#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২১ ||
নিহান ওয়েটিংরুমে বসে একটা ম্যাগাজিন খুব মনোযোগ দিয়ে পরছে।
তার চোখে সানগ্লাস, চুলগুলো আচঁড়ানো হলেও বাতাসে তার সামনের কিছু চুল কপালে লেপ্টে আছে।
নিহান কালো শার্ট আর কালো জিন্স পরিহিত।
শার্টের হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করা।
নিহানকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে।
অফিসের কিছু মেয়ে স্টাফ নিহানের দিকে একবার তাকানোর পর দ্বিতীয়বার না দেখে থাকতে পারছে না।
সবাই কমবেশি তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।
নিহান ম্যাগাজিন ঘাটতে এতই ব্যস্ত যে তার সেদিকে নজর নেই।
কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার এসে বলে,
—“স্যার আপনাকে যেতে বলেছে।”
ম্যানেজারের কথায় নিহান চোখ তুলে তার দিকে তাকালো।
ম্যাগাজিন ভাঁজ করে ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনের কেবিনের দিকে হাঁটা ধরলো।
—“আসবো বাবা?”
—“অনুমতি নেয়ার কী আছে, এটা তো তোদের দুই ভাইয়েরই অফিস।”
—“শুধু নিবিড়ের।”
নিহানের কথায় নিহানের বাবা ফিক করে হেসে দিলেন।
ছেলের ভ্রু কুচকে থাকা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
—“বুঝি না তুই কেন এই অফিস থেকে দূরে থাকিস বলতো? বুড়ো হয়েছি কই তুই সামলাবি তা না আমাকেই খাটাস!”
—“জানো আমার দলের এক মহিলা তোমায় দেখে কি বলেছিলো?”
—“কী?”
—“এই লোকটা মানে তোমাকে দেখিয়ে বলে উনি সিঙ্গেল কি না!”
নিহানের কথা শুনে সিফাত চৌধুরী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
শেষে কি না ৩ দামড়া ছেলেমেয়ের বাবাকে বলে সিঙ্গেল কিনা?
নিহান বলে,
—“ওই মহিলার মতো তোমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বেশ বুঝলাম তুমি বুড়ো নও। তো আমি তোমায় কোনদিক দিয়ে খাটালাম?”
—“তোর সাথে কথায় পারা যায় না।”
—“পারো না যখন লাগতে আসো কেন?”
—“আচ্ছা বাদ দেই এই টপিক। তুই এখানে অফিসে হঠাৎ আসলি যে?”
—“জরুরি কথা আছে।”
—“সে তো বাসায়ও বলতে পারতি।”
—“সম্ভব ছিলো না তাই এখানেই আসলাম।” সানগ্লাসটা খুলতে খুলতে উত্তর দিলো নিহান।
সিফাত চৌধুরী নড়েচড়ে বসলো।
তারপর হাতদুটো ভাঁজ করে ভ্রু কুচকে বলে,
—“কিসের জরুরি কথা?”
—“জামিন(নাফিহার বাবা) আঙ্কেলের বিষয়ে।”
জামিন রহমানের নাম শুনতেই সিফাত চৌধুরী মুখটা গোমড়া করে ফেললো।
নিহান গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলো,
—“বাবা শুনেছি উনি ১২ বছর আগে কোনো এক কাজে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। তার তিন থেকে চার বছরের মাঝেই ফিরে আসার কথা ছিলো, উনি কেন আসলেন না? উনি তো একজন মাফিয়া আর সরকারের সিক্রেট এজেন্সিও তাইতো?”
—“হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস। জামিন গভার্মেন্টের হয়েই কাজ করতো। কিন্তু তুই হঠাৎ এসব প্রসঙ্গ তুলছিস কেন?”
—“দরকার আছে তাই। তুমি প্লিজ আমাকে প্রথম থেকে সবটা খুলে বলো।”
সিফাত চৌধুরী কিছু একটা ভেবে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
যদিও নিহানকে উনি আগে এসব বিষয়ে বলেছিলো কিন্তু তেমনভাবে খোলাসা করেননি।
আজ হয়তো তার ছেলেকে ভেঙ্গে সবটা বলার সময় হয়েছে।
আর কতো অপেক্ষা করবে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর জন্য।
চোখের সামনে বন্ধুর পরিবারের এমন দশা উনি আর মেনে নিতে পারছেন না।
—“আজ তোকে সব বলবো। শুন তাহলে, রেলমন্ত্রী ইমরান সিকদার তার কি কাজে যেন জামিনকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো অন্যদিকে। তোর আঙ্কেল আবার ওই রেলমন্ত্রীর সকল পাপকর্মের বড় সাক্ষী ছিলো এবং তার কাছে বেশ প্রুভও আছে। তোর আঙ্কেল তাকে একবার সাবধান করেছিলো এসব যেন না করে। জামিনের এমন সাবধান করায় ইমরানের মনে বড়রকম ক্ষোভ সৃষ্টি হলো।”
—“তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু..”
—“আমার কথা পুরোপুরি শেষ হয়নি। জামিন সেদিন যাওয়ার পর আমার সাথে যোগাযোগ রাখলেও তোর আন্টিদের সাথে যোগাযোগ করেনি। জামিন দেশের বাইরে ৪বছর থাকবে সেটা নিশ্চিত ছিলো। তবে যদি এরপর না ফিরে বা যোগাযোগ করতে না পারে তাহলে আমি যেন তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিই। অলরেডি সেদিন সে এডভান্স ১০ লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করেছিলো আমার একাউন্টে। আমি নিতে চাইনি একপ্রকার জোরে করেই দিয়েছিলো৷ এরপর আমি প্রতিমাসে ওদের টাকা পাঠাতাম৷ নাফিহা এবং জিনিয়ার স্কুল ফিও প্রতিমাসে পৌঁছে যেত। এসব আমি ভাবীকে আগেই জানিয়েছিলাম তাই ভাবী এই টাকা পাঠানো নিয়ে বেশি কিছু বলতো না। এভাবে সেই ১০ লক্ষের ডিল প্রায় ৭বছরে ফুরিয়ে যায়। তখনো আমি জিমানের কোনো খবর পাইনি।
তাই উপায় না পেয়ে আমি নিজেই তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেই তবে খুবই গোপনে। আর জিমানের এক সহকারীর মাধ্যমে জেনেছিলাম, জিমান দেশে ফেরার দিনই এয়ারপোর্ট থেকে হুট করে উধাও হয়ে যায়। তার ধারণা কেউ তাকে অপহরণ করেছে তাও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই। আমি আজ অবধি তার কোনো খবরা-খবর জানতে পারিনি।”
বলেই সিফাত চৌধুরী থামলো।
নিহান সবটাই মনোযোগ সহকারে শুনলো।
নিহানকে যেন সকল প্রশ্ন একসাথে চেপে ধরেছে।
সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না জামিনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা।
নিহান হুট করেই বলে,
—“পুলিশে খবর দিয়েছিলে?”
—“কি করে দিবো?”
নিহান কিছু বললো না।
তারপর ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
—“ইমরান সিকদারের কোনো ছেলে আছে?”
—“হ্যাঁ আছে তো। ওর নাম আমির।”
—“আব আয়ে না লাইনি পে!”
—“মানে?”
—“এই আমির ছেলেটা এখন নাফিহার পিছে পরেছে।”
—“বলিস কী!” অবাক হয়ে বললো সিফাত চৌধুরী।
—“সে আর বলছি কী! খোঁজ লাগিয়ে জেনেছি তার মেয়েদের প্রতি খুব নেশা! দাঁড়াও তোমাকে ফ্ল্যাশব্যাক বলছি।”
বলেই নিহান একে একে বলতে শুরু করলো,
ফ্ল্যাশব্যাক,,
নিহান ড্রাইভিং করতে করতে তার টিমকে ফোন করছিলো আর এদিক সেদিক নাফিহাকে খুঁজছিলো।
এমন সময়ই তার টিমের একজন নিহানকে ফোন করলো।
নিহান হ্যালো বলার আগেই ওপাশের ছেলেটি বলা শুরু করে,
—“স্যার আমরা এইদিকে ম্যামকে দেখলাম কারা যেন ম্যামকে টেনে হিঁচড়ে একটা মাইকোতে ওঠাচ্ছিলো।”
—“হোয়াট! তোমরা নাফিকে না বাঁচিয়ে ওদের তামাশা দেখে আমাকে বলছো?” অনেকটা চিল্লিয়েই নিহান কথাগুলো বলে।
ছেলেটা নিহানের ধমকে কেঁপে উঠলো।
তারপর আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
—“স্যার পুরো কথাটা তো শুনবেন। আমরা ওদের গ্যাঙকে ধরে আমাদের গোডাউনে নিয়ে এসেছি আর ম্যামের মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে আপনি জলদি করে রাস্তার মোড়ে আসুন।”
নিহান আর এক মুহূর্তও দেরী না করে সেদিকে ছুটলো।
গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে খুব জলদিই সে নাফিহার কাছে এসে হাজির হলো।
নাফিহাকে তখনই ইমার্জেন্সি হসপিটালে নিয়ে গেলো নিহান।
ভাগ্যবশত ক্ষত বেশি গুরুতর নয়।
ভারী জিনিসটা মস্তিস্কে তেমনভাবে আঘাত হানেনি তাই হয়তো নাফিহা বেঁচেছে নাহলে লাইফ রিস্কে পরে যেত।
তবে বেশ ব্লিডিং হয়েছে যার ফলে নাফিহা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
নিহান বুঝতে পারে এই চালটা ছিলো নাফিহাকে অজ্ঞান করা।
নাফিহাকে আদ্রানের কাছে দিয়ে নিহান চলে যায় নিজের গোডাউনে।
ছেলেগুলোকে উত্তম মাধ্যম বেশ করে দেয়ার পর তারা কেঁদে কেঁদে বলে উঠে,
—“আমরা কিছু জানি না! আমাদের আমির সাহেব বলেছিলো এই মেয়েকে অজ্ঞান করে তার কাছে নিয়ে যেতে।”
নিহান আরেক লাথি দিলো লোকটার নাক বরাবর।
এতোই জোরে আঘাত করলো যে লোকটার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করলো।
—“কেন? কেন পাঠিয়েছিলো! এই শু*ড় বল! কেন পাঠিয়েছিলো তোদের?” হুংকার ছেড়ে কথাগুলো বললো নিহান।
—“তার নাকি মেয়েটাকে মনে লেগেছে। তাই ওনাকে বেড…”
বলার আগেই লোকটার কপাল বরাবর শুট করলো নিহান।
খুব কাছ থেকে শুট করায় গুলি লোকটার মাথার খুলি উড়িয়ে দিলো।
লোকটির এমন নির্মম মৃত্যু দেখে বাকি লোকদের আত্মা কেঁপে উঠলো।
বাকিগুলোকেও একইভাবে মারলো নিহান।
★
সিফাত চৌধুরী কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।
নিহান তাকে খুন করার বিষয়টা চেপে সবটা বলেছে।
সিফাত চৌধুরীর কপালে চিন্তার ভাঁজ!
কপাল থেকে হাত সরাতে সরাতে বলে,
—“তাহলে কি করে নাফিহাকে সুরক্ষিত করবো? ওই আমির তো ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। আজ বা কাল যেকোনো ক্ষতি, সে করবেই।”
—“আমারও সেই চিন্তা। তোমাকে একটা প্রস্তাব করতে চাই বাবা, তাহলে যদি নাফিহাকে বাঁচানো যায়।”
—“কী প্রস্তাব?”
—“আমি নাফিহাকে বিয়ে করতে চাই তাও নাহিদার বিয়ের দিনই।”
সিফাত চৌধুরী বিস্ময়ের সাথে ছেলের দিকে তাকালো।
এরকম একটা মুহূর্তে ছেলের মুখে এমন কথা শুনবে তা সে আশা করেনি।
★
ঘুম থেকেই উঠেই দেখলাম বিছানায় শাড়ি, গহনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা।
এসব দেখে কপালে ভাঁজ পরলো।
হুট করে হিদ এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো কেন?
আড়মোড়া ভেঙ্গে বসতেই হিদসহ আরও অনেকে ভেতরে প্রবেশ করলো সাথে মা আর জিনিয়াও ছিলো।
আমি হতভম্বের মতো তাকালাম।
ওনারা এখন এখানে কেন?
আজ যেহেতু হিদের গায়ে হলুদ সেহেতু তাদের দুপুরের পরে আসার কথা ছিলো, এখন তো দেখছি সকাল সকাল এসে হাজির।
আশ্চর্য!
তাদের দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে মা বললো,
—“কী এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? যা গিয়ে ফ্রেশ হ আমি খাবার আনছি।”
বলেই মা বেরিয়ে গেলো।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, সবটা যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
কিছু না বলে আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে আসলেই মা আমাকে যত্ন করে খাইয়ে দিলেন।
অনেকদিন পর মায়ের হাতে খেতে পেরে আমার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠলো।
খাওয়া শেষে সবার অগোচরে ওষুধগুলোও খেয়ে ফেললাম।
তারা শাড়ি, গহনা আর বিভিন্ন অর্নামেন্টস দেখছে আর নানান আলোচনা করছে।
আর আমি ইনুকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে ওদের আলোচনা দেখছি।
হুট করে হিদ এসে আমার গায়ে একটা হলুদ শাড়ি ধরলো।
আমি চোখ বড় বড় করে বলি,
—“আমাকে এগুলো দেখাচ্ছিস কেন? তোর বিয়ে তুই-ই নিজের সাথে ম্যাচ করে দেখ।”
—“আমার সাথে যে আরেকজনের বিয়ে হবে।”
—“কার?” অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
—“বলবো না।”
—“দেখ ফাইজলামি মুডে নেই আমি, প্লিজ বল। প্লিজ!!!”
হিদ হেসে বলে,
—“দুই বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে এবার একসাথেই হবে।”
—“মানেহ?” চোখ বড় বড় করে।
তখনই পাশ থেকে জিনিয়া বললো,
—“হিদ আপু আর তোমার। তোমার বিয়ে হবে নিহান ভাইয়ার সাথে।”
বলেই সকলে মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো।
এদিকে আমার চোখ কপালে তুলে ফেললাম।
চলবে!!!
(আইডির সমস্যার কারণে গতকাল গল্প দিতে পারিনি। আজকে আরেক পর্ব পাবেন ইন শা আল্লাহ। আর তাদের বিয়ের অগ্রিম দাওয়াত রইলো। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।)