#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৭ ||
আর ৭দিন পর হিদের বিয়ে।
তাই হিদ এবং আন্টি উভয়েরই হুকুম যেন ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে তাদের বাসায় রওনা হই।
তারা কোনরকম ভনিতা শুনবে না আমাকে যেতে হবে মানে যেতে হবেই!
জিনিয়াকেও বলেছিলো কিন্তু মা নিষেধ করে দিয়েছে কারণ জিনিয়ার পরিক্ষার বেশি দেরী নেই।
তাই তারাও আর জোর করেনি।
এখন আমারই বা কি করার একাই যেতে হবে।
ব্যাগ গুছিয়ে হঠাৎ আলমারি চেক দিতেই মনে পরে গেলো মা এবং বোনের জন্য কিছু ড্রেস কিনেছিলাম।
টিউশনির টাকা জমিয়ে জমিয়ে জিনিয়ার জন্য একটা লং টপস আর মায়ের জন্য একটা লাল শাড়ি।
প্রায় ৭ মাসের টাকা জমিয়ে এইগুলা কিনেছি।
জিনিয়ার শপিংব্যাগ টা তুলে রেখে মায়ের প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে চললাম মায়ের ঘরে।
রুমে গিয়ে দেখি মা কিছু একটা ঘাটাঘাটি করছে আলমারিতে।
আমি আস্তে করে “আম্মু” ডাকতেই মা আমার দিকে ফিরলো।
তারপর ব্যস্ততা নিয়ে বলে,
—“কিরে সব গুছিয়ে নিয়েছিস? আর রেডি হসনি কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই তো ওনারা গাড় পাঠাবে।”
আমি কিছু বললাম না।
পিছে প্যাকেটটা লুকিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
—“তোমার সাথে কথা বলার ছিলো আম্মু।”
—“বলতে হলে বল না, তাড়াতাড়ি বল নয়তো রেডি হতে দেরী হয়ে যাবে তোর। তা ইনুকে নিবি নাকি রেখে যাবি? ইনুকে রেখে গেলে তো তোকে ছাড়া ইনু আরও পাগলামি করবে। কি করবি বল তো?”
আমি মায়ের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম।
মা ভ্রু কুচকে প্যাকেটটার দিকে তাকালো।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“কি আছে এটায়?”
–“দেখো কি আছে।”
মা প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখে একটা শাড়ি।
শাড়িটায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে বলে,
—“হ্যাঁ রে নাফি, এই শাড়িটা কার জন্য?”
—“তোমার জন্য আম্মু।”
মা হতবাক হয়ে আমার দিকে ফিরলো।
তার চোখে বিস্ময়ের শেষ নেই।
আমি মুচকি হেসে বলি,
—“টিউশনির টাকায় কিনেছি আম্মু। এটা তুমি হিদের বিয়েতে পরে যাবে প্লিজ।” অনুরোধের সুরে বললাম।
মুহূর্তেই মায়ের চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো।
নিজের অশ্রু লুকাতে মা এদিক সেদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
শেষে না পেরে নিজের অশ্রু লুকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে,
—“আচ্ছা ঠিকাছে, তাই হবে। এখন জলদি গিয়ে রেডি হয়ে নে।”
আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে আসলাম।
নিজের উপার্জনে কিছু দেয়ার প্রাপ্তিতে অনেক সুখ আছে যা আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।
সেদিন হিদের সাথে শপিং এ গিয়েই ওদের জন্য এগুলো কিনে এনেছিলাম।
মায়ের চোখের জলই বুঝিয়ে দিয়েছে উনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন।
বেশি কিছু না ভেবে রেডি হয়ে নিলাম।
রেডি হতে বলতে জাস্ট বোরকা আর হিজাব।
ইনুকে নিয়ে যাবো বলে ঠিক করেছি।
জিনিয়ার এমনিতেই পড়াশোনা আর মা একাও পারবে না ইনুকে সামলাতে।
তাই আর কি করার।
ইনু যবে থেকে শুনেছে আমরা বেড়াতে যাবো তবে থেকেই সে মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বের হওয়ার অপেক্ষায়।
এই বিড়ালটা আমাকে না হাসিয়ে পারে না, এ তো আমার ভাবনার চেয়েও বেশি দুস্টু।
আমাকে নিতে এলো নিবিড় ভাইয়া।
মাকে বিদায় দিলাম।
বিদায় দেয়ার আগে আমাকে এবং ইনু দুজনকেই ভালোভাবে শাসিয়ে দিলো মা।
আর আমি, ইনু দুজনেই চুপচাপ হজম করলাম।
যাওয়ার আগে মাকে জানিয়ে দিলাম, জিনিয়া আসলেই যেনো তাকে আলমারি থেকে বের করে প্যাকেটটা দিয়ে দেয়।
আমিই দিতাম কিন্তু এখন জিনিয়া স্কুলে।
ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে।
অবশেষে আমি আর ইনু এসে গাড়িতে বসলাম।
নিবিড় ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে বসলো।
আমি আর ইনু চুপচাপ বাইরের কাঠফাটা রোদের রাস্তাঘাট দেখছি।
খুব একটা পথচারী নেই এটা বললেও ভুল।
ঢাকা-শহরের প্রতি কোণায় কোণায় মানুষ পাওয়া যাবে এই সময়টায়।
তআর উপর এখন লাঞ্চ টাইম, কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছে নিজ বাসস্থানে দু’মুঠো ভাত পেটে দিতে আবার কেউ-বা কোনো রেস্টুরায়।
একেকজনের একেকরকম কাজ, ব্যস্ততা।
হিদের বাসায় আসতেই দেখলাম কিছু মানুষের ঘুরাঘুরি।
বিয়ে হতে আরও কতোদিন বাকি আর আজ থেকেই যেন ডেকোরেশন শুরু করে দিয়েছে সবাই।
যতোই হোক, নিহান আফ্রানের একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা, সবটাই সেরা হওয়া চাই।
ভালো কথা, নিহান ভাইয়াকে তো আশেপাশে দেখলাম না।
যাক গে আপাতত কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
বাড়ি পৌঁছাতেই নিবিড় ভাইয়া এক সার্ভেন্টকে ডেকে বললো যেন আমাকে হিদের রুমে পৌঁছে দেয়।
সার্ভেন্ট মাথা নাড়িয়ে আমার ব্যাগটা নিবিড় ভাইয়ার থেকে নিয়ে আমাকে তার পিছু নিতে বললো।
আমিও সম্মতি জানিয়ে তার পিছে পিছে যাচ্ছি।
হিদ রুমে ছিলো না তবে বেলকনি থেকে ঠিকই ফুসুরফুসুরের শব্দ পেয়েছি।
তার মানে হিদ বেলকনিতে আদ্রান ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলছে।
বেশি মাথা ঘামালাম না।
সার্ভেন্টকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেতে বলতেই উনি চলে গেলেন। আমি ইনুকে সোফার উপর বসিয়ে বেলকনিতে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম ম্যাডাম ডিভানে পায়ের উপর পা তুলে এক আঙ্গুলের সাথে চুল পেঁচাতে পেঁচাতে আরামসেই কথা বলছে।
আমি বেলকনির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে দুইহাত গুজে হিদের কান্ড দেখতে লাগলাম।
হিদ কথা বলায় এতোই ব্যস্ত যে আমাকে অবধি সে খেয়াল করেনি।
আমি হালকা গলা পরিষ্কার করে বললাম,
—“বইন, লাঞ্চ টাইম এখন। জিজাজীকে তো একটু শান্তিতে খেতে দে কিন্তু তুই নিজেও খাচ্ছিস না আবার জাজাজীর মুখের খাবারও কেড়ে নিয়েছিস। এ অবিচার কি জাতি নামবে বাবু?”
আমার কথায় থতমত খেয়ে উঠে বসলো হিদ।
তার অপ্রস্তুত থাকায় ভুল করে ফোনটা হাত থেকে পরে গেলো।
হিদের এমন চমকে যাওয়া কান্ড দেখে আমি ফিক করে হেসে দিলাম।
হাসতে হাসতে এমন অবস্থা কথাই বলতে পারছি না।
হিদের ফোন পরে যাওয়ার ওর চেহারাটা দেখার মতো ছিলো।
হিদ ফোন কানে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই কটমট গলায় বলে,
—“রাখো এখন ফোন।”
বলেই খপ করে কেটে দিলো।
এই বিষয়টায় আমার হাসি আরও বেড়ে গেলো।
আমাকে হাসতে দেখে হিদ রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—“এই কুত্তি চুপ! আমার প্রেমের মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে লজ্জা করছে না বেহায়ার মতো হাসতে?”
—“বেস্টির প্রেমে যদি বেঘাত ঘটাতে না-ই বা পারি তাহলে আমি কেমন বেস্টু হলাম?”
—“তোরে আমি চটকানা খাওয়ামু নিহান ভাইয়াকে দিয়ে।”
—“কচুটা পারবি।”
শুরু হলো আমাদের ছুটাছুটি।
ইনু বেক্কলের মতো আমাদের ছুটাছুটি দেখছে।
আর আমি দৌড়াতে দৌড়াতে হিদকে ভিষণরকম খোঁচাচ্ছি।
একসময় আন্টি রুমে ঢুকে দিলো এক ধমক।
ওনার ধমকে দুইজনই থেমে গেলাম আমরা।
—“এটা কেমন ফাজলামো নাহিদা। এইসব জ্যাম-ধুলোবালি দিয়ে মেয়েটা আসলো সবে, আর এখনই এমন ছুটাছুটি লাগায়সিস! দুদিন পর বিয়ে, কান্ডজ্ঞান কি সব খেয়ে ফেলেছিস? নাফিহা মা যাও ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো। আসার পর বোরকাটা অবধিও খুলোনি।”
বলে আরও কিছুক্ষণ হিদকে শাসিয়ে আন্টি চলে গেলেন।
এদিকে হিদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ গরম করে।
অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছি নয়তো আরেকদফা কেলেঙ্কারি ঘটবে ভেবেই হিদের দিকে না তাকিয়ে জলদি জলদি বোরকা হিজাব খুলে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটলাম।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
বেরিয়ে হিদকে রুমে দেখলাম না।
ইনু তো হেঁটে হঁটে পুরোটা ঘর দেখছে আর পর্যবেক্ষণ করছে।
আমি মুচকি হেসে তাওয়াল নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে লম্বা চুলগুলো মুছতে শুরু করে দেই।
—“নাহিদা তুই কি চয়েস করেছি মেহেন্দিতে কোন ড্রেস প….”
নিহান ব্যস্ততার সাথেই হিদের রুমে যেতে যেতেই হিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো।
রুমে এসে নাফিহাকে ভেঁজা চুলে ওড়নাবিহীন অবস্থায় দেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো।
সে জানতোই না এই মুহূর্তে নাফিহা হিদের রুমে এই অবস্থাতে থাকবে।
নয়তো কখনোই এইরুমে আসতো না।
নাফিহার এমন রূপ দেখে তার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম।
চুল মুছতে মুছতেই কারো কন্ঠ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম নিহান ভাইয়া থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
তাও অবাক হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে।
নিহান ভাইয়ার এমন অদ্ভুত চাহনিতে আমার সারা-শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পরতেই নিজের দিকে তাকাতেই বুঝলাম আমি ওড়না ছাড়া।
দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম কারণ, ওড়না আমি ভুল করে সেখানেই রেখে আসছি।
তোয়ালের কারণে ভুলেই গেছিলাম ওড়না নেয়ার কথা।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি একটা কান্ড ঘটে গেলো ছিঃ।
এখন নিহান ভাইয়া কি ভাববে?
লজ্জায় মন চাচ্ছে মাটি দু’ভাগ করে ঢুকে পরি।
ওড়না ভালোভাবে পেঁচিয়ে বাথরুমের দরজা কিছুটা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করলাম নিহান ভাইয়া আছে কি না।
নাহ উনি চলে গেছেন।
ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসলাম আর তখনই হিদ হাতে একটা ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।
আমাকে বাথরুমের সামনে দাঁড়াতে দেখে হিদ বললো,
—“নেন মহারানী, এগুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করলে বড়ই উপকৃত হবো।”
আমি নিজেকে সামনে হিদের হাতের দিকে তাকালাম।
দেখলাম ট্রেতে বেশ কিছু খাবার প্লেট দিয়ে ঢাকা।
আমি বুঝেও না বুঝার ভান ধরে বললাম,
—“খাবারের জায়গায় প্লেট খাবো?”
—“তোরে না মন চাচ্ছে বাড়ির পেছনের সুইমিংপুলে চুবাতে। ফাজিল মাইয়া,”
—“আরে বইন হয়েছে হয়েছে আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। দে ট্রে টা হাতে দে।”
বলেই ট্রে টা নিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখলাম এবং খাওয়া শুরু করলাম।
বিকালের আগ অবধি আমি রুম থেকেই বের হলাম না লজ্জায়।
যদি কোনোভাবে নিহান ভাইয়ার সামনে পরে যাই, তখন তো ইজ্জত সব যাবে।
সন্ধ্যায় ইনুর জ্বালায় বের না হয়ে পারলাম না।
নামাজটা পরে ইনুকে নিয়ে রুমে থেকে বের হলাম।
না চাইতেও একবার নিহান ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিলাম উনি আছেন কি না সেটা দেখতে।
উঁকি দিয়ে যখন দেখলাম নেই তখন আর না দাঁড়িয়ে নিচে চলে আসলাম।
ইয়া বড় হলরুম দেখে ইনু আমার কোল থেকে নেমে এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো।
আমি ওর ছুটাছুটি দেখতে দেখতেই সোফায় গিয়ে বসলাম।
হিদ আসতেই হিদের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।
হিদের থেকে জানলাম পরশু নাকি মেহেন্দি অনুষ্ঠান হবে তবে বেশি বড় হবে না, ফ্যামিলি-ফ্যামিলিই মূলত এই অনুষ্ঠানে এটেন্ড থাকবে।
রাতে জলদি জলদি খাবার খেয়ে হিদের রুমে চলে আসলাম কারণ আমি শিওর রাতে নিহান ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হতো।
তাই আগেভাগে খেয়েই চলে এসেছি।
পরেরদিন ঘুমের মধ্যেই কেমন চেঁচামেচি শুনলাম।
চোখমুখ কুচকে ঘুম থেকে উঠলাম।
পাশে ফিরে দেখি হিদ নেই।
আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম নিচে থেকে এমন চেঁচামেঁচির শব্দ আসছে।
তার মানে কি নিচে কিছু হয়েছে?
উম.. বিষয়টা দেখতে হচ্ছে।
ভেবেই চুল ঠিক করে, মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেলাম।
নিচে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি।
চলবে!!!