#অশান্ত বসন্ত
(নবম পর্ব)
#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য
জয়া চক্রবর্তী
*********************
পল্লবের পলকহীন চোখের অপার মুদ্ধতা বহ্নিকে অপ্রস্তুত করে দিলো।’দরজাটা ছাড়লে আমি ভিতরে আসতে পারি’,বহ্নির কথায় কোনো ভাবে দরজাটা ছেড়ে দাঁড়ায় পল্লব।ভাগ্যিস ওর ফুলমানি কলিং বেল শুনে নিজেও বেরিয়ে এসেছিলো।
বহ্নিকে দেখে ঘরের ভিতরে আসতে বললো ফুলমানি।বহ্নি নিজের ঝোলানো ব্যাগ থেকে ব্লাউজ চারটি বের করে টেবিলের ওপর রাখলো।ফুলমানি নাড়িয়ে চাড়িয়ে ব্লাউজ গুলো দেখে প্রফুল্ল মনে, বহ্নিকে সোফাতে বসতে বলে ভিতরে গেলো টাকা আনতে।
ফুলমানি ভিতরে যেতেই একটু ধাতস্থ হয়ে পল্লব বললো,’আমাকে চিনতে পারলেন?সেই যে একদিন আপনার পিছনে গিয়েছিলাম কথা বলবার জন্য।আর আপনি বিনা কারনেই ভয় পেয়ে দৌঁড়োতে শুরু করেছিলেন’,বহ্নি এবার বিরক্ত মুখে পল্লবকে আপাদমস্তক দেখলো।
এমনিতেই গতকাল রাত থেকে বহ্নির মাথা কোনো কাজ করছেনা।বাবা যাওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেদের সামলে ছিলো।বহ্নি বুঝতে পারছেনা ওর বাবার ফিরে আসাটা ওদের জীবনে আবার কোনো ঝড় তুলবে কিনা!
বলতে গেলে এক রাতের মধ্যেই বহ্নি পালটে ফেলেছে নিজেকে।সেই ভীতু বহ্নি আজ মিসিং।বহ্নি ঠিক করেছে ওষুধ গুলো কিনে বাড়ি ফিরে মুখোমুখি বাবার সাথে কথা বলবে।ও কোনো ভাবেই আর চায়না ওই লোকটা ওদের জীবনে ফিরে আসুক।
বহ্নিকে চুপ থাকতে দেখে পল্লব বললো,’আপনার সাথে কথা বলবার জন্যই আজ কাঁথিতে আসা।ভাবিনি এতো সহজেই মুখোমুখি হতে পারবো।বহ্নি কপাল কুঁচকে পল্লবের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমার সাথে আপনার কথা বলবার কি কারন থাকতে পারে সেটাই তো বুঝছিনা!আমি তো চিনিওনা আপনাকে’।
ইতিমধ্যে পিউ এসে দাঁড়িয়েছে পল্লবের পাশে।সেটা খেয়াল করে পল্লব বললো,’আপনি তো এখনই বের হবেন,আপনার সাথে যেতে যেতেই না হয় কারনটা বলবো’,পল্লবের কথা শেষ হতে না হতেই বহ্নি বললো,দুঃখিত আমি আজ ব্যস্ত, এছাড়া আপনাকে চিনিনা তাই কথা বলবারও কোনো প্রয়োজন দেখছিনা’।
পল্লবের ফুলমানি ঘরে ঢুকতে গিয়ে শান্ত মেয়েটাকে ওরকম রাগি গলায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গেলো।তবে সেটা বুঝতে না দিয়েই ব্লাউজের টাকাটা বুঝিয়ে দিয়ে আরো দুটো শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বললো,’এগুলোর ব্লাউজ পিস কাটা হয়নি,মাকে বলিস শাড়ি দুটো ফলস-পিকো করে ব্লাউজ বানিয়ে দিতে’।বহ্নি মাথা নাড়িয়ে শাড়ি দুটো ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
‘বিশ্বাস করুন শুধুমাত্র আপনার সাথে কথা বলবার জন্যই আমার কাঁথিতে আসা’,পল্লবের কথায় বিরক্ত মুখে বহ্নি বললো,’দেখুন আমি এই মুহূর্তে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, কোনো কথা শোনবার অবস্থাতে নেই’।
পল্লব বললো,’আমরা কি কাল দেখা করতে পারি?’,না পারিনা,আমরা কোনোদিনই দেখা করতে পারিনা’,কথাটা বলেই বহ্নি হাঁটা লাগালো।পল্লব বুঝতে পারছেনা এই মুহুর্তে ওর কি করা উচিত! ওর কাঙ্ক্ষিত নারী ওর সামনে দিয়ে এভাবে চলে যাচ্ছে, এটা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলোনা পল্লব।একবার শেষ চেষ্টা করলো।
স্থান কাল পাত্র ভুলে বহ্নির হাত ধরে টানলো।বহ্নি প্রচন্ড রেগে পল্লবের গালে চড় বসিয়ে দিলো।তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো।
দাদাভাই মেয়েটার সাথে কি কথা বলতে চায় সেটা জানার কৌতূহলে পিউ ও চুপিচুপি বেরিয়ে এসেছিলো বাড়ির থেকে।দাদাভাইকে ওই ভাবে মার খেতে দেখে নিজেই কেমন হতভম্ব হয়ে গেলো।
পিউ দেখলো,দাদাভাই দাঁড়িয়ে মেয়েটির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাভাই এর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভুমিকম্প হচ্ছে মনের ভিতর।পিউ চাইলোনা দাদাভাই জানুক যে সে দাদাভাইকে মার খেতে দেখেছে।তাই যেভাবে চুপিচুপি বেরিয়ে এসেছিলো সেভাবেই ঘরের ভিতরে চলে গেলো।
বহ্নি এতো বাজে ব্যবহার এর আগে কারো সাথে করেছে বলে ওর মনে পরছেনা।কেন যে ছেলেটা আজকেই ওর সামনে আসলো।অন্যের রাগ ছেলেটার ওপরেই ঝাড়লো।
আসলে কাল রাতে বাবাকে চাতালে পরে থাকতে দেখে এক মুহুর্তে বহ্নির মনে হয়েছিলো,বাবা আর নেই,মনে মনে খুশিও হয়েছিলো।
এই লোকটা চলে যাওয়ার পর থেকে যে অপমানের বোঝা তাদের পুরো ফ্যামিলিকে বইতে হচ্ছে,সেটার কোনো ক্ষমা হয়না।রাস্তায় বের হলেই লোকজন কারনে অকারনে বাবার কথা তোলে।কেউ কেউ বলে,তোদের নতুন মা তোর দিদির বয়েসীই হবে।লজ্জা অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে বহ্নির।অথচ তার প্রতিমার মতো সুন্দরী মা এই বাবার ভালোবাসার ভরসাতেই ঘর ছেড়েছিলো।
ভালোবাসা!এই শব্দটায় ঘেন্না ধরে গেছে বহ্নির।
যে বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি সম্মান করতো, ভালোবাসতো,আজ সেই বাবার নামটা পর্যন্ত শুনতে চায়না। হয়তো মনের অজান্তে ঘৃণাও করে।তাছাড়া যে নিজের সুন্দরী স্ত্রী আর মেয়েদের ফেলে অন্য মহিলায় আশক্ত হয় তাকে ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা দেওয়া যায়!এই একটা লোকের জন্য রাস্তার লোকজন তাদের দিকে আঙুল তোলবার সাহস পায়।
বারবার অপমানে বিদ্ধ হলেও কাউকে কিছু বলতে পারেনা বহ্নি।গতকাল লোকটা ফিরে আসাতে সেই সব না-বলা পুঞ্জীভূত রাগ যেন দাবানলের মতো ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পাড়ার দোকানে ওষুধ গুলো কিনে ঘরে ঢুকতেই দেখে,তার দিদিয়া ভয় ভয় মুখে দরজার কোনে দাঁড়িয়ে, মায়ের হাতে চা জলখাবার। বহ্নি ওষুধের প্যাকেট খাটের ওপর ছুঁড়ে দিলো।
মুখে বললো,’এর মধ্যেই আপনার প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ।নিয়ম করে খেলে আশা করি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন’,বহ্নিকে দেখে অর্নবের মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।কিন্তু বহ্নি এই ভাবে কেন কথা বলছে!আর অর্নবকে আপনি সম্মোধনই বা কেন করছে!
অর্নব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে।এই কি তার সেই ডল!এতো পরিবর্তন! অর্নবকে আরো অবাক করে দিয়ে বহ্নি বলে উঠলো,’দেখুন আমরা জানি বাড়িটা আপনার,চাইলে ছেড়ে দিতে বাধ্য আমরা।তবু কয়েকটা বছর যদি দিতে পারেন,আশা করছি নিজেরাই ছেড়ে দিতে পারবো’,বহ্নির কথায় অর্নবের চোখে জল চলে আসে।তার ছোট্ট ডলের সাথে কোনোভাবেই মেলাতে পারেনা ওকে।
কিছু সময় চুপ করে থেকে একটু গুছিয়ে নেয় নিজেকে।তারপর বলে,’কানাডা অফিসে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছি আগামী সপ্তাহে। হয়তো আর কখনোই এদেশের মাটিতে পা দেবোনা।তোদের ওপর অনেক অন্যায় করেছি,জানি এর ক্ষমা হয়না।তবু যদি ক্ষমা করতে পারিস এই নাম্বারে ফোন করিস’,কথাটা বলে বুকপকেট থেকে একটা কার্ড বিছানার ওপরে রাখলো অর্নব।
অর্নবের কথায় ঝরঝর করে কেঁদে চলেছে করুনা।শুধু বহ্নির এসব কথায় যায় আসেনা।’যাওয়ার সময় প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ গুলো নিয়ে যাবেন।আপনার টাকাতেই ডাক্তার দেখানো হয়েছে আর ওষুধ কেনা হয়েছে।না বলে আপনার মানিব্যাগ ধরার জন্য দুঃখিত’,অর্নবের সাথে কথাটা শেষ করে বহ্নি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’টিউশনি যাচ্ছি,ফিরতে দেরি হবে’।
বহ্নির চলে যাওয়ার দিকে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকে অর্নব।আজ অর্নবের চোখে মুখে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা।
উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরে বেলা শেষে পল্লব ফুলমানির বাড়িতে আসলো।পিউয়ের কাছে ইতিমধ্যেই ফুলমানি শুনে নিয়েছিলো পল্লবের এবার কাঁথি আসার সেই বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা,বহ্নিকেই যে পল্লব ভালোবেসে ফেলেছিলো সেটাও বুঝে গেছে।আর সেই বহ্নির হাতে চড় খাওয়ার কথা শুনে ফুলমানি নিজেও অপ্রস্তুত।
পল্লব আসতেই বললো,’খাওয়ার বাড়ছি,খেয়ে নে’,পল্লব বললো,’ফুলমানি আমি খেয়ে এসেছি। আর আজ সন্ধ্যেতেই ফিরছি আমরা।অফিস থেকে ফোন করেছিলো আমায়’।
ফুলমানি সবটাই বুঝলো,কিন্তু পল্লবকে আর ঘাটালোনা।
পিউ আসার সময় ঠিক করেছিলো,দাদাভাইকে বলবে ফেরার পথে মন্দারমনি নিয়ে যেতে ।কিন্তু দাদাভাইকে দেখে আর কথা বাড়ালোনা। এক বেলার মধ্যে পিউ নিজেও যেন বড়ো হয়ে গেছে।
(চলবে)