#অশান্ত বসন্ত
(একাদশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
***********************
কানাডাতে গিয়ে অর্নব নিজেকে আবার কাজের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়েছে।অর্নবের অবসর বিনোদনের বাইরে গিয়ে এখন একটাই কাজ,’নিজের মুখোমুখি হওয়া’ বা ‘নিজেকে মূল্যায়ন’।
আসার আগে অদ্রিজাকে মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়ে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত সে।
অর্নবের বিশ্বাস, অদ্রিজাও এটাই চেয়েছিলো।তাই মিউচুয়াল ডিভোর্সের কথাতে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলো।
সাধারণত কিছু কিছু মানুষের মূল্যায়ন তাঁদের জীবনকালেই সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
আবার কিছু মানুষের আসল মূল্যায়ন শুরু হয় মৃত্যুর পর থেকে।
অর্নবের বিশ্বাস তার মৃত্যু কারোর মনেই কোনো হতাশা এনে দেবেনা।কিন্তু সত্যিই কি তাই!
বহ্নিকে যখন যে জানালো,কানাডায় চলে আসবে,তখন করুনা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলো।
অর্নবের সাহস হয়নি এগিয়ে গিয়ে করুনার চোখের জল মোছাবে,কাছে টেনে নেবে করুনাকে,সব ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে।আসলে কোনো না কোনো ভাবে নিজেকেই সে ক্ষমা করতে পারেনি।
কতো কম সময় দেখা হতো করুনার সাথে।একটা দুটো কথা হতো, সেটাই ছিলো অর্নবের কাছে অনেকখানি পাওয়া। তারপর বিয়ে হলো,শরীরে শরীর মিললো।হৃদয় কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বেষ্টনীতে ঘিরে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় ঘেরা দুটো শরীর-মন ডুবে থাকতো নিজের খেয়ালে।
কিন্তু সময় ধীরে ধীরে দুটো কাছের মানুষের মাঝেও একটা অদৃশ্য পর্দা তুলে দেয়।যে দাম্পত্য দুটো মানুষের স্বপ্ন কে সফল করে তোলে,তাও একদিন ফিকে হয়ে যায়।
দুজনের মাঝে যেটুকু সেতু সেও তার বাচ্চাদের জন্যই টিকে থাকে।
অভ্যস্ত সংসারে দুটো মানুষ যেন দুটো দ্বীপ,মাঝে লবনাক্ত সমুদ্র।একই হাওয়া দুটো দ্বীপে বয়ে চলে,শুধু ঋতু পরিবর্তন হয়না।
সে কারনেই বুঝি বাতাসের প্রবল মাতনে নতুন হাওয়ার অসীম টানে অদ্রিজার কাছে যাওয়া।মেদের মজলিসে আনন্দের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছোনো।
আর এখন সব হারিয়ে ফেলবার পরেও, সময় তাকে মাঝেমাঝেই টেনে নিয়ে যায় গভীর পাকে।তাই সময় স্রোতে এখন শুধুই গড়িয়ে চলা।আর দিন শেষে হোঁচট খাওয়া স্তূপীকৃত কুশীলবে।
এখন এতো ভীড়েও তার একলা বাউল মন।যে মন জীবনের প্রতি নির্লিপ্ত।তবু যদি ফোনে ডাক আসে করুনার!তবু যদি বাবা বলে ডেকে ওঠে তার আদরের ডলি!এই একটা আশাই বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে।আজকাল বড়ো মেয়ে শিখার প্রতি ও কেমন টান অনুভব করে।হারিয়ে ফেলবার পরেই বুঝেছে ওরা কতো মূল্যবান ছিলো ওর জীবনে।
মেয়েটা ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিলো।তারমানে পল্লবের সঙ্গে দেখা করবার ক্ষেত্রে আপত্তি নেই ওর।
মানে সত্যিই আগামীকাল মেয়েটার মুখোমুখি হবে কফিশপে!পল্লবের আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে।যদিও আনন্দ পাওয়ার মতো কিছুই হয়নি এখনো।বাকি আছে আরো অনেক পথ চলা।
পল্লবের মনে হয়না আজ রাতে আর ঘুম আসবে।
মেয়েটা ফোন রেখে দেওয়ার পর থেকে মনের ভিতর অসহ্য আবেগের স্পন্দন অনুভব করতে পারছে পল্লব।
যদিও সবকিছুই প্রায় অনিশ্চয়,তবু অসম্ভবও নয়।আসলে দূর থেকে সব সমস্যাই তীব্রতর মনে হয়।কাল্পনিক আতঙ্ক আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।মনের ভিতর তাই সবসময়ই ‘গেল’ ‘গেল’ রব।
সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলে হয়তো সব আতঙ্কের অবসান হতে পারে, উৎকন্ঠার কারনটিও প্রশমিত হতে পারে।
ভেবেছিলো আগামীকাল দেখা করে মনের সব কথা গুলো জানাবে।জানাবে যে ওকে এতোদিন দুর থেকে ভালোবেসেই নিজের মনের আকাশকে রাঙিয়ে তুলতো পল্লব।
তবে মনে হচ্ছে এখনো সময় আসেনি কথাটা বলবার। বিশেষ করে যে মেয়েটি ওকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো,এমনকি চড় পর্যন্ত মেরেছে,তাকে ভালোবাসি বললে আবারো রিজেক্ট হতে হবে। দেখা করতে যে রাজি হয়েছে আপাতত এটাই অনেক।
না আগে মেয়েটির সাথে মিশতে হবে।সাথে নিজের মনের ভালোবাসার প্রকাশকে সচেতন ভাবে আড়াল রাখতে হবে।
আগে পরিচিতি পর্বটা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ,মেয়েটির মনে জায়গা করে নিতে হবে।তারপর না হয় বলা যাবে,’ভালোবাসি তোমায়।ভীষণ -ভীষণ ভালোবাসি’,গভীর আবেশে পল্লবের চোখ বুজে আসলো।
এই প্রথম কলেজে যায়নি বহ্নি।আসলে শেষ রাতের দিকে ঘুমটা এমন ভাবে আসলো যে মোবাইলের এলার্মটাও কানে আসেনি।সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙবার পরেও হাই তুলছে বার বার।আঁচল পাশের বেডে নেই।ওকে তো একবার ডাকতে পারতো।যাক গিয়ে মলে তো যেতেই হবে কাজে।এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে না।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলো বিছানায়।আর মনে পরে গেলো সেই লোকটার সাথে দেখা করতে হবে।কেমন যেন একটা অস্বস্তি ছেয়ে গেলো মনে।ওকে সেই লোকটা কি বলতে চায় এটা ওর কাছে একটা বড়ো প্রশ্ন!বিছানা থেকে নেমে স্নান সেরে আসলো।ভিজে চুলটা আঁচড়ে নিয়ে কফি কালারের কুর্তি আর সাদা লেগিংস্ টা পরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার দেখলো নিজেকে।তারপর ঝোলা ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পরলো।
পল্লব নিজেকে অনেক কষ্টে শাসন করে রেখেছিলো সাড়ে পাঁচটা অবধি।
কিন্তু আর পারছে না।একটা কি ফোন করবে মেয়েটাকে।কিছু যদি মনে করে!কিন্তু ফোন না করলে তো জানতেও পারবে না মেয়েটা আদৌ আসবে কিনা।ভাবতে ভাবতে ফোনটা করেই ফেললো পল্লব।
(চলবে)