অশান্ত বসন্ত পর্ব-৩৪

0
650

#অশান্ত বসন্ত।
(৩৪ তম পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
****************
সারা দিন ঝা-ঝা রোদের পর আসন্ন সন্ধ্যায় ঝমঝম বৃষ্টি নেমে গুমোট বাতাবরণটা নিমেষে বদলে দিলো। সাথে দক্ষিণের ঠান্ডা হাওয়ার দাক্ষিণ্য শরীর মনকে যেন তরতাজা করে দিলো।

অঞ্জনা যদিও এই গুমোট গরমের ভিতরেই হাসি মুখে সকাল থেকে বিভিন্ন দিক সামলাচ্ছিলো। তাড়াহুড়োতে হলেও পিউ আর সৃঞ্জয়ের রেজেস্ট্রি ম্যারেজ উপলক্ষে বাড়িতেই ছোট্টো একটা পারিবারিক মিলন সন্মেলনের আয়োজন করেছে।

পিউয়ের বাবা,অসীমের যদিও এই তাড়াহুড়ো করে রেজেস্ট্রি বিয়ে একেবারেই পছন্দ ছিলোনা। তবে বেশ কয়েকবার বিরক্তি প্রকাশ করলে-ও বিশেষ কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

কলকাতায় এই নিয়ে সীমাকে রাজ্যের কথা শোনালেও, ব্যাঙ্গালোরে পল্লবের ফ্ল্যাটে পা দেওয়া অবধি সীমাকেও এই বিষয়ে কথা শোনাতে গেলে পিউ,পল্লব মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

তার উপর ওই উটকো দুটো আপদ, বহ্নি আর শিখা।এরাও যেন সীমার নতুন পাহাড়াদার হয়েছে। সীমাকে একা পাওয়ার সুযোগ নেই। মনে মনে ঠিক করেছে এদুটোকে পল্লবের ফ্ল্যাট থেকে বিদায় না করে কলকাতায় ফিরবেনা অসীম।

তাছাড়া কোনো এক অলৌকিক মন্ত্রবলে সীমাও যেন তার কথা অগ্রাহ্য করে চলেছে । অসীমের অসহ্য লাগছে সীমার এই পরিবর্তন। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পর মজা বোঝাবে সীমাকে।

এদিকে সীমার মধ্যে বেশ একটা স্বস্তি কাজ করছে।একটা দুর্বোধ্য হিসেব মিলে গেলে যে স্বস্তিটা পাওয়া যায় ঠিক সেই রকম স্বস্তি, সাথে অঞ্জনার প্রতি কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতাবোধ মনটাকে ভরিয়ে দিয়েছে সীমার।

অসীম তো নিজেই কিছুদিন আগে অবধি পিউয়ের বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ে পরেছিলো। মেয়েটাকে পড়াশোনা অবধি শেষ করে নেওয়ার সুযোগ দিতে চায়নি। আর আজ যখন বিয়েটা হচ্ছে তখনো অভিযোগ অনুযোগের শেষ নেই অসীমের। অঞ্জনা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ধুমধাম করে বিয়ে দিতে দিচ্ছেনা তাদের!

আসলে সীমার আপন মনের নিভৃতিতে যে ভালো লাগাটুকু কাজ করছে পিউয়ের বিয়ে উপলক্ষে, তা যেন টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলতে পারলেই অসীমের শান্তি।

যতোদূর বুঝেছে তাতে পল্লবকে নিয়েও আর চিন্তার কিছু নেই। এই বহ্নি মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী, যদিও ওরা দুজন মিলে ঠিক করেছে যে বিয়ে না করে পাশাপাশি থাকবে আজীবন। সেটাই জানিয়েছে পল্লব। নাহলে সীমা চেয়েছিলো একই দিনে বহ্নি পল্লবের চারহাত ও এক করে দেবে।

অবশ্য বিয়ে না করলেও কিই বা যায় আসে তাতে!সম্পর্কের স্বীকৃতি দিলেই সম্পর্ক দারুণ মাধুর্য এনে জীবনকে ভরিয়ে তোলে তা তো নয়। আসল কথা হলো দুজনের দুজনের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা,সম্মান।

সীমার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায়। দীর্ঘকাল একসাথে থাকলেও আমাদের জানার বাইরেও অনেক কিছু থেকে যায়। যেমন অসীমের জানা নেই যেই সীমাকে সে আইসক্রিমের মতো মনে করে সেই সীমাই প্রয়োজনে অগ্নিবৎ হতে পারে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সীমার।

মাঝেমাঝে ভাবতো,অসীম কিছু বললে বোকার মতো চুপ করে কেন থাকে সে! অমন অপরাধী অপরাধী ভাবের কি দরকার! তারপর ভাবতো ওর অনুচ্চারিত কথা গুলোই ওর শক্তি, সেই শক্তিই ওকে সংসারে রেখেও নির্লিপ্ত আর নিশ্চিন্ত করে রেখেছে।

ভেবেছিলো বিয়ের পর নিজের স্বামীর সাথেই চুটিয়ে প্রেম করবে। যদিও অসীম তাকে সেবাদাসীর বেশি ভাবতেই পারলো না কখনো। অথচ প্রেমে পরার পক্ষে অনুপযুক্ত তো ছিলোনা সীমা। সুন্দরী, সুশিক্ষিতা, বাকপটু, কর্ম দক্ষ,সংগীতে পারদর্শিনী-অথচ অসীম তাকে প্রেমিকার নজরে দেখলোই না কোনোদিন।

কলকাতা থেকে আসার সময় পিউয়ের জন্য মোহিনী মোহন কাঞ্জিলাল থেকে বেনারসি আর নিজের বিয়ের সমস্ত গয়না সাথে করে এনেছে সীমা।

গতকালই গয়নার বাক্স থেকে অসীমের মায়ের আশীর্বাদ করা মকর মুখী বালা জোড়া বের করে নিজের হাতে বহ্নিকে পরিয়ে দিয়েছে, বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে না চাইলেও পল্লবের সারা জীবনের সঙ্গিনী হিসেবে এটা বহ্নিরই প্রাপ্য।

তারপর শিখাকে নিজের কানপাশা পরিয়ে দিয়েছিলো বিয়ের আগাম উপহার হিসেবে।
বাকি গয়নার বাক্সটা ধরে পিউকে দিয়ে বলেছিলো,
‘ এর ভিতরের যাবতীয় গয়না তোর’। পিউ বলেছিলো,’নিজের জন্য কিছু না রেখে সব কেন দিয়ে দিচ্ছো মা!’, সীমা হেসে বলেছিলো,’আমার আসল গয়না যে তোরা,এই গয়না রেখে কি করবো আমি!’

যদিও বহ্নি আর সীমাকে গয়না দেওয়াটা অসীমের আড়ালেই সেরেছে সে।

পিউ আর সৃঞ্জয় রেজেস্ট্রির এক সপ্তাহের মাথাতেই একসাথে আমেরিকা পাড়ি দেবে।
পিউয়ের ইচ্ছে ছিলো ওর শিখাদির বিয়েতে ও নিজে হাতে শিখাদিকে সাজাবে।কিন্তু চাইলেই কি আর সব হয়! আগামী মাসের ১৫ তারিখে বিয়ের তারিখ স্থির হয়েছে শিখার। একটু আগেই বরুন সাহার মা ফোন করেছিলো বহ্নিকে। তবে পিউয়ের শিখাদি আর বরুনদার যে বিয়ে হচ্ছে তাতেই দারুণ খুশি পিউ।

বহ্নি তারিখ স্থির হতেই শিউলি মাসীকে ফোন করে দিদিয়ার বিয়েতে আমন্ত্রণ জানালো। শিউলি মাসি তো ফোনে কেঁদেই ফেলেছে আনন্দে।
শিউলি মাসির থেকেই বাবা নামক ভদ্রলোকের ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করতেই অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘদিন পর একটা গমগমে কন্ঠস্বর কয়েক মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রাখলো বহ্নিকে।

কোনোরকমে বললো,’আমি বহ্নি,চিনতে পারছেন না নিশ্চয়ই! সম্পর্কে আমি আপনার মেয়ে’।বহ্নির গলা শুনে চোখে জল এসে পরলো অর্নবের। কোনোক্রমে বললো,’নিজের মেয়েকে চিনতে পারবোনা?ভালো আছিস তো ডল?’,বহ্নি যতোদূর সম্ভব গলাটা স্বাভাবিক রেখে বললো,’হ্যাঁ আমি আর দিদিয়া খুব ভালো আছি’।খুব শব্দটার ওপরে অকারন বেশি জোর দিলো বহ্নি।

তারপর বললো,’আগামী মাসের ১৫ তারিখ দিদিয়ার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। চাইছি বাবার কোনো দায়িত্ব পালন না করলেও বিয়ের দিন এসে অন্ততঃ সম্প্রদানের দায়িত্বটা পালন করবেন । বাড়ির ঠিকানায় কার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসার সময় সাথে করে শিউলি মাসিকে আনবেন,এইটুকুই বলবার ছিলো’।

কথাটা শেষ করেই বহ্নি ফোন কেটে দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। যে বাবাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো, সেই বাবার সাথে এই ভাবে কথা বলতে তার নিজেরও কি কম কষ্ট হয়! কিন্তু মায়ের মৃত্যুর জন্য মনে মনে এই লোকটাকেই দায়ী করে বহ্নি।

বহ্নিকে একা একা বসে চোখের জল ফেলতে দেখে, কাছে গিয়ে মাথায় স্নেহের হাত রাখলো সীমা। বহ্নি সীমাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। সীমা বললো,’আজ যে পিউয়ের বিয়ে। এইভাবে কান্নাকাটি করলে চলবে! পার্লার থেকে পিউকে সাজাতে লোক চলে এসেছে। ছয়টার মধ্যে আমাদের কিন্তু অঞ্জনাদের বাড়ি পৌঁছাতে হবে’।

সীমার কথায় বহ্নি চোখের জলটা মুছে মুখটা হাসিতে ভরিয়ে নিয়ে বললো, ‘এসো আন্টি আমি তোমায় সাজিয়ে দিই, শত হলেও মেয়ের মা বলে কথা!’, বহ্নির কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো সীমা। বললো,’আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি,তুই বরং শিখাকে তৈরি করে দিয়ে নিজেও তৈরি হয়েনে।আর একজন নাহলে দেরি হলে হইচই করে বাড়ি মাথায় তুলে বসবে’।

কথাটা মুখে বললেও সীমার আজ আর অসীমের অহেতুক চেঁচামেচির জন্য ভয় নেই । মনে মনে স্থির করে রেখেছে, পিউরা আমেরিকা পারি দেওয়ার পর সে নিজেই অসীমের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবে চিরতরে।যদিও জানে পল্লব আর বহ্নি জানতে পারলে তাকে জোর করে নিজেদের কাছেই আটকে রাখবে।

কিন্তু সেটা চায়না সীমা। বাকি জীবনটা বৃদ্ধাশ্রমে সেবার মাধ্যমে কাটিয়ে দিতে চায় সে। সেই ভাবে আগে থেকেই কথা বলে রেখেছে সোনারপুরের সংসপ্তক বৃদ্ধাশ্রমে।অনেক থেকেছে সবার মতো করে, এবার সীমা নিজের মতো করে বাকি জীবনটা বাঁচবে।

তবে ভাবছে বহ্নি আর শিখার যেহেতু মা নেই, তাই শিখার বিয়েতে মায়ের কাজটা পালন করে তারপর সব ছেড়ে বেরিয়ে পরবে। সব মিলিয়ে সীমার মনটা নির্ভার হয়ে গেছে। আর মাত্র কিছুদিন তারপরেই এই সংসার নামক খেলাঘর থেকে মুক্তি।

অপর প্রান্তে অর্নব ও ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পরে।কতোদিন পর তার আদরের ডলের গলার আওয়াজ পেলো। তার একটা ভূলের মাশুল গুনে যাচ্ছে গোটা পরিবার। তবে শিখাকে আবার কে বিয়ে করতে রাজি হলো!ভাবনাটা চেপে ধরলো অর্নবকে।
কিছু সময় পর ধাতস্থ হয়ে ঠিক করে ব্যাঙ্গালোরের ফ্লাইট বুক করবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here