হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-২১

0
618

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

শাহেদ আর রুনার ছেলে তামিমের বয়স আড়াই বছর। প্রচন্ড চঞ্চল। তাকে সামলানো ভারী মুশকিল। রুনার একা একা কষ্ট হয়। শাহেদ থাকে সারাদিন অফিসে। এদিকে রুনারও এবার মাস্টার্স চলছে। বাচ্চা হওয়ায় মাঝে দু বছর গ্যাপ নিয়েছিল। শহরে আত্মীয় স্বজনও কেউ নেই যে বাচ্চাকে প্রয়োজনে কারো কাছে রেখে যেতে পারবে। তাই সবদিক বিবেচনায় নিয়েই তারা ছেলের জন্য একজন আয়া রেখেছেন। মহিলার বয়স ভালোই। কর্মজীবনে নার্স ছিলেন। এখন রিটায়ার্ডের পর ভালো স্যালারী যাচাইয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ নিয়েছে। তার নাম ফাতেমা। রুনার খুব সুবিধা হয়েছে তাকে রেখে। আজ রুনা একটু বিশেষ কাজে বাইরে বেড়িয়েছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখে তার আদরের ছেলেটা সোফার উপর বসে বসে খেলছে। রুনা গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। রুনা ফিরে আসায় ফাতেমা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে বাথরুমে গেলো। শাহেদ আবার ফোন করেছিলো কিনা দেখার জন্য রুনা ফোন বের করতেই তার উপর হামলে পড়লো তার ছেলে৷ রুনা স্মিত হেসে ফোন থেকে ছেলেরই কিছু মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তার হাতে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বাচ্চাটির পাশে বসলো ফাতেমা৷ ফোন পেয়ে এলোপাথাড়ি কিছু টিপাটিপি করে ফোনটা রেখে আবারও খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তামিম৷ সোফার উপর পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের উপর একটা ছবি দৃশ্যমান হয়েছিল। সেটা দেখে ফাতিমা বলল, ‘বাহ! মেয়েটা তো ভারী সুন্দর। এটা কার বিয়ের ছবি রুনা?’

বয়সে ছোট হওয়ায় ফাতিমা রুনাকে নাম ধরেই ডাকে। এতে করে রুনারও কোন আপত্তি না থাকায় সে কিছু বলে না। ফাতিমার প্রশ্নে রুনা বলল, ‘আমার ভাসুরের মেয়ে। ও’রই বিয়ের ছবি। আরও আছে দেখুন।’

ফাতেমা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে একটার পর একটা ছবি দেখতে থাকে। সবগুলোই ছিল ধারার বিয়ের ছবি। কিছু ছিল এ বাড়িতে থাকাকালীনই আর কিছু ছিল শ্বশুরবাড়িতে প্রথম যাওয়ার পর নিয়ম রীতি পালনের ছবি। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে ফাতিমার দৃষ্টি আঁটকে যায়। ভ্রুকুটি করে সে বেশ খানিকক্ষণ গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে থাকে৷ হঠাৎ কিছু অনুধাবন করতে পেরে তার ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠে। ফোনটা রুনার দিকে ফিরিয়ে ফাতেমা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলে উঠে, ‘তোমার ভাসুরের মেয়ের পাশে এই মহিলাটা তোমাদের কি হয় রুনা?’
শাহেদের থেকেই রুনা জানতে পেরেছিল ইনি ধারার শ্বাশুড়ি হন। শাহেদও প্রথম বাড়িতে গিয়ে ধারার থেকে ছবি দেখেই চিনেছিল। সেই কথাটাই রুনা ফাতেমাকে বলার আগেই সে অনবরত কথার সুরে বলে যেতে থাকেন,
‘তাকে তো আমি চিনি। অনেক আগের কথা। সম্ভবত আরো ছাব্বিশ সাতাশ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। আমি তখন সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলাম। তার নামটাও যেন কি? হ্যাঁ…হ্যাঁ মনে পড়েছে খোদেজা। সেই অনেক বছর আগে খোদেজা যা করেছিল তারপরও কি আর ওঁকে না চিনে পারি!’

রুনা জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘কি করেছিলেন উনি?’

ফাতিমা একটু থামলো। ফিরে গেলো সেই ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনায়। যেই ঘটনা এতদিন শুধু গুটিকয়েক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

খোদেজা আর নুরুন্নাহার ছিল বাল্যকালের সখী। তাদের বেড়ে উঠা একসাথেই। বড় হতেই নুরুন্নাহারের সম্পর্ক গড়ে উঠে পাশের গ্রামের এক যুবকের সাথে। কিশোরী বয়সে আবেগের বশবর্তী হয়ে নুরুন্নাহার একটা ভুল করে বসে। নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে সেই ছেলেকে। শুধুমাত্র একজনের উপর ভরসা রেখে পাড়ি জমায় অচেনা যান্ত্রিক শহর ঢাকায়। মেয়ে পালিয়ে যাবার মতো কলঙ্ক নুরুন্নাহারের বাবা মায়ের গায়ে লাগতেই পুরো গ্রাম তাদেরকে দেখে ছি ছি করে। মূলত এই ভয়েই এরপর খোদেজার বাবা মা খোদেজার জন্য যত দ্রুত সম্ভব সম্বন্ধ দেখে খোদেজার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পর কিছু বছর খুব ভালোই কাটছিল খোদেজার। এরপরই তার স্বামীর এক বড় অসুখ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপের দিকে গেলে বেশ কিছু জমি বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ সম্বল করে খোদেজা একা একাই স্বামীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় গিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে থেকে তার স্বামীও টুকটাক কাজ করতে থাকে। ভাগ্য খোদেজার সুপ্রসন্ন ছিল না। কিছুমাস সুস্থ থাকার পর তার স্বামীর অবস্থা আবারও খারাপ হতে থাকে। একদিন হাসপাতালেই মৃত্যু নামক ভয়াবহ থাবা তার স্বামীকে কেড়ে নিলে খোদেজা একা হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে কিছু প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে সেখানেই দাফন কাজ সমাধা করতে হয় খোদেজাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর খোদেজা এক প্রকার ভেঙেই পড়ে সেই সময়৷ তার পরে একদিন হাসপাতালের কেবিন থেকে তার স্বামীর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গেলে খোদেজার হঠাৎ দেখা হয় নুরুন্নাহারের সাথে। হাসপাতালের করিডোরে নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে নুরুন্নাহারকে পড়ে থাকতে দেখে সে। নুরুন্নাহারের অবস্থা দেখে খোদেজা আঁতকে উঠে। তার চাইতেও বেশি শঙ্কিত হয় নুরুন্নাহারের কাহিনী শুনে। পালিয়ে বিয়ে করে ঢাকায় কিছুদিন সংসার করার পরেই নুরুন্নাহারের স্বামী তাকে একটা বস্তি মতন জায়গায় নিয়ে কোন এক আত্মীয়ের বাসায় তাকে একা কিছুদিন রাখার কথা বলে নুরুন্নাহারকে একা ফেলে চলে যায়। কিছুদিন যাবার পরই নুরুন্নাহার বুঝতে পারে কত বড় প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে সে৷ এটা তার স্বামীর কোন আত্মীয়ের বাড়ি নয়। দেহ ব্যবসার কারখানা। নিজের মন ভরে যাওয়ার পর কিছু টাকার বিনিময়ে যেখানে তাকে বিক্রি করে গেছে তার ভালোবাসার মানুষটি। সবটা উপলব্ধি করতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে নুরুন্নাহার। সকলের পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। সেখান থেকে পালানোর অনেক অনেক চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। ততদিনে তার নামের সাথে পতিতা শব্দও যোগ হয়ে যায়। নুরুন্নাহার থেকে নাম হয়ে যায় কমলা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই জীবনই এরপর মেনে নিতে হয় নুরুন্নাহারকে। তারপর একদিন হঠাৎ তার মধ্যে আরেকটা অস্তিত্ব আসে যার সঠিক পিতৃপরিচয় নুরুন্নাহারের অজানা। এরপরে সবটাই তো খোদেজার সামনে। নুরুন্নাহারের মুখ থেকে সবটা শুনে খোদেজার চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে। এত কিছু হয়ে গেছে নুরুন্নাহারের সাথে! খোদেজা তো জন্মের পর থেকেই শ্যামলা। কিন্তু নুরুন্নাহারের গায়ের রং ছিল ফর্সা। হাসলে তার বাম গালে কতো সুন্দর টোল পড়তো! তাকিয়েই থাকতে মন চাইতো শুধু। আর আজ সেই নুরুন্নাহারের কি অবস্থা! জীর্ণ রোগা শরীর। কালো হয়ে গেছে যেন একদম। দেখে চেনাই যায় না। নুরুন্নাহার খোদেজার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘আমি যেই ভুল করছিলাম তার শাস্তি আমি পাইয়া গেছি খোদেজা৷ আমি জানি না আমার পোলা হইবো নাকি মাইয়া। আমি শুধু চাই আমার সন্তান ভালো থাকুক। ঐ নোংরা জায়গায় আর না যাক। একটা স্বাভাবিক জীবন পাক। ঐ জায়গা থিকা আমি যে কেমনে হাসপাতালে আইছি তা আমিই জানি৷ ওইখানে থাকলে আমার বাচ্চাটা বাঁচতো না রে।’

এরপরে নুরুন্নাহারের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাকে। তার ডেলিভারি ফাতেমা নামের একটি নার্স করে। বাচ্চা সুস্থ জন্ম নিলেও নুরুন্নাহার মারা যায়। ডাক্তার বা নার্স কেউই প্রথমে নুরুন্নাহারের আসল পরিচয় না জানলেও তার মৃত্যুর পরে কথাটা কিভাবে যেন ছড়িয়ে যায়। মা তো মরে গেছে, এখন এই পতিতার ছেলেকে নিয়ে ডাক্তাররা কি করবে তার চিন্তায় পড়ে যায়। মায়ের মৃত শরীরটাট পাশে হাত পা নাড়িয়ে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক দেখছিল বাচ্চাটি। খোদেজার কেমন যেন মায়া লাগলো বাচ্চটির জন্য। আচ্ছা বাচ্চাটি তো বাকি বাচ্চাদের মতোই নিষ্পাপ। তার গায়ে কি লেখা আছে তার জন্ম ইতিহাস? খোদেজা আলতো করে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটি তার স্বচ্ছ ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে খোদেজার দিকে। হঠাৎ এক হাত দিয়ে খোদেজার শাড়ির আঁচল শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে সে। খোদেজার তখন আচমকা কি যেন হয়। স্বামীহীন নিঃসঙ্গ জীবনে সে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার টান অনুভব করে। তার মাতৃত্ব জাগ্রত হয়। সে ঠিক করে এই বাচ্চাকে সে মানুষ করবে, তার পরিচয়ে। সেখানে উপস্থিত এক বড় ডাক্তার আর নার্সরা অবাক হয়ে যায় খোদেজার কথায়। একটা পতিতার ছেলেকে কে নিতে চায়! খোদেজার উদার মনের পরিচয় বড় ডাক্তারকে মুগ্ধ করে। শিক্ষিত হয়েও এমন জন্ম পরিচয়ের মতো এই ধরণের সেনসিটিভ ব্যাপার সমাজের মানুষের কাছে কতোটা প্রভাব ফেলে তা সে ভালো করেই জানে। আর সেদিকে খোদেজা গ্রামের মেয়ে হয়েও যেভাবে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে বাচ্চাটিকে আপন করে নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বড় ডাক্তার খোদেজার অনেক প্রশংসা করলেন আর ছেলের নামটাও তিনিই রেখে দিলেন৷ এই ছেলে একদিন নিজের কর্ম দিয়ে নিজের জন্মের কালো ইতিহাসটাকে পৃথিবীর কাছে উপেক্ষিত করে তুলবে এই আশায় নাম রাখলেন ‘শুদ্ধ’।

ফাতেমা একবুক শ্বাস নিয়ে হাসপাতালে খোদেজার সেদিনকার কাজের কথাটা খুলে বলল। সবটা শুনে রুনার মুখ হতভম্ব হয়ে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করলো,
‘উনার কি আর কোন ছেলে আছে?’
ফাতেমা বলল, ‘না। তার স্বামী যখন মারা গিয়েছিল তখন তো সে খালিই ছিল। এখন যদি আবারও বিয়ে না করে থাকে তবে সেই পালক ছেলে ছাড়া তো আর কোন ছেলে আছে বলে মনে হয় না।’
রুনার যা বোঝার সে বুঝে যায়। এরপর শাহেদ অফিস থেকে ফিরে এলে তাকেও সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে শাহেদের মাথার রগ রাগে দপ দপ করতে থাকে। শেষমেশ একটা পতিতার ছেলে হলো তালুকদার বাড়ির জামাই! ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে উঠে। সে তৎক্ষনাৎ আবার অফিসে ফিরে যায় ছুটির আবেদন নিয়ে। ছুটি মঞ্জুর হয়, তবে পাঁচ ছয় দিন পর৷ এমন একটা ব্যাপার, ফোনেও সব খুলে বলা যাবে না। সে চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকে কবে এই মাঝের দিনগুলো পার হবে। এই বিয়ে তার আগের থেকেই পছন্দ ছিল না। তার উপর এতো বড় ধোঁকা! এবার সে এর একটা হেনস্তা করেই ছাড়বে।
__________________________________________

খোদেজার মুখে সব সত্যিটা শোনার পর থেকে শুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছুই যেন থমকে যায় তার কাছে। সে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায় না। তার সমস্ত পৃথিবীটাই আজ যেন মিথ্যা হয়ে গেলো। খোদেজাও নিশ্চুপ হয়ে আছে। সবটা শোনার পর শুদ্ধ’র প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বারবার আড়চোখে দেখছে শুদ্ধকে। খোদেজা কখনই চায়নি এই সত্যটা শুদ্ধ’র সামনে আসুক। গ্রামবাসীও কেউ কিছু জানে না। খোদেজা যখন ছোট্ট শুদ্ধকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল তখন সবাই শুদ্ধকে তার নিজের ছেলে বলেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। এতদিন কেউ কিছু জানেনি। সামনেও কাউকে জানাতে চায়নি খোদেজা। কিন্তু শুদ্ধ’র মতো বিচক্ষণ ছেলের সামনে মিথ্যা বলাটাও মুশকিল। যেখানে শুদ্ধ কিছু আঁচ করতে পেরেছে। তাই খোদেজাকে আজ সবটা সত্যি বলতেই হলো। শুদ্ধ তার ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সত্য বড়ই কঠিন। তবে শুদ্ধও শক্ত ছেলে। ভেতরের অবস্থা যাই হোক বাইরে থেকে নিজেকে সামলে নিল সে। নিজের কাজে এর কোন প্রভাব পড়তে দিল না। শুধু আগের চাইতে আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে পড়লো। শুদ্ধ আর এ নিয়ে কোন কথা বলল না। খোদেজাও আর কিছু তুললো না। শুধু ভেতরে ভেতরে ছেলের জন্য কষ্ট পেতে লাগলো। দুই দিন বাদে ধারা ফিরে এলো। সেদিন সেই মুহুর্তেই ধারা রূপনগরে চলে আসতে চাইলেও মেয়েকে পাঠাতে আসমার দুইদিন লেগে যায়। ফিরে এসে শুদ্ধ’র এমন চেহেরা দেখে ধারার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ধারার জন্য কষ্ট শুদ্ধ’র মধ্যে আগের থেকেই ছিল, নিজেকে নিয়ে সত্যটা জানতে পেরে তথাপি সেই যন্ত্রণা আরও বেশি বৃদ্ধি পেলো। নতুন যন্ত্রণার প্রাবল্যতা এতো বেশি ছিল যে পূর্ব আঘাত তার কাছে হয়ে উঠলো গৌণ। আর এদিকে ধারা ভেবে নিল এই সবটাই বুঝি ধারার জন্যই। তার জন্যই আজ শুদ্ধ’র এমন বেহাল দশা। তার মুখে হাসি নেই, কথা নেই, কোন আনন্দ নেই। শুদ্ধ তার সাথে কথা বলে না। এই যন্ত্রণা ধারাকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো। শুধুমাত্র একটি মানুষের নিরবতায় ধারার মনে হলো পুরো পৃথিবীটাই বুঝি শব্দহীন হয়ে গেছে। এই শব্দহীন পৃথিবীর নিস্তব্ধতা ধারাকে আঘাত দেয়। মনে মেঘ জমায়। প্রতি রাতে বৃষ্টি নামায়। এখন শুধু মনে হয় পুরো পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, যতো মূল্যই শোধ করতে হয় হোক, শুধু এই মানুষটা একটু কথা বলুক। টোল পড়া হাসি দিয়ে আরেকবার মুগ্ধ করুক। আরো একবার তার সেই ভরাট স্পষ্ট গলায় ‘ধারা’ বলে ডেকে উঠুক। কিন্তু তা আর হয় না। ধারা সারাদিন শুদ্ধ’র পিছে পিছে ঘুরে। সুযোগ খুঁজে কথা বলার। কিন্তু আগের মতো তা আর হয় না। একদিন রাতে ধারা একা সব রান্না করলো। খাবার বেড়ে দিয়ে বসে পড়লো খোদেজার পাশে। শুদ্ধ তখনই বাড়ি ফিরে আসায় খোদেজা তাকেও বসতে বললো। শুদ্ধ’র মন তখন ভালো ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না বলে সে না করে আবার বাইরে চলে গেলো। ধারা ভেবে নিলো শুদ্ধ বুঝি তাকে এখন এতোটাই ঘৃণা করে যে সে রান্না করেছে বলে সেই খাবার পর্যন্তও খেতে চায় না। ধারাও আর সে রাতে খেলো না। খোদেজার সামনে কোনমতে ঠোঁট চেঁপে কান্না আটকিয়ে খাবার ফেলে ছুটে উপরের রুমে চলে এলো ধারা। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে ভেঙে পড়লো অঝোরে কান্নায়।
__________________________________________

মাঝ রাতে পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই খোদেজার ঘুম ভেঙে যায়। চমকে উঠে বসতেই দেখে শুদ্ধ তার পা টিপে দিচ্ছে। খোদেজা বারণ করে পা সরিয়ে নিতে নিতে বলে, ‘আরে আরে কি করছিস?’
শুদ্ধ পা সরাতে দেয় না। জোর করে নিজের কাছে রেখে পা টিপে দিতে থাকে। খোদেজা অপলক শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে থাকে। মলিন মুখে বলে,
‘মাহাতাব, আমাকে মাফ করে দিস বাবা।’
শুদ্ধ ঝট করে খোদেজার দিকে তাকায়। করুণ গলায় অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, ‘আম্মা…তুমি আমার কাছে মাফ চাইছো আম্মা! তুমি তো আমার জীবনটাকে সুন্দর করে দিয়েছো। তুমি আমার জন্য যা যা করেছো! তুমি এতো ভালো কেন আম্মা?’

শুদ্ধ’র চোখে পানি জমতে থাকে। শুদ্ধ’র মুখে আম্মা ডাক শুনে খোদেজার মন ভরে যায়। ঠিক এই ভয়টাই সে এতদিন পাচ্ছিলো। খোদেজা ভেবেছিল শুদ্ধ যদি জানতে পারে খোদেজা তার আসল মা না তাহলে হয়তো আর আগের মতো ভালোবাসবে না। খোদেজার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলতে থাকে,
‘আমি কিন্তু তোমাকে এর জন্য কৃতজ্ঞতার কথা বলতে পারবো না। কারণ কৃতজ্ঞতা তো বলা হয় বাইরের মানুষকে। তুমি তো আমার নিজের মা। মাকে কি কেউ ধন্যবাদ বলে, বলো? সত্য যাই হোক। আমার কাছে কোন ম্যাটার করে না। আমি জন্মের পর থেকে তোমাকেই আমার মা বলে জেনে আসছি। তুমি আগে যেমন আমার আম্মা ছিলা তেমন সবসময়ই আমার আম্মা থাকবা। আমি আর কিছু জানি না। আমি আর কিছু জানতে চাই না।’

বলতে বলতে শুদ্ধ খোদেজার পা পেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে। খোদেজা আবেগ্লাপুত হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কাটে। নিরবে চলতে থাকে মাতা পুত্রের অনুভূতির আদান প্রদান। কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলে, ‘আম্মা একটা কাজ কিন্তু তুমি ঠিক করো নাই। আমার বিয়ের আগে তুমি ধারার পরিবারকে বললে না কেন এই সত্যিটা?’
খোদেজা আঁতকে উঠে। বলে,
‘এইসব কি বলতাছোস মাহতাব? এইসব কথা কেউ বলে! যেই জিনিসটা কেউ জানে না, দরকার কি তা আবার জানানোর৷ তুই আবার ধারাকে কিছু বলতে যাইস না।’
‘না আম্মা। তুমি ভুল কথা বলছো। তারা আমার কাছে তাদের মেয়ে দিচ্ছিলো। বিয়ের আগে তাদের পুরো অধিকার ছিল ছেলে সম্পর্কে সবটা জানার। এভাবে সত্য গোপন রাখাও এক প্রকার ঠকানো৷ এই কাজটা একদম ঠিক হয়নি। তোমার তাদেরকে বলা উচিত ছিল৷ আর ধারাকে তো আমি বলবোই। ধারা আমার স্ত্রী। ও’র সবটা জানা প্রয়োজন।’

খোদেজা বিচলিত হয়ে উঠে। আবার কি না কি ঝামেলা হয়ে যায় এই কারণে সে শুদ্ধকে থামানোর জন্য বলে, ‘আচ্ছা ঠিকাছে শুধু ধারা জানবে। কিন্তু ধারাকে আমি বলবো৷ আমি নিজে সবটা খুলে বলবো। তুই কিছু বলবি না। ঠিকাছে?’

শুদ্ধ সায় দেয়।

সকাল হতেই কি একটা কাজে আবুল আসে শুদ্ধ’র কাছে। শুদ্ধকে বাড়িতে পায় না। সে আরো আগেই তার কাজে বেড়িয়ে পড়েছে। খোদেজা ধারাকে পাঠায় দেখার জন্য৷ ধারা গিয়ে দেখে আবুল কারেন্ট বিলের কাগজ দেখাতে এসেছে শুদ্ধকে। কি একটা হিসাবে তার গড়মিল লাগছে, বুঝতে পারছে না। ধারা আবুলকে বুঝিয়ে দেয়। সবটা বোঝার পর আবুল কাগজ জমা দেওয়ার আগে একটা ছবি তুলে নেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করে৷ কাগজটা টেবিলের উপর রেখে আবুল ছবি তোলার জন্য ফোন বের করে। আবুলের ফোনের দিকে তাকিয়ে ধারা অবাক হয়। এটা তো শুদ্ধ’র ফোন। আবুলের কাছে কি করছে? আর শুদ্ধ’র হাতেও তো আজকাল একটা বাটন ফোন ছাড়া আর কোন ফোন দেখা যায় না। মনে খটকা লাগলেও মুখ খুলে আর প্রশ্নটা করা হয় না ধারার। আবুল চলে যায়। ব্যাপারটা সারাদিন ভাবায় ধারাকে৷ এর উত্তর পায় সে রাতে। শুদ্ধ বাড়িতে ছিল না। ফাহিমের কল আসে তার কাছে। ধারা রিসিভ করতেই প্রশ্ন করে,
‘আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ভাবী?’

ধারা কি বলবে ভেবে পায় না। আমতা আমতা করতে থাকে। ফাহিম উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলতে থাকে,
‘নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। শুদ্ধ যেমন করে খেটেছে না ভালো হয়ে কি পারে! রেজাল্ট আসা পর্যন্ত বেশি চিন্তা করবেন না ভাবী। দেখবেন ভালোই হবে। আর ভাবী, শুদ্ধকে আমার হয়ে একটু সরি বলে দিবেন। বলবেন আমি অনেক লজ্জিত। এমন হঠাৎ করে টাকার প্রয়োজন না হলে আমি শুদ্ধকে কখনোই এমন ইমারজেন্সি ভাবে আমার বেতন দিতে বলতাম না। আট হাজারের মতো টাকা! শুদ্ধ’রও নিশ্চয়ই হঠাৎ করে ম্যানেজ করতে খুব কষ্ট হয়েছে! আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।’

ফাহিম আরো কিছু বলতে থাকে৷ ধারার কানে যায় না। আস্তে আস্তে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেলে সে। এই মুহুর্তে সে বাকরুদ্ধ। শুদ্ধ’র ফোন কেন আবুল ভাইয়ের কাছে তা সবটাই বুঝতে পারে সে। শুদ্ধ তার জন্য নিজের ফোন বিক্রি করে ফেলেছে আর সে….! ধারা হঠাৎ হাঁটুতে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে নিজের হাত কামড়ে ধরে। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে এই মুহুর্তে শেষ করে ফেলতে পারলেই বুঝি তার মিলতো অনুতপ্তের এই উত্তপ্ত আগুনে যন্ত্রণাদায়ক ভাবে দগ্ধ হওয়া থেকে মুক্তি।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here