#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৩ ||
আমার ডানপাশে নিহান ভাইয়া বসেছে আর বামপাশে নাহিদা।
বামপাশের কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে হিদ আর তার পাশে আদ্রান।
মাত্রই আঙ্কেল আন্টি আমাকে আর নিহানকে হলুদ ছুঁয়ে গেলো।
হুট করে লাইট’স অফ হয়ে গেলো।
হুট করে অন্ধকার হওয়ায় আমি কিছুটা ঘাবড়িয়ে নিহান ভাইয়ার পাঞ্জাবির হাতা খামচে ধরলাম।
এমন সময়ই গালে কারো ছোঁয়া অনুভব করলাম।
দু’গালে, কপালে সেই হাতের স্পর্শ পেলাম।
হুট করে কানের কাছে পরিচিত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
—“শুভ হলুদ সন্ধ্যা নাফিপাখি!!”
নিহান ভাইয়ার এমন নেশার্ত কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলাম।
এমন সময়ই লাইট চলে আসলো।
আমি চোখদুটো বড় বড় করেই সামনের দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি যেন একটা স্ট্যাচু, হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।
কেউ হলুদ ছোঁয়াতেই ধ্যান ভাঙ্গলো আমার।
নিহান ভাইয়ার দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম উনি মিটমিট করে হেসে চলেছে।
বুঝলাম কিছুক্ষণ আগে উনিই আমাকে হলুদ ছুঁয়েছেন।
কিছুক্ষক্ণ পরপরই নেতাসাহেবের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি।
সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে।
যাকে বলে চোখ ধাঁধানো।
একে একে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে আর কিছু না কিছু খাইয়ে দিচ্ছে।
আমি একদম চুপচাপ আছি।
হলুদের পর্ব শেষ হতেই আমরা বেশি ছবি তুললাম।
ক্যামেরাম্যানের কথায় একেক পোজ দিতে দিতে অবস্থা খারাপ।
এমনিতেই আমি ভিষণরকম নার্ভাস তার উপ নেতাসাহেবের গুতাগুতি অসহ্যকর লাগছে।
ওদিকে হিদকে দেখো, নার্ভাসের বাপকে খেয়ে দিব্বি নিজে নিজেই পোজ দিয়ে ছবি তুলছে আর এদিকে তার দামড়া ভাইটার গুতাগুতি!
অসহ্যকর!!!
ওদিকে ইরিন আর ফুপি গাল ফুলিয়ে এক কোণায় বসে আছে।
ইরিন ভাবলো কী আর তার সাথে হলো কী!
—“দেখেছো মা তোমার ভাইয়ের মেয়ে কী করে ওই নিহানকে কেড়ে নিলো!”
—“সে তো দেখতেই পারছি। এতো গণ্যমান্য মানুষদের জন্য কিছু বলতে পারছি না। আমার ভাইয়ের টাকায় ফুটানি মেরে শেষ অবধি কিনা আমার হবু জামাই বাবাজিকে কেড়ে নিলো! কি ভয়ংকর মেয়েরে বাবা।”
ইরিন আগের মতোই গাল ফুলিয়ে নাফিহা আর নিহানের ফটোশুট দেখছে।
ইরিনকে মুখ গোমড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিনিয়া মুচকি হেসে ইরিন পাশে এসে ইরিনের কাঁধে এক ধাক্কা দিলো।
ইরিন থতমত খেয়ে পিছে ফিরে তাকালো।
জিনিয়াকে দেখে আবার মুখভঙ্গি আগের মতো করে সামনে ফিরলো।
জিনিয়া হালকা কেশে বললো,
—“কী মানিয়েছে না আমার আপু আর নিহান ভাইয়াকে?”
—“একদমই মানায় নাই!”
—“আরে বাবা মাহশাল্লাহ্ বলো মাহশাল্লাহ্ বলো!”
ইরিন ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে জিনিয়ার দিকে ফিরে বলে,
—“মাহশাল্লাহ্ কেন বলতে যাবো?”
—“এইযে আমার আপুর তারিফ করলা!”
—“আমি নাফিহা আপুর তারিফ করিনাই।” অনেকটা বিরক্তির সুরেই বললো ইরিন।
—“ওহ তাহলে হয়তো ভুল শুনেছি। আচ্ছা তুমি বসো আমি এই কাপলের সাথে কয়েকটা পিক তুলে আসি। মে রাঙ্গা শার্ব তো কেয়ায়ায়া!”
জিনিয়া গান গাইতে গাইতে নিহানদের দিকে ছুটলো।
জিনিয়ার কথাগুলো ইরিনের গায়ে ফোস্কার মতো লাগলো।
আর এক মুহূর্ত সেখানে না থেকে তার মাকে নিয়ে চলে গেলো বাড়ি থেকে।
অনেক নাচ-গান, আনন্দ-ফূর্তির মাঝে রাত ২টায় গিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো।
মা চাইছিলো আজকে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে, কিন্তু নিহান ভাইয়া শ্রেফ না করে দিয়েছে।
অনেক জোরাজুরির মাঝেও উনি কারো কথাই শুনলেন না।
মা আঙ্কেলকে বলতেই আঙ্কেলও নিহান ভাইয়ার পক্ষ হয়ে অনেক বোঝালেন।
অবশেষে দুই বাপ-ব্যাটা মিলে মাকে রাজি করিয়েই ফেললো।
আমি বুঝি না, একদিনের জন্য আমার বাড়িতে গেলে নিহান ভাইয়ার কী সমস্যা?
আমি কী হারিয়ে যাচ্ছি নাকি ভাই!?
জাস্ট একটাদিনেরই তো ব্যাপার, তারপর তো এখানে চলে আসবো।
অদ্ভুত!
নিহান ভাইয়া শুধু আমাকে নয়, মা এবং জিনিয়াকেও যেতে দিলেন না।
এক সার্ভেন্ট মা এবং জিনিয়াকে রুম দেখিয়ে দিলো।
আমি সোজা চলে আসি হিদের রুমে।
হিদ ফ্রেশ হয়ে মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
হিদ বের হতেই আমি রাতের ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলাম।
লম্বা একটা শাওয়ার নেয়ায় এখন বেশ হালকা লাগছে।
চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখি হিদ আমার ফোন নিয়ে বসে আছে।
আমাকে বের হতে দেখেই হিদ আমার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“ভাইয়া ফোন দিয়েছে যা গিয়ে প্রেম কর, আমিও প্রেম করি।”
হিদের কাধে এক চড় মেরে বলি,
—“আমি তোর মতো এতো বেশরম না তাই আমাকে এসব বলবি না।”
—“ওরে রে নতুন বউ লজ্জা পাচ্ছে, চিন্তা না! একবার আমার ভাইয়ের নামে পার্মানেন্ট হয়ে যাও তারপর তোমার লজ্জা আমার ভাই-ই ছুটাবে।”
—“অসভ্য মেয়ে যা তো! আমি একা নতুন বউ না তুই নিজেও নতুন বউ! বাসরের জন্য তুইও রেডি থাক।”
বলেই আমি ফোনটা কেড়ে নিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পরলাম।
হিদও হাসতে হাসতে নিজের ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো।
ফোন হাতে নিতেই বেজে উঠলো।
আমি তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বললাম।
—“কই ছিলে তুমি জানপাখি! কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি!”
হুহ দরদ এক্কেবারে উতলায় পরে।
এই নেতাসাহেব তো গিরগিটির চেয়েও ফাস্ট রঙ বদলায় ভাইরে ভাই!
একবার তুই-তুকারি আবার দরদের “তুমি!”
হাহ! ঢংয়ে পিএইচডি প্রাপ্ত!
—“ওয়াশরুমে ছিলাম। বলুন কি বলবেন!”
—“হোয়াট!!”
নিহান ভাইয়ার চিল্লানোতে হকচকিয়ে গেলাম।
—“কি হলো? কি হলো?”
—“কী বললা তুমি আমি কি বলবো? কেন তোমার কিছু বলার নেই?”
—“না তো। আপনি ফোন দিয়েছেন আপনি-ই তো বলবেন।”
—“হায় মাবুদ। এ তো এখনো পিচ্চি-ই রয়ে গেলো।
আমার বুঝি আমার প্রেম হলো না।” হতাশার সুরেই কথাগুলো বললো।
ওনার এখনকার রিয়েকশনের চেহারার অঙ্গি-ভঙ্গি কেমন হবে ভেবে আমি হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছি।
—“এই হাসছো কেন হ্যাঁ?”
—“এমনি, কিছু না।”
—“আচ্ছা যাহোক আমিই নাহয় শুরু করি।”
—“হু করেন।”
—“হাতে মেহেদী লাগিয়েছো?”
—“হ্যাঁ!”
—“কখন?”
—“হলুদের নিয়মকানুন শেষে।”
—“আমি কেন দেখলাম না?”
—“আপনি তখব আশেপাশে ছিলেন না, কোথায় কার সাথে গিয়েছেন কে জানে!”
—“ওহ আচ্ছা। তা কালার হয়েছে?”
—“হু।”
—“ভালোবাসি।”
নেতাসাহেবের এই একটা শব্দই আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।
কেমন অজানা অনুভূতি হচ্ছে।
—“কী হলো চুপ কেন?”
—“কককই,”
এরকম নানান আলোচনা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
গহুম থেকে উঠে দেখি এখনো লাইন কাটেননি উনি।
আল্লাহ!
এতক্ষণ উনি লাইনেই ছিলেন?
আমি হ্যালো হ্যালো করছি, নাহ কোনো সাড়াশব্দ নেই।
তার মানে কী উনি ঘুম?
এমন সময়ই ইনু এসে আমার উপর হামলে পরলো।
—“আরেহ কী হলো কী?”
—“মিঁয়াও!”
—“সিঁড়ির দিকে একটা কিউট বিড়াল দেখেছিস?”
—“মিঁয়াও!!”
—“তার মালিক তাকে বাগানে ঘুরাতে নিয়ে গেছে এখন তুইও যেতে চাস?”
—“মিঁয়াও!”
—“দেখ ভাই! আজ আমার বিয়ে আর তুই সকাল সকাল আবার বিরক্ত করছিস! বলেছিলাম না কোনো বিড়াল না যে তোরে অন্য বিড়ালের সাথে সেটিং করায় দিবো!”
—“কী হলো এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?” ঘুম ঘুম কন্ঠে নিহান বললো।
নিহানের কন্ঠ শুনে নাফিহা হকচকানো ফোন কানে দিয়ে বললো,
—“আর বলবেন না, ইনু নাকি কোন বিড়ালকে দেখেছে তার মালিকের সাথে বাগানের দিকে যেতে এখন আমাকে বলছে যেন আমি তাকে বাগানে ওই বিড়ালটার কাছে নিয়ে যাই। কেমন লাগে বলেন তো?”
নাফিহার কথায় নিহান ঘুম ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে বসলো।
তারপর অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
—“এই তুমি কী বিড়ালের ভাষা বুঝতে পারো?”
—“হঠাৎ এই কথা বলছেন কেন?” ভ্রু কুচকে বললো নাফিহা।
—“তাহলে বুঝলা কেমনে ওই বিড়াল তোমাকে কী বলেছে।”
—“ওহ এই ব্যাপার! সব বিড়ালের ভাষা বুঝতে না পারলেও ইনুর ভাষা আমি বুঝি?”
—“কী করে?”
—“বলবো না। আপনি একটু ব্যবস্থা করুন না, আমি ভিষণ ক্লান্ত।”
—“আচ্ছা তোমার বিড়ালকে আমার কাছে পাঠায় দাও বাকিটা আমি দেখছি।”
—“এই আপনি কী ওরে ধমকাবেন? একদম ধমক দিবেন না আমার ইনুকে।”
—“আরে চুপ! বেশি বোঝা ভালো না জলদি পাঠা আর তুই রেস্ট কর!”
নিহান ভাইয়ার ধমকে মুখ গোমড়া করে ইনুকে নিহান ভাইয়ার রুমে পাঠিয়ে আমি ওয়াশরুমের দিকে গেলাম।
হিদকে বিছানায় না দেখে হুট করে কি যেন মনে হতেই বেলকনিতে চলে গেলাম।
হায়রে! আজ যে মেয়ে অন্য ঘরের বউ হবে সেই মেয়ে বারান্দার ডিভানে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুখ খুলে ঘুমাচ্ছে।
এই হিদ আর শোধরালো না।
ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমে চলে আসলাম।
★
জিনিয়া কিছু তাঁজা ফুল আনতে বেরিয়েছিলো।
তাড়াহুড়ো করে ফেরার পথে কারো সাথে ধাক্কা খেলো।
ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে তার হাতে থাকা ফুলের ডালাটা পরে গেলো।
ভাগ্যিস পলিথিনে মোড়ানো ছিলো নয়তো সব পরে নষ্ট হয়ে যেতো।
জিনিয়া ধাক্কা খাওয়া ব্যক্তিটির দিকে না তাকিয়েই “সরি” “সরি” বলতে বলতে নিচু হয়ে ডালাটি হাতে নিলো।
পেছন ফিরে লোকটির দিকে তাকাতেই জিনিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেলো।
সামনে যে সাজিদ দাঁড়িয়ে।
সাজিদকে দেখে জিনিয়ার যায় যায় অবস্থা।
সাজিদ কিছুটা অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
—“আপনার ফুলগুলো কী নষ্ট হয়ে গেছে?” সাজিদের কথায় জিনিয়ার ধ্যান ভাঙলো।
—“আরে না না, পলিথিনে মোড়ানো ছিলো বিধায় কিছু হয়নি।”
—“ও আচ্ছা।” বলেই চুপ করলো সাজিদ।
এরপর জিনিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে সাজিদ বললো,
—“তুমি নাফিহার বোন না?”
—“জ্বী!”
—“ওহ তাহলে ঠিক চিনেছি। তা এই কাঠফাটা রোদে এই ফুল নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
—“আপুর বিয়ে তো তাই কিছু ফুল প্রয়োজন ছিলো সেগুলা নিতে গিয়েছিলাম।”
—“এক সেকেন্ড আপুর বিয়ে মানে তো নাফিহার বিয়ে! হঠাৎ বিয়ে? আমাকেও তো দেখছি দাওয়াত দিলো না!”
—“আসলে বিয়েটা হুট করেই হচ্ছে। গত পরশুই আমরা জানলাম। আর আপুকে তো আমরা কালকেই জানালাম। ”
—“ওও আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার। কিন্তু আফসোস হচ্ছে, এক বোনের বিয়ে খাওয়া হলো না।” অনেকটা মুখ গোমড়া করেই উত্তর দিলো সাজিদ।
সাজিদের কথায় জিনিয়া ফিক করে হেসে দেয়।
হাসতেই হাসতেই বলে,
—“আপুর হয়ে আমি দাওয়াত দিলাম। চলে আসবেন যথাসময়ে।”
বলেই জিনিয়া চলে আসতে নিলো ওমনি সাজিদ পিছু ডেকে বলে,
—“আরে দাঁড়াও!”
জিনিয়া থেমে গেলো এবং পিছে ফিরে বললো, “জ্বী বলুন।”
—“দাওয়াত দিলা ভালো কথা তা ঠিকানা না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো হু?”
জিনিয়া নিজের করা বোকামীতে হেসে ফেললো।
—“আচ্ছা আমার নাম্বার লিখুন আমি আপনাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিবো। এখন তাড়া আছে জলদি করুন।”
—“ও হ্যাঁ।” বলেই সাজিদ চটজলদি নাম্বার নিলো জিনিয়ার থেকে।
জিনিয়ার তাড়ার কারণে সাজিদ ভুলেই গেলো “ঠিকানার সাথে নাম্বারের কী সম্পর্ক?” সেটা জিজ্ঞেস করতে।
জিনিয়া নাম্বার দিয়েই চলে আসলো।
আজ তার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি।
আজ যেন সে আকাশের চাঁদ হাতে পেলো।
চলবে!!!