#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
৪১
আজ রুবির দিকে আঙ্গুল উঠছে।যত্নে বেড়ে উঠা ছেলে-ছেলের বউয়েরা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
রুবি বিচক্ষণ মহিলা সবার মেজাজ পরে ফেলছে।ঝরের পূর্বাভাস বুঝেই বলে উঠলো।
-বাবারা তোমরা হয়তো ভাবছো আমি তোমাদের বাবাকে ভুল ওষুধ দিয়েছি।কিন্তু আমি উনাকে কোনো ওষুধ দেয়নি।তিনি নিজেই নিজের ওষুধ খেতেন।
কণিকা-মা তাহলে কি বাবা নিজের ওষুধ ভুল খেয়েছেন?
-সেটাই তো তিনি ডাক্তার হয়ে ভুল ওষুধ খেলেন কি করে?
-বড় মা আপনি যতোই বলুন।আমরা তো সবসময় দেখেছি মম বাবাকে ওষুধ দিতেন।মম চলে যাওয়ার পরেই এই ঘটনা ঘটলো।
-কণিকা তুমি দেখছি সোজা আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো।
রুমেল- ও তো ভুল বলেনি।মমকে তো দেখেছি বাবার খাবারের আগে ওষুধ দিতেন, খাবার খেয়ে উঠার সাথে সাথে ওষুধ দিতেন।
-অরুর সাথে আমার তুলনা করছো তোমরা।ও তো কাজ ছিলো ঘর সামলানো।ও কি আমার মতো বাইরে বিজনেস করতো।
-তাহলে কি দাঁড়ায় মমের দায়িত্ব অনেক বেশি ছিলো। চলে যাওয়ার সাথে সাথেই বাবার সাথে এই অঘটন ঘটলো।
-এই দিন দেখার জন্য তোদের বুকের উপর রেখে বড় করেছিলাম।
শিমুল-বড় মা,আপনি কিন্তু ভুল বুঝছেন।মম নেই যেহেতু সেক্ষেত্রে আপনার কর্তব্য ছিলো বাবার খেয়াল রাখা।
-তুই বলছিস আমি খেয়াল রাখিনি?
প্রিয়ন্তি-বড় মা, আপনি খেয়াল রাখলে আজ বাবা কোমায় থাকতেন না।
সবার কথার মধ্যে হিমেল একটা কথা ও বলেনি।মা যেদিন বাড়ি ছেড়েছিলেন সেদিন থেকেই হিমেল উনার অভাব বুঝতে পারছে।
ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরলে কেউ কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না।
আজকাল তো খাবার টেবিলে দু রকমের তরকারি ছাড়া অন্য কোনো আইটেম থাকে না।কিন্তু মা সবার পছন্দের খাবার দিয়ে টেবিল সাজিয়ে রাখতেন।
অফিসে যাওয়ার আগেই জামাকাপড় ইস্ত্রি করে রাখা থেকে শুরু করে অফিস থেকে ফেরার পর কোন জামা পরবো সেটা পর্যন্ত খেয়াল রাখতেন।আর আমরা কি না সেই মাকে কোনোদিন মা বলে ডাকলাম না।
**দু দিন হলো হাসানকে বাসায় দেয়া হয়ছে। রুম পুরো হাসপাতালের কেবিনের মতো একজন নার্স সারাক্ষণ খেয়াল রাখছে।
যত্নের ত্রুটি নেই ছেলে-বউয়েরা যথেষ্ট সেবাযত্ন করছে।আজ যখন রুবি রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলো। তখন সকল অবাক হয়ে তাকালো।
-বড় মা,আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন।
-বিজনেসের প্রচুর লস হচ্ছে।কর্মচারীদের হাতে কতদিন দিয়ে রাখা যায়।
-আমাদের মনে হচ্ছে এখন আপনি এসব ছেড়ে দিন।
-ছেড়ে দিবো, কেনো?
-এখন কি আপনার উচিত না সারাক্ষণ বাবার কাছে থাকা?
-তোমাদের বাবার কাছে নার্স আছে।তাছাড়া তিনি কোমায়।এই অবস্থায় উনার কিছুর প্রয়োজন পরবে না।নার্সের কাজ তো আমি করতে পারবো না।
রুবির এমন উত্তরে সবাই হতবাক।
হিমেল-বড় মা, আপনি বাবার প্রেমিকা রয়ে গেলেন।বউ হয়ে উঠতে পারলেন না।
আজ যদি এখানে মা থাকতেন, মা কিন্তু এক মিনিটের জন্য বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতেন না।
-হিমেল তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো?
-বলতে বাধ্য হলাম।যাক এই প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়ায়। ভাবি তোমাদের অসুবিধা নেই তো বাবাকে দেখতে।
কণিকা-আমার চাকরি বাঁধ দিয়ে বাবার কাছে বসে থাকবো।
প্রিয়ন্তি-আমি ও এসব পারবো না।এমনিতে রান্না করতে করতে জান শেষ।
হিমেল একটা মুচকি হাসি দিলো তবে সেটা বিষাদের। হাসান সাহেব আজ আপনি সত্যিই অসহায়।সোনার চাইতে চিকচিক করা রেডিমেড এর স্টোনের জুয়েলারি কখনোই দামি হয় না।
তেমনি অন্ধ ভালোবাসায় আসল সোনা আর রেডিমেডের মূল্য আপনি বুঝলেন না।
**স্বপ্নার মন মানছে না বারবার মন চাইছে একবার গিয়ে সালমানকে দেখতে।সালমানের অবস্থা বেশি খারাপ দেখে ওকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়ছে।কেউ ওর সাথে দেখা করতে পারবে না।
কেইসের তদন্ত করছে স্বপন তদন্ত অনুসারে সালমান হয়তো নির্দোষ প্রমাণ হবে জেল থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে যে মুক্তি নেই।
১সপ্তাহ পর সালমান কিছুটা সুস্থ হয়।তখন সালমানের সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয় ওর পরিবারকে।
সকাল থেকে স্বপ্না রান্না করছে সালমানের প্রিয় সব খাবার।সকল অভিমান যেনো ভুলেই গেছে স্বপ্না।
এতোদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে,নিজেকে প্রশ্ন করে বিধস্ত করেছে তবুও শেষমেশ মনে হলো, একবার যদি দেখা না করি তবে সারাজীবন বিবেক কুঁড়েকুঁড়ে খাবে।
রান্না শেষ করতে রিদ্ধ গাড়ি নিয়ে হাজির হলো।স্বপ্না তাড়াহুড়ো টিফিন রেডি করে বেড়িয়ে গেলো রিহান,তরীকে নিয়ে।
স্বপ্নার অস্থিরতা বেড়ে গেলো রাস্তা শেষ হচ্ছে না কেনো।শেষ দেখা কি জীবিত অবস্থায় দেখতে পারবে।
হাসপাতালের করিডোরে স্বপন অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
-এতো দেরি করলে কেনো?
-কি হয়েছে খারাপ কিছু?
-ভিতরে আসো।
স্বপ্না আর তরী ভয়ে ভয়ে ভিতরে যায়।রিদ্ধ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিতরে যাওয়ার সাহস নেই ওর।
একটা বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে সালমান।ওকে দেখে স্বপ্না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
চোখের জল আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে।তরী ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।স্বপ্না দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
-এমন কেনো হলো বাবা?
-আমি যে খারাপ বাবা ছিলাম।তাই আল্লাহ শাস্তি দিলেন।
-আমরা যে কখনোই শাস্তি চায়নি।
-আল্লাহর বিচার।
তরী বাবার মাথার কাছে বসে রইলো। চুল নেড়েচেড়ে দিচ্ছে অঝোরে কাঁদছে সালমান।
-সুখের কপালে অশুভ ছায়া হয়ে এসেছিলো রুমা।আমার এতো ভালো সংসার ছেড়ে আমি কি করলাম।
-যা হয়ে গেছে বাদ দাও বাবা।
স্বপন এসে তরীকে বললো
-চল বাইরে।
তরী উঠে চলে যায়।স্বপ্নার কাঁধে হাত রাখে স্বপন।
-আপা ভিতরে যা, কথা বল।
তরী বেড়িয়ে আসতে ধীরপায়ে এগিয়ে যায় স্বপ্না।স্বপন,তরীকে নিয়ে রিদ্ধের কাছে গেলো।
স্বপ্না গিয়ে চেয়ার টেনে সালমানের পাশে বসলো।কারো মুখে কথা নেই সালমান কেবল তাকিয়ে আছে।
স্বপ্না আস্তে করে জানতে চাইলো।
-কেমন লাগছে এখন?
সালমান উত্তর দিচ্ছে না।আবার ও দুজনেই চুপ।
কেটে যায় কয়েক মিনিট।
-ভালো, সত্যি খুব ভালো লাগছে।
-আমি খাবার এনেছিলাম।
-আমার জন্য।
-হ্যা তোমার জন্য।
-এখন খাবে বেড়ে দেই?
-দাও।
স্বপ্না টিফিন খুলে সাদা পোলাও এর সাথে কোয়েল পাখির রোস্ট দিয়ে খাবার বেড়ে দিলো।
দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো সালমানের চোখ থেকে।
-খেয়ে নাও।
হাতে ক্যানেলা লাগানো ব্যথা খেতে পারছেনা।স্বপ্না ভাতের থালা নিজের হাতে নিলো।দু লোকমা ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিলো সালমানকে।
সালমানের আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই।স্বপ্না প্লেট রেখে দিলো।
-আমাকে ক্ষমা করে দিও।
-ক্ষমা করে দিয়েছি বলেই তো আজ এসেছি প্রতিজ্ঞা ভেঙে।
-আমি একটা কথা বলবো।জানি অন্যায় তবুও বলতে হচ্ছে।
-কি বলো?
-তিয়াস,শত হোক আমার ছেলে।তুমি যদি তিয়াসকে তোমার মতো বড় করতে।আমি জানি তুমি ছাড়া ও মানুষ হবে না।
-ওর নানি কি দিবে?
-ওরা দিবে।
-আমি চেষ্টা করবো।
হাসপাতালের সময় শেষ বাইরে চলে আসতে হলো স্বপ্নাকে।
ওইদিন রাতেই মারা যায় সালমান।সব শোক কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগে যায়।
সবার মন ভালো করতে রিদ্ধ সকলকে নিয়ে কক্সবাজার যায়।
উল্লাস দেশে ফিরছে দু দিন হলো।ওদের বাসায় উঠেছে একা এসেছে।
আজ যাবে তরীর সাথে দেখা খুব এক্সাইটেড। উল্লাস রেডি হয়ে ফুলের দোকানে গেলো।এক তোড়া ফুল কিনে তরীদের বাড়িতে যায়।সোজা ওদের বাসায় যাচ্ছে প্রেম করার ইচ্ছে নেই বিয়ের প্রস্তাব দিবে।
বাসায় আসার পর দেখলো বাসা তালাবদ্ধ। কাউকে দেখছে না আশেপাশে।
কি করা করার ফিরে আসছে।গাড়ির লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলো নীলা,তরীর বান্ধবী।
গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলো ওর কাছে।
-আমাকে চিনতে পারছো নীলা আমি উল্লাস।ওই যে তরী।
নীলার মনে ছিলো উল্লাসকে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সেদিন উল্লাসের জন্য তরীর পরিবারকে ছোট হতে হয়েছিলো রুমার কাছে।তরী ওর মায়ের কাছে অনেক বকা খেয়েছে।
-আচ্ছা তুমি জানো তরী কোথায়?
-জানি।
-ওরা কোথায়?
-তরী তো ওর স্বামীর বাড়ি।ওর মা গ্রামে।
-ত তরী আমার মিষ্টি ওর বিয়ে হয়ে গেছে?কি বলছো তুমি?
-কিছুদিন আগে হয়েছে।
-এটা কি করে সম্ভব।
-আমাকে যেতে হবে।
-প্লিজ নীলা বলো,মিষ্টি ও কি করে বিয়ে করে নিলো?
নীলা তাড়াহুড়ো করে রিকশা ডেকে উঠে পরে।উল্লাস সেখানেই চুপটি করে বসে রইলো।
চলবে