#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী (মেহু)
#পর্ব_এগারো
-আমার মায়ের লোভ আজ তোমাকে আমার থেকে আলাদা করে দিলো। অবশ্য আমার দোষ সবার থেকে বেশি আমি আমার মাকে অন্ধ বিশ্বাস করেছিলাম। আমার চোখ থাকতেও আমি অন্ধের মতো সত্যি-মিথ্যা যাচাই না করে তোমাকে প’শু’র মতো অত্যা’চা’র করে গেছি। শুধু তুমি না কোনো মেয়েই আমার মতো কা-পুরুষ এর সাথে থাকতে চাইবে না…….
বলেই জায়ান হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলো। ইরা বেগম দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ছেলের এই অবস্থা দেখে নিরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রুমের দিকে পা বাড়ালো। কিছুক্ষন আগেই থানা থেকে ফোন করে জায়ান কে বলা হয়েছে জেমির ক্ষতি করতে চাওয়ায় মায়াকে তারা এরেস্ট করেছেন। আর জেমি নিজে মায়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে মায়ার শাস্তির আবেদন করেছে। জায়ান এইবার খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে জেমি জায়ান কে ছেড়ে চলে গেছে। জায়ান কাঁদছে হয়তো এতদিন জেমির উপর করা অন্যায়ের শাস্তি আজ জায়ান পাচ্ছে। জেমি শাস্তি পেয়েছিলো শারীরিক আর জায়ান পাচ্ছে মানসিক শাস্তি। মানসিক যন্ত্রনার চাইতে বিষাক্ত যন্ত্রনা বোধহয় অন্য কিছুহতে পারে না। জায়ান কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় বললো…
–তোমাকে ভালোবেসে শুধু মাত্র নিজের কাছে রাখার ভুলচেষ্টা গুলো আজ তোমাকে আমার থেকে দূরে করে দিলো। অতিরিক্ত ভালোবাসা বিষাদময় আমি বুঝতে পারিনি।
____________________________________________
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাতে অন্ধকার ছেয়ে গেছে আলোয় ভরা পৃথিবী। হেনা বেগমের কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে জেমি। পৃথিবীতে একমাত্র মায়ের কোলেই সব থেকে নিরাপদ স্থান। যেখানে কোনো কষ্ট থাকে না, কোনো হতাশা থাকে না, থাকেনা কোনো যন্ত্রনা, শুধু থাকে বুক ভর্তি ভালোবাসা। জেমির কাছে এই মুহূর্তে ওর মায়ের কোলটাকে পৃথিবীর সব চাইতে সুখকর স্থান মনে হচ্ছে। হেনা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে কষ্টটা একমাত্র মায়েরাই বুঝতে পারে। মেয়েটা যে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছেড়ে সুখে থাকতে পারেনি সেটা জেমি ওর মায়ের কাছে না বললেও ওর মা ঠিকি বুঝতে পারে। মেয়ের মনের অব্যক্ত কথা গুলো মায়েরা না বললেও বুঝে যায়। এখানেই, হয়তো মা আর বাকি সবার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। অনেক ক্ষন পর মা আর মেয়ের মাঝে নিরবতার রেশ কা’টা’তে হেনা বেগম বলে উঠলো…..
— এখন তুই বড় হয়েছিস। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছিস। নিজের জন্য ভালোটাই বেছে নিতে শিখে নিয়েছিস। আমরা আশরাফুল মাখলুকাত যার অর্থ সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীতে বসবাসরত কোনো মানুষেই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কেউ জেনে বুঝে ভুল করে আবার কেউ অজান্তেই বিরাট ভুল করে বসে। আর ক্ষমা হচ্ছে মহৎ গুন। যে মানুষ ভুল করে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। তার ভুল শুধরানোর জন্য প্রথম ও শেষবারের মতো একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি জানিনা তোর আর জায়ান বাবার মধ্যে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে যার কারনে আজ তোদের সম্পর্ক বিচ্ছেদের পথে। শুধু মা হিসেবে একটা উপদেশ দিব “জায়ান যদি কোনো ভুল করে থাকে আর ও যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় তাহলে আমি বলব জায়ানকে ক্ষমা করে প্রথম ও শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিয়ে সমস্ত মান-অভিমান মিটিয়ে নে ” এতেই শান্তি বজায় থাকবে। মা হিসেবে এইটুকু বলা উচিত ছিলো আমার আমি বললাম বাকিটা তোর মতামতের উপর নির্ভর করছে তোর যেটা সঠিক মনে হয় সেটাই করবি। আমি আর তোর বাবা সবসময় তোর পাশে আছি।
জেমি ওর মায়ের কথাগুলো চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। হেনা বেগমের কথা শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস রুম ত্যাগ করলেন। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে একটু একা ছেড়ে দেওয়া উচিত। হেনা বেগম চলে যেতেই হেনা বেগমের কথা গুলো জেমি ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষন নিজের মনে নিজেই কথাগুলো বিড়বিড় করে জায়ানের কতা অত্যা’চার গুলোর দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করলো। দৃশ্য গুলো মনে করেই জেমি বিছানার চাদর খামচে ধরলো শক্ত করে। তারপর নিজে নিজেই কঠিন স্বরে বলে উঠলো…..
— আমি জানি মা জায়ান ভুল করেছে কিন্তু এমন একটা ভুল যেই ভুলের ক্ষ’ত আমার শরীরে আমি বয়ে বেড়াচ্ছে। আমি ক্ষ’ত গুলো হয়তো কয়েক মাস, কয়েক বছর পর মিশে যাবে। কিন্তু আমার মনের ক্ষ’তটা, সেটা কি করে মুছব আমি। আমার হৃদয়ে প্রত্যেকটা মুহূর্ত র’ক্ত ক্ষ’রণ হচ্ছে মা। আমি চাইলেও এই র’ক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে পারব না। জায়ানকে যদি আমি ক্ষমা করে দেই তাহলে ও নিজের ভুল কোনো দিন বুঝতে পারবে না।
“কিছু কিছু সময় শাস্তি না দিয়ে সবটা উপর- ওয়ালার আর পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত”
আমি যদি তাকে শাস্তি দেই তাহলে আমিও তার সমান অপরাধে অপরাধী হয়ে গেলাম। তাই আমি জায়ান কে শাস্তি দিতে চাইনা আবার ফিরে ও যেতে চাই না। নিঃশব্দে সবটা ছেড়ে এসে জায়ান কে বুঝিয়ে দিতে চাই “থাকতে মূল্য দিতে হয়, হারিয়ে গেলে আফসোস করে লাভ হয়না”। তুমি জানোনা মা, জায়ানের ভালোবাসা বিষাক্ত, বিষাদময়, ভয়ংকর, যেই ভালোবাসা সহ্য করার মতো শক্তি আমার নেই…….
কথাগুলো বলেই জেমি দীর্ঘ-শ্বাস ছাড়লো।
____________________________________________
জেমি চলে যাওয়ার দুইদিন কেটে গেছে আজ। জায়ানের অবস্থা প্রায় পা’গল পা’গল। ইরা বেগম নিজের করা অপরাধের ফল ভুগছে। ছেলের সামনে দাড়ানোর মতো মুখ নেই তার। ছেলের এই অবস্থা চোখের সামনে সহ্য ও না করতে পারছে না। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় জায়ান নিজের রুমের বেলকনিতে বসে গিটারে টুংটাং শব্দ করছে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। গিটারের পাশেই জেমির ডায়রিটা। জায়ানের সব কিছু বিষাক্ত লাগছে। জেমিকে ফিরিয়ে আনার সাধ্য ওর নেই। কোন মুখে গিয়ে দাড়াবে জেমির সামনে। জায়ানের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। মুখটা খানিকটা শুকিয়ে গেছে। হাতের মধ্যে রক্ত জমাট হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাতের উপর কতটা ক্ষ’ত করেছে। জায়ানের ভেতর টা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছে। জায়ানের কষ্টটা জায়ান কাউকে বোঝাতে পারছে না। জায়ান ভাঙা গলায় গিটার বাজিয়ে শুরু করলো……
” মন তোরে বলি যত…
তুই চলেছিস তোর মতো..
স্বার্থ কি আমার ছুটি তোর তোর পিছনে ”
মন বলি তুই ফিরে যা..
মন ছাড়া কি যায় রে বাঁচা…
তুই ছাড়া কে আর আছে এ জীবনে…
কি কারন-অকারন এত করিস জ্বালাতন…
ভালো লাগেনা এই দোটানা..
উচাটন সারাক্ষণ…
বল না তুই বল না কেনো এ ছলনা
ও মন তুই বল না ভালোবাসিস বল না
বল না তুই বল না ভুলে গিয়ে ছলনা
একবার শুধু বল না ভালোবাসিস বল না…
এইটুকু গেয়েই আর গাইতে পারলো না। গলা আটকে আসচ্ছে ওর। জায়ান গিটার টা বুকের মধ্যে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ করেই জায়ানের কাঁধে কেউ হাত রাখতেই জায়ান হকচকিয়ে উঠে পেছনে না ফিরেই বলে উঠলো….
—জেমি? তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবে। তু…..
বলেই পেছনে ফিরতেই জায়ানের মুখটা চুপসে গেলো। বিষন্ন ভরা মন নিয়ে বললো…..
— ওহ তুই…..
ইভা জায়ানের পাশে বসতে বসতে বললো….
–ভাই তুই মায়ের কথা বিশ্বাস করে জেমির উপর যেই অন্যায় করেছিস সেই অন্যায়ের ক্ষমা হয় না।
আর মাকে এখন আমার মা বলতেও ঘৃনা লাগে। আমি ও তার একটা মেয়ে আমি ও অন্য কারোর বাড়ির বউ আজ যদি আমার স্বামী আর শাশুড়ী আমার সাথে এই ব্যবহার করতো তোরা কি করতি?
আমার তোর উপর ও ঘৃনা হচ্ছে, এতটা নিচে নেমে গেলি কি করে? একটা মেয়েকে এইভাবে নির্যাতন করলি তাও সেই মেয়েটাকে যাকে তুই ভালোবেসে বিয়ে করেছি, যেই মেয়েটা তোর জন্য পরিবার ছেড়ে এসেছিলো, যেই মেয়েটা তোর সন্তানের মা হতে যাচ্ছে।
“তোর সন্তানের মা হতে যাচ্ছে” কথাটা শুনেই জায়ানের চোখ মুখের অবস্থা মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। ওর মাথায় যেনো বাজ পড়লো। জায়ান এক লাফে দাড়িয়ে গিয়ে বলে উঠলো….
—কি কি বলছিস তুই? জেমি মা হতে যাচ্ছে মানে?
জায়ানের কথা শুনে ইভা একটা রির্পোট জায়ানের হাতে দিয়ে বলে উঠলো….
—এটা দেখ? এখানে স্পষ্ট লেখা আছে জেমি মা হতে চলেছে। এই রির্পোটটা আমি তোর পাশের রুমের টেবিলের উপর পেয়েছি।
জায়ান রির্পোটটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ থেকে পানি টপটপ করে রির্পোট এর উপর পড়ছে। জায়ান এই মুহূর্তে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে অনেক ওর। ইভা আজ হঠাৎ করে এখানে এসেছিলো আর এসেই ইরা বেগমের মুখে সবটা শুনে ইভার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। জায়ানের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ইভা জায়ানের কাঁধে হাত দিতেই জায়ান ইভাকে ঝাপটে ধরে মেয়েদের মতো শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
___________________________________________
জেমি নিজের রুমে কত গুলো কাগজ-পত্র নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। জেমির সামনেই হেনা বেগম দাড়িয়ে আছে। অনেক ক্ষন দাড়িয়ে থেকেও জেমির এইসব কান্ড বুঝতে না পেরে বলে উঠলো……
—এইসব দিয়ে কি করবি?
জেমি কাগজ গুলো দেখতে দেখতে জবাব দিলো…..
—মা আমি আমার স্বপ্ন টাকে অর্ধেক পথে ভেঙে দিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম ভালোবাসার পেছনে। তাই এখন আমি নিজের স্বপ্ন টাকে পূরন করবো মা। নিজের জীবন টাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করব। ভেঙে গেলে চলবে না। আমাকে উঠে দাড়াতে হবে। মানুষ স্বপ্ন ভাঙ্গতে পারে। জীবনের চলার পথে অনেক বাধা আসবে থেমে গেলে চলবে না। আমার ভেতর এখন ছোট্ট একটা প্রান বেড়ে উঠছে আমি ওকে আমার পরিচয়ে বড় করব। ওকে এমন ভাবে শক্ত করব যেনো আমার মতো পরিস্থিতি ওর জীবনে না আসে। আমার মতো যেসব মেয়েরা শুশুড় বাড়ি অত্যা’চারিত আমি সেসব মেয়েদের শক্তি হবো। আমাকে দেখে ওরা শিখবে৷ আমি চাই ওরা আমার শক্ত হয়ে জীবনে অনেক দূর যাবে। রাস্তায় থাকা বৃদ্ধ জান্নাত গুলোকে দুইহাতে কুড়িয়ে আনব। এটাই হবে আমার জীবন যুদ্ধ।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। অনেক সুস্থ দোয়া করবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)