#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৫ ||
আদ্রান আসলো সবে।
সেই সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছিলো।
ঘন্টাখানেক আগে বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশের তুলোর মতো মেঘগুলো এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে।
আদ্রান ভাইয়া আসতেই সকলে রেডি হয়ে বিচের দিকে রওনা হলাম।
এখন বিকেল হয়ে গিয়েছে।
চারপাশে কাঠফাটা রোদের বদলে সব শীতল হয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরপর ঠান্ডা বাতাস শরীর ছুঁয়ে আসছে।
আজ নিহান ভাইয়া আমার সাথেই হাঁটছে আর বাকিরা আমাদের থেকে খানিকটা সামনে।
নিহান ভাইয়া হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
—“তোর এই জায়গাটা ভালো লাগছে?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না।
কেন দিবো? সারাদিনে কি একটাবারও খবর নিয়েছে?
না সে কেন নিবে, সে তো আমাকে চিনেই না।
যত্তোসব।
নিহান ভাইয়া আবার বললো,
—“কিরে কথা কানে যায় না!”
—“না!”
—“এতো ঢং কেমনে করিস তুই?”
সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলাম।
নিহান ভাইয়াও থেমে গেলো আমার জন্য।
—“কি এভাবে চেয়ে আছিস কেন?”
—“কি বললেন আমি ঢং করি?”
—“তাইতো দেখছি।”
—“ঢং আমি না আপনি করেন। কাল তো সাবা আপুর গায়ে চিত্তায় পরেন আর আজ আজ আসছেন আমার সাথে ঢং করতে। আপনার আসলেই চরিত্রের ঠিক নেই।”
নিহান ভাইয়া ফিক করে হেসে ফেললো আমার কথায়।
আজব! আমি হাসির কি বললাম?
—“তোরে এতদিন বুদ্ধিমতি মেয়ে ভাবতাম কিন্তু তুই যে একটা বাচ্চা সেটা আমি ভুলেই গেছি।”
—“একদম বাচ্চা বলবেন না, আমি এখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী হুহ!”
—“বুদ্ধির দিক দিয়ে বাচ্চা তুই। এই নিহান আফ্রানের পার্সোনালিটি এতো লো না যে ওইরকম মাতাল মেয়েকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করবো।”
—“মাতাল মানে?” জেনেও না জানার ভান ধরে।
—“এতো অবুঝ সাজিস না, আমি জানি তুই গতরাতের ঘটনা হিদের থেকে জেনে নিয়েছিস। এখন কথা না বাড়িয়ে চল। সবাই অনেকদূর চলে গেছে।”
নিহান ভাইয়ার কথাতে আমি প্রচুর লজ্জিত হলাম।
ধুর, এতো অবুঝ ভান ধরতে কে বলেছিলো?
এখন নিজেরই এমন লজ্জায় পরতে হলো ধ্যাত!
নিহান নাফিহার লজ্জামাখা মুখটি আড়চোকজে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
নিহান নিজের কান্ট্রোল হারিয়ে একটা বড় কাজ করে বসলো।
আমি নিজের মনের মাঝেই নিজেকে বকে চলেছি এমন সময়ই আমার হাতে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে হাতের দিকে তাকালাম।
নিহান ভাইয়া আমার হাত ধরে হাঁটছে!
অসম্ভব ব্যাপার আমার জন্য, আচ্ছা আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
ইয়াং পলিটিশিয়ান যাকে দেখলেই মেয়েরা উঠতে বসতে ক্রাশ খায় সেই মানুষটা এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হাত ধরে বসবে আমার কল্পনার বাইরে ছিলো।
আমার ভাবনায় ছেদ করলো নিহান ভাইয়ার কথা।
—“শোন আমাদের দৌড়াতে হবে। আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি, তাই দৌড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
—“তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু হাত ধরলেন কেন?”
—“যাতে দৌড়াতে গিয়ে তোকে হারিয়ে না ফেলি। তুই তো বাচ্চা, তোরে হারায় ফেললে কই পাবো? তখন আবার থানা-পুলিশে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।”
মেজাজ বিগড়ে গেলো নিহান ভাইয়ার কথায়।
এই হিটলারটায় আসলেই নিরামিষ!
এরে নিয়ে আমি ভাবি কি আর তার উত্তর হয় কী!
এর মাঝে কি আল্লাহ কোনোদিন ফিলিংস টিলিংস দিলো না, যত্তোসব।
—“একদম বাচ্চা বলবেন না। আমার হাত ছাড়ুন! লাগবে না আপনার দরদের।”
নিহান ভাইয়া তাও ছাড়লো না।
সে আমার হাত ধরেই দিলো এক দৌড়।
এর দৌড়ের গতির ঠ্যালায় আমি চাইলেও দাঁড়াতে পারছি না।
একসময় হাঁপিয়ে গেছি বলে দাঁড়াতে চাইছিলাম তাও দাঁড়াতে দিলো না অসভ্য।
২মিনিটের মাঝে আমরা চলে আসলাম আর বাকিদের থেকে কিছুটা দূরে এসেই থামলাম।
আমি এবং নিহান ভাইয়া দুজনেই হাঁপাচ্ছি, কিন্তু আমার অবস্থা ভীষণ খারাপ।
তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে গেছে।
নিহান ভাইয়া হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো আর আমি ছাতার নিচের আরামদায়ক চেয়ারটিতে গিয়ে বসলাম।
ভিষণ ক্লান্ত লাগছে, তবে ক্লান্তি ভাবটা খুব কম সময়েই কেটে গেলো এই ঠান্ডা পরিবেশে।
হিদ আমার কাছে এসে পানির বোতল এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে পুরোটা বোতলের পানি সাবাড় করে ফেললাম।
আরও ২-৩ মিনিট রেস্ট নিয়ে হিদের সাথে চলে আসলাম।
বিচে গিয়ে দেখলাম একজায়গায় বাঁশ দিয়ে জাল লাগানো আর নিহান ভাইয়ারা সেদিকেই এগোচ্ছে।
আজ আন্টি এবং আঙ্কেলও এসেছেন আমাদের সাথে।
ইনু তো আছেই।
ইনুকে আজ রিয়াদ ভাইয়া(ওদের কাজিন) নিয়েছে।
ইনুকে কমবেশি সকলেই পছন্দ করে শুধুমাত্র ওই হিটলার ছাড়া।
এই হিটলার গায়ে যেন চুলকানি লাগে আমার ইনুকে নিয়ে।
একটা বিষয় খেয়াল করেছি ইনু নিহান ভাইয়ার থেকে দূরে থাকে।
গতকাল জিনিয়া বললো ইনু নাকি নিহান ভাইয়ার গিয়ে বসেছিলো।
এতে ইনুর সুবিশাল লম্বা লেজ গিয়ে নিহান ভাইয়ার নাকে লাগে।
এতেই নিহান ভাইয়ার হাঁচি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ।
ইনুকে সে এক হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেই ইনু গিয়ে আদ্রান ভাইয়ার কোলে গিয়ে পরে।
নিহান ভাইয়ার এমন কার্যকলাপে ইনু ভিষণ ভয় পেয়ে যায়, আদ্রান ভাইয়া না থাকলে তো তার হাত-পা ভেঙ্গে পরে থাকতে হতো।
যদি হাত-পা ভেঙ্গে বসে থাকে তাহলে সে খরগোশ-বিড়ালদের সাথে লাইন মারবে কি করে?
তাই বেচারা জীবনের মায়ায় পরে ভুলেও নিহান ভাইয়ার আশেপাশে ঘেঁষে না।
আমি এসব শুনে রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম, শেষে রেগেও যাই নিহান ভাইয়ার উপর।
আমার এতো আদরের বিড়ালটাকে এভাবে ছুঁড়ে ফেললো?
সে জানে কতো অপেক্ষার পর আমার জান-বাচ্চাটাকে পাইসি হু!
হুহ বেদ্দপ ছেলে।
নিহান ভাইয়ারা ভলিবল খেলবে।
আন্টি আর আঙ্কেল গেছে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে।
ভলিবলে এখন সব ছেলেরা খেলছে।
রিয়াদ ভাইয়া খেলতে যাওয়ার আগে জিনিয়ার কোলে ইনুকে দিয়ে যায়।
ইনু কয়েকবার কোল থেকে নেমেছিলো বালিতে গড়াগড়ি খাওয়ার আশায় কিন্তু জিনিয়া বরাবরের মতোই আবার কোলে উঠিয়ে নেয়।
ইনুকে গড়াগড়ি করতে দিচ্ছে না বলে বেচারী মুখ গোমড়া করে আছে।
আমরা মেয়েরা বালিতেই সাইডে সাইডে বসলাম আর ছেলেদের চিয়ারআপ করতে লাগলাম।
ওরা ৪জন করে দুই দলে ভাগ হয়েছে।
নিহান, নিবিড়, আদ্রান এবং আমির ভাইয়া এক দলে আর বাকিরা অন্যদলে।
রিয়াদ ভাইয়ার বউ মানে ভাবী তার ছোট্ট পুচকে কে সামলাচ্ছে আর খেলা দেখছে।
কেউ কারো থেকে কম নয় ভলিবল খেলায় তবে নিহান ভাইয়া আর নিবিড় ভাইয়া বেশি ভালো খেলছে।
সবাই-ই খেলতে খেলতে ঘামিয়ে গেছে তবুও খেলছে তো খেলছেই।
আমার বেশ লাগছে খেলা দেখতে।
হুট করে কোন দল এসে আমাদের চারপাশে এসে ঘিরে ধরলো।
এই ভয়টাই ছিলো আমাদের।
পাবলিক নিহান ভাইয়াকে দেখে যেমনভাবে চিল্লাচ্ছে আমার তো বিরক্তি ধরে গেলো।
রাতে ডিনার করে আমরা রিসোর্টে পৌঁছালাম।
বেশ মজা করেছি সবাই মিলে।
বড় পরিবারে আসলেই অনেক মজার মুহূর্ত পাওয়া যায়, সেখানে আন্টি-আঙ্কেলের খুনশুটি তো জমে খিড়!
তবে হিদকে বেশি আনন্দ করতে দেখিনি।
আদ্রান ভাইয়াকেও খেয়াল করেছি সে হিদের আশেপাশে গেলেই হিদ তাকে এড়িয়ে চলে, এদের কাহিনী স্বাভাবিক লাগলো না।
যাইহোক হিদের কাজিন হিদই বুঝে নিবে আপাতত আমার চিন্তা নিহান ভাইয়াকে নিয়ে।
আচ্ছা ওনাকে এতো সুদর্শন হতে কে বলেছিলো?
আজ না চাইতেও আমার চোখদুটো বেহায়া হয়ে গিয়েছিলো তার উপর মেয়েদের চেঁচামেচি তো কানে বাজার মতো অসহ্য।
জিনিয়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেধ হয়ে আসতেই শুয়ে পরলাম।
মাথার মধ্যে নিহান নামটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে।
হঠাৎ বিকেলের মোমেন্টটা মনে করতেই গালদুটো জ্বলে উঠলো।
আজ উনি আমার হাত ধরেছিলেন, তারপর একই সাথে হাঁটা, দৌড়ানো সবটাই মনে পরছে।
একসময় আর ভাবতে না পেরে আরেকটা বালিশ মাথার উপর চেপে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
নাহিদা বসে বসে সেই ৩ বছর আগের কথা ভাবছে।
তখন আদ্রান সবে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেছে।
নাহিদা একপ্রকার পাগল ছিলো আদ্রানের জন্য।
সারাক্ষণ ফোন দিয়ে জ্বালাতো।
বাসায় আসলেও প্রচুর জ্বালাতো বিধায় আদ্রান তাদের বাসায় আসা ছেড়ে দেয়।
তবুও তার জ্বালাতোন আনলিমিটেড চলতোই।
প্রায় ২ মাস এভাবে জ্বালানোর পর নাহিদা তাকে একদিন জোরপূর্বক দেখা করতে বলে।
আদ্রানও বাধ্য হয়েই দেখা করলো।
নাহিদা সেদিনই অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।
আদ্রানকে সে প্রপোজ করে বসে, আদ্রান সেদিন অনেক রেগে যায় এবং নাহিদাকে অনেককিছু বলে অপমানও করে।
তখন সে ধরে নিয়েছিলো নাহিদা ছোট, ভালোবাসা জিনিসটা একপ্রকার মোহ তার কাছে।
হয়তো নাহিদা ভালোলাগাকে ভালোবাসা ধরে বসেছিলো তাই সে তাও বুঝিয়ে দেয়।
সেদিন নাহিদা কেঁদেছিলো তার সামনেই কিন্তু আদ্রান গুরুত্ব দেয়নি।
নাহিদা সেদিনই বলে দেয়,
—“ঠিক আছে দুঃখিত আপনাকে এতদিন ডিস্টার্ব করার জন্য। সবটা দুস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন আশা করছি। আর হ্যাঁ এই “দুস্বপ্ন” নামক আমিটা আর কখনোই আপনার ধারেকাছে ঘেঁষবে না। ভালো থাকবেন।”
বলেই সেদিন নাহিদা এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।
ব্যাপারটা হয়তো এখানে শেষ হলেই হতো কিন্তু না।
সেদিনের পর নাহিদা যোগাযোগ রাখেনি বিধায় আদ্রানের সবকিছুতেই কেমন শূণ্যতা লাগছিলো।
সে না চাইতেও কেন যেন ফীন হাতে নিয়ে বসে থাকতো নাহিদার একটা ফোনকল বা ম্যাসেজের অপেক্ষায়।
তার এই অপেক্ষা এক বছর পার করিয়ে দিলো, কিমতু না সে কিছুতেই নাহিদার সাথে যোগাযোগ করতে পারলো না।
সে বুঝে গিয়েছিলো নাহিদা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সে বিহীন তার জীবনটা মরিচীকার থেকে কম নয়।
সেও বুঝে ফেলে নিজের অজান্তেই এই মেয়েটাকে সে মনের গহীনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে।
যবে থেকে বুঝলো তবে থেকেই সে নাহিদার কাছে ক্ষনা চাইলো বারংবার মিশতে চাইলো কিন্তু নাহিদা প্রতিবারই আদ্রানকে এড়িয়ে চলে।
এখন আদ্রান বুঝে নাহিদাকে সে কতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলো।
সবটা ভেবে নাহিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পরলো।
সকালে প্রায় ৯টায় আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
আরও ২রাত থাকার কথা ছিলো, সেন্টমার্টিনও আজ যাওয়ার কথা ছিলো।
শেষে তা আর হলো না, নিহান ভাইয়ার নাকি জরুরি কল এসেছে একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে তার আর সেটা আজ সন্ধ্যার পরেই।
তাকে যেকোনো পরিস্থিতিতেই সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
নিহান ভাইয়া ভেবেছিলো একাই যাবে ঢাকায় কিন্তু আন্টি- আঙ্কেলও তার সাথে যাবে বলেছে।
যেহেতু ওনারা কেউই থাকবে না তো আমরা থেকে কি করবো?
তাই আমরাও চলে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কোনোরকমে খাওয়া কমপ্লিট করেই বেরিয়ে পরলাম।
মনটা প্রচন্ড খারাপ।
কক্সবাজারের চেয়ে সেন্টমার্টিন বেশি আকর্ষণীয় জায়গা আর সেখানেই আমাদের যাওয়া হলো না।
চলবে!!!
বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়ার সময় হয়ে উঠেনি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম, আসসালামু আলাইকুম।