#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৭ ||
রাতের আকাশে তুলোর মতো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর পর রাত জাগা পাখির এদিক সেদিক ছুটে চলাটা লক্ষ্য করা যায়।
আজ আকাশে গোলাকার চাঁদটি নেই, নেই কোনো তারা-নক্ষত্র।
শুধু সাদা সাদা মেঘগুলোই দৃশ্যমান।
আকাশের মেঘের মতোই যেন আমার মনে হাজারো মেঘের মেলা বসেছে।
তবে সেগুলো সাদামেঘ নয়, ভয়ংকর কালো!
যেই কালো মেঘ আমার মনকে ভয়ংকরভাবে বিষিয়ে তুলছে।
মনে কালো মেঘের পাথর বসেছে।
যা সহ্য করতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর কালো মেঘগুলো চোখের পানি আকারে বের হয়ে এর ভার কমতে শুরু করলো।
বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ নয়নজোড়ার অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি।
ইনু আমার পায়ের সাথে লেগে তার মাথা অনবরত আমার পায়ের সাথে ঘষছে।
ছলছল দৃষ্টিতে ইনুর দিকে নিচু হয়ে তাকালাম।
নিচু হওয়ায় কয়েক ফোঁটা চোখের জল ইনুর গায়ের অঢেল লোমের উপর গিয়ে পরলো।
ইনু হুড়মুড়িয়ে পিছে ফিরে ধপ করে বসে পরলো আর এদিক সেদিক উপর নিচে বোকার মতো তাকাচ্ছে।
ইনুর কান্ডে আমি কান্নার মাঝেই হেসে ফেললাম।
এই বিড়ালটা আমাকে হাসাতে বাধ্য করবেই করবে।
হুট করে ফোন বেজে উঠে।
ফোন হাতে থাকায় বারান্দাতে দাঁড়িয়েই ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম।
আন্টি(হিদের আম্মু) ফোন করেছে।
আমি কান্না থামিয়ে ফেললাম।
ইনু পুণরায় আমার পায়ের উপর ভর দিয়ে বসলো।
আমি সময় দেখলাম, আটটা চুয়াল্লিশ মিনিট।
এই সময়ে হুট করে আন্টি কেন কল দিলো?
আমি বেশি কিছু না ভেবে কল রিসিভ করে আগে ওনাকে সালাম দিলাম।
আন্টি সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
—“কেমন আছিস মা? এই আন্টিটাকে কি আর মনে পরে না? কতদিন আসিস না হিসেব আছে হু?”
আমি ডান হাতে উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
—“কি বলছো তুমি আন্টি? তোমাকে কেন ভুলবো হু? আসলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তার উপর বাড়িতে মেহমান এসেছে বুঝতেই তো পারছো।”
—“ও হ্যাঁ, তোর মা বলেছিলো তোর ফুপি আসবে। তা তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন নাফিহা? তুই কি কাঁদছিস?”
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম।
জলদি ফোনে হাত দিয়ে গলা পরিষ্কার করলাম।
কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার ফোন কানে ধরে নরমাল ভাবে বললাম,
—“আরে নাহ! কে বললো তোমাকে আমি কাঁদছি? তুমি হয়তো ভুল শুনেছো।”
—“হয়তোবা। এখন কন্ঠ ঠিক থাকলেও তখন কেমন যেন শোনাচ্ছিলো।” চিন্তিত সুরে বললো আন্টি।
—“সেটা তোমার ভুল ধারণা আন্টি যাইহোক, তুমি বলো কেমন আছো?”
আরও কিছু কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।
আমার কান্নার একটাই কারণ ওই ফুপি আর তার মেয়ে ইরিন।
ফুপি আর ইরিন আজ নানাভাবে কথা শুনিয়েছে আমাকে আর মাকে।
তাও এমন এমন কথা বলেছে যা মুখে প্রকাশ করার মতো নয়।
ফুপির আচার-ব্যবহার, কথার রুচি অত্যন্ত জঘন্য।
আমি চাইলে তাদের সঠিক উত্তর দিতে পারি কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারি না।
মাও সবটা মুখ বুজে সহ্য করে নেন।
বাবা-মার লাভ ম্যারেজ হওয়ায় প্রথমে বাবার পরিবার মাকে মানেনি।
পরে আমার দাদা দাদু মানলেও এই জল্লাদ ফুপি মাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারেনি।
আর এখন বাবা লেপাত্তা, এ নিয়ে তো ফুপির খোঁচানি মার্কা কথার শেষ নেই।
মায়ের বিয়ে ফুপির অনেক পরে গিয়ে হয়েছে।
আর মা ফুপির আগেই কনসিভ করেছে, এই কারণে ফুপি যেন আরও জ্বলেপুড়ে যায়।
মায়ের প্রথম সন্তান যেহেতু আমি তাই সেই পুরানো হিংসা, ক্ষোভের জন্য ফুপি আমাকেও দেখতে পারেন না।
ওনার মেয়ে ইরিনটাও হয়েছে পুরো ফুপির কপিকেট।
ইরিন এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
ফুপি আর ইরিন আমাকে এবং আমার মাকে সহ্য করতে না পারলেও অজানা কারণে ওনারা জিনিয়াকে বেশ পছন্দ করেন এবং ওর সাথে ভালোভাবে মিশেন।
জিনিয়া এদের মোটেও পছন্দ করে না তবুও ভদ্রতার খাতিরে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখে।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলাম হঠাৎ আবার চেঁচামেঁচির শব্দ শুনতে পেলাম।
জলদি ইনুকে পা থেকে নামিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
লিভিংরুমে এসে দেখি আবার হরতাল শুরু হয়েছে তাও আমাকে নিয়ে।
—“কি তোমার স্বাধের বড় মেয়ে কই? কোনখানে কোন পোলার লগে আবার ফষ্টিনষ্টি করতে বইসে? এইহানে যে তার ফুপি আইসে সেই খেয়াল আছে? কই হাত-পা টিপে দিবে তা না করে লাইন মারে কি বেয়াদব এই মেয়ে!” ফুপি মৃদ্যু চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো।
মা শান্ত সুরে বলে উঠে,
—“আমাকে যাচ্ছে তাই বলেছেন বলছেন, এই বলে আমার ফুলের মতো পবিত্র মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। আপনাকে কেউ অধিকার দেয়নি আমার মেয়ের চরিত্র সম্বন্ধে কটু কথা বলার।”
—“বাব্বাহ এতো তেজ! তুমিও তো কম না, আমার ভাইয়ের লগে ফষ্টিনষ্টি কইরা আমাগো বাড়ির বউ হইয়া আইসো। নির্ঘাত বিয়ের পরেও অন্য বেডাগো লগে ফষ্টিনষ্টি করসো যা জানতে পাইরা আমার ভাই তোমারে রাইখা পলাইসে।”
মন চাচ্ছে মহিলার গালে কয়েক ঘা লাগায় দেই, কিন্তু না এটা আরও বেশি অভদ্রতা দেখায়।
এই মহিলার সাহস কম না আমার মাকে এসব বিশ্রী কথা বলছে!
হাতজোড়া মুঠি বদ্ধ করে মায়ের দিকে তাকালাম, অপমানে মায়ের চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে।
অনেকদিন পর মাকে এভাবে কাঁদতে দেখলাম।
কেউ যেন আমার ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে।
এতো কষ্ট কেন এই জীবনে?
ফুপি পান চিবুতে চিবুতে আমার দিকে ফিরলো।
—“ওরে বাবা আইসেন আন্নে মহারানী? তা রুমে বইয়া কোন পোলার লগে এতোক্ষণ ফষ্টিনষ্টি করলেন হুনি?”
আর রাগ কান্ট্রোল করতে পারলাম না।
হুংকার ছেড়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ফুপি,
—“ওমাগো আমার পায়ের কাছে এইডা কি!” বলে লাফিয়ে উঠলো।
আমি ফুপির পায়ের দিকে তাকালাম।
ইনুকে দেখতে পেতেই আমার মন খুশিতে নেচে উঠলো।
এখন মহিলা বুঝবে আমার ইনু কি জিনিস।
ফুপি দুই পা উঠিয়ে সোফায় বসে পরলো আর ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো।
—“ফাজিল বিলাই! তোর সাহস কম না আমার মাকে ভয় দেখাস, দাঁড়া বুঝাচ্ছি মজা।” বলেই ইরিন ইনুর দিকে এগোতে লাগে ইনুকে খপ করে ধরবে বলে।
ইনু ক্রোধের দৃষ্টি নিয়ে পিছে ফিরে তাকায়।
ইনুর উজ্জ্বল হলদে চোখ দেখে ভয়ে ইরিনের গা গুলিয়ে উঠলো তাই সে এক লাফে আরেক সোফায় গিয়ে এক কুশুন হাতে নিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে পরলো।
ইনু আবার ফুপির দিকে ফিরলো আর এক লাফে ফুপির কোলে গিয়ে বসে।
এবার ফুপির চিৎকার কাকে বলে, বারবার এক কথা “কেউ এই বিলাইটারে সরা, আরে ভাই সরা!”
এতক্ষণে আমি মা মেয়ের কান্ডে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি।
জিনিয়াও আমার সাথে যোগ দিলো।
আমি ফুপিকে কঠিন কথা শুনানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম।
মা বুঝতে পেরে আমার হাত ধরে কিছু না বলতে ইশারা করলো।
কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারছি না।
শেষে মায়ের চোখ গরমে আমি অটোমেটিক চুপ করে গেলাম।
—“ইনু এদিকে আয়।”
ইনুর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
সে আগের মতোই ফুপির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
এদিকে ফ্যান চলা সত্ত্বেও ফুপি অনবরত ঘামছে।
ইনুর কয়েকবার “মিঁয়াও মিঁয়াও” বলাতে ফুপি চুপসে গেছে।
যাই বলুক সে বিড়াল ভিষণ ভয় পায়।
ছোটবেলায় তার এক সহপাঠীকে নিজের চোখের সামনেই এক বিড়াল কামড়ে দিয়েছিলো।
সেই ভয়ে তার মনের মাঝে ভালোভাবেই গেঁথে গেছে।
যখনই সে কোনো বিড়াল দেখে তখনই সেই ঘটনাটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
ইনু তাকে কামড় দিবে সেই ভয়ে চুপ মেরে আছে।
মহিলা যে ইনুকে ভয় পাচ্ছে সেটা ইনু বুঝতে পেরে অনেক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে।
তার মন চাচ্ছে আরও জ্বালাতে কিন্তু তার মালিকের ডাকে সে আর সাড়া না দিয়ে পারলো না।
আমি ইনুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
ইনুকে রেখে আবার চলে আসলাম খাবার সার্ভ করতে।
ইরিন, ফুপি আর জিনিয়া অনরেডি খাবার টেবিলে বসে পরেছে।
ইরিন বা ফুপি কারো মুখে কোনো কথা নেই।
তারা যেন কোনো এক ঘোরে আছে।
তাদের অবস্থা দেখার মতো।
জিনিয়া অপরপাশে মুখ টিপে হেসে চলেছে।
আমি নিশব্দে একটা হাসি দিয়ে প্লেট, গ্লাস তাদের সামনে রাখতে শুরু করলাম।
ইনু কি আর ঘরে বসে থাকার মানুষ?
সেও নাফিহার পিছে পিছে বেরিয়ে গেছে।
হঠাৎ সে খুদা অনুভব করলো তাই সে নাফিহাকে রেখেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
রান্নাঘরে মা খাবার গরম করছিলো।
ইনু চুপচাপ বসে মায়ের কাজ দেখছে কোনো শব্দ করলো না।
খাবার গরম করতে করতেই মায়ের চোখ ইনুর দিকে গেলো।
ইনু বারবার লেজ নাড়ছে চুপচাপ।
আজ ইনুকে দেখে মায়ের একদমই বিরক্তি লাগলো না বরং ভালো লাগলো।
আজকের ঘটনায় ইনু বেশ ভালো করেই মায়ের মনে জায়গা করে ফেলেছে।
ইনুকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মা হেসে ফেলে।
—“খিদে পেয়েছে?”
—“মিঁয়াও!”
—“আচ্ছা আপাতত তোকে দুধ আর মাছের কাটা দিচ্ছি। কাল তোর জন্য ক্যাট ফুড আনাবো নাফিকে নিয়ে।”
ইনু ঠিক কি বুঝলো সেটা বোঝা মুশকিল।
তবে সে আগের মতোই বারংবার লেজ নেড়ে চলেছে।
মা খুশিমনেই ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে এক বাটিতে দুধ ঢেলে ইনুকে দিলো আর আরেক বাটিতে মাছের টাকা দিয়ে দিলো।
ইনু তো লাফ দিয়ে খাবারে হামলা চালালো।
আমি কিচেনে এসে দেখি মহারাজা জমপেশ ডিনার সারছে।
আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।
মা কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে ইনুর দিকে তাকাচ্ছে আবার মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিচ্ছে।
কি হলো ব্যাপারটা?
এতো মিল দুইজনের মাঝে?
রাতে লিভিংরুমে বিছানা পাঁতছি।
ফুপি আর ইরিন আসায় তারা দুইজন মায়ের ঘরে ঘুমাবে।
আর আমার ঘরে মা এবং জিনিয়া ঘুমাবে।
খাট বেশি বড় না হওয়ায় ৩ জন ঘুমানো সম্ভব না তাই কি করার লিভিংরুমেই ঘুমাতে হবে বিছানা করে।
একটা পাতলা তোষক আর একটা মোটা কাঁথার উপর চাদর বিছিয়ে দিলাম।
তারপর বালিশ।
কোলবালিশের বদভ্যাস আমার নেই।
ইনু সোফায় বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে।
আমি লাইট অফ করে শুলাম ওমনি ফোনের ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলাম।
ফোন হাতে নিয়ে দেখি নিহান ভাইয়া কল দিয়েছে।
এতোরাতে উনি কেন কল দিলো আশ্চর্য!
রাত কম করে হলেও ১২টার বেশি বেজেছে।
আমার রিসিভ করতে মন চাইলো না তাই ফোন আবার বালিশের পাশে রেখে দিলাম।
ভেবেছি একবার রিসিভ না করলে আর ফোন দিবে না, কিন্তু উনি কি এতো সহজ মানুষ?
অনবরত ফোন দিয়েই চলেছে।
শেষে রেগে ফোন সাইলেন্ট করে শুয়ে পরলাম।
চোখ বুজতেই রাজ্যের ঘুম এসে আমার চোখে ভর করলো।
অতঃপর আমি ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝাপসা চোখে দেখি কেউ আমার উপর ঝুঁকে আছে।
আমি ভয়ে উঠে বসতে নিতেই সামনের ঝুঁকে থাকা মাথার সাথে আমার কপাকে বারি খেলাম।
চলবে!!!
বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।