#শুভ্র_স্পর্শ
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ৩
সেরাতে খাবার টেবিলে সরব যেনো এক নিস্তব্ধতায় মোড়া মানব। কারো কোন কথা কান অবধি পৌঁছালেও মস্তিষ্কে স্পর্শ করছে না৷
কিন্তু এদিকে মনোয়ারা বেগম, বৃন্ত তো আরহা নাম জপেই যাচ্ছে।
কোন ভাবে কিছু খেয়ে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সরব।
আরহাকে প্রথম দেখেছিলো যেদিন সেদিন গুলুমুলু একটা মেয়ে হাতে আইসক্রিম। পিচ্চি মেয়ে বাবার কোলে ছিলো। আদর করার ছলে এক আন্টি চুলে হাত দিয়েছিলো বলে সে কি কান্না!
ক্লাস ওয়ান-টু তে পড়তো হয়তো মেয়েটা। স্বাভাবিক বাচ্চারা যেমন হয় তেমন ছিলো কিন্তু অসুস্থ, দরিদ্রের প্রতি আরহার বিশেষ টান ছিলো। প্রায় সময় সরব দেখতো নিজের ভাগের টিফিনের টাকা হয়তো কাউকে দিয়ে দিচ্ছে কিংবা রাস্তার কুকুরকে কিছু কিনে খেতে দিচ্ছে।তবে ভালোবাসা বলতে তখন কিছুই ছিলো না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরহা যখন ক্লাস সেভেনে উঠলো তখন সরবের সামনে এইচ এস সি এক্সাম। একদিন সকাল বেলা বাসায় চিৎকারে টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছিলো। দরজা লাগিয়ে সরব পড়তে বসেছে, যদি চিৎকারের শব্দ কম আসে আরকি। কিন্তু হলো বিপরীত! কেউ একজন দরজায় অনবরত আঘাত করে চলেছে।দরজা খুলে দিতেই দু-চারটে কিল সরাসরি এসে সরবের বুকে লাগতেই সামনের ব্যক্তির বোধ শক্তি উদয় হলো। দুচোখে দুটি প্রশান্ত সাগর নিয়ে হাত দিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে সরবের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় আরহা।
কান্না থামছেই না। ঘটনার আকস্মিকতায় সরব নিজেকে চুপচাপ কয়েক মূহুর্ত সময় দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে সামনে এগিয়ে যায় আরহার দিকে।
“কাঁদছিস কেনো? ”
অপর পাশ থেকে কান্না ব্যতীত কোন উত্তর আসছে না দেখে সরব জোরে ধমক দিলে আরহা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে নিজের নাকের বা দিকে ইশারা করে দেখায়।
লাল হয়ে আছে নাকের বা পাশে। ছোট্ট একটা সাদা সুতো ঝুলছে।
“নাক বিধিয়েছিস? ”
” আমি বিধাতে চাই নি।আম্মো,আন্টি উনারা জোর করে……. ”
কথা শেষ করবে কি? মেয়েতো কেঁদেই অস্থির। সরব এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। কিন্তু সে কিছুতেই খাবে না। যখন রুমের দরজা খুলতে যাচ্ছিলো সরব, আরহা দৌড়ে গিয়ে বাধা দেয়। কারণ এখনো না কি কান বিধানো বাকী আর সে কান বিধাবে না। আর সরব বা অন্য কেউ জোড় করলে বাসা থেকে চলে যাবে। দরজার ওপাশ থেকে মনোয়ারা বেগম, আরহার মা সব শুনে সরব কে বলে আরহা কে একটু দেখে রাখতে। কিছু লাগলে দিতে, তবে কোথাও যেনো না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলে চলে যায়।
ড্রয়ার থেকে নাপা বের করে একদম আরহাকে খাইয়ে দেয় সরব। এদিকে আরহা কান্না করছিলো ব্যথায়, নাক দিয়ে পানি পড়ছিলো হঠাৎ যখন নাকের পানি মুছতে যায়, নাকের বা পাশে লেগে ব্যথায় চিৎকার করে উঠে আরহা।
“কান্না করলে নাক দিয়ে পানি পড়বে স্বাভাবিক। কিন্তু আর এক ফোটা পানি নাক দিয়ে পড়লে খবর আছে। চোখ দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলে ফেলতে পারিস কিন্তু নাক দিয়ে পানি পড়লে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
সরবের এমন হুমকিতে আরহা চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পর সরবের স্টাডি টেবিল থেকে ‘মীর মশাররফ হোসেন’ এর ‘লিখা বিষাদ সিন্ধু ‘ নিয়ে পড়তে লাগলো আরহা।
সরব তখন ক্যালকুলাসে ডুব দিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর যখন সরবের মনে হলো এরুমে আরহা নামের কোন প্রাণী আছে! ততক্ষণে আরহা ঘুমের সাগরে ডুব দিয়েছে।
এলোমেলো আরহার বুকের উপর থেকে বই সরিয়ে মাথার নিচে বালিশ ঠিক করে গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয় সরব। নাক টা হালকা ফুলেছে।
জীবনের আঠারো তম বছরের এক হাড় কাপানো শীতের দুপুরে সরব নিজেকে বড্ড তৃষ্ণার্ত অনুভব করলো। মস্তিষ্কের নিউরন গুলো দ্রুত সংকেত পাঠাচ্ছিলো। বুকের ভিতর অদ্ভুত অনুভূতি। সেই অনুভূতির পথে হেটেই সরব ছোট ছোট অনুভূতিতে ভরিয়ে দিয়েছিলো আরহার নাকের বা পাশে সদ্য বিধানো অংশ।
সেদিনের পর থেকে আরহা নামের মানে হয়তো পাল্টেছিলো। কারণে অকারণে দেখতে ভালো লাগতো। কিন্তু এক্সামের জন্য এত সময় হয়ে উঠতো না। তারপর আটমাস পর আরহা যেদিন ব্যথা পেলো সেদিন ছিলো শেষ দেখা। আরহাকে নিয়ে ফিরে এসেই দ্রুত নানুবাড়ি যেতে হয় সরবদের৷ পনেরোদিন পর যখন ফিরে এসেছিলো, এসে জানতে পারলো আরহারা চলে গিয়েছে। তারপর দীর্ঘ আট বছর পর সামনে এসেছে আরহা।
আরহার স্মৃতিগুলো বাক্সে বন্দী ছিলো এতকাল।ওর চুলের কাটা, একটা দুল, ভাঙা নাকফুল সাথে রক্তে মাখানো ওড়না।সবার আড়ালে লুকিয়ে-চুরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সরব।
প্রথম টিউশনির পুরো টাকা আজও গচ্ছিত আছে সরবের আলমিরার ড্রয়ারে আরহার জন্য। আচ্ছা? এটা কি শুধুই ভালোবাসা ছিলো না কি আবেগ?
দিন কয়েক খুব অস্থিরতায় কাটলো আরহার। হঠাৎ একদিন নিমন্ত্রণ এলো সরবদের বাসা থেকে। আরহার বাবা নিমন্ত্রণ রাখলেন। শুক্রবারের সকালে আরহার পরিবার উপস্থিত হলো সরবদের বাসায়৷
আরহা যেদিন ব্যথা পায় সেদিন সরবের বড় মামী আত্নহত্যা করে। তাই দ্রুত তারা চলে গিয়েছিলো। বড়ভাবীর কথা বলে বেশ আক্ষেপ করলেন সবাই। কিন্তু আত্নহত্যা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। বৃন্তর স্বামীর সাথে পরিচিত হয় আরহার পরিবার। বেশ ভালো,ভদ্র ছেলে বৃন্তর স্বামী।
পুরোদিন বেশ আমেজে কাটিয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো বিকেলে পাশের রিসোর্টে যাবে।
পুরো রাস্তায় আরহার মা আফসোস করছিলো। আসলে সরবদের পরিবার যেদিন নানুবাড়ি যায় তার কয়েকদিন পর হঠাৎ আরহার বাবার ইমারজেন্সী ট্রান্সফার হয়, দুদিনের মধ্যে শিফট খুলনায়। যাওয়ার পথে আরহার মায়ের ফোন হারিয়ে যায়। তাই যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
সবাই রিক্সায় করে যাচ্ছিলো। কিন্তু মনোয়ারা বেগম সরবকে বলল,
আরহা কে নিয়ে বাইকে আসতে। কারণ আরহার রিক্সায় প্রচন্ড ভয়। বেচারি মেয়েটা যখন রিক্সায় উঠে তখন কিছু না কিছু হবেই।
সবাই চলে যাওয়ার পর আরহা সরবের বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুটা অস্বস্তি দেখে সরব জিজ্ঞেস করল,
“কোন সমস্যা?”
ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুখে হাসি টেনে মাথা দুপাশে দুলিয়ে আরহা বলল,
“না!”
উঠে বসতেই সরব বেশ বুঝতে পারলো আরহা প্রথম বার বাইকে উঠছে। মুচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“প্রথম বার? ”
“হ্যাঁ!”
“কেনো? ”
“কার বাইকে উঠবো? এতটা স্পেশাল কারো লাইফে হয়ে উঠিনি। তাই….. ”
“উমম! বাট ম্যাম, ইউ আর স্পেশাল. ইউ নো হোয়াই? ইউ আর দি ফার্স্ট গার্ল টু সিট অন দি ব্যাক অফ মাই বাইক।”
“মানে?”
” মানে কিছুই না। কাইন্ডি একটু ধরে বসিয়েন। পড়ে গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ”
বেশ উপভোগ করছিলো আরহা সরবের সঙ্গ। নীরবতা কাটিয়ে আরহা জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার বড় মামী মারা গেলো কিভাবে? ”
“আত্নহত্যা করেছিলো।”
“কেনো?”
“একটা সন্তান জন্ম না দিতে পারার অক্ষমতার কারণে, দিন শেষে মামার অবহেলার কারণে,বন্ধ্যা-অলক্ষী অপবাদ খন্ডাতে……..
চলবে
#ছবিয়ালঃআর্থ