সুতোয় বাঁধা সংসার পর্ব-১৩

0
632

#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
১৩
দিন কেটে যেতে লাগলো সবাই যার যার মতো ব্যস্ত।রিদ্ধ স্কুল থেকে ফিরে দোকান সামলায়।
রিদ্ধের দাদি,উনার মেয়েদের গ্রামের অংশ দিয়ে দিয়েছেন।ওদের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।
স্বপ্নার বাপ-ভাইয়েরা অনেকবার এসেছিলো একবার ওদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
বরাবরই স্বপ্না প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে।কিন্তু আজ এক নিরিহ বাবা এসেছেন মেয়ের কাছে।
-মা রে তোর সাথে সবসময় অন্যায় হয়েছে।সেদিন যদি তোর ভুল আমরা মেনে নিতাম তাহলে তোকে অসহায় ভেবে সালমান এতো বড় অন্যায় করতো না।আবার যদি সেদিন তোকে এখান থেকে নিতে যেতাম।তবে তুই মানসিক শান্তি পেতে।
ছেলে মেয়ে ভুল করবে, বাবা মা তো মাফ করে দিবে। কিন্তু আমরা তোকে মাফ করতে পারলাম না।এবার তুই আমাদের মাফ করে একবার তোর মাকে দেখতে চল।

স্বপ্না নিজের বাবাকে এতোটা অসহায় কখনোই দেখেনি।বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে কিন্ত কিছু বলতে পারছেনা।ওর শাশুড়ী কি বলবেন সেটার অপেক্ষায় আছে।
তিনি স্বপ্নার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন বুঝতে পারছেন।স্বপ্না নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিবে না, যদি না তিনি কিছু বলেন।

-স্বপ্না তুই চুপ করে আছিস।বাবাকে বল যে আমরা সবাই মিলে যাবো।
-মা, আমি যাবো?
-যাবো কি রে, অবশ্যই যাবি।
-বাবা,আমি যাবো বাবা,মা কে দেখতে আমি যাবো।

স্বপ্নার মা খুব অসুস্থ একমাত্র মেয়েকে দেখার জন্য সবার কাছে অনুরোধ করছেন।
স্বপ্নার বাবা চলে যেতেই, ওরা সবাই পরেরদিন যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করলো।
সবাই অনেক খুশি নানাবাড়িতে যাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম।
স্বপ্নার মনে ভয় হচ্ছে ও যাবার আগেই যদি মায়ের কিছু হয়ে যায়।পুরো রাস্তা দম মেরে বসেছিলো কারো সাথেই কথা বলেনি।
গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করলো।এই এলাকার পথঘাট সবকিছু স্বপ্নার চেনা।স্মৃতি বিজড়িত সবকিছু। স্কুলের পাশ দিয়ে যেতেই স্বপ্নার চোখ থেকে জল গড়ালো।
এই স্কুল থেকেই তো সালমান কে চিনেছিলো।কিশোরী বয়সের স্বপ্না ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, চুলগুলো দু পাশে বেণি করে স্কুলে যেতো।কলেজ পড়ুয়া সালমান বেড়াতে এসেছিলো এই গ্রামে।ছোট্র স্বপ্নাকে দেখে ভালো লেগেছিলো।
হাজার যুবকের মধ্যে সালমান ছিলো প্রাণোচ্ছল।সব মেয়েদের ক্রাশ বলা যায়।
সেই সালমান যখন স্বপ্নাকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখালো,ভালোবাসার জোয়ারে ভাসালো।স্বপ্না সবকিছু ভুলে কেবল সালমানের ধ্যানে মগ্ন হলো।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই,মানুষের সমারোহ দেখে স্বপ্নার ভিতর আঁতকে উঠলো।
মায়ের কিছু হয়নি তো?সবাই তখন ঘাবড়ে যায়। স্বপ্না বাড়ির ভিতর ছুটে গিয়ে দেখে ওর মা নিজ হাতে মাদ্রাসার ছাত্রদের খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।
মা-মেয়ে দুজনেই কেবল তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।কারো মুখে শব্দ নেই।এতোটা বছর একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে মা কি করে পারলেন?
স্বপ্না, মা বলে ডাক দিতেই তিনি ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন।
দুজনেই কাঁদছে বহুদিনের খালি বুক আজ পরিপূর্ণ।
-স্বপ্না, ওরা আমারভনাতি নাতনি। নানুর কাছে আসবিনা তোরা?

তরী,রিহান,রিদ্ধ ছুটে যায় নানুর কাছে।সবাইকে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন।
সবশেষ রিদ্ধের দাদীর কাছে গেলেন।
-আপনি স্বপ্নার আসল মা,আপনি এতো বছর মেয়েটাকে আগলে রেখেছেন।এই দুঃসময়ে নিজের ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছেন আমার মেয়েটার জন্য।
-বেয়াইন মেয়েটা আপনার কাছে ১৬বছর ছিলো।আমার কাছে ১৯বছর এবার বলুন তো মেয়েটার কার বেশি?
-আপনার বেয়াইন।
-শুধু দুঃখ আপনার বেয়াই দেখে যেতে পারলেন না স্বপ্নার খুশি।
-আমাদের মাফ করে দিয়েন।দু পরিবার সেই তো এক হলো সময় থাকতে হলো না।
-বাদ দিন আজ আর মন খারাপের গল্প না।আজ আমাদের আনন্দের দিন।

স্বপ্না- মা এতো সব আয়োজন,বাড়ি ভর্তি মেহমান কেনো?
-আজ আমার মেয়ে প্রথম আসছে এই বাড়িতে।তোর বাবা পুরো মহল্লাকে খাইয়েছেন।এতিম বাচ্চা,পথশিশু,ভিক্ষুক সবাই আজ পেট ভরে খাবার খেয়েছে।ভিতরে গিয়ে দেখ কতো আত্মীয় এসেছে তোদের দেখার জন্য।তোর ভাইদের শ্বশুর বাড়ির লোক সবাই এসেছে।

স্বপ্নার খারাপ লাগছে ওকে সার্কাসের জোকার বানিয়ে নিয়ে আসার কোনো মানে ছিলো না।
-মা তোমরা এসব কেনো করলে?
-তুই আসবি এগুলো করবো না?
-আমাকে জোকার বানানোর খুব কি প্রয়োজন?
এই অবস্থায় আমি চুপিচুপি এসেছি কার কাছে মুখ দেখাবো। বলতে পারো, সালমানের কথা সবাই যখন জানতে চাইবে আমি কি জবাব দিবো?

স্বপ্নার মা তিনি চুপ করেই রইলেন।আবেগাপ্লুত হয়ে উনারা সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন।মেয়ের হেনস্তার কথা ভুলেই গিয়েছেন।

স্বপ্না সবাইকে নিয়ে যেতে চাইলে তপনের বউ সামনে আসে।
স্বপ্নার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
-আপু আমি কলি তপনের স্ত্রী।আপনার অনেক গল্প শুনেছি সামনে থেকে দেখা হয়নি।আজ এভাবে চলে যাবেন না।
প্রমিজ আপনার কোনো অপমান হবে না।

সবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্না ভিতরে গেলো।সবার সাথে পরিচিত হয়ে কলি কে বললো রুমে যাবে ওরা।

-আপু তরী আমার মেয়ে তুলোনির সাথে ওর ঘরে গেছে।রিদ্ধ আছে কোথাও, আর আন্টি মায়ের ঘরে।আপু তুমি তোমার ঘরে যাও।
-আমার ঘর?
-আগের ঘরটা তোমারই রয়েছে।মা এই ঘর নিজ হাতে পরিস্কার করেন সাজিয়ে রাখেন।

মায়েরা বুঝি এমনি হয়। স্বপ্না নিজের ঘরটাকে দেখছে।আলনায় ওর স্কুল ড্রেস, বই গুলো সুন্দর করে গুছানো। ওর প্রিয় রং পেন্সিলের বক্সটা যত্ন করে শোকেসে সাজানো।
অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরছে।স্বপ্নার মা আসলেন রুমে।
-দেখ তোর রুম আগের মতো আছে কি-না?
-মা আমাকে পর করে দিলে আমার স্মৃতি কেনো আগলে রাখলে?
-সন্তান পর হয় না রে।তুই আমাদের প্রথম সন্তান অনেক বেশি আদরের।তাই তোর উপর অভিমান বেশি ছিলো।
তোর বাবা কসম দিয়ে আমায় আটকে রেখেছিলেন।কিন্তু নিজেই তোর বিপদের কথা শুনে ছুটে যান।

-মা তুমি অসুস্থ ছিলে?
-ছিলাম তুই আসবে বলে ভালো হয়ে গেছি।

**রিদ্ধ অনেকগুলো ফ্রেন্ড পেয়ে গেছে ওর মামাতো ভাই দুইটা আর ওদের ফ্রেন্ড আরো চার-পাঁচটা।
তরীর বয়সী কেউ নেই তবুও ওর মামাতো বোন তুলোনি বেশ মিশুক।বয়সে তরী থেকে ৭বছরের ছোট হবে।পাকাপাকা কথা বলে!

সব আত্মীয়রা চলে যায়। স্বপ্নারা এখানে তিন চারদিন থাকবে।তপন আর স্বপনের স্ত্রী দুজনেই ভালো।স্বপ্নাদের খেয়াল রাখছে প্রচুর।

**সকাল সকাল সালমান অফিসের কাজে বেড়িয়ে যায়।রুমা ছেলেকে খাইয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা সালমান ফিরছেনা দেখে কল দিলো।
-তুমি আসছো না কেনো?
-একটু দেরি হবে, আমি শহর থেকে অনেকটা দূরে আছি।
-তাড়াতাড়ি এসো।

রুমা ফোন কেটে দিলো। অফিসের ম্যানেজার এসেছে সালমান কে একটা ফাইল দিতে।
আনুমানিক বয়স ৩৫বছর হবে।সুন্দর, সুদর্শন ছেলেটা মার্জিত কথাবার্তা।
-ম্যাম স্যারকে ফাইলটা দিয়ে দিবেন।
-ভিতরে আসো, চা খেয়ে যাও।
-না ম্যাম কাজ আছে।
-প্লিজ এক কাপ চা।
-ওকে ম্যাম।

রুমা চা বানিয়ে নিয়ে আসলো।দু কাপ চা সাথে বিস্কুট।
-চা কেমন হয়েছে?
-খুব ভালো ম্যাম।
-তোমার স্যার আজ কোথায় গেলেন?
-অফিসের কাজেই একটু গ্রামের ওদিকে।
-ওহ।
-আমি তাহলে উঠছি ম্যাম।
-আরে বসো।গল্প করতে কি খারাপ লাগছে?
-না ম্যাম খুব ভালো লাগছে।
-আমার ও খুব ভালো লাগছে।
-ম্যাম আপনার ছেলে?
-এই যে আমার ছেলে তিয়াস।
-খুব মিষ্টি বাচ্চা।
-আপনি ও খুব মিষ্টি।

ছেলেটা আনইজি ফিল করছে উসখুস করছে উঠে যাওয়ার জন্য।
-তোমার নাম্বার দিয়ে যাও।আমার বোরিং লাগলে তোমাকে কল দিবো।

ছেলেটা নাম্বার দিয়ে বেড়িয়ে যেতে গেলে।
-নামটা বলে যাও।
-রাসেল।

ছেলেটা একমতো তাড়াহুড়ো করেই বেড়িয়ে গেলো।
রুমা খুব সুন্দর করে রাফা লেখে নাম্বারটা সেইভ করলো।

রাত দুটো বাজতেই তরীর ফোন বেজে উঠলো। এতো রাতে ফোন বাজতে তরী ভয় পায়।
ভাগ্যিস মা পাশে নেই, এখন নিশ্চয় অন্যকিছু ভাবতেন।আননোন নাম্বার তবে বাহিরের দেশের নাম্বার দেখে তরী ধরবে কি-না ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো।

কিছুক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে এটা কি উল্লাস?গ্রামে নেটওয়ার্ক প্রচুর জ্বালায়। নেট একদম নেই প্রায় ১০মিনিট পর আবার কল আসলো।তরী রিসিভ করে।
-মিষ্টি প্লিজ ফোন কাটবে না আমি উল্লাস।
-জি বলুন।
-কেমন আছো তুমি?
-ভালো। আপনি কেমন আছেন?
-কি বলছো কিছুই তো বুঝা যাচ্ছে না?
-আমি গ্রামে আসছি নেট নেই।
-কোথায় তুমি?
-গ্রামে।
-মিষ্টি শোনা যাচ্ছে না।

টু টু করে ফোন কেটে গেলো। নেটওয়ার্ক নেই এই মুহুর্তে তরীর কিছু করার ও নেই।দিন হলে বাইরে গিয়ে কথা বলা যেতো।কিন্তু রাতে বাইরে যাওয়া সম্ভব না।
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তরী ঘুমিয়ে গেলো।সকালে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ফোন সুইচড অফ।
চার্জ শেষ পুরো ব্যাগ খুঁজে চার্জার পায়নি।তুলোনি কে বলে সবার কাছে চার্জারের জন্য পাঠালো।কারো কাছে আই ফোনের চার্জার নেই।
কি আর করার ফোন ব্যাগে রেখে দিলো।ফোন ছাড়া তিনদিন থাকতে হবে।
একবার রিদ্ধকে বলে দেখবে আশেপাশে কোনো দোকানে চার্জার পাওয়া যায় কি না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here