বিষাদময়_প্রহর পর্ব ০৮

0
887

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৮ ||

সিঙ্গেল সোফায় বসে কপাল ঘষছি আর কিছুক্ষণ পরপর দূরের সোফায় বসে থাকা নিহান ভাইয়ার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি।
নিহান ভাইয়ার ফকফকা কপালটাও কেমন লাল হয়ে আছে।
হওয়ারই কথা যা বারি খেলাম আল্লাহ গো!
ইনুকে আশেপাশে দেখছি না, হয়তো জিনিয়ার সাথে গিয়ে ঘুমাচ্ছে।
নিহান ভাইয়ার কপালের রগ ফুলে আছে।
এনার মগজে রাগ চেপেছে তা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছি তাই কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না।
কিন্তু সকাল সকাল উনি এখানে কি করছে?
নিরবতা ভেঙ্গে নিহান ভাইয়াই বলা শুরু করলো,

—“তোর সাহস তো কম না, এতোবার করে ফোন দিলাম একবারও রিসিভ করলি না!”

এ্যা! তাহলে কি ফোন না ধরার কারণে এই সক্কাল সক্কাল এসে হাজির হয়ে যাবে?
আজিব লোক তো!
নিহান ভাইয়ার ধমকে নরম সুরে বললাম,

—“আ..আসলে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই দেখিনি।”

—“ঘুমিয়েছিস ভালো কথা, রিংটোনের শব্দ কি কান অব্দি পৌঁছায় না?” রাগি কন্ঠ।

এইরে, এখন আবার মিথ্যা বলতে হবে।

—“সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। ঘুমের মাঝে কোনো শব্দ পেলে ঘুম ভেঙ্গে যায়, সাথে চরম মাথা ব্যথাও উঠে। আর জানেন তো এই সিম কোম্পানিগুলো কতো বজ্জাত! রিচার্জ করবে না তবুও ঘন্টায় ১০০ টা ফোন আসবে আর ২০০ টা ম্যাসেজ আসবে। বেদ্দপ কোম্পানি!”

—“হইসে! তোর থেকে আমি এতো ব্যাখ্যা চাইনি।”

নিহান ভাইয়ের কথায় আমি কেন জানিনা বেশ লজ্জা পেলাম।
আমি খুব চুপচাপ স্বভাবের মানুষ।
আর নিহান ভাইয়ার সামনে তো হ্যাঁ অথবা না বাদে কোনো কথাই হয়ে উঠে না।
সেখানে আজ কিনা এতোকিছু বলে ফেললাম?
সত্যি আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।
নিহান ভাই কি এখন আমাকে বাঁচাল মনে করবে?
আরে ধুর! যা ইচ্ছে ভাবুক গিয়ে, তার ভাবনা নিয়ে আমার কি আজিব!
আর কিছু না ভেবে হুট করেই বলে ফেললাম,

—“আমার বাসায় এই ভোরবেলা কি করছেন?”

আমার প্রশ্নে নিহান ভাইয়া যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
কি বলবে তা নিয়ে যেন কনফিউশনে পরে গেলো।
বুঝলাম না সামান্য কথায় এতো কনফিউশন হওয়ার কি আছে?
বলে দিলেই তো হয় আমার জন্য আসছে,
হুহ যত্তোসব ঢং!
আমি আর নিহান ভাইয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে পরলাম।
আমাকে লিভিংরুম থেকে বের হতে দেখে নিহান ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
—“কোথায় যাচ্ছিস?”

—“আপনার বিয়ার দাওয়াত খেতে।”

বলেই হনহন করে চলে আসলাম।
নিহান হা করে নাফিহার যাওয়া দেখলো।
নাফিহার এমন উত্তরের জন্য সে একদম আশা করেনি।
আমি ওয়াশরুমে ঢুকতেই খেয়াল হলো আমি নিহান ভাইয়াকে কি বলে আসলাম!
আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, মাথা কি আমার খারাপ হয়ে গেলো?
সকাল থেকে কি হলো আমার শুধু আজেবাজে বকছি।
নাহ! নাফিহা রিলেক্স!
শান্ত হ!
বলেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি মা নেই।
এদিকে মাথাটা ধরেছে বিধায় চা বানানো শুরু করলাম।
নিহান ভাইয়ার কথা মনে আসতেই নিহান ভাইয়ার জন্যও আরেক কাপ বানিয়ে নিলাম।
তবে চা নয় কফি।
উনি নাকি সকালে কফি খেতে অভ্যস্ত।
কফির মগ এক হাতে আর আরেক হাতে নিজের চায়ের কাপ নিয়ে চললাম লিভিংরুমে।
ফুপিরা এখনো মরার মতো ঘুমোচ্ছে।
ফুপির হাইডোজের ঘুমের পিল থাকায় সে নয়টা কি সাড়ে নয়টার মাঝে ঘুম থেকে উঠে।
আর এখন তো বাজে সকাল ৭টা।
কিন্তু মাকে আমি কোথাও পেলাম না, কই যে গেলো এই ভোরবেলায়।
লিভিংরুমে এসে দেখি উনি গেমস খেলছেন বসে বসে।
বাব্বাহ! নেতাসাহেব আবার গেমসও খেলে দেখছি।
সোফায় ধারে যেতে যেতেই বললাম,

—“নিন আপনার কফি।”

নিহান ভাইয়া মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালো।
এরপর কফির দিকে তাকিয়ে আমার হাত থেকে কফিটা নিলো।
কফি নেয়ার সময় উনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার হাত ছুঁয়েছেন।
জানি না আসলেই ইচ্ছাকৃত ভাবে কিনা!
কিন্তু আমার মাইন্ড তা-ই বললো।
আমি চোখ বড় বড় করে নিহান ভাইয়ার দিকে তাকালাম।
উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
আমি বেশি কিছু না ভেবে সামনের সোফায় বসে পরলাম।

—“এই জিনিসটাই এতক্ষণ মিস ছিলো।”

বলেই নিহান ভাইয়া কফিতে চুমুক দিলো।
আমি কিছু না বলে শুধু ভেংচি কাটলাম।
আমার ভেংচি কাটা দেখে নিহান ভাইয়া রেগে বললো,

—“তোরে একবার বলেছিলাম না এভাবে মুখ বাঁকা করবি না! ফের যদি দেখি চিরজিবনের মতো থাপ্রিয়ে মুখ বাঁকা করে দিবো!”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম।
সাথে সাথে অন্যদিকে ফিরে গেলাম।
এই হিটলারকে বিশ্বাস নাই আমার।
চা খেতে খেতেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

—“আচ্ছা আম্মু কোথায়?”

—“বললো তোর ফুপির নাকি কি লাগবে তাই একটু আগেই তো বেরিয়ে গেলো। ও হ্যাঁ ভালো কথা কাল তুই কাঁদছিলি কেন?”

আমি থতমত খেয়ে নিহান ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
উনি জানলো কীভাবে আমি কাল কেঁদেছিলাম?
সামান্য ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,

—“কই!”

—“দেখ মিথ্যা একদম বলবি না। মায়ের সাথে যখন কথা বলছিলি তখন আমি মায়ের সাথেই ছিলাম! সো তুই মাকে বোকা বানাতে পারলেও আমাকে এতোটা বোকা ভাবিস না। তুই বলবি না থাপ্রিয়ে তোর পেট থেকে কথা বের করবো?”

আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
—“আপনি কথায় কথায় আমাকে শুধু বকেন কেন?”

—“তুই সোজা কথায় চলার মানুষ না, তাই তোরে বকা না দিয়ে থাকা যায়না।”

চোখ গরম করে নিহান ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
এর সাথে কথা বলাই বেকার!
চায়ের কাপ নিয়ে রেগেমেগে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
টি-টেবিল থেক্ব ওনার রাখা কফির কাপ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলাম।
বের হওয়ার আগে ভাইয়া কিছুটা ধমক দিয়ে বলেছিলো,

—“প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

—“মরতে যাই! মরবেন আমার সাথে?”

বলেই রাগি লুক দিয়ে চলে এসেছিলাম।
সকাল সকাল মেজাজ দিলো খারাপ করে।
নিজের রুমে গিয়ে রেডি হয়ে ব্যাগ কাধে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম টিউশনির উদ্দেশ্যে।
ইনু ঘুমিয়ে থাকায় ওরে বিদায় দিয়ে আসিনি নয়তো এও আমার পিছু পিছু চলে আসবে।
কিন্তু ইনু পিছু ছাড়লেও এই হিটলার আমার পিছু ছাড়ে নাই।
মেজাজ খারাপ হয় না?
সে কি আরামসে আমার পিছে পিছে আসছে।
নিহান ভাই মাস্ক আর ক্যাপ পরে আছে তাই কারো চেনার সম্ভাবনা নেই।
পকেটে হাত দিয়ে আমার পাশে এসে হাঁটছে।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

—“কি সমস্যা আমার সাথে হাঁটছেন কেন?”

—“রাস্তা কি তোর?”

—“আমি এটা কখন বললাম?”

—“রাস্তা যেহেতু তোর না আমি হাঁটতেই পারি, তোর এখানে সমস্যা কোথায়?”

—“আমি কি বলসি আপনি হাঁটতে পারবেন না? আপনি এখানে হাঁটেন বা গড়াগড়ি খান সেটা আমার দেখার বিষয় না, তবুও আমার থেকে দূরে থাকেন।”

নিহান ভাইয়া ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো।
তারপর কি যেন ভেবে বলে,

—“ওকে।”

বলেই আমার হাত ধরে আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগলো।
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলি,
—“আরে আরে, কই নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
নিহান ভাইয়া কিছুই বললো না।
আমি বকবক তো করেই চলেছি হাত ছাড়ানোর জন্য।
উনি আমায় ওনার গাড়ির কাছে এনে গাড়ির ডোর খুলে আমাকে ভেতরে বসিয়ে দেয় সাথে নিজেও আমার পাশে ঘেষে বসলো।
মন তো চাচ্ছে এক লাথি মেরে গাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে আসি হিটলার একটা।

—“ড্রাইভার চলো।”

ড্রাউভার সম্মতি পেতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আমি চোখ বড় বড় করে নিহান ভাইয়ার দিকে তাকালাম।

—“চলো মানে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

—“মুখটা কি এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ রাখতে পারিস না?” বিরক্তির সুরে কথাগুলো বললো নিহান ভাইয়া।

—“না পারি না। আমাকে কি আপনার সরকারি সম্পদ পাইসেন যে যা ইচ্ছা তাই….উমমমম!!!”

আমি কিছু বলার আগেই নিহান ভাই আমার গলায় ঝুলানো ওড়নাটা দিয়ে আমার মুখ শক্ত করে বেঁধে দিলো।
এতো শক্ত গিট্টু দিয়েছে যে আমি দুই হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

—“নে এবার আরও বেশি বকরবকর কর! মাথা খেয়ে ফেলসে চিল্লাতে চিল্লাতে।”

বলেই ভাইয়া নিজের ফোন ঘাটাঘাটি শুরু করলো।
এই হিটলারের মাথায় যদি তার ফোন দিয়ে এক বারি দিতে পারতাম।
ফাজিল ছ্যাঁমড়া!
এর জ্বালায় আমার আজকের দিনটাই খারাপ যাবে।
এমন শক্ত করে কেউ গিট্টু দেয়।
উফফফ মাথা ধরে গেছে।
কোনো উপায় না পেয়ে একদম চুপ করে বসে রইলাম।

আমাকে নিহান ভাইয়া তাদের বাসায় নিয়ে গেলো।
হিদ এখনো ঘুমিয়ে থাকায় তাকে ডাকলাম না।
বাসায় আসতেই নিহান ভাইয়া আমার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো।
আন্টি আমাকে দেখে বেশ খুশি হলেন।
আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে অনেকক্ষণ গল্প করে আমাকে ইচ্ছাশিড় খাইয়ে তবেই ছেড়েছে।
এতো খেয়ে আমার বমি চলে আসছে দেখে নিহান ভাই আমার মুখ চেপে মুখে সুপারি ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,

—“সুপারিটা চুষতে থাক বমি আসবে না।”

আমি চুপচাপ সুপারি মুখে রেখে দিয়েছি।
সত্যি সত্যিই বমি ভাবটা কেমন কেটে যাচ্ছে।
আমাকে সুপারি খাওয়ানোর সময় আন্টি কিচেনে ছিলেন অবশ্য, কিন্তু এক সার্ভেন্ট এভাবে খাওয়ানো দেখতে পায়।
সার্ভেন্ট কিছুক্ষক্ণ পর পর আড়চোখে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে চলেছে।
নিহান ভাইয়ার সেদিকে খেয়াল নেই।
সে অনেকগুলো ফাইল নিয়ে লিভিংরুমে বসেছে আর মনোযোগ দিয়ে সেসব ঘাটাঘাটি করছে।
এদিকে আমার কেমন গাল জ্বলছে।
অসভ্য নেতা! লজ্জা-শরমের মাথা খাইসে নাকি?
এভাবে মুখ চেপে খাওয়ানোর কি দরকার ছিলো? এখন এই সার্ভেন্ট তো উল্টোটা ভেবে বসে আছে।
ফালতু!

কিছুক্ষণ পর হিদ উঠে আসলো সাথে নিবিড় ভাইয়াও।
চারজন সেইরকম আড্ডা জমালাম।
আড্ডার মাঝেই হিদ বলে উঠে,

—“আমরা কিন্তু ফ্যামিলি পিকনিকে যাবো!”

—“তো যা।”

—“এইযে ম্যাডাম আমরা দুই ফ্যামিলি যাচ্ছি। তোরা এন্ড আমরা একসাথে।”

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
—“আমরা কি করে যাবো আর আমাদের বাসায় অলরেডি মেহমান আছে।” আমার কথার মাঝে নিবিড় ভাইয়া বলে উঠে,

—“আমরা যে এখন যাচ্ছি এমন তো না। তোদের সামনে পরীক্ষা, আমার পরীক্ষা তো অলরেডি চলছেই, একমাসের আগে শেষ হবে না। তার উপর সামনে ভাইয়ের ইলেকশন। কম করে হলেও প্রায় ৩ মাস পর আমরা যাচ্ছি। এখন থেকে তো জাস্ট বলে রাখলাম।”

—“হুম তাও ঠিক।” কথার মাঝে লক্ষ্য করলাম নিহান ভাইয়া আড়চোখে কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়েও ফেলেছে।
তাকাক গা আমার কি হুহ!!

ভার্সিটি থেকে ফিরে ইরিন আর ফুপির নতুন বায়না শুরু হলো।
ইরিন নাকি ঘুরতে চায় তাই তাকে যেন আমি ঘুরিয়ে আনি।
এএএহ মামা বাড়ির আবদার পাইসে।
আসলেও ঠিক মামার বাড়ির আবদার, যেহেতু আমার বাবা তার মামা হয়।
উফফ এখন এই ঝামেলাটাকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবো?
ভাবতে ভাবতেই বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলাম।
ইনু আমার মুখের সামনে বসে আছে।

—“মিঁয়াও।”

—“তুই ঘুমিয়ে ছিলি তাই তোকে না বলেই চলে গেছিলাম।”

—“মিঁয়াও।”

—“আমিও তোকে অনেক মিস করেছি এখন আমাকে একটু ঘুমাতে দে অনেক ঘুম পাচ্ছে। তুই তো অনেকক্ষণ পরে পরে ঘুমিয়েছিস।”

বলেই আমি চোখ বুজে ফেললাম।
যেই ঘুমোতে নিবো ওমনি মায়ের ডাকাডাকি!
জ্বালা রে জ্বালা!

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here