#শুভ্র_স্পর্শ
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ৫ (অন্তিম)
মাতৃত্ব এক অদ্ভুত অনুভূতি। নিজের মাঝে ছোট্ট একটি সত্বা ধীরেধীরে বেড়ে উঠবে৷ প্রতি স্পর্শ শুভ্রতা নিয়ে আসে। কেমন অনুভব হয় যখন বাচ্চাটা প্রথম নড়ে উঠে? নির্দিষ্ট সময় পর একটা ছোট্ট প্রাণ জন্ম নিবে।
এ অনুভূতি সব নারী অনুভব করতে চায়। আরহা ব্যতিক্রমী নয়। কিন্তু সবার ভাগ্যে সব থাকে না। আল্লাহ্ তায়ালা সবাইকে এই সুখ দান করেন না।
সমাজ এটাকে নারীর অক্ষমতা হিসেবেই নেয়৷ কারণ পুরুষদের এ বিষয়ে সমস্যা হতে পারে এটা এখনো অনেকে মানতেই পারে না।
বন্ধা নারীদের সমাজে স্থান খুব একটা সম্মানীয় নয়। তারা কোন শুভ কাজে থাকতে পারে না।কারো বিয়েতে শরীক হতে পারে না।কারো প্রথম বাচ্চা হলেও তাদের কোলে দেওয়া হয় না। অন্যসব না হয় বাদ দিলাম।
একটা দম্পতি হয়তো সন্তান ছাড়া একে অপরের পাশে থেকে পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে চায় কিন্তু তখন শুরু হয় বংশধর হিসেবে কাউকে তো চাই!
দিনশেষে একটা সন্তানের আশায় অনেক বন্ধ্যা মেয়েদের স্বামীর জন্য দ্বিতীয় বাসর সাজাতে হয়। মেয়ে তোমার ক্ষমতা নেই সন্তান জন্ম দেওয়ার! তাহলে তুমি কেনো স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করাতে দেবে না? ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে তো না কি? অথচ সমাজ কখনো এটা বলবে না
“তোমরা একটা অনাথ বাচ্চাকে দত্তক নাও। বাচ্চা মা-বাবা পাবে আর তোমরা সন্তান।”
তবে সমাজ এটা বলবে,
“কার না কার পাপ রক্ত! তার দরকার নাই ওসবের। ”
আরহার যেনো এমন কিছু শুনতে না হয় এ জন্য সরব আরহার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কারণ সমাজ আজো বড্ড সেকেলে।দোষ, অপমান সব তো আরহাকে করবে। একটা সন্তানের জন্য মেয়েটা কষ্ট পাবে আবার অপমান সহ্য করবে দায়ী না হওয়া স্বত্বেও।
আরহার জ্ঞান ফিরেছে। বৃন্ত বেশ রেগে আছে। পারলে ঠাটিয়ে চড় মারে আরহার দু গালে। এদিকে মনোয়ারা বেগম ছেলের বিরুদ্ধে গিয়েই আরহা কে সব সত্য বলে দেয়। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যায় সরব-আরহাকে একান্তে সময় দিয়ে।
সবটা শুনে আরহা হাত বাড়িয়ে দেয় সরবের দিকে। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আরহার পাশে বসে সরব।
সরবের বাম হাত জড়িয়ে কাধে মাথা রাখে আরহা। নাকের পানি, চোখের পানি এক করে বলল,
“তোমাকে বেস্ট অভিনেতার এওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ। এমন করলে কেনো? জানো আমার কতটা কষ্ট হয়েছে? মিথ্যেও বলেছো।”
সরব তখনো চুপচাপ। দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে। আরহা সরবকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দুহাতের আজলায় সরবের মুখ রেখে বলল,
“বাচ্চাই কি সব? আমার তো তুমি হলেই চলবে। আমি কখনো বাচ্চার কথা বলবো না। কারো বাচ্চা কোলেও নিবো না। কিন্তু তুমি প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিও না। আমি থাকতে পারবো না।”
“বেশ পারবে। প্রথম কয়েকদিন কষ্ট হলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে। স্বামী -সংসার সব হবে। ভালোভাবে হবে। আমার প্রতি দয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই। ”
“তুমি দয়া দেখানোর কিছু না। তাছাড়া তোমাকে নিয়েই বেশ আছি। সন্তান হবে না বলে আবার বিয়ে করতে হবে এটা কেমন কথা? আমরা দুজনে বেশ থাকতে পারবো। তাছাড়া একজন বাচ্চা দত্তক নিবো। যদি মা রাজি হয়। ”
“এখন এমন বলছো অথচ সকালে আমার জন্য পাত্রী দেখতে যেতে চেয়েছিলে।”
“সমাজে এক পুরুষ দুই স্ত্রী নিয়ে থাকতে পারে। আর তাছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে তুমি করলে আমি মেনে নিতাম ঠিক তবে হয়তো সম্পর্কের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতো। ”
“বাহ্! এটা খুব ভালো বলেছো । নিজের সমস্যা বলে স্বামীর বিয়ে করাতে দুবার চিন্তা করবে না অথচ স্বামীর সমস্যা বলে দয়া দেখিয়ে যাবে? ”
“যাবো তো। একশো বার যাবো। কারণ আমার অনুভবে প্রথম এবং শেষ পুরুষ তুমি। সদ্য ফোটানো নাকে চুমু দেওয়া পুরুষ তুমি। রক্তাক্ত মাখা ওড়না যত্ন করে রাখা পুরুষ তুমি। তুমি আমার অনুভবের সেই পুরুষ যার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি আটটি বছর অপেক্ষা করেছি। তবুও বলবে আমি দয়া করছি? বললে বলতে পারো। তবুও আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না। কারণ আমার অনুভূতি তুমি।”
আরহার কথায় উত্তর দেয়না সরব। যা বুঝানোর জন্য এত অভিনয় করলো হয়তো আরহা এবং পরিবারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে৷
দেখতে দেখতে দুমাস পার হয়ে যায়। আজ বৃন্তর ডেলিভারির ডেট। সি সেকশনে যেতে হয়েছে বাচ্চার পজিশনের জন্য। তাছাড়া টুইনস জন্ম দিয়েছে বৃন্ত৷
আরহা দূর থেকে দেখলো দুজন নার্স দুটো বাচ্চা কোলে নিয়ে আসছে।
ওদের কাছাকাছি আসতেই বৃন্তর স্বামীর কোলে একটা বাবুকে নার্স দিতে চাইলে বৃন্তর স্বামী সরে গিয়ে আরহাকে এগিয়ে দেয়।
বৃন্তর প্রথম সন্তান কে প্রথম আরহা কোলে নেয়৷
ছেলে বাবু! বেশ বড়সড় চোখে তাকিয়ে আছে। আরহা কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্য বাবু বৃন্তর স্বামীর কোলে।
আয়া খালারা এসে টাকা চাইছে কারণ একজোড়া রাজ পুত্র জন্ম নিয়েছে।
তাদের উদ্দেশ্যে বৃন্তর স্বামী বলল,
” এই নাও খালা! আমার ছেলের টাকা আমি দিলাম। বড় ছেলের জন্য টাকা বড় ছেলের বাবার কাছ থেকে নেবে বুঝলে। কম নিও না কিন্তু! ”
কথা বলেই সরবের দিকে ইশারা করে বৃন্তর স্বামী । আরহা ঠিক বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। কিন্তু এটাও বুঝতে বাকী নেই যে সন্তান জন্ম না দিয়েও আজ সে মা হতে চলেছে।
কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি ঝড়ছিলো মনোয়ারা বেগমের। মেয়ের জামাইয়ের মাথায় হাত রেখে অনবরত কেঁদেই চলেছেন তিনি।
মুখে হাসি টেনে বৃন্তর স্বামী বলল,
“আরহা আমার ছোট বোনের মতো। আর তাছাড়া আল্লাহ্ তো আমাদের দুটো দান করেছেন। আমি জানি, ভাইয়া-ভাবি আমাদের থেকে ভালোভাবে মানুষ করবে। আমাদের প্রথম সন্তান আমরা আরহাকে দিয়ে দিবো এমনটা দু মাস আগে থেকেই মনস্থির করেছিলাম। এমন তো নয় খুব দূরে দিচ্ছি! যখন তখন চাইলেই তো কাছে পাবো।”
শেষ কথাগুলো বলার সময় গলা ধরে আসে ভদ্রলোকের। সরব এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বোন জামাইকে।
মুচকি হেসে ভদ্রলোক নিজেও আবদ্ধ হয় গভীর আলিংগনে।
“আমি এ ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না ভাই। ধন্যবাদ দিয়েও ছোট করবো না। ”
” এটা আপনার উপহার ভাই। আরহার ভাইয়ের পক্ষ থেকে উপহার। আপনি আমার বোনের জন্য যা করেছেন আমি কিন্তু সবটা জানি। ভয় নেই। তৃতীয় ব্যক্তি কখনো জানবে না। তবে এর বিনিময়ে আপনাকে কথা দিতে হবে। আপনি কখনো আমার বোনকে ছাড়বেন না। কখনো কষ্ট দিবেন না। ”
শক্ত করে ভদ্রলোকের দুহাত ধরর সরব বলল,
” কথা দিলাম ভাই। কথা দিলাম।”
ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে আরহার দিন ইদানীং কিভাবে পার হয়ে যায় আরহা নিজেও বুঝে না৷ প্রথম কয়েকদিন বৃন্ত এ বাসায় ছিলো। আরহা তখন সারাদিন দুই বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। নন-আইডেন্টিক্যাল টুইনস দুই ছেলে।দুটোই পুরো কিউটের ফ্যাক্টরি। এত কিউটনেস কোথায় পায় কে জানে? মাস খানেক পর বৃন্ত চলে যায় নিজের বাসায়। নিজের সন্তানকে এভাবে রেখে যাওয়া যে কতটা কষ্টের সেদিন হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলো বৃন্ত। তবুও আরহার দিকে তাকিয়ে যখন ওর মুখের হাসি দেখে!
কষ্ট যেনো কর্পূরের মতো উবে যায়।
আজ সরব আরহা বাবুকে টিকা দিতে নিয়ে এসেছে৷ দেড় মাস চলছে। তাই নিয়মিত টিকা দিতে তো হবেই।
টিকা দিয়ে ফিরে আসছিলো ঠিক তখন একজন ডক্টর বাচ্চাদের ওয়ার্ডে প্রবেশ করে।
দম্পতিকে চিনতে অসুবিধে হয় না ডক্টরের। তবে কি তারা বাচ্চা এডপ্ট করেছে? কথা বলতে চাইলে সরব ইশারায় না করে। কিছুক্ষণ পর আসছি বলে চলে যায়।
আরহাকে হাসপাতালের রিসিপশনের ওয়েটিং সিটে বসিয়ে রেখে সরব পা বাড়ায় ডক্টরের কেবিনে।
ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসার পর একজন মহিলা জিজ্ঞেস করে উনি কেনো এভাবে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন।
ডক্টর হেসে জবাব দেয়,
“ক্যারিয়ার জীবনে অনেক পুরুষ দেখেছি সন্তান জন্ম না দিতে পারায় স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু উনি আমার লাইফে দেখা প্রথম পুরুষ যে কি না স্ত্রীর অক্ষমতার কারণ পুরো পৃথিবীর কাছে লুকিয়ে ভুল রিপোর্ট বানিয়ে নিজের অক্ষমতা আছে বলে বেড়াচ্ছেন। শুধু মাত্র তার স্ত্রীকে বন্ধ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি দিতে। সত্যি! পুরুষ জাতি এক অনন্য সৃষ্টি। কারণ কাপুরষ তো কখনো পুরুষদের কাতারেই পড়ে না৷”
ধীর গতিতে রিক্সা চলছে৷ আরহার কোলে বাবু৷ সরবের বাম হাত প্যাচিয়ে আছে আরহার কোমর।
মেয়েটার রিক্সার ভীতি এখনো গেলো না। তাতে কি? রিক্সার ভীতি থাকলে হয়তো এভাবে বসা হতো না। আরহাকে যখন বাবুর সাথে কথা বলতে দেখে সরব তখন মনে হয় তার সামান্য মিথ্যের কারনে চারপাশ শুভ্র স্পর্শে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সমাপ্ত।
#ছবিয়ালঃআয়াত