#অশান্ত বসন্ত
(চতুর্দশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
**********************
মা বলতো,’বিপদেরা আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়।কখনো বা জানিয়ে আসে, কখনো না জানিয়ে।কিন্তু যখন আসে সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে যায়।বিপদে কখনো ভেঙে পরবে না। শক্ত মনে মোকাবিলা করবে’।
বহ্নি বিপদের ভয়ে পিছিয়ে পরা মেয়ে ছিলোনা।বরাবরই করুনার কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যাবতীয় বিপদের মোকাবিলা করে এসেছে সে।কিন্তু আজকে যেন বিপদের পাহাড়টাই আচমকা ভেঙে পরেছে ওর মাথায়।মায়ের এইভাবে আভাস না দিয়ে চলে যাওয়াটাকে সে আর কি বলতে পারে।
বহ্নির ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মাকে ডাকতে।কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি দুটোই তার বিপক্ষে।চোখের জল যদিও বাঁধ মানছেনা,ঝরেই যাচ্ছে অবিরাম।নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে বহ্নির।
এদিকে মেঘেদের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের আকাশ যান। বহ্নির চোখ দুটো সেই মেঘেদের মধ্যেও মাকেই খুঁজে চলেছে।
মা ছোটোবেলাতে দুষ্টুমি করলে বলতো,ওদের দিম্মা নাকি মেঘেদের আড়ালে থেকে ওদের দেখে।যখন ওরা মায়ের কথা শোনেনা,দিম্মার চোখের জল তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরে।আর যখন ওরা দুষ্টুমি করেনা তখন দিম্মার খুশি রোদ্দুর হয়ে হাসি বিছিয়ে দেয়।
বহ্নির শিশু মন এই বিশ্বাসটাকে আঁকড়ে নিয়ে বড়ো হয়েছে।যতই সিলেবাসের বই গুলো বৃষ্টি হওয়ার সাইনটিফিক রিজন দেখাক না কেন,বহ্নির ভাবতে ভালো লাগে,কোথাও না কোথাও আমাদের প্রিয় মানুষেরা রয়ে যায়।আমাদের খুশিতে তারা খুশি হয়,আমাদের দুঃখে তারাও কষ্ট পায়।
মেঘগুলো বহ্নির হাতের নাগালে।মেঘের মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছেনা মাকে।বহ্নি অস্ফুটে বলে ওঠে,’মা মাগো,আমি যে আর পারছিনা’,পল্লব বহ্নির হাতের আঙ্গুল গুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জোরে চাপ দিলো।বহ্নি এবার একটু আওয়াজ করেই কেঁদে উঠলো।
কোনোভাবেই মানতে পারছেনা বহ্নি ওর মা আর ওদের সাথে নেই।অবশ্য হঠাৎ মানাটা সম্ভব ও নয় আর স্বাভাবিক ও নয়।আছের থেকে নেই হয়ে যাওয়াটা মাত্র এক চুল ব্যবধান। কিন্তু নেই এর মধ্যে যে হাহাকার লুকিয়ে আছে,সেটা সেই বোঝে যার প্রিয় মানুষ হঠাৎই আছে থেকে নেই হয়ে যায়!
বিশেষ করে সেই মানুষটি যদি মা হয়।তাহলে তো হাহাকারের আর সীমা পরিসীমা থাকেনা।পল্লব অনেক চেষ্টা করেও বহ্নিকে কিছু খাওয়াতে পারেনি।জলটাও গলা থেকে নামায়নি মেয়েটা।ফ্রুট জুস খাওয়াবার চেষ্টা করেছিলো,কিন্তু মুখটা খোলাতেই পারেনি।
বহ্নি সেই গাড়িতে বসা থেকে ফ্লাইটে বসা সব কিছুই পল্লবের কথায় যন্ত্রবৎ করে গেছে।শুধু এই একটা কথাই শোনেনি।পল্লব নিজেও সে কারনে কিছু খেতে পারেনি।মাথাটা ওর ও ভার হয়ে আছে।কড়া করে এক কাপ কফি দরকার ছিলো।কিন্তু মেয়েটা কিছু মুখে দিচ্ছেনা,সেখানে কি করে ও কিছু মুখে দেয়।অগত্যা সেও না খাওয়া অবস্থাতেই বসে।
দমদম থেকে কাঁথি যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি বুক করে নিতে হবে।পল্লব মনে মনে এটাই ভেবে নেয়।
ফ্লাইট ল্যান্ড করতে আর বেশি সময় নেই।পল্লব নিজের সাথে বহ্নির সীট বেল্টটা ও লাগিয়ে দেয়।
বহ্নি শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।আর মাঝেমধ্যে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে।
বহ্নিকে এভাবে দেখতে হবে ভাবেনি পল্লব।অবশ্য এমন অদ্ভুত কথা ভাবার কথাও নয়।
এতো যে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা অথচ চাইলেও এই কষ্টের ভাগীদার সে হতে পারছেনা।আসলে যে হারায় সেই শুধু উপলব্ধি করতে পারে হারানোর যন্ত্রণাটা, বাকিরা তো শুধু শুকনো শান্তনাই দিতে পারে।
পল্লব এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসলো বহ্নিকে সাথে করে।কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁথি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ও বুক করে নিলো।
ড্রাইভার এর পাশে বসতেই পারতো পল্লব,কিন্তু বহ্নির বর্তমান পরিস্থিতি পল্লবকে বহ্নির পাশেই বসালো।
বহ্নির শরীর ছেড়ে দিয়েছে ট্যাক্সিতে বসে।ঘাড়টা একদম এলিয়ে গেছে।পল্লব ব্যস্ত হাতে বোতল থেকে জল বের করে বহ্নির চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতে থাকলো।বহ্নি জলের ছিটেতে চোখ মেললো। রুমালটা বের করে যত্নের সাথে বহ্নির মুখ মুছিয়ে দিলো পল্লব।বহ্নি পল্লবের হাত ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো।
ট্যাক্সি খালি রাস্তা দিয়ে জোরে চলছে।বহ্নির মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখলো পল্লব।বললো,’আর কেঁদোনা এবার একটু শক্ত হও।জেনে রাখো আমি তোমার সাথে সবসময় আছি,থাকবো’।
বহ্নি এটা বুঝতে পারছে যে,পল্লব না থাকলে কোনোভাবেই এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো সম্ভব হতো না। সন্ধ্যে বেলাতে যার বন্ধুক্তের হাতকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছিলো ক্যাফে থেকে।রাতে তার হাত ধরেই এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে।
ওর দিদিয়া এখন কার কাছে আছে!কি করছে!হঠাৎ দিদিয়ার কথা ভেবে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলো বহ্নি।দিদিয়া যে মা আর বহ্নি ছাড়া কারো সাথেই থাকেনি কখনো।হ্যান্ড ব্যাগ হাতড়ে ফোনটা বের করে শিউলি মাসিকে ফোন করলো বহ্নি।নিশ্চিন্ত হলো যে শিউলি মাসি তাদের বাড়িতে দিদিয়ার কাছেই আছে।
বহ্নির মনে পরে গেলো,বাবা নামের সেই লোকটাও কানাডা থেকে রওনা দিয়েছে।যতই হোক মাকে ছুঁতে দেবেনা বহ্নি।যার খামখেয়ালীপানায় তাদের জীবনে এতো বড়ো ঝড় উঠেছিলো,তাকে কিছুতেই কাছে ঘেষতে দেবেনা মায়ের।বহ্নির চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো,চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো।পল্লব বহ্নির মুখের ভাবান্তর দেখে একটু অবাক হলেও মুখে কিছুই বললোনা।
ট্যাক্সি তার নিজের বেগে ছুটতে থাকলো।ধীরে ধীরে আলোতে ভরে গেলো চারিদিক।পল্লবের পারমিশন নিয়ে গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার চা খেয়ে আসলো।চা টা পল্লব কেও টানছিলো খুউউব।কিন্তু বহ্নিকে চায়ের জন্যও রাজি করানো গেলোনা বলে পল্লব ও আর চা খেলোনা।
‘মা আর একটু অপেক্ষা করতে পারলেনা?আমি যে তোমার স্বপ্ন পূরণ করাকেই নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নিয়েছি।তুমি চেয়েছিলে,দিদিয়াও কথা বলবে,দিদিয়ার ও স্বাভাবিক জীবন হবে।আমিও তো ঠিক এটাই চাই মা।আমি তো এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।যতো টাকাই লাগুক, আমি ব্যবস্থা করে অপারেশনটা করাবোই।
তুমি দেখবে না মা তোমার শিখাও কথা বলছে…’,মনে মনে আরো হাজারো কথা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে বহ্নি।ওর বন্ধ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে।
পল্লব সেই দিকেই হা করে তাকিয়ে আছে।আর ভগবান কে বলছে,’বহ্নিকে শক্তি দাও’।
(চলবে)