#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:3
আরশান মাঝরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্য তার জানা। অন্তি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর যখনই অন্তির কথা মনে হতো আরশান রোজ অন্তির স্কুল গেটের সামনে এসে দাড়াতো। অন্তির স্কুল থেকে অন্তি যে বাসায় থাকতো সে বাসার রাস্তা পর্যন্ত পায়চারি করতো। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন অন্তি ঢাকার সাথে সাথে আরশানের জীবন থেকেও চলে গেলো। এরপর দরকারেও এ পথে আসা হয় নি।
উত্তরায় খুব একটা পানি জমে না। আরশান অন্তির স্কুল গেটের সামনে জুতা খুলে দাড়লো। পায়ে একটু পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন আগেই খুব জোর ঝড় হয়ে প্রকৃতিটা এখন একদম নিরব। স্কুলের সামনের রাস্তাটার দিকে আরশান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাঁটা শুরু করলো।
অতীত গুলো আরশানের চোখে এখন ঝাপসা।
অন্তি কোনো ভনিতা ছাড়াই হুট করে একদিন আরশানের সামনে এসে বলেছিলো
-আপনি অনেক কিউট। আপনাকে আমার ভালো লাগে।
বিস্ময়ে যেনে আরশানের চোখ বড় বড় হয়ে গেছিলো। অবশ্য অন্তিকে এই অবস্থায় আনার জন্য আরশানের বেশ কাঠখর পুড়োতে হয়েছিলো। এর পেছনে আরশানের অনেক বেশি পাগলামিটাই খুব কাজে দিয়েছিলো। দিন দিন অন্তির ভালোলাগাটার পরিমাপ বেড়ে ভালোবাসা হয়ে গেলো।
সম্পর্কটা একটা গতি নিয়ে চলতে শুরু করেছে সবে। আরশান অন্তির ভেতর দিন দিন এতো এতো বিস্ময় কর বিষয় আবিষ্কার করছিলো যে আরশান নিজেও বিষম খেয়ে বসত।
অন্তিকে বেশির ভাগ সময় আরশান মেঘবতী বলেই ডাকতো। ততোদিনে অন্তি আরশানের নামটা ছোট করে শান বলে ডাকতে শুরু করেছে।
অন্তির দিনগুলো তখন রঙ্গিন ফানুসের মতো। কেমন রং ছড়িয়ে আকশে পাড়ি জমাচ্ছে। তার স্বপ্নগুলোও সাথে তাল মিলিয়ে দিনকে দিন পাহাড় সমান হচ্ছে।
ক্লাস নাইন এর শেষ থেকে মোটামুটি শান আর ওর রিলেশনটা শুরু হলেও টেনে উঠার পর সবাই জানলো অন্তির বয়ফ্রেন্ড আছে।
বিষয়টা অন্তির বাসায় পৌঁছাতেও যেনো খুব একটা সময় নিলো না।
অন্তির বাবা মা শুধু এটুকু জানে যে অন্তি আর মিলি স্কুল থেকে ফেরার পথে কোন এক ছেলেকে প্রায়ই তাদের সাথে দেখা যায়। অন্তির সাথে বেশি কথা হয়। তাই কি না কি মনে করে অন্তির বাবার সন্দেহের তীর টা মিলির দিকেই ঘুরে গেলো। পেশায় ব্যাবসায়ী হলেও উনার আচরন বরাবর ডিটেকটিভদের মতো। উনার মতে অন্তি যেহেতু প্রাণ খুলে কথা বলে তার মানে ও কালপ্রিট না। যে লোকের ভয় করে সেই দোষী। তবুও অন্তি তখন মোটামুটি নজর বন্দি। স্কুল থেকে এখন রোজ অন্তির মা নিয়ে আসে। স্কুলে যাওয়ার সময় রিক্সা করে দেয়।
প্রেম পাহাড়া দিয়ে আটকানো যায় না। ঠিক তাই। অন্তির উপর থেকে সন্দেহটা একটু হালকা হতেই মাসে পনেরো দিনের প্রাইভেট ক্লাসের জায়গায় বিশ দিনের রুটিন ধরিয়ে দিলো অন্তি তার মার হাতে।
খুব যাচাই বাছাই করেই বাকি দিন ঠিক করলো অন্তি। যে দিন অন্তির মা ব্যাস্ত থাকে অন্তির ছোট ভাই রুশ্যকে নিয়ে, বিশেষ করে বুধবার। এ সময়টা রুশ্যর এক্সট্রা কারিকুলার ক্লাশ। আর সপ্তাহের তিনদিন অন্তির বাবা ঢাকায় থাকলেও চারদিন ব্যবসার দরকারেই চট্টগ্রাম থাকে। রবি থেকে বুধ বার চট্টগ্রাম থাকেন তিনি। এই রুটিনটা ফিক্সট। অন্তি দিন আর সময় গুলো সেভাবেই গুছিয়ে নিলো। ঠিক বিকাল ৪ টা থেকে ৫ টা। আসা যাওয়া নিয়ে আরও ত্রিশ মিনিট। প্রায় দের ঘন্টা আরশান আর ও পুরো শহর সপ্তাহের এই একটা দিন চশে বেরাতো বাইকে করে।
বেশির ভাগ সময় তারা দিয়া বাড়িতে বেড়াতে যেতো। লোকজনের ভির একটু কম বটে বুধবারে। আরশান মুগ্ধ হয়ে অন্তিকে দেখতো। রোদের আলোয় অন্তির চুল গুলো কেমন যেনো লালচে আভা ছড়ায়। আরশানের মুগ্ধচোখের সামনে ছটফট করে কথা বলেযেতো এক অবাধ্য ষোড়শী।
এক শরৎশুভ্র বিকেলে আরশান অন্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই বললো
-অন্তি এই বর্ষায় তুমি নজর বন্দি ছিলে আর আমার সেকেন্ড সেমিস্টার। বর্ষা নিয়ে আমার একটা ফেন্টাসি আছে বুঝলে।
অন্তি চারপাশের কাশ ফুল মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো। যেনো ও মেঘের রাজ্যে নরম তুলোর মতো মেঘ গুলোর মাঝে হারিয়ে গেছে।
অন্তির নিরবতা দেখে আরশান আবার বললো
-এই অন্তি।
-হুম বলো।
-আমি চাই এক বর্ষায় তুমি আমি দুজন কোনো এক খোলা মাঠে দাড়িয়ে হাতে হাত ধরে ভিঝবো। ঝুম বৃষ্টি হবে। অথবা কোন ঝিলের বুকে নৌকায় থাকবো তুমি আর আমি। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তোমায় ছুঁয়ে যাবে। আর আমি মুগ্ধতা নিয়ে দেখবো। তুমি নীলপেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে খোপায় পড়বে বেগুনী জারুল ফুল। জানো অন্তি বৃষ্টি যখন থেমে যায়, চার পাশটা কেমন যেনো স্নিগ্ধতায় ভরে উঠে। নীরব সবুজ। গাছের পাতাগুলো যেমন ঝুবঝুবে ভিজে থাকে ঠিক তেমনি তোমার খোলা চুলগুলো তোমাতে লেপ্টে থাকবে। তোমার চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে ফোটা ফোটা পানি পরবে। নাকের ডগায় থাকবে শিশিরের মতো জমে থাকা পানি আর ঠান্ডায় থরথরে কাঁপা তোমার ঠোঁট।
-অন্তি নৌকার মতো ব্রু গুলো উচু করে আরশানকে প্রশ্নছুড়ে বসলো “আচ্ছা শান জারুল ফুল কোনটা?দেখতে কেমন?”
অন্তিকে আর জারুল ফুল দেখানো হয় নি। নীল পেড়ে সাদা শাড়িও কিনে দেওয়া হয়নি। এই ইচ্ছা গুলো আরশানের স্বপ্ন হয়েই থেকে গেলো। অন্তির সাথে আর কোনো বর্ষায় দেখা হয় নি। তার আগেই অন্তি আবারও বাসায় ধরা পরে গেলো। আর এবার তো বাসার বাইরে যাওয়াও বারন। আরশানকে অন্তির বাবা মা দেখেনি তবে প্রাইভেট থেকে আনতে যেয়ে মেয়েকে পেলেন না মিসেস হাসনাত।
সেদিন অন্তি ঠিক সময়েই ঘরে ফিরলো। কোনোকিছু বুঝতে আর যেনো বাকি রইলো না।
একে একে অন্তির এস এস সি শুরু হলো। পড়ালেখার চাপ বেড়েছে। তখন আরশানের সাথে কথা হয় ছোট্ট মুঠোফোনে। খুব লুকিয়ে, সবাই ঘুমিয়ে গেলে ওয়াস রুমে ঢুকে ফিসফিসিয়ে দুচার কথা।
পরীক্ষা গুলো ভালো খারাপ মিলিয়েই হলো। অন্তির বাবা মা সহজ সমাধান বের করলেন, মেয়েকে এপথ থেকে ফেরাতে হলে শহর পাল্টাতে হবে। স্বপরিবারে চট্টগ্রাম শিফট হয়ে গেলেন। এতে অন্তির বাবা সহজে ব্যবসাও দেখতে পারবে আর মেয়েকেও।
ঢাকা ছেড়ে আসার দিন আরশান অন্তিদের বাসা ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিলো। সেই কয়েক পলকের দেখা এখনো যেনো অন্তির চোখে দূর্স্বপ্ন হয়ে আসে।
খুব বাজে ভাবে অন্তির ঘুমটা ভাংলো। প্রিয়া অন্তিকে ডেকে তুললো। চোখ খোলার পর প্রিয়া চেহারাটা দেখে অন্তি কিছুটা ঘাবরে যেয়ে বললো
-কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?
-আপু কাল রাতে যে লোকটি পায়চারি করছিলো উনি বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। রাস্তার ঠিক ওই ল্যাম্প পোষ্ট টার নিচেই পরে আছেন।
অন্তি চশমাটা কোনো ভাবে চোখে দিয়ে উরনা পেচিয়ে দৌড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো।
নিচে অনেক মানুষের ভীর। লাশের চারপাশে পুলিশ বেস্টনি।
অন্তির হাত পা কেমন জানি কাঁপছে। কাল রাতেও লোকটাকে জীবন্ত চলাফেরা করতে দেখলো। আর এখন নীথর দেহটা পরে আছে।
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই পুনমকে দেখলো বিছানায় বসে বসে কাঁদছে।
অন্তি পুনমের পাশে বসে বললো
-কাঁদছো কেনো আপু??
-এমন দিনে এমন একটা অলুক্ষনে বিষয়।
-তুমি এসব বিশ্বাস করো। লোকটা মারা গেছেন। তার আয়ু ছিলো এতোদিন।
প্রিয়া কথা টেনে বললো
-এভাবে ভালোবেসে পাগলের মতো রোজ ছটফট করার থেকে মারা গেছেন এই ভালো।
পুনম যেনো প্রিয়ার কথায় খুব চটে গেলো। এ কেমন কথা একটা মানুষ মারা গেছেন।
কিন্তু প্রিয়ার কথাটা অন্তির বুক চিড়ে অনেক গভীরে পৌছালো।
মনের মাঝে একা একাই শব্দ যুদ্ধ শুরু হলো,আরশানও কি এভাবে ছটফট করেছিলো সেদিন?
মনে মনেই অন্তি বললো “আরশান আমায় ক্ষমা করে দিও”। অন্তির ভেজা চোখ টা মুছে নিলো।
বিকালের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টালো। সন্ধ্যায় গায়ে হলুূদ। এর মাঝে হলুদের স্টেজ করা হলো। রংবেরং এর কাগজ আর কাপর দিয়ে পুনমদের বাসার সামনের মাঠ টুকু সাজানো হলো।
সন্ধ্যায় মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। পুনম আর অভির গায়ে হলুদ এক সাথেই তবে দুইজনের স্টেজ দুটো।মাঝখানে নেটের পর্দা টানা।
গায়ে হলুদেও যে এতো মানুষ আসতে পারে অন্তির জানা ছিলো না। কনে পক্ষে যতো না মানুষ বর পক্ষের মানুষে গিজগিজ করছে।
বরপক্ষের কিছু মেয়ে এসে পুনমকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে গেলো।
ল
এক মেয়ে তো অতিরিক্ত নেকামি করে বললো,
-ওফ আই লাভ দিজ প্রোগ্রাম। ব্রাইডাল শাওয়ার ইজ মাই ফেভরেট পার্ট অফ এনি ওয়েডিং।
কথাটা শুনেই প্রিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে মুখ বাকিয়ে বললো
-আই লাভ টু সি দেট টাইপ অফ মেকআপ লাইক আ আ, আচ্ছা অন্তি আপু পেত্নির ইংরেজি কি?
-আহ প্রিয়া কি হচ্ছে, শুস, একদম চুপ।
-বুঝেছি তুমিও পেত্নির ইংরেজি জানো না।
ছেলেকে হলুদ দিতে এসে প্রিয়া, উরশী আর পুনমের কিছু বন্ধু বান্ধবি বরের স্টেজে বসলেও অন্তি একটু সাইড হয়ে দূরেই দাড়িয়ে দেখছিলো সবটা। লচোখ দুটো কিছু একটা খুঁজছে।
অস্ফুট বেলি ফুলের একটা মালা অন্তির বরাবর কেউ একজন এগিয়ে দিতেই অন্তি তাকালো সেদিকে
-শান(খুব নিচু গলায় অন্তি বললো)
-ভয় পেয়ে গেলে? আমায় খুজছিলে?
-না (মাথা নিচু করে অন্তি জবাব দিলো)
-কিন্তু আমায় যে বললো তুমি আমায় খুঁজছিলে
-কে?
-ইউর আইস।
অন্তি আর কোনো জবাব দিলো না। আরশান এখনো কতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। আচ্ছা আরশান কি অন্তি কে ক্ষমা করে দিয়েছে নাকি অন্য কিছু। অন্তি যেনো আর ভাবতে পারছে না। তার আগেই চোখ পানিতে ভরে গেলো।
আরশান আবার নিরবতা ভেঙ্গে বললো,
-খোপায় ফুলটা পরো পরিপূর্ণ লাগবে। (হাতে রাখা বেলির মালাটা এগিয়ে ধরলো আরশান)
-লাগবে না।
-জানি তো। মানুষটাকেই আর লাগে না। তার দেয়া ফুল, অতি নগন্য কিছু একটা।
আরশান ছুড়ে ফেলেদিলো মালাটা।
অন্তি এবারও কোনো জবাব দিলো না।
আরশান রাগী গলায় বললো,
-এই মেয়ে তুমি কি এখনো জামা কাপর গুছিয়ে রাখতে শিখো নি? শাড়ি সামলাতে জানোনা পড়েছো কেনো?
-মানে?
-কোমর দেখা যাচ্ছে। আর তুমি মানে জিঙ্গেস করছো?
-অন্তি আঁচল টেনে কোমর ঢেকে নিলে। এমন একভাজের শাড়ি অন্তি কখনো পড়ে নি তাই ঠিক ভাবে সামলে উঠতে পারে নি। কিন্তু আরশানের ধমকে একদম চোখ থেকে পানি ঝরে গেলো অন্তির।
প্রিয়া অন্তিকে পাশে না পেয়ে আশেপাশে তাকাতেই কিছু দূরে দেখলো কাল যে ছেলেটা গান করেছিলো তার সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে
প্রিয়া উঠে এসে অন্তির পাশে দাড়াতেই খেয়াল করলো অন্তি কান্না করছে।
প্রিয়া অবাক হয়ে বললো
-আপু এনি প্রবলেম?
-না। আমি একটু বাসায় যাবো।
-কিন্তু,
-আমার ভালো লাগছে না।
প্রিয়া আর কথা বাড়ালো না
অন্তি একবার আরশানের দিকে তাকিয়েই প্রিয়ার সাথে চলে গেলো।
চলবে…