#অশান্ত বসন্ত
(সপ্তদশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
**********************
পল্লবের মা,বাবা,বোন সকালের ফ্লাইটেই ব্যাঙ্গালোরে এসেছে।একপ্রকার পল্লবকে না জানিয়েই পিউয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন ওনারা।
ডেট ফাইনাল করতেই নাকি ব্যাঙ্গালোরে আসা।তাছাড়া ছেলের আংটি, ব্রেসলেটের মাপ,জুতোর মাপটাও নিয়ে যাবেন সাথে।
পল্লবের মায়ের ছোটোবেলার বান্ধবী অঞ্জনা মাসীর ছেলের সাথেই নাকি পিউয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
পল্লব জিজ্ঞেস করে,’অঞ্জনা মাসি বা ওনার ছেলে আমাদের পিউকে আবার দেখলো কবে?’,’উত্তরে ওর মা জানায়, ‘পিউয়ের ছবি দেখেই পছন্দ করেছে অঞ্জনা।আর এবার তো মুখোমুখি ও দেখাটা হয়ে যাবে।
ছেলেটা এম.টেক ইঞ্জিনিয়ার,দেখতেও সুদর্শন আর কথাবার্তা ও ভদ্রোচিত’।
পল্লব বুঝতে পারেনা এই মুহুর্তে ওর ঠিক কি রিএক্ট করা উচিৎ!একটু চুপ করে থেকে বললো,’ছেলে -মেয়ে দুজন দুজনকে দেখলোনা পর্যন্ত আর তোমরা ডেট ফাইনাল করতে কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে চলে এলে,এমনকি আমাকে একবার জানালেনা পর্যন্ত ‘।
পল্লবের মা বলেন,’উফ আসতে কথা বল,তোর বাবা বাথরুম থেকে শুনতে পাবে।কেন তুই তো দেখেছিস ছেলেকে,কথাবার্তা ও বলেছিস,ভালো লাগেনি তোর?’একটু থেমে গিয়ে বললেন,’তোকে তো সেই কারনেই অঞ্জনার ঠিকানা দিয়ে দেখা করে আসতে বলেছিলাম।আর তুই তো ফোনে বললি বেশ ভালো ঘরদোর অঞ্জনা মাসির,আর ওনার ছেলে,মেয়ের ব্যবহারটা ও ভীষণ ভালো’।
পল্লবের মনে পরে যায় মাস কয়েক আগে মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে একবার গিয়েছিলো অঞ্জনা মাসীর বাড়িতে।তবে তখন তো আর জানতোনা মায়ের মনে এসব চলছে!হ্যাঁ ওনার দুই ছেলে মেয়েই উচ্চশিক্ষিত।ওদের ব্যবহারটাও অমায়িক, এমনকি বাড়ি ঘর ও খারাপ নয়।কিন্তু তা বলে আজকালকার দিনে এতো তাড়াতাড়ি পিউয়ের কেন বিয়ে দিতে চাইছে মা বাবা সেটাই এখনো ক্লিয়ার হয়নি পল্লবের কাছে।মনটা বিরক্তিতে ভরে যায় সকাল সকাল।
যদি ও আপাতত কথা না বাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে বাজারের দিকে ছোটে পল্লব। এক ঘন্টার মধ্যে ওকেও বের হতে হবে ভিক্টোরিয়া হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আজই শিখার প্রথম অপারেশনের ডেট পড়েছে।গতকালই বহ্নির সাথে গিয়ে শিখাকে হসপিটালে এডমিট করে দিয়ে এসেছিলো পল্লব ।তারপর প্রায় সারা রাতই বহ্নি আর পল্লব ফোনে ছিলো।বহ্নি খুবই কান্নাকাটি করছিলো।
আসলে ডক্টর এ.কে.গুপ্তা শিখার কেসটা নিতেই চাইছিলেননা।অনেক গুলো টেস্ট, এক্স-রে ইত্যাদি করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে,শিখার অপারেশনটা খুবই রিস্কের।
একটা নয় দুটে অপারেশন করতে হবে মিনিমাম ছয় মাস অন্তর।তারপরেও যে ঠিক হয়ে যাবে তেমন কোনো গ্যারান্টি নেই।হতে পারে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে এমনকি ব্লিডিং বন্ধ না হলে প্রানহানিও ঘটতে পারে।
৫% মাত্র চান্স আছে ভালো হওয়ার। তাও সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।বহুদিন স্পিচ থেরাপি নিতে হবে অপারেশন যদি সাকসেসফুল হয় তাও।
বহ্নি কথাগুলো শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো ডাক্তার বাবুর সামনেই।তারপর বলেছিলো,’আমি যে অনেক আশা নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।আমার মায়ের একমাত্র এটাই স্বপ্ন ছিলো যে আমার দিদিয়া সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।আপনি তো শুনেছি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন কঠিন কঠিন কেস,আর আপনার অপারেশন সবসময়ই সাজসেসফুল হয়।আর একটা চ্যালেঞ্জ নিননা ডাক্তার বাবু।প্লিজ আমার দিদিয়াকে ভালো করে দিন’।
উনি বেশ কিছুক্ষণ সময় চুপ করে থেকে বলেছিলেন,’ রিস্কটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে’,বহ্নি বলেছিলো,কিসে রিস্ক নেই বলুন তো?রিস্ক না নিলে তো জীবনে পিছিয়ে পরতে হয়।আর দিদিয়া যে জীবন কাটাচ্ছে সেটা কি একটা জীবন বলুন?প্লিজ আপনি অপারেশনের ডেটটা দিন।আমার বিশ্বাস আপনার হাতে আমার দিদিয়ার কিছু খারাপ হতেই পারেনা’।
বহ্নির কথায় আবার চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিলেন ডাক্তার বাবু।তবে বহ্নির অর্থনৈতিক অবস্থা আন্দাজ করে বেসরকারি নার্সিংহোমে নয়,ভিক্টোরিয়া হাসপাতালেই ডেট দিয়েছেন।
আর আজ সেই অপারেশন। বহ্নিকে মনে জোর দিলেও পল্লবের নিজেরই বেশ টেনশন হচ্ছে।অপারেশনটা না করালেই পারতো বহ্নি।সত্যি যদি খারাপ কিছু একটা হয়ে যায় নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে বহ্নি!কথাটা ভেবেই অস্থির লাগছে পল্লবের।
তিন দিনের মতো বাজার করে নিয়ে এসে কিচেনে রেখে দিয়ে,পল্লব ওর মাকে জানায় ওকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।ওর বন্ধুর দিদির অপারেশন আজ।পল্লবের কথা শেষ না হোতেই পিউ বলে ওঠে,’সেকিরে দাদাভাই আমরা তো সবে এলাম।আর তুই আমাদের ফেলে চলে যাবি?যেতে হলে আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে হবে’।
পল্লব হেসে বলে,’পাগল নাকি তুই?হসপিটাল কি শপিং মল নাকি যে ঘুরতে যাবি?’,কিন্তু পিউ নাছোড়বান্দা। যেতে হলে ওকে নিয়েই যেতে হবে,নাহলে যাওয়া কেন্সেল করতে হবে।অগত্যা পল্লব বলে,’পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসতে পারলে তবেই নিয়ে যাবো’।
পিউ কুর্তিটা চেঞ্জ করে,চুলটা আঁচড়ে দুমিনিটের মধ্যে কাছে এসে দাঁড়ায়।পল্লব হেসে ফেলে বোনুর হাত ধরে বলে, ‘চল তাহলে’।
পল্লবের বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ওদের বেরিয়ে যেতে দেখে সীমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় গেলো ওরা?’,সীমা বললো,চা টা জুড়িয়ে যাচ্ছে, আগে খেয়ে নাওতো’।
গাড়িতে উঠেই পল্লব বলে,’বুঝতে পারছি অনেক কথা আছে আমার সাথে।আমি গাড়িটা স্টার্ট দিচ্ছি,তুই তোর মুখটা স্টার্ট দে’।
দাদাভাইয়ের কথায় কেঁদে ফেলে পিউ।বলে,’বিয়েটা আটকা দাদাভাই।আমি সত্যিই এতো তাড়াতাড়ি এই বিয়ের গ্যাড়া কলে পরতে চাইছিনা।আপাতত কম্পিটিটিভ পড়ে চাকরির পরীক্ষা গুলোতে বসতে চাইছি।চাকরি করা কালীন যদি কাউকে সত্যিই মন চায়,তখনই একমাত্র বিয়েতে বসবো’,।
পল্লব বলে,’একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।কিন্তু কথাটা কি বলেছিস বাবাকে?’,পিউ কেঁদে ফেলে আবারো বলে,’আমার কি তোর মতো সাহস আছে নাকি?বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই ভয় লাগে’।
পল্লব হেসে বলে,’না তাকিয়ে বলবি।জেনে রাখ জীবনটা তোর,তাই সেই জীবনের সিদ্ধান্তটাও কেবল তোরই হওয়া উচিত।দ্যাখ মা বাবার কথা শোনা আমাদের কর্তব্য হলেও তাদের ভূল সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে জীবন কাটানোটা অনুচিত। জীবন একটাই,তাই নিজের ইচ্ছে ডানায় ভর করে বিন্দাস বাঁচা উচিত ‘।
পল্লবের কথায় পিউয়ের মুখের কালো মেঘ কেটে যায়।চোখের জল মুছে বলে,’তুই আমার সঙ্গে আছিস তো?’পল্লব হেসে বলে,ইয়েস মাই সুইট সিস,এবার তো হাসি মুখটা দেখা’,পিউ খিলখিল করে হেসে উঠলো।
পল্লব এবার ফোন করে বহ্নিকে বলে,’শোনো আর পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই হসপিটাল পৌঁছোচ্ছি,একদম চিন্তা কোরো না।সব ঠিকঠাক মতোই হবে’,পিউ ফিচেল হাসি হেসে বলে,’এটা বন্ধু ছিলো না বান্ধবী ছিলো রে?’
(চলবে)