#চিরেকুটের_শব্দ (পর্ব ৫)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
অতি জিনিস টা বলতেই ভয়ঙ্কর হয়। হয়তো অর্ণবের ক্ষেত্রেও তাই। হয়তো হুট করে আজ তার এতো ভালোবাসার পেছনেও কোনো কারণ আছে। তবে তা জানার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই অর্থির। তার মন জুড়ে আর একটাই কথা বলছে, যে কতোদিন পর অর্ণব আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে। মায়া থেকেই তো ভালোবাসার জন্ম। হোক না শুরু একটু একটু করে।
অর্ণবের সাথে বের হলো সে। আজ খুব খুশি। অর্ণব ড্রাইবিং করছে, আর পাশে বসে আছে সে। চুল গুলো হালকা উড়ছে তার। তবে এই সন্ধার পর অর্ণব তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা তার অজানা। তবে স্বামীর সাথে জাহান্নামে যেতেও রাজি সে।
এর পর এক একটা বড় বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। অর্থি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে বাড়িটা খুব ঝাকঝমক পূর্ণ ভাবে সাজানো। ভেতরে অনেক মানুষের কোলাহল শুনা যাচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে, বা পার্টি।
এতো কিছুর মাঝে অর্ণব তাকে স্ত্রীর পরিচয়ে এখানে নিয়ে আসবে তা ভাবতেই অবাক হচ্ছে অর্থি।
গেটের সামনে আসতেই দুইটা ছেলে এসে রিসিভ করলো তাদের। ভেতরে ঢুকে চার দিকে তাকাচ্ছে সে। কতো বড় আয়োজন। এর আগে কখনো এমনটা দেখেনি অর্থি। কারণ এরকম কোনো অনুষ্ঠানে তাকে কখনো নিয়ে যায়নি তার বাবা মা। মান-সম্মানের ভয়ে অর্থিকে ঘরে রেখে যেত সবাই। প্রথম প্রথম খুব কান্না পেলেও পরে সব মেনে নিতে শিখে যায় অর্থি।
আজ ওসব মনে পরতেই চোখে জল আসে তার। তার ফ্যামিলি তাকে কোথাও নিয়ে যেতে লজ্জা পেত, কিন্তু অর্ণব লজ্জা পাচ্ছে না। ঠিকই তার স্ত্রী পরিচয়ে নিয়ে এলো। মানুষটা কে যতটা খারাপ ভেবেছিলো ততোটাও নয়। সত্যিই ভালোবাসা তৈরি হতে সময় লাগে।
আজ নাকি অর্ণবের অফিসের কোন কর্মকর্তার ফাষ্ট বিবাহ বার্ষিকি। তাই এই পার্টির আয়োজন।
অনেকে এসেই অর্ণবের সাথে হাত মিলিয়ে মত-বিনিময় করছে। চার পাশে চোখ বুলাতেই চার পাশের মানুষ গুলো দেখে রাগ হলো অর্থির। তাকে দেখে অনেকেই হাসা-হাসি করছে। কারণ টা হয়তো তার ড্রেসআপ।
পার্টিতে সব মেয়েরাই এসেছো ছোট ছোট কাপড় পরে, যেখানে তাদের শরিরের অনেক অংশই দেখা যাচ্ছে। আর এদের মাঝে অর্থিই একমাত্র ব্যাক্তি যে এসেছে বোরকা হিজাব পড়ে। হাতেও কালো রংয়ের মুজা পরা।
এসব পরে পার্টিতে আসায় অনেকেই তার দিকে চেয়ে হাসাহাসি করছে। বিষয়টা খুব খারাপ লাগছে তার। অর্ণবের পাশে পাশে হাটছে সে চুপচাপ। কয়েকজন তার সাথে কথা বলতে চাইলে অর্ণব তা মানিয়ে নিচ্ছে। যে, অর্থির ঠান্ডা লেগেছিলো তাই গলা ব্যাথা।
আবার কেউ কেউ অর্থির সাথে হাত মিলাতে আসলেও অর্থি সরে অর্ণবের পেছনে গিয়ে দাড়াচ্ছে। কারণ পরপুরুষের সংস্পর্শে আসা ঠিক না এই ভেবে।
পার্টিতে প্রায় সব ক্যাপল নিজেদের মতো নাচছে, অনেকের হাতেই মদের গ্লাস। আর অর্থি অর্ণবের পাশে অর্ণবের এক হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। অর্ণবের দিকে চেয়ে ইশারায় বলছে, তার এখানে ভালো লাগছে না। বাড়ি চলে যাবে সে।
অর্ণব হেসে অর্থিকে নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলো। সেখানে ঈষিতা একটা টেবিলে বসে আছে। তার হাতেও এলকোহল।
অর্থিকে নিয়ে তার সামনের টেবিলে বসলো অর্ণব।
ঈষিতা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
– এটা তোমার বৌ?
– হ্যা,,,
– কিন্তু এটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, প্রাচিন কালের মেয়ে বিয়ে করেছো তুমি। ড্রেসাপ সেই প্রাচিন কালের ক্ষেত’দের মতো।
অর্থির খারাপ লাগলো ঈষিতার কথায়। ইচ্ছে করছে এখন ঈষিতাকে কিছু কথা শুনাতে। কিন্তু সে চাইলেও তা পারবে না। তাই চুপচাপ বসে আছে। ভেবেছে তার হয়ে উত্তরটা অর্ণবই দিয়ে দিবে এই বাজে মেয়েকে।
কিন্তু অর্নবের মাঝে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হেসে ঈষিতাকে বললো,
– ও এমনই, পর্দা করে চলে।
ঈষিতা টেবিলে দুই হাত রেখে অর্থির দিকে চেয়ে বললো,
– তা কেমন আছো, হুজুরিনি?
অর্থি চুপচাপ বসে আছে। এর মাঝে অর্ণব অর্থির উদ্দেশ্যে বললো,
– কি হলো অর্থি, উত্তর দাও।
এবার অর্থি মাথা তুলে অর্ণবের দিকে তাকায়। অর্নব সব জানার পরও মেয়েটার সাথে তাল মিলাচ্ছে। অর্ণব এবার হেসে বললো,
– ওহ্ হো, আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে তুমি কথা বলতে পারো না। তাই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছ না, সো সেড,,,,
অর্থি এবার ভালোই বুঝতে পারছে, অর্ণব মেয়েটার সাথে মিলে তাকে অপমান করছে। যে যাই বলুক, অর্ণবের কাছে এসব শুনে খুব খারাপ লাগছে তার।
অর্ণব আবারও বলতে লাগলো,
– বুঝে গেছো তো নিজের লেভেল টা? কি ভেবেছিলে, আমি ভালোবাসা দেখিয়ে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি? হা হা আমি এ তোমাকে এখানে এনেছি এই জন্য যে, যেন তুমি নিজের অবস্থানের কথা জানতে পারো। নিজের যোগ্যতা টা কতটুকু তা বুঝতে পারো। এবার তুমি নিজেকেই প্রশ্ন কর, যে তুমি আমার কাছে যে ভালোবাসা আশা করো সেই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা টা তোমার কতটুকু আছে? আসার পর থেকে এই পর্যন্ত আমার একটা ক্লাইন্টের সাথেও তো তুমি কথা বলতে পারোনি। এবার তো বুজতে পারছো নিজের অবস্থান টা?
অর্থি কিছু বলতে পারছে না। চুপচাপ বসে অপমান সহ্য করছে সে। চোখ দুটু ভিজে উঠেছে তার। নিজের প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে অপমান সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো মানুষ খুব কমই আছে।
ওখানে আর দাড়িয়ে না থেকে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে রাস্তায় দাড়ায় অর্থি। এখানে মানুষজন তেমন একটা নেই। তাই রাস্তার এক পাশে বসে হু হু করে কেঁদে উঠে সে। ভেবেছিলো তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে চোখের জল কখনো শুকায় না। সময় হলে ঠিকই বেড়িয়ে আসে।
খুব কষ্ট হচ্ছে আজ তার। একটা মানুষ হাত দিয়ে আঘাত করলে তা কিছুক্ষন পর ভালো হয়ে যায়। মুখ দিয়ে গালি দিলে সেটাও ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু নিজের দুর্বলতা নিয়ে আঘাত করলে কষ্ট টা খুব গভিরে গিয়ে লাগে।
এর মাঝে অর্ণবও এসে গাড়ির সামনে দাড়ায়। অর্থিকে এভাবে কাঁদতে দেখে অর্থির এক হাত ধরে গাড়িতে উঠায় সে। তারপর সোজাসুজি বলে দেয়। সব কাঁন্না এখানেই শেষ করতে। তার বাসায় গেলে বাবার সামনে যেন ভেজা চোখ নিয়ে না যায়। কারণ বাবার মনে কষ্ট দিতে চায় না, বাবাকে খুব ভালোবাসে সে।
বাড়িতে ঢুকে সবার সামনে মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করলেও রুমে এসে সেই হাসি বিলিন হয়ে যায়। না চইতেও বার বার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে।
এর মাঝে অর্ণব এসে বলে,
– নেকামির সাগর এখনো শুকায়নি দেখছি।
অর্থি আর চুপ না থেকে তার ছোট্ট খাতাটা আর কলম নিয়ে অর্ণবের সামনে আসে।
‘দেখুন আপনি যেমন একটা মানুষ, তেমন আমিও একটা মানুষ। আমার দুর্বলতা নিয়ে আমাকে এভাবে অপমান কা করলেও পারতেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাকে আপনি নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছেন। এর পর নিজেই সব করছেন। আমি চুপচাপ সব সহ্য করে যাচ্ছি, আপনাকে সম্মান করি বলে। তাই বলে আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন না।’
এটা ছিলো অর্ণবের কাছে তার দ্বিতীয় লেখা। অর্ণব কাগজটা হাতে নিয়ে হাসলো। তার পর বললো,
– বাপরে, সাহসও দেখছি দিন দিন বেড়েই চলছে। তো কি করেছি আমি শুনি?
অর্থি আবারও একটা লেখা অর্ণবের দিকে এগিয়ে দিলো।
‘ওই বাজে মেয়েটার সামনে আমায় এভাবে অপমান করেছেন কেন?’
অর্ণব কাগজ টা হাতে নিয়ে অর্থির গালে একটা চর বসিয়ে দেয়।
– তোমার সাহস কি করে হয় ঈষিতাকে বাজে মেয়ে বলার। তার স্ট্যাটাস আর তোমার স্ট্যাটাস কখনো মিলিয়ে দেখেছো? যোগ্যতা যতটুক আছে তার মাঝেই থাক। বেশি এগোতে যেও না।
To be continue…..