#অশান্ত বসন্ত
(ত্রয়োদশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
***********************
‘কিগো শিউলী ফোন ধরলো বহ্নি?’,শিউলী আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে বললো,’নাগো রনির মা সেই কখন থেকে ফোন করে চলেছি।বেজে বেজে নিজে থেকেই কেটে যাচ্ছে ফোনটা’।
‘খবরটা কি তাহলে দিতে পারোনি?’,রনির মায়ের কথায় শিউলি বললো,’না না প্রথম যখন ফোনটা ধরেছিলো,তখনই তো জানালাম।শুনেই এমন কাঁদতে শুরু করলো যে,কেটে গেলো ফোনটা’।
একটু থেমে বলে,’মনে হয় রাস্তায় ছিলো মেয়েটা।গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।ভগবান করে ওর আবার যেন কিছু না হয়’।
‘শিখা কিছু খেয়েছে গো?’,কমলার প্রশ্নের উত্তরে শিউলি বললো,’ও মেয়ে তো কেঁদেই চলেছে সমানে।ওঠানোই যাচ্ছেনা মায়ের কাছ থেকে’।
রনির মা বললো, ‘ওদের বাবা তো এখন বিদেশে থাকে।করুনার সাথে শুনেছি ভালোবাসাবাসির বিয়ে ছিলো। মুখটা দেখলে বোঝাও যেতোনা ধড়িবাজ লোক,তলে তলে এদিকে অন্য মেয়ের সাথে…. ‘রনির মায়ের কথা শেষ না হতেই সায় দিলো কমলা।
শিবানী বলে উঠলো,’তা আর বলতে।ঘরে সুন্দরী বৌ,দুটো বড়ো মেয়ে ফেলে তুই কোন আক্কেলে যাস বিয়ে করতে!তাও শুনেছি নিজের বড়ো মেয়েটার বয়েসী মেয়ের সাথে বিয়ে করেছে!’
শিউলি চোখ মুছে বলে,’এসব বরের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয়।আমিই তো করুনাকে সব জানাই’।
শিবানী বললো,’শুধু ভাবি কেমন করে ঠকাচ্ছিলি ওই ভালো মানুষ বৌটাকে!’।
রনির মা বললো,’মেয়েটা নাকি এক অফিসেই চাকরি করতো অর্নবদার সাথে।আমায় রনির বাবা বলেছে,সেই থেকেই লটরপটর’।
শিবানী বললো,’আমি তো শুনেছি অর্নবদা প্রায় প্রতিদিনই অফিস ফেরত, মেয়েটার ফ্ল্যাটে গিয়ে সময় কাটিয়ে তবে বাড়ি ফিরতো’।
কমলা ভালোমানুষি মুখ করে বললো,’আমি বাজে দেখতে হলেও তোমাদের নন্দদা কিন্তু আমায় ছেড়ে কোথাও কখনো যায়নি’।
রনির মা বললো, ‘কি জানো রাখতে জানতে হয় বেঁধে। বোঝোনা পুরুষ মানুষের ওমন একটু ছুকছুকে বাই থাকেই’।
কমলা বললো,’ঠিক বলেছো,বৌদের দায়িত্ব সব কিছু নজর করে রাখা’।
শিবানী বললো,’করুনাতো ওর মেয়েদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।আর ওই দিকে বর কেষ্ট লীলা চালিয়ে যাচ্ছিলো’।
রনির মা বললো,’সেটাই, পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করেছো তো ঠকেছো।ব্যাটাদের গাছের ওপরেরটাও চাই আবার তলানিটাও,সবাই তো আর রনির বাবা নয়’।
কমলা বললো,’করুনাদির বাপের বাড়ি কোথায় জানো?সেখানে কেউ নেই?একটা তো খবর দিতে হতো।মেয়েটা তো সেই পরে পরে কাঁদছে।এই সময় জ্ঞাতি গুষ্টি লাগে।আমরাই বা কি করতে পারি’।
শিবানী বললো,’সেই কখন এসেছি,রাতের রান্নাটাও চাপাইনি’।
রনির মা বললো,’আমি তো রনিকে বলেছি ক্লাবে গিয়ে কথা বলতে।পাড়ার লোকজনের থেকে চাঁদা তুলে দাহটা করিয়ে দিতে,নাহলে বরফ চাপা দিয়ে রাখতে’।
কমলা বললো,’এতো সময় এইভাবে তো আর বডি ফেলে রাখা ঠিক নয়। তবে একটা পার্মিশন নিতে হতো মেয়েটার,নাহলে পরে আমাদের ওপরেই দোষ চাপাবে’।
শিউলি বললো,’বহ্নির ফোনটা এখন নন রিচেবেল বলছে,কি যে করি!’
তারপর শিখার কাছে গিয়ে ইশারাতে বোঝাতে চেষ্টা করলো আর কোনো ফোন নাম্বার কি আছে!
শিখা নিজের মতো করে কথাটা বুঝে উঠে দাঁড়ালো।তারপর তোষক তুলে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো শিউলি মাসির দিকে।শিউলি দেখলো কার্ড টা ওদের বাবার।সেখানেই ফোন করলো।
অর্নব খবরটা জানার সাথে সাথেই মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পরলো।
ভাবতেই পারছেনা, করুনা নেই। ওর অন্যায়ের খেসারত দিতে হলো করুনাকে।
কোনোরকমে বললো,বডিটা পাঠিয়ে মর্গে দিয়ে প্রিজার্বড করতে।জানালো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্লাইট ধরবার চেষ্টা করছে।
রনির একাউন্ট নাম্বার জেনে ওর একাউন্টে টাকা ও ট্রান্সফার করে দিলো।
রাস্তায় এক জায়গায় জটলা দেখে পল্লব গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়।গিয়ে দেখে বহ্নি পরে আছে অজ্ঞান হয়ে।
সবাইকে সরিয়ে বহ্নিকে কোলে তুলে গাড়ির পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারের দিকে রওনা হলো।
বহ্নি কফি শপ থেকে বেরিয়ে আসার পর বেশ কিছু সময় ওই কফি শপেই বসে কাটিয়েছিলো পল্লব।তারপর অফিসের পার্কিং এ গিয়ে ধীরেসুস্থে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিলো।
এখন এতো বেশি হাঁত কাঁপছে যে স্টিয়ারিং সোজা ভাবে ধরে রাখতে পারছেনা।কোনো ভাবে তাও ডাক্তার চ্যাটার্জি কে ফোনটা লাগায়। উনি জানান চেম্বারেই আছেন।
ইতিমধ্যে বহ্নির জ্ঞান ফিরে আসে।বহ্নি ধড়ফড় করে উঠে বসে।’কে আপনি,গাড়ি থামান শিগগিরই’।
পল্লব সাইড করে গাড়ি থামাতেই বহ্নি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে ছুটতে থাকে।
পল্লব ও বাধ্য হয়ে বেরিয়ে ওর পিছু নেয়।বহ্নির পথ আগলে কারন জানতে চাইতেই বহ্নি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।বলে,’ও আপনি!জানেন আমার মা মারা গেছে।আমাকে এক্ষুনি কাঁথি যেতে হবে’।
পল্লব এতোক্ষণে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে।বহ্নির হাত ধরে বলে, ‘কাঁথি কি সামনের মোড়ে?যে এক দৌঁড়ে চলে যেতে পারবেন?প্লিজ আমায় ভরসা করে গাড়িতে উঠুন।আমাকে সামলাতে দিন ব্যাপারটা।বয়েসে আর অভিজ্ঞতায় দুটোতেই আমি বড়ো আপনার থেকে।প্লিজ প্লিজ আমার কথাটা শুনুন,গাড়িতে বসুন’।
বহ্নি কাঁদতে কাঁদতে বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসে।পল্লব গাড়িতে না উঠে ফোন থেকেই টিকিট আছে কিনা ঘেটে দেখে, তারপর রাত সাড়ে দশটায় এয়ার এশিয়ার দুটো ফ্লাইটের টিকিট বুক করে।
গাড়িতে উঠে বহ্নিকে বলে,’এখানে কোথায় থাকেন আপনি, আগে সেটা জানান’।বহ্নি কোনোরকমে হোস্টেলের ঠিকানাটা বুঝিয়ে দেয়।
দশ মিনিটের মধ্যে বহ্নির হোস্টেলের নীচে পল্লবের গাড়িটা থামে।পল্লব নিজেই গাড়ির পিছনের দরজা খুলে হাত ধরে বহ্নিকে নামায়।
তারপর বলে,’যান তিরিশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসুন, সাড়ে দশটায় ফ্লাইট ।আর যেখানে যেখানে ফোন করবার প্রয়োজন মনে হয় করে নিন,আমি নীচে আছি’।
বহ্নি এবারো বাধ্য মেয়ের মতো রুমে ঢুকে যায়।প্রথমেই শিউলি মাসিকে ফোন করে।শিউলি মাসি জানায়, বডি ওরা মর্গে দিয়েছে।কারন ওদের বাবার সেটাই ইচ্ছে।উনিও কানাডা থেকে রওনা দিচ্ছেন’।
বহ্নির বাবার কথায় মুখটা তেতো হয়ে গেলো।এই বাবার জন্যই সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলো ওদের।না কোনো দিন ক্ষমা করতে পারবেনা বাবা নামের লোকটাকে।
বহ্নি এরপর মলের মালিককে ফোন করে জানায়,সঙ্গে কলেজের প্রফেসরদের।কারন ওর ফিরতে সময় লাগবে।
এবার বাথরুমে গিয়ে কোনোরকমে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে এসে ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়।সব কিছু মাত্র কুড়ি মিনিটেই সেরে বেরিয়ে আসে।
পল্লব বলে,’দশ মিনিট রেস্ট নিয়ে নিতে পারতেন।সময় ছিলো কিন্তু, ফ্লাইট তো সেই সাড়ে দশটায় ।বহ্নি জানালো,সে এয়ারপোর্টেই গিয়েই অপেক্ষা করতে চায়।
পল্লব গাড়ির সামনের দরজা খুলে দেয়।বহ্নি কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকেই উঠে বসে।পল্লবের গাড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে ছোটে।
(চলবে)