ভাবীর সংসার
৮ম পর্ব।
রাহেলা বেগমের স্বর্ণের একটা বালা ছিল, সেই বালা আজ বিক্রি করে, বিয়ের দিনের খাবারের বন্দোবস্ত করলেন । জামাইয়ের জন্য সামান্য কিছু বাজার, আর জলির জন্য দুটি সুতির শাড়িও কিনলেন। মেয়েটার সাথে দুটি নতুন শাড়ী তো যাওয়া দরকার। সাঈদ বলেছেন আসার সময় তিনি দই-মিষ্টি নিয়ে আসবেন, তারই অপেক্ষা করছেন তিনি।
কলি বিয়ের দুই দিন আগে থেকে, একটা নতুন শাড়ি কেনার জন্য কান্নাকাটি করছে, কিন্তু রাহেলা বেগমের কাছে অবশিষ্ট কিছুই নেই, যে তিনি কলি কে কিছু কিনে দিবেন। শেষ পর্যন্ত জাহিদ দুইটা মেহেদী, লিপিস্টিক আর এক ডজন কাচের চুড়ি দেওয়ায় কিছুটা খুশি হয়েছে কলি।
বিয়ের আগের দিন জলির মামা শ্বশুর একটা ট্রাংক দিয়ে গেলেন, সাথে পাঁচ কেজী মিষ্টি। তিনি খুবই সাদাসিধা ধরনের।
রাহেলা খানম কে বললেন, বেয়ান আমার বোনের সংসারে মেয়েকে শক্ত করে দিবেন, কারণ অত্যন্ত টানাটানি করে চলতে হবে। তারেকের বেতন খুবই নিতান্ত, আমিও একজন কেরানী মানুষ, তাই ভাগ্নাকে তেমন সাহায্য করতে পারিনা। আর কিছুই বললেন না তিনি। এক গ্লাস লেবুর শরবত মুখে নিয়েই তিনি বিদায় হলেন।
কলি-পলি খুব হাসাহাসি করছে ট্রাংক দেখে। তবুও বেশ আগ্রহ করে, দুইবোন ট্রাংক খুললো।
খুলে একে বারেই হতাশ হয়ে গেল, তিনটা শাড়ী এসেছে,বিয়ের শাড়ীটি লাল টাংগাইলের শাড়ি, জরি সুতার কাজ করা, খুবই কমদামি শাড়ী। বাকি দুটি প্রিন্টের শাড়ি, এক জোড়া কালো ফিতার স্যান্ডেল, একটা রুমাল। শাড়ীর সাথে ব্লাউজ আর ছায়া। বিউটি বক্সে পাউডার, লিপিস্টিক, কাজল, আর আলতা, একটা সোনালী রঙের রঙ করা টিকলি, এক জোড়া চুড়ি, আর একটি চেইন। আর সরিষার দানার মতো ছোট্ট একটা স্বর্ণের নাক ফুল।
পলি আর কলির খুব মন খারাপ হলো এই জিনিস গুলো দেখে, তাদের ভাবীর বিয়ের বেনারসী ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও দামী, এক সেট স্বর্ণের গহনা ছিল। ভাইজান তার তিন শালীর জন্য উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু জলিপার এই কেমন পরিবারে বিয়ে হচ্ছে, দুই শালীর জন্য কিছুই নাই এমন কি বিয়ের শাড়ীটা এমন হালকা, দেখেই কেম যেন লাগছে!
জলি তবুও খুশি, বিয়ে তো হচ্ছে! কমদামি হোক তবুও নতুন জিনিস তো দিয়েছে।
রাহেলা বেগম বারান্দার খুঁটি ধরে বসে জাহিদ কে বলছেন, বাবা তোমরা আমার মেয়েকে কোথায় বিয়ে ঠিক করেছো? আজ থেকে পয়তাল্লিশ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে, তোমার স্কুল শিক্ষক বাবা, তখনই মদলিন শাড়ী বিয়েতে দিয়েছিলেন, তোর দাদীমা দুই সেট গহনা দিয়েছিলেন। আর এই মেয়ের কোথায় বিয়ে হচ্ছে বাবা?
– আমি তো মা, প্রথমেই তেমন পছন্দ করিনি, তুমি…
– থাক, আর কথা না। ওর সামনে কিছু বলিস না, কষ্ট পাবে। আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছেন। তাই হবে….
রাহেলা বেগম বিয়ের দিনের চিন্তা করছেন সব কিছু ঠিকঠাক হবে তো?ছেলেটা ভালো হবে তো? মেয়েকে সুখী রাখবে তো? সাঈদ কখন আসবে, দই মিষ্টি নিয়ে!
বড় যাত্রী আসলেন সব মিলিয়ে পনেরো জন। তারেক দেখতে ফর্সা, লম্বা, চেহারা ও খুব সুন্দর। কিন্তু ততো টা স্মার্ট নয়। সাদা একটা পাঞ্জাবি পরেছে সাথে ঘিয়া রঙের পাগড়ী।
কলি জামাই দেখে এসে বললো, আপা, শেরোওয়ানী ছাড়া বিয়ে করতে চলে এসেছে! কি আজব। শুনেছি আব্বাও নাকি শেরোওয়ানি পরেও বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।
– তুই চুপ থাক, দয়া করে। দেখতে খারাপ না, এটা নিয়ে শান্তিতে থাক।
সাঈদ বড় যাত্রীর আসার কিছুক্ষণ আগে বাড়ীতে এসেছেন, দই মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। শারমিনের দুটি পুরোনো শাড়ি, জলির জন্য। জলি তাতেই বেশ খুশি।
বর যাত্রী সবাই, খুবই নরমাল পোষাকে এসেছে,মনে হচ্ছেনা, বিয়ে বাড়ী এসেছে।
এই লাল টাংগাইল শাড়ীতে জলিকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। শ্যানলা হলেও চোখ দুটি ভীষন মায়াবী। বিয়ে নিয়ে জলির কোন অভিযোগ নেই, বিয়ে হচ্ছে তাতেই সে খুশি। কারণ এই কয়েক বছরে আত্নীয় স্বজন আর পরিবারের মানুষের কথা শুনতে শুনতে এক্কে বারে নাজেহাল অবস্থা জলির। তাই, বিয়ে হচ্ছে এটা নিয়েই খুশি জলি।
রাহেলা খানম, সাঈদ যে ডেকে বললেন বাবা, এদের সংসারে আমার মেয়ে থাকতে পারবে তো?
– মা, জা্হান যদি সুন্দরী শিক্ষিত ধনী হয়েও আমার মতো গরীব ছেলেকে মানতে পারে৷ তবে এরা কেন পারবেনা?
– না, সেটা বলিনি বাবা। জামাই একটু সুন্দর হয়ে আসার দরকার ছিল না?
– কিসের সুন্দর, জলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাই আলহামদুলিল্লাহ বলো। এখনো পলি আর কলি বাকী।
– বউ কেমন আছে?
– আছে ভালো। আমি জলিকে বিদায় দিয়েই, রওনা হবো। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করো।
– আজ থেকে যাও বাবা।
– কত ঝামেলা ফেলে আসছি মা, সেটা আমিই শুধু এখন থাকতে পারবো৷ না!
বিদায় বেলা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছে জলি। সে সারাদিন মায়ের সাথে সাথে থেকে সব কাজ করতো। মায়ের সাথে তারা অন্য রকম এক প্রশান্তির সম্পর্ক আছে।
রাহেলা খানমের মেয়ে বিদায়ের পর,চিন্তায় পাগল পাগল লাগছে! তার বুকের ভিতরে যেন ঝড় বইছে। ভেতর যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
কলি আর পলির মন খুব খারাপ হয়ে আছে। কোন প্রকার আনন্দ ছাড়াই এই বাড়ীর বড় কন্যার বিয়ে হয়ে গেল, ভাবা যায়!
যাওয়ার সময় তারেকের মামা, পরের দিন তারেকের বাড়ী যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে গেলেন, পুরো পরিবার কে।
সাঈদ যাওয়ার আগে মাকে ডেকে বললো, সব সময় মা, সাঈদ সাঈদ করো। তোমার পলির জন্য কেমন ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসলো, ছেলের বউ আছে বলে সে রাজী হয়নি।
– না বাবা, এটা ভালো করেছে। বউ আছে সংসারে, তাহলে কেন বিয়ে দিবে? আমার এরকম জামাই পছন্দ না।
– এজন্য বলেছি, আমি তোমার পলির বিয়েতে আর নাই।
– রাগ কর কেন বাবা? ওরা তোমারই বোন।
– রাগ করছিনা, আমি যাচ্ছি। আর এই এক হাজার টাকা রাখো, কাল মিষ্টি নিয়ে দাওয়াতে যেও, আমি আজ যাই।
– সাবধানে যেও, গঞ্জে একটা ফোন দিও, শাহিদ কে রাতে পাঠাবো।
– তুমি সাবধানে থাকবে, আসছি।
কলি মায়ের পাশে এসে বললো, মা, দুলাভাই এমন কিপটা গেইটে মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়েছে।
– থাক, এসব নিয়ে কথা বলার দরকার নাই।
– কাল কে কি সব যাবো আমরা?
– কাল আসুক, দেখি। আমারে একটু তেল আর পানি মিক্স করে মাথায় দিয়ে দেয়, শরীর টা ভালো লাগছেনা।
– লেবুর শরবত দিব?
– না। তেল-পানি নিয়ে আয়।
রাহেলা খানমের চিন্তায় কিছুই ভালো লাগছেনা, এই সহজ সরল মেয়েটা এই ঘরে গিয়ে সুখী হবে তো! জামাই কি তাকে সুখী করবে!
তিনি বার বার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন আর মনে মনে বলছেন সাঈদের আব্বা এই ভবের সংসারে, আমাকে একলা রেখে কেন চলে গেলে? আমি যে আর পারছিনা! আমার মেয়ের চিন্তায় কিছই ভালো লাগছেনা, কাকে কি বলবো, সবই আমার পোড়া কপাল। আল্লাহ মেয়েকে সুখী করুন, আর কিছু চাওয়ার নাই…..
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী
–