#অশান্ত বসন্ত।
(প্রথম পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
(#প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
*******************
শেফালী মাসি মাকে জানিয়েছিলো আমার বাবা নাকি নতুন সংসার পেতেছে।মা খবরটা জানবার পর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরতেই মা আমাদের সামনেই বাবাকে প্রশ্ন করেছিলো কথাটা সত্যি কিনা!বাবা বলেছিলো,কথাটা মিথ্যে নয়,আর সামনের মাস থেকেই বাবা আর আমাদের সাথে থাকবেনা।মা আর কোনো প্রশ্ন করেনি বাবাকে।
বাবা চলেও গিয়েছিলো এক মাস বাদে।বাবা চলে যাওয়ার আগে মাঝের ওই দিনগুলো মা কেমন অন্যমনস্ক থাকতো।কখনো দেখতাম লাল হয়ে আছে মায়ের চোখ,খাওয়াদাওয়া ও বিশেষ করতো না।সারাদিন কি একটা ভাবতো।
তবে আমার বাবা নতুন সংসারে পুরোপুরি ভাবে চলে যাওয়ার পর থেকে, মা অভিমান করে বাবার থেকে আমাদের বা নিজের জন্য আর কোনো খরচ নেয়নি।সেই সময় আমাদের প্রায়দিনই পেট ভরে খাওয়ার জুটতোনা।শেফালি মাসি তাও জোর করে আমাদের কিছু কিছু সাহায্য করতো।তবে সেটা বেশিদিনের ব্যাপার ছিলোনা।
এক সময়ে মা টেলারিং এর কাজ শিখেছিলো।বাড়িতে একটা সেলাই মেশিন ও ছিলো।
এরপর মা দোকানে দোকানে ঘুরে ব্লাউজের অর্ডার নিয়ে নিজেই ব্লাউজ বানাতে শুরু করলো।অনেক সময় রাত ভোর হয়ে যেত অর্ডারের কাজ শেষ করতে।
আমিও সকালের দিকে স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়িতে বসেই কয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই ।সেখান থেকেও কিছু আসে।সব মিলিয়ে কোনোরকমে চলে যায় আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসার।তিনজন বলতে আমি,আমার মা আর আমার দিদিয়া।
ভেবেছিলাম ছুটির দিনে মাকে কাজে সাহায্য করবো।
কিন্তু মা বলেছে,’আমিই মায়ের একমাত্র আশা ভরসা।তাই আমাকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে’।আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাতে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।মা যখন রাত জেগে ব্লাউজ সেলাই করে,আমি তখন নিজের মতো পড়াশোনা করি।আমাকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।
আমার এখন আর কোনো প্রাইভেট টিউটর নেই।
আমি একাই নোটস বানাই লাইব্রেরির বই ঘেঁটে ঘেঁটে।মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট হয়,বাবার জন্য মন কেমন করে।কিন্তু মা বলেছে,’বাবা আমাদের ভুলে গেছে’,বলেছে,’ বাবার গলার কাঁটা আমরা,পারলে উপরে ফেলতো’।
মা বলে,মায়ের সাথে বাবার বিয়েটা নাকি রেজেস্ট্রি করে নয়।মা বাবার সাথে পালিয়ে গিয়ে কালিঘাটে বিয়ে করেছিলো।সেই থেকে মামা বাড়ির সাথে যোগাযোগটা আর নেই।মায়ের একটাই ভয়,বাবা যদি আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়,তাহলে আমাদের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
আমি খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে মা’য়ের জন্য,একটা বাড়ি বানাতে চাই।
রান্নাঘরের সব কাজ সেরে যখন মা ঘরে এসে দাঁড়ায়, তখন কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের মধ্যে সিঁদুরের টিপটা জ্বলজ্বল করতে থাকে।মা মনে হয় সিঁদুর পরতে খুব ভালোবাসে,তাইতো বাবা আমাদের সাথে না থাকলেও মা রোজ সকাল বিকেল সিঁদুর ছোঁয়ায় সিঁথিতে।
ক্লান্ত মুখের হাসিটা অম্লান রেখে, দিদিয়াকে রোজ গলা গলা ভাতে,ডাল,আলুসেদ্ধ চটকে মেখে খেতে দেয়।আমার দিদিয়া কথা বলতে পারেনা,মুখ দিয়ে
সমানে লালা ঝরে।দিদিয়ার জিভের আগাটা সামনের দিকে লাগানো।
জন্মের পর ডাক্তার নাকি বলেছিলো,পাঁচ বছর বয়েস হলে অপারেশন করিয়ে নিতে।
বাবা অপারেশন করায়নি।বলেছে,’ওর পিছনে খরচ করে লাভ নেই,ও ঠিক হওয়ার নয়’।
আমি দিদিয়াকে খুব ভালোবাসি।রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিই।লুকিয়ে কেনা তেঁতুলের আচার শেয়ার করি।আমি এখন টুয়েলভে পড়ি।দিদিয়া কখনো স্কুলে যায়নি।স্পেশাল স্কুলেও ওকে পাঠায়নি বাবা।
মা চোখের জল মুছে বলেছিলো,’বহ্নি তুই চাকরি পেয়ে কিন্তু সবার আগে শিখার অপারেশনটা করিয়ে দিস’।
দিদিয়া কথা না বলতে পারলেও,দিদিয়ার চোখ দুটো যেন কথা বলে। ওই চোখের দিকে তাকালে সব বোঝা যায়।
দিদিয়া আমায় খুব ভালোবাসে।সর্ষের তেলে মেথি ফুটিয়ে সেই উষ্ণ তেল ঘসে ঘসে আমার মাথায় লাগিয়ে দেয়।তারপর টাইট করে চুলের বেনি করে দেয়।
আমি দিদিয়ার থেকে দশ বছরের ছোটো।কিন্তু মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে বলে রেখেছে,দিদিয়া বয়েসে বড়ো হলেও আমাকেই নাকি ওর খেয়াল রাখতে হবে।আমাকেই ওর ভালো মন্দ সব বুঝতে হবে।
আমি বুঝি আমার অনেক দায়িত্ব। তাইতো মুখ বুজে পড়াশোনাটা করি।কারন আমি জানি,টাকা পয়সা না থাকলে আত্মীয় স্বজনরাও দুরে পালিয়ে বেড়ায়।আমার কাকাই কাম্মা পাশেই থাকে।কিন্তু আমাদের সাথে কথা বলেনা।কাকাই এর ছেলে টুকলুদা ও মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
রাখিপূর্ণিমায় আমি দিদিয়াকেই রাখি পরাই।ভাইফোঁটার বদলে দিদিয়াকেই বোনফোঁটা দিই,আর দিদিয়াও আমাকে রাখি পরায়,ফোঁটা দেয়।
মা বলে,’বোনফোঁটাটাই বেশি জরুরি আমাদের সমাজে।বোনফোঁটাতে মেয়েরা নিজের মূল্য বুঝে নিজেকে সম্মান করতে শিখবে,নিজেদের অপমানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবে’।
আজকাল স্কুল যাওয়ার সময় মনে হয় কেউ যেন আমাকে ফলো করছে।অথচ তাকালে কাউকে দেখতে ও পাইনা।শাড়ি পরে হাঁটতে হয় বলে জোরে হাঁটতে ও পারিনা।তবু চেষ্টা করি পা চালিয়ে যেতে।
আজ স্কুল থেকে ফিরছি হঠাৎ ,’এই যে শুনছো?হ্যাঁ তোমাকেই বলছি’,একটা পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ কানে যেতেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম।দেখলাম,একটি ছেলে হাত নাড়িয়ে দাঁড়াতে বলে আমার দিকেই আসছে।
আমি কেমন ভয় পেয়ে গেলাম।এই ছেলেটাই মনে হয় রোজ ফলো করছে আমায়।খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছি আর মাঝেমধ্যে পিছনের দিকে তাকাচ্ছি।ছেলেটাও দেখলাম তাড়াতাড়ি আসছে।ঘাবড়ে গিয়ে আমি দৌড়োনো শুরু করলাম।
‘কি হলো,দাঁড়াতে বলছি তো’,রাগী গলাটা কানে আসলেও আমি দাঁড়ালাম না।
প্রানপনে ছুটতে থাকলাম।
আমাদের বাড়িটা স্কুল থেকে অনেক দুরে।এতো দুর থেকে সাধারণত কেউ পায়ে হেঁটে স্কুল যায়না।কিন্তু আমার তো কোনো উপায় নেই।আমাকে হাঁটতেই হবে।কারন আমার সাইকেল নেই আর রিক্সায় চড়ার ক্ষমতা ও নেই।অথচ পড়াশোনাটাও জরুরি। প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টা আগেই স্কুলের জন্য রওয়ানা দিই।
আমাদের স্কুল সকাল সাড়ে এগারোটায় শুরু হয়,আর ছুটি হয় বিকেল পাঁচটা পনেরোতে।তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশিরভাগ দিনই সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। বিশেষ করে শীতের বিকেল গুলোতে গাঢ় অন্ধকার নেমে যায়।আমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবার আশায় বেশিরভাগ দিনই শর্টকাট ধরি।
ওই রাস্তাটায় লোকজন তেমন একটা থাকেনা।গাছপালার ছাউনি দিয়ে ঘেরা কাঁচা রাস্তা।মা একদিন জানতে পেরে বলেছিলো,’ওই রাস্তায় লোকজন থাকেনা,কেন আসিস ওখান দিয়ে,যদি বিপদে পরিস!’,মাকে হেসে বলেছিলাম,’লোকজনকেই তো ভয় লাগে মা,সবাই কেমন করে তাকায়,আমার অস্বস্তি লাগে’,মা শুনে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলো,কোন এক অজানা শঙ্কায়।
আমি যতক্ষণ বাড়িতে না ফিরি,মা পায়চারি করে ঘরের ভিতরেই।তখন মা ব্লাউজ সেলাই ও করতে পারেনা।মা বলে, ‘এতো রূপ,এতো রঙ কোনো দিন না আবার কোনো সর্বনাশ ঘটে’।
আজ আমিও সেই অজানা সর্বনাশের ভয়ে প্রানপনে ছুটে চলেছি,মনে মনে বলছি,’মা,মাগো তুমি কোথায়,আমাকে বাঁচাও’।(চলবে)