখের পাতায়।
ডিসেম্বর মাস। ইংরেজি মাসের শেষমাস হলেও বাংলা মাসের নবম মাস। পৌষ মাস। জে এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তার পুরো ক্রেডিট না গেলেও অর্ধেকের বেশি ক্রেডিট ছিল ভাইয়ার। আমাকে একস্ট্রা ভাবে এত সুন্দর আর সহজ করে সব পড়া বুঝাতো যা সহজেই বুঝতাম আমি। আর মনেও থাকতো। তাই ঠিক করেছিলাম ভাইয়াকে একটা গিফট দিবো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাট কী দিবো? তখনই মাথায় এলো ডায়রীর কথা। ফ্রেন্ডের সাথে গিয়ে কিনেছিলাম এটা দোকানটার পাশেই ছিল ঘড়ির দোকান। একটা ঘড়ি ও কিনেছিলাম সেদিন। ভাইয়াকে তা দিতেই এতটা খুশি হয়েছিল তা বলার বাহিরে। কেঁদে ফেলেছিল ভাইয়া। সেদিনই প্রথম ভাইয়াকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। আমাকে সেদিন খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরেছিল ভাইয়া।
ডায়রীটা হাতে নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলাম আমি। খুব যত্ন করে রেখেছে ডায়রীটা। একটুখানি দাগ পড়তে দেয়নি তাতে। হুট করেই মাথায় এলো ভাইয়ার আমার সাথে করা অন্যায় গুলোর কারন লেখা নেয় তো এখানে! জানতে হবে আমাকে। যা ভাবা তাই কাজ।
বাইরের অতিরিক্ত শব্দে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথাটা ভার ভার লাগছে আমার। তবুও উঠে বসলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেলা অনেক হয়েছে। পাশে প্রিয়ক নেই। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাড়ির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। মা চাচীরা রান্নাঘরে হরেক রকম খাবারের আয়োজন করায় ব্যস্ত। বাড়ির নতুন জামাই বলে কথা! জামাই! হাসি পেয়ে গেল কথাটা ভাবতেই। আমাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এলো আমার দাদীমা। এসেই বলল,
“কিলো নাতিন, এত হাসছ ক্যান?নাতজামাইয়ের সোহাগের কতা মনে পরল নি?”
“তোমার মতন না গো বুড়ি আমি। ”
“হ্যারে বু। তোগো মদ্যে সব ঠিক আছে লো? পিয়ক কিছু কইছে নি লো?”
দাদীর আদর মাখা কন্ঠশুনেই বুঝতে পারলাম আার জন্য কতটা চিন্তিত ছিল। দাদীর কথায় এক পলকের জন্য দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে চলে যায়। মামাদের সাথে কাজে ব্যস্ত সে। সেই সাথে ছোট বাচ্চাদের সাথে চলছে দুষ্টামি। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাদীকে বললাম,
“সব ঠিক আছে গো, দাদীমা। তুমি এত চিন্তা কইরো না। শরীর খারাপ করবো তোমার। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”
সকাল পেরিয়ে দুপুর ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতি তীব্র রোদের তাপে গরম হতে থাকে। এসময় একটু শীতল বৃষ্টির ছোয়া পেতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির কোণে কোণে থাকা ক্লান্ত শরীর। সেই ছোয়া দিতেই যেন নেমে আসে বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টির কণা মাটিতে স্পর্শ করার আগে স্পর্শ করছে আমাকে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জলের ধারা। এমনও দিন দেখতে হবে তা জানা ছিল না আমার। কষ্টটা যে এত পরিমানে হতে পারে তা কখনই ভাবতে পারিনি। চোখের নোনা জল যেমন বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাচ্ছে তেমন যদি কষ্ট গুলোকেও ধুতে পারতাম! বাট আফসোস!
কাল রাতের কথা মনে পড়ল। ডায়রীর প্রথম পৃষ্টায় খুব সুন্দর করে লেখা
“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”
চলবে..??
(ক্ষমা করবেন আমাকে। এর বেশি লেখা সম্ভব হয়নি। গত পর্বেই বলেছিলাম পরীক্ষা আমার। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ। আর আগামী পর্বে অনেকটা ক্লিয়ার হবেন।)