কিছুক্ষণ পূর্বে আমার স্বামী আমার জন্য লাল সাদা মিশেলে একটা শাড়ি কিনে এনেছেন। নিজ হাতে আমাকে শাড়িটা দিয়েছেন উনি। কারণ? কারণ আজ আমার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।
বিষয়টা বড়ই হাস্যকর হলেও এটাই সত্য।
এখন উনি আশা করছেন আমি উনার কথা মতন যেন তৈরী হয়ে বিকেলে পাত্র পক্ষের সামনে যাই।
একশ্বাসে কথাগুলো গড়গড় করে বলল আরহা। মুঠোফোনের অপর পাশে থেকে কি জবাব এলো শুনতে পাওয়া গেলো না। কারণ ইতিমধ্যে সরব রুমে প্রবেশ করেছে।
আরহার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সরব।
পুরো রুমের ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগে কেনা শাড়ির টুকরো। কিন্তু এমন শাড়ি তো আরহার বেশ পছন্দের।
“আমলকি! এসব কি? কিছুক্ষণ পর উনারা চলে আসবে। আর তুমি শাড়ি কেটে ফেলেছ কেনো? আচ্ছা বাদ দাও। তাহলে না হয় এই কালো শাড়িটা পড়ে নাও। ”
রাগে ক্ষোভে আরহার দুচোখের পানি অনবরত পড়ছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আরহা শক্ত হাতে সরবের কলার চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“ফাজলামো পাইছেন? এসব কি? না কি আপনি আমার সাথে নিছক তামাশা করতেছেন? যদি তামাশা করে থাকেন তাহলে আমি বলে দিচ্ছি এখন এসব বন্ধ করুন। না হলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। ”
সরব মুচকি হেসে আরহাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“ভালোবাসার টানপোড়ন চলছে প্রিয়তা। নিজে অসুখী থেকেও যে ভালোবাসার মানুষকে সর্বচ্চো সুখী দেখতে চায় সেই তো প্রকৃত প্রেমিক।”
“মানে?হেয়ালি করবেন না স্পষ্ট করে বলুন।”
“প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কিছু স্বপ্ন কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে। যখন সে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে বরাবর শূন্য হতে থাকে তখন বাধ্য হয়েই ছাড়তে হয় প্রিয় মানুষের হাত। আমার একজন সন্তান চাই। ”
“ডক্টর রিপোর্ট দিয়েছেন? রিপোর্টে কি এসেছে? ওয়েট, আমি ইনফার্টিল তাই তো? ”
সরবের দৃষ্টি এতক্ষণ বাহিরে থাকলেও এখন স্থির দৃষ্টি আরহার দিকে। শেষ কথা বলার সময় আরহার স্বর অস্পষ্ট। কোন ভাবে নিজেকে সামলে সে বিছানার এক পাশে নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছিলো।
সরব বেশ করে চাইছে আরহা কে সামলাতে, শক্ত হাত এগিয়ে দিতে কিন্তু এ সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে আমাদের নিয়তি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে না, যেখানে আমরা নিয়তির হাতে সবাই নিছক খেলনা বৈ কিছুই নই।
“তুমি নারী। নিজের ক্ষমতা, অক্ষমতার কথা নিজেই ভালো জানবে হয়তো। কিন্তু আমার সন্তান চাই আমলকি।
“ডক্টর কনফার্ম করেছেন?যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আপনি বিয়ে করতে পারেন। আমি অনুমতি দিলাম। কিন্তু এসব বলবেন না। ”
“তুমি আমার দায়িত্ব। প্রথমে তোমাকে সুখী দেখতে চাই। কিন্তু হ্যাঁ আমি এটাও চাই আমার একজন সন্তান থাকুক। প্রতিটি মেয়ের মতন প্রতিটি ছেলের সুপ্ত ইচ্ছে থাকে একদিন তার অংশ পৃথিবীতে আসবে। সবাই তখন সন্তানের বাবা বলে ডাকবে। বৃদ্ধ বয়সে অবলম্বন হবে। আমিও তাই চাইছি কিন্তু এর বিনিময়ে আমি তোমার সুখ কে নিলামে উঠাতে পারবো না। ”
“সমস্যা আমার হলে বিয়ে আমাকে কেনো দিবেন? আপনি বিয়ে করে নিন৷ আমার কথা আপনার না ভাবলেও চলবে। ”
“তুমি বুঝতে পারছো না কেনো? এভাবে হয় না।”
নিভে যাওয়া প্রদীপের শিখা হঠাৎ ঘি পেলে যেভাবে জ্বলে উঠে ঠিক সেভাবে জ্বলে উঠলো। দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলল,
“আজ আপনি রিপোর্ট পেলেন,জানতে পারলেন আমি মা হতে পারবো না আর আপনি এক বেলার মধ্যে আমার জন্য পাত্র ঠিক করে ফেললেন? আপনাকে সন্তান দিতে পারবে এমন কাউকে বিয়ে করে আনলেই তো হয়। আমাকে নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেনো দেখাচ্ছেন? আপনার সমস্যা তো আমি তাই না? আমি থাকলে আপনার সমস্যা হবে এটাই তো? আমি চলে যাবো কিন্তু আপনি এখন এখান থেকে চলে যান। আপনার মুখ আমি দেখতে চাই না। আল্লাহ্ তালার কাছে প্রার্থনা করুন যেনো আমার মুখ আপনাকে আর দেখতে না হয়। তবুও আল্লাহ্ তালার দোহাই আমার উপর এমন মানসিক অত্যাচার বন্ধ করুন। না হলে আমি আত্নহত্যা করতেও দুবার চিন্তা করব না। ”
এ পর্যায়ে আরহা ধাক্কাতে ধাক্কাতে সরবকে রুম থেকে বের করে দেয়। রুমের দরজা আটকে দিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো আরহা।
সরবের চোখ মুখে তখন অপমানে ছাপ স্পষ্ট।শক্ত চোয়ালে বেশ দৃঢ় কন্ঠে দরজার ওপাশে থাকা আরহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ঠিক নয়টা। নয়টার সময় পাত্র পক্ষ আসবে। তৈরী হয়ে থাকবে। না হলে আমার থেকে আর কেউ খারাপ হবে না। আশকারা পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছো। যত্তসব! ”
এতক্ষণ চুপচাপ ছেলে, ছেলের বউয়ের সব দেখছিল মনোয়ারা বেগম। কি হয়েছে, কেনো এমন করছে কিছুই জানে না উনি।আজ সকালেও তো সব ঠিক ছিলো। তবে এখন কি হলো। আরহা তো এমন মেয়ে নয়, অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। সরবের কোন কথার অমান্য করে না। ঝগড়াঝাটি তো অনেক দূরের কথা। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের মধ্যে কখনো মনোমালিন্য হয় নি। আজ কি হলো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরহার রুমের দিকে এগুলো মনোয়ারা বেগম। দরজার ওপাশে আরহার গোঙানির শব্দ স্পষ্টত্ব শুনতে পাচ্ছেন। দ্রুত চাবির গোছা এনে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে দেখলেন
আরহা ফ্লোরে পড়ে আছে। অজানা আশংকায় মন কুকুড়ে যাচ্ছিলো। তবে কি সরব মেয়েটাকে মেরেছে।
মাথায় কারো স্পর্শে চোখ মেলে তাকিয়ে আরহা আবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। কোন ভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে বলল,
“মা! আমি কখনো মা হতে পারবো না। বিধাতা আমাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। তাই বলে কি তোমার ছেলে আমাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে পারে? সমস্যা যেহেতু আমার তাহলে উনি বিয়ে করলেই তো পারে। আমি না হয় শুধু নাম মাত্র স্ত্রী রইলাম। কিন্তু উনি আমাকে বিয়ে দিতে চাইছে কেনো? আমার কি দোষ?”
আরহার কথা তেমন একটা বুঝতে পারলো না মনোয়ারা বেগম।আলগোছে আরহার শাড়ির আচঁল টেনে দিয়ে রুম থেকে বের করে এনে নিজের রুমে নিয়ে আসে। মস্তিষ্কে শুধু একটা কথায় চলছে। আরহা মা হতে পারবে না তাহলে সরব তাকে কেনো বিয়ে দিতে চাইছে?
খুব সযত্নে নিজের রুমেই আরহা কে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো মনোয়ারা বেগম। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় সরব ফিরে এলো। হাতে রিপোর্ট নিয়ে। বসার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আরো একবার চোখ বুলালো রিপোর্টে। না কোন ভুল নেই। সব সত্যি৷ কিছুক্ষণ পর পা বাড়ায় রুমের উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলো আরহা হয়তো রুমের দরজা আটকে রাখবে কিন্তু দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। রুমে আরহা নেই।
একরাশ ভয়ের মেঘ জমেছে মনে, হয়তো এক্ষুণি বৃষ্টি হয়ে ঝড়ঝড়িয়ে পড়বে দু-চোখ দিয়ে কিন্তু নিজেকে কিভাবে সামলাতে হয় সরব জানে।
“আরহা আমার রুমে। ”
মায়ের কথায় পিছন ফেরে সরব। সরব এহসান, মরহুম ওসমান এহসান এবং মনোয়ারা বেগমের একমাত্র ছেলে। সরবের বোন বৃন্ত এহসান। দুই ছেলে মেয়ে ছিল। বছর চারেক আগে বিয়ে দিয়েছে।বৃন্তর বিয়ের পর নতুন এক ছেলেকে পেয়েছেন ঠিক তেমনি আরহা উনার আরেক মেয়ে। বৃন্তর বিয়ের পর ওসমান সাহেবের মস্তিষ্কে পানি জমতে শুরু করে।খুব বেশি সময় ছিল না উনার হাতে। তাই দ্রুত সে ছেলের বউ নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আরহা উনার পছন্দ করা বউ। মনোয়ারা বেগমের কাছে তার স্বামীর শেষ আমানত। আরহা কে সে পুত্রবধূ নয় মেয়ে হিসেবেই মানে। আর সেই মেয়ের সাথে তার ছেলে এমন কেনো করছে সে কৈফিয়ত নিতেই এখানে দাঁড়িয়েছে মনোয়ারা বেগম।
“তৈরী হতে বলো মা! কারণ পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। ”
সরবের এমন কথায় মনোয়ারা বেগম সজোরে থাপ্পড় মারে সরবের গালে।
“লজ্জা করে না? এ শিক্ষা তোমার বাবা তোমাকে দিয়েছে? তুমি সাহস কি করে পাও আরহা কে এসব বলতে?
” কারণ তোমার ছেলে অক্ষম। পারবে না কখনো ওর শূন্য কোলে একটা ফুটফুটে সন্তান দিতে। তোমার ছেলেকে সে ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দেয়নি। ”
মনোয়ারা বেগম করুণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“একবার তুমি বলছো তুমি বাবা হতে পারবে না, আবার আরহা বলছে আরহা মা হতে পারবে না। কি হচ্ছেটা কি আমাকে একটু স্পষ্ট করে বলবে? ”
হাতে থাকা রিপোর্ট মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে সরব বলল,
“আরহা কে মিথ্যে বলেছি মা। ও যদি জানতে পারে অক্ষমতা আমার তাহলে ও আমাকে ছাড়বে না। সারাজীবন একটা সন্তানের জন্য এভাবে কষ্ট পাবে সমাজের মানুষ কথা শোনাবে আমি এসব মেনে নিতে পারবো না। মা তোমার কাছে অনুরোধ তুমি এসব আরহা কে বলবে না। আমিও চাই আমার প্রিয়তা সুখী হবে। তাইতো এসব। তুমি হয়তো বলবে এ কেমন পাগলামো! তাই না? হয়তো জীবনের কোন একদিন ও জানতে পারবে আজ যা হচ্ছে সব মিথ্যে। কিন্তু সেদিন আফসোস থাকবে না। কারণ ওর তখন নিজের সন্তান থাকবে। এ সমাজ কখনো দেখবে না সমস্যা বা অক্ষমতা কার, সমাজ কথা তো শোনাবে আরহা কে। আমি চাই আরহা আজকের ব্যবহারের জন্য আমাকে ঘৃণা করুক, জেদ করুক, জেদ করে আত্নসম্মানের বসে বেরিয়ে যাক এ বাসা থেকে। নিজের জীবন নতুন করে গুছিয়ে নিতে পারবে এটা আমার বিশ্বাস। আমি চাই আরহা যেনো পৃথিবীর সব থেকে মিষ্টি অনুভূতি শুভ্র স্পর্শ অনুভব করতে পারে। আমার সেই ক্ষমতা নেই বলে কি আমি আরহার অংশের সুখ, অনুভূতি নিলামে তুলতে পারি? পারি না মা। তোমার ছেলেটা বড্ড স্বার্থপর। সে তার স্বার্থের জন্যই এসব করছে। ”
চলবে
#শুভ্র_স্পর্শ
#সৌরভে_সুবাসিনী (moon)
#পর্বঃ১
#ছবিয়ালঃআপন