#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৭
মামুনি শামুক পিঠা বানাচ্ছে আর আমি পাশে বসে আছি। তখন যে রুম থেকে বের হয়েছিলাম আর রুমে যায়নি। রুদ্রের তখনকার মুখটা মনে পড়লেই হাসি পায়। মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। কেমন অপরাধীর ন্যায় বসেছিল। আমাকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য উনি অনেক বাহানা করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমি তো উনাকে আজকে সারাদিন জ্বালাব। রাতে কী হয়েছিল তা তো বলবো না।
হঠাৎই মাথায় এলো রুদ্রের বলা রাতের কথাগুলো। উনি কাকে ভালোবাসতেন? নাম কী ছিল মেয়েটার? কী হয়েছিল? সবটা জানতে হবে। উনাকে জিঙ্গেস করলে তো উনি কিছুতেই বলবেন নাহ। মামুনি তো নিশ্চয়ই জানে।
মামুনি তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
তো বল। জিঙ্গেস করার কি আছে।
রুদ্র কাকে ভালোবাসতো?
মামুনির মুখটা কালো হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণের হাসিটা মিলিয়ে যায়। চুপ করে আছে মামুনি।
কী হলো মামুনি? চুপ করে আছো কেনো?
তোকে এসব কে বলেছে?
রুদ্র গতকাল জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করছিল। বল না আমাকে রুদ্র কাকে ভালোবাসতো? নাম কী সেই মেয়ের?
ঐ মেয়ের নাম আমি মুখেও নিতে চাই না। ঘৃণা করে ঐ নাম শুনলে। বিষের চেয়েও বিষাক্ত লাগে। ঐ মেয়েটা আমার ছেলের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। আমার প্রাণবন্ত ছেলেটাকে রোবট বানিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটার নাম অরি। আমি তোকে আর কিছু বলবো না। তুই নিজে সবকিছু রুদ্রের কাছ থেকে যানবি। যেদিন ঐ মেয়েটার বিয়ে ছিল সেদিন রুদ্র আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিল। এরপর থেকে আমি আমার ছেলেটাকে কখনো কাঁদতেও দেখিনি, হাসতেও দেখিনি। কেমন জানি হয়ে গিয়েছিল। তুই পারবি না আমার ছেলেটাকে আগের মতো করে দিতে। পারবি না ওর মুখের হাসি ফিরিয়ে দিতে।
আমি জানি না তোমার ছেলেকে আগের মতো করে দিতে পারব কিনা। তবে আমি চেষ্টা করবো।
রিয়া একটু শুনে যাও তো।
রুদ্রর ডাক শুনে আমি আর মামুনি দুজনেই চমকে ওঠে। আমার ঠোঁটের কোণে সয়তানি হাসি ফুটে ওঠে। আমি নিজের হাতেই নিজে একটা কামড় দিলাম।
কী করছিস এসব?
তোমার ছেলেকে মজা দেখিয়ে আসছি।
মাথায় উড়নাটা ভালো করে টেনে লজ্জা লজ্জা মুখ করে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। রুমে এসেই দেখি উনি বিছানায় বসে মাথার চুল টেনে ধরেছেন, আর কী যেনো বিড়বিড় করে বলছেন। আমি গিয়ে উনার সামনে দাঁড়ায়।
আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?
আমার কথা শুনে উনি চমকে ওঠেন। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে যান। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা কেশে বলেন,
আমাদের মাঝে কিছু হয়নি। এম আই রাইট?
উনার কথাটা শুনে আমি লজ্জাবতী লতিকার ন্যায় নুইয়ে গেলাম। কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সন্তপণে সরিয়ে দিলাম। চুল সরানো তো একটা বাহানা ছিল। আমি তো উনাকে হাতের দাগটা দেখাতে চেয়েছিলাম। উনি আমার হাতের দাগটা খেয়ালও করলেন। উনি খপ করে হাতটা চেপে ধরলেন। কিয়ৎক্ষণ উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনি ফট করে বলে ওঠলেন।
এটা তোমার কামড়ের দাগ। তুমি নিজেই নিজের হাতে…….
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎই উনি থেমে গেলেন। উনি আমার গলার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার দৃষ্টি অনুসরণ করে গলার দিকে তাকালাম। গলার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠলাম। পরক্ষণেই মনে পড়লো এটা তো আমার নোখের আঁচড়। গলা চুলকাতে গিয়ে আঁচড় লেগে গিয়েছিল। কিন্তু উনি তো অন্য কিছু ভাবছেন। আমি আরেকটু লজ্জা পাওয়ার ভাণ করলাম। উনি ফট করে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন।
অহ শিট। আমি,, আমি …..
উনি কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
_______________
সবাই এক সাথে লাঞ্চ করছি। উনি মাথা নিচু করে এক মনে খেয়েই যাচ্ছেন। কোনো দিকে তাকাচ্ছেন নাহ। আমি উনার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি আর খাচ্ছি।
আজকে তো রুদ্র আর রিয়ার রিয়াদের বাড়িতে যাওয়ার নিয়ম।
আংকেলকে থামিয়ে দিয়ে মামুনি বলে ওঠল, ওরা যাবে কী করে? রুদ্রের এতো জ্বর। বিয়ের পরে যদি একা যাওয়া যেতো। তাহলে আমি রিয়াকে দিয়ে আসতাম। কিন্তু এখন তো একা যাওয়া যাবে না। দুজনকেই এক সাথে যেতে হবে।
আম্মু আমি যাব এবং আজকেই যাব।
আমি নিশ্চুপ হয়ে খেয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু….
আমি একদম ঠিক আছি। তোমার আমাকে নিয়ে টেনশন করতে হবে না। আজকে বিকালেই যাব।
উনি চলে গেলেন। আমিও নিঃশব্দে টেবিল ছেড়ে ওঠে পড়লাম।
_________________
বাসাতে এসেছি অনেকক্ষণ। ভাইয়া আর আব্বু বাসায় নেই। আম্মু কিচেনে রান্না করছে। নতুন জামাই বাড়িতে এসেছে। তার জন্য স্পেশাল কিছু তো করতেই হবে। কিচেন থেকে সোজা নিজের রুমে চলে এলাম। আচমকা আমার আগমনে উনি থতমত খেয়ে গেলেন। চটজলদি শার্ট গায়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শার্টের বোতাম লাগাতে। আমি এক পা এক পা করে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উনার ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনার শার্টের বোতাম লাগাতে বললাম,
আমাকে দেখে এতো লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমিই তো। আপনার সব তো আমার দেখাই হয়ে গেছে।
উনি আমার হাতটা ধরে গম্ভীর গলায় বলেন,
বাচ্চা বাচ্চার মতোই থাকো। একদম বড় হওয়ার চেষ্টা করো না। তোমার শরীরের দাগগুলো তোমার নিজেরই করা। আমি তোমার মতো গাধা না। এতটুকু বোঝার মতো কমনসেন্স আমার আছে। আমার হাতের নোখ এতো বড় না যে তার আঁচড় এতো গভীর হবে না। নেক্সট টাইম এমন ফাজলামো আমার সাথে করবে না।
উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। উফ উনি এতো চালাক কেনো? একটু বোকা হলে কী হতো? উনি আমাকে বাচ্চা বললেন। আমি বাচ্চা?
রাগে ফুসতে ফুসতে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ভাইয়া সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। হয়তো মাত্রই অফিস থেকে এসেছে। আমি গিয়েই ভাইয়ার চুল টেনে ধরলাম। ভাইয়া লাফিয়ে ওঠে। ভাইয়া রেগে বলে,
এই তুই আমার বাসায় কী করছিস? দুই দিন না যেতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছিস। কই ভাবলাম শাকচুন্নি বাসা থেকে বিদায় হয়েছে শান্তিতে থাকব। কিন্তু তা আর হলো কই? দুই দিন না যেতেই শাকচুন্নি এসে হাজির। আচ্ছা তোকে কী তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিয়েছে?
আম্মু! আম্মু দেখো তোমার ছেলে আমাকে মারছে।
কিচেন থেকে আম্মু চিৎকার করে বললো, এতো বড় বড় দুইটা ছেলে মেয়ে এখনো মারামারি করে। শাওন আমি আসলে কিন্তু ভালো হবে না। এতোদিন পরে মেয়েটা বাসা এসেছে আর তুই জ্বালাচ্ছিস।
তোকে কখন আমি মারলাম। তোরা মেয়েরা আসলেই ধান্ধাবাজ। সবকিছুর পিছনেই একটা মোটিভ থাকে। তোরা কোনো কিছুই এমনি এমনি করিস না। তোদেরকে থাপড়ায়া থাপড়ায়া সোজা করা দরকার।
আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাই। ভাইয়া বেক্কেল মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
আমি তো কিছু বলিনি। তুই এই প্যাকেটটা রুদ্রকে দিয়ে দিছ।
কী আছে এটাতে?
তোর জামাইরে জিঙ্গেস করগা।
_______________
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর বসে আছি। উনি ওয়াশরুমে আছেন। প্যাকেটের ভিতর কী আছে সেটা আমি এখনো জানি না। প্যাকেটটা হাতে নিয়েই বসে আছি। হঠাৎই রুদ্র ভাইয়ার ফোন বেঁজে ওঠে।
রুদ্র আপনার ফোন বাঁজছে।
ভিতর থেকে কোনো সারা শব্দ নেই। ফোন বাঁজতে বাঁজতে কেটে গেলো। নতুন উদ্যমে আবার বাজতে বাজতে শুরু করে। ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। আমি দ্বিধায় ভোগছি ফোনটা রিসিভ করবো নাকি না। রিসিভ করলে যদি উনি রাগ করেন। ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনের স্কিনে তাকাতেই চমকে ওঠলাম। আমার দৃষ্টি ফোনেই আটকে গেছে। অরি নামটা দেখেই বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো। আচমকা কেউ আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল।
চলবে…….