#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৪৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
১২৩.
ভোরের আলো ফুটতে থাকার দৃশ্যটি নয়নভরে অবলোকন করছে সূচনা। আজ সে ভীষণ খুশি। আজকে পরীক্ষাটা দিলেই তখন শান্তি আর শান্তি। কোনো প্যারা নেই, চিন্তা নেই। তাই সে আজ খুশিমনে পড়তে বসেছে। জানালা দিয়ে ভোর হওয়া দেখছে। ভালো লাগছে তার। সকাল সাতটা অব্দি পড়াগুলো রিভিশন দিয়ে সে বই বন্ধ করে। ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে খেতে বসে। আজ তার সঙ্গে বাড়ির সকলেও প্রায় অনেক এক্সাইটেড। কেননা এতদিন ওর পরীক্ষার জন্য বাড়ির সকলেই ভীষণ নিরব ছিল। অযথা কথা বলা, গল্প করা, গান শোনা সব থেকে বিরত ছিল। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে কথা বলত। আজ ওর পরীক্ষা শেষ মানে ওর সাথে সকলেরই শান্তি।
খাওয়া শেষ করে সুখী আর সূচনা একসাথে বের হয়। সূচনার এক্সাম শেষ হলে সুখীর ক্লাস শুরু হবে। এতক্ষণ সে এখন কম্পিউটার শিখবে। তাই দুজনে সকালে একসাথেই বের হয়। রিকশায় বসে সুখী লাজুকলতার মতো করে বলে,’আপু, শিশিরকে তোমার কেমন লাগে?’
সূচনা অবাক হয় না প্রশ্নটি শুনে। কেননা তাদের সম্পর্ক সূচনা ইতিমধ্যে আদিলের কাছে শুনেছে। তবুও সে এমন একটা ভান ধরে যে, সে কিছুই জানে না। তাই মুখটা ইনোসেন্টের মতো করে সুখীর দিকে তাকায়। সুখী আমতা আমতা করে বলে,’না মানে ইয়ে, তোমার জন্য নয়। ইয়ে আরকি এমনিই জানতে চাচ্ছিলাম হেহে।’ সুখীর হাসি আসছে না। তবুও সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে কথাটাকে উড়িয়ে ফেলতে চায়। তবে সূচনা মজা করার এই সুযোগটি একদমই হাতছাড়া করতে চায় না। তাই সে সুখীর ফোনটা ব্যাগ থেকে নিয়ে নেয়। সেখানে লিখে,’আদিলের চেয়ে কি শিশিরের সাথে আমায় বেশি মানাবে? অবশ্য হলে কিন্তু ভালোই হয় বল! আমি আর আপু বিয়ের পরও একসাথে একই বাড়িতে থাকতে পারব।’
সুখীর মুখটা এবার কাঁদোকাঁদো হয়ে যায়। সে বিমর্ষ হয়ে বলে,’না তো! আমি তো এমন কিছু মিন করিনি। তাছাড়া তোমাকে আদিল ভাইয়ার সাথেই অনেক অনেক অনেক ভালো লাগে। মানে যা বলব, তাই কম মনে হবে বিশ্বাস করো! তাছাড়া ভাইয়া তোমায় কত্ত ভালোবাসে তাই না?’
সূচনা মুখটিপে হেসে পূণরায় লেখে,’তাহলে শিশিরের কথা কেন জিজ্ঞেস করলি?’
‘এমনি। তেমন কোনো কারণ নেই। বিশ্বাস করো।’
‘বিশ্বাস করলাম না। তুই যে ডুবে ডুবে জল খাস, সেটা আমি জানি। শিশির ভাইয়ার সাথে রিলেশন করিস ভালো কথা, আমি জানলে সমস্যা কোথায়?’
সুখী কিছুটা ইতস্তত করে বলে,’না, মানে কেমন জানি লজ্জা লাগে।’
সূচনা প্রত্যুত্তরে হাসে শুধু। রিকশা কম্পিউটারের দোকানের সামনে আসতেই ওরা আদিলকে দেখতে পায়। আদিলও ওদেরকে দেখে হাত নাড়ে। সুখী রিকশা থেকে নামার আগে সূচনাকে বলে,’সারপ্রাইজ!’
এর অর্থ হচ্ছে সুখীই আদিলকে এখানে এসে অপেক্ষা করতে বলেছে। সুখী নামার পর আদিল উঠে বসে। সে কিছু বলছে না। সেই প্রথম লিপ কিস করার পর থেকে সে একা আদিলের সামনে থাকলে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। কেমন যেন সংকোচ, জড়তা কাজ করে। যেমন সে এখনো রিকশার এককোণে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে। বিষয়টা আদিল খেয়াল করে। সে ডান হাত দিয়ে সূচনার কোমরে ধরে টেনে নিয়ে এসে বলে,’এতদূরে কিনারে বসলে তো পড়েই যাবে। আবার এক্সিডেন্ট করার শখ আছে নাকি?’
সূচনা সংকুচিত হয়ে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে বসে থাকে। নড়েচড়ে না, রেসপন্সও করে না। আদিল উদাসীনভাবে জিজ্ঞেস করে,’আজকের প্রিপারেশন ভালো তো?’
সূচনা এবারও নিরব। আদিল এবার ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে? কী সমস্যা?’
সূচনা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, কোনো সমস্যা নেই। আদিল নাছোড়বান্দার মতো ধরে সূচনাকে। বলে,’আমি খেয়াল করে দেখেছি, আমার সামনে আসলে কেমন যেন মিইয়ে যাও। চুপসে যাও। কেন বলো তো? আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?’
সূচনা আদিলের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। আদিল বলে,’হাসলে তো হবে না। আমার উত্তর চাই। বাই দ্যা ওয়ে, সেদিনের চুমুটার জন্য না তো?’
সূচনা লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। আজ,এখন, এখানে, এই সময়টাতেই তাকে সেই প্রসঙ্গটা তুলতে হলো? সূচনার গালের লালাভ হওয়া দেখে আদিল আসল ঘটনা বুঝে যায়। রিকশা এসে তখন থামে কলেজের সামনে। সূচনা তড়িঘড়ি করে নামার আগে আদিল হাত টেনে ধরে। চোখের পলকে সূচনার গালে চুমু খেয়ে বলে,’অল দ্য বেস্ট। ভালোমতো পরীক্ষা দিও।’
এই ঘটনার পর সূচনা পড়িমরি করে পালায়। আর ওর কাণ্ডে আদিল মুচকি হাসে। তারপর সেও ঐ রিকশায় করে তার অফিসে চলে যায়।
______
১২৪.
ফোনের ওপর ফোন আসতে থাকায় ভূমিকা বিরক্ত হয়ে ফোনটাই সাইলেন্ট করে রেখেছিল। ফোনগুলো করেছিল শোহেব। সে জানে, ভূমিকা এই মুহূর্তে অফিসে রয়েছে তবুও সে এ ধরণের পাগলামিগুলো করেই যাচ্ছে। বাচ্চাদের মতো এমন পাগলামি করলে হয়? তার আচার-আচরণে মনে হচ্ছে সদ্য কোনো কিশোর নতুন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
হাতের কাজগুলো শেষ করে সে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ৫০+ মিসডকল ভেসে ওঠে। সাথে রয়েছে অনেকগুলো ম্যাসেজ। এই যেমন,’ফোন ধরছ না কেন?, বলো তোমার কাছে কাজ আগে নাকি আমি?, ওহ এখন তো আর আমাকে ভালো লাগে না। আমি তো এখন পুরনো হয়ে গেছি।’
ম্যাসেজগুলো পড়ে ভূমিকা হেসে ফেলে। সুযোগ বুঝে কলব্যাক করে শোহেবকে। এবার শোহেবও যেন ইচ্ছে করে পালটা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। পাঁচবার ফোন করার পরও সে ফোন তুলছে না। ভূমি ভেবে নেয়, শোহেব বোধ হয় সত্যিই ব্যস্ত তাই আর ফোন করে না। দু’মিনিট পর শোহেব নিজেই ফোন করে। ভূমি ফোন রিসিভ করে বলে,’বলেন।’
‘কী বলব?’ ওপাশ থেকে অভিমানীকণ্ঠে বলল শোহেব। ভূমি মুচকি হেসে বলে,’কী বলবেন সেটাও আমায় শিখিয়ে দিতে হবে?’
‘অবশ্যই। আপনি লেখিকা মানুষ, তার ওপর আবার কর্মজীবী; আপনার সাথে তো আমার বুঝে-শুনে কথা বলা উচিত তাই না? তাই কী কথা বলব,কীভাবে কথা বলব সেগুলো শিখিয়ে দিলে উপকৃত হতাম ম্যাম।’
‘কী হয়েছে হঠাৎ আপনার?’
‘আমি মেয়ে নাকি যে আমার কিছু হবে?’
‘নির্লজ্জ! রাগ কেন করেছেন?’
‘তো কি তা ধিন তা ধিন করে নাচার কথা?’
‘উত্তরেও রাগ দেখাচ্ছেন।’
‘ফোন কেন ধরেননি?’
‘আমি অফিসে। এখানে আমি কাজ করতে আসি তাই না? কাজ রেখে প্রেমালাপে সময় ব্যয় করলে চলবে?’
‘হ্যাঁ,পুরান হলে মানুষ কত অজুহাত দেখায়।’
ভূমিকা এবার ফিক করে হেসে ফেলে। শোহেবের মতো করেই করুণকণ্ঠে বলে,’আহারে! তাই নাকি? জানতাম না তো।’
‘ঢং হুহ!’
‘আপনি নিজে মেয়েদের মতো ঢং করতেছেন।’
‘ইশ! গা জ্বলে যায় যেন আমার।’
‘পানি ঢালব?’
‘চুমু লাগবে।’
‘অসভ্য! ফোন রাখছি।’
শোহেব নিজেও এবার হেসে বলে,’আচ্ছা শুনেন।’
‘কী?’
‘মিস করছিলাম খুব। তাই এতবার ফোন দিয়েছি, আপনি ব্যস্ত জেনেও। রাগ করেননি তো?’
‘আপনার ওপর রাগ করা যায়?’
‘যায় না?’
‘একটুও না।’
‘তাও আমার ওপর বমিরানী কত রাগ দেখায়!’
‘শুরু হয়েছে আবার।’
‘আচ্ছা, রাখছি। পরে কথা হবে।’ হেসে বলল শোহেব।
‘আচ্ছা। আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
দুজনের এমন মান-অভিমান, রাগ, খুনসুটি এখন নিত্যকার রুটিন। এসকল কিছুই এখন যেন ভূমিকার ভালো থাকার মেডিসিন হয়ে গেছে।
_______
১২৫.
সূচনার পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র বিয়ের শপিং করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে আদিল। সে আর সময় নষ্টই করতে চায় না। সুযোগ বুঝে নুসরাত পিঞ্চ মেরে তো বলেও ফেলেছিল,’তুমি দেখি বিয়ে পাগল হয়ে গেছ।’
আদিল উত্তরে কিছু না বললেও কটমট করে তাকিয়ে ছিল শুধু। আদিলের আবদারের কাছে হার মানতে হয়েছিল সবাইকে। অপরদিকে সবার কাছে ফ্রিতে লজ্জা পেতে হয়েছিল সূচনাকে; তাও আবার কোনো কিছু না করেই। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিনই সবাই মিলে গিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করে ফেলেছে। সারাটাদিন বাকিদের কেমন কেটেছে সূচনার জানা নেই। তবে তার খুবই বিরক্ত লেগেছে। একের পর এক দোকান ঘোরা। এই শাড়ি ট্রায়াল করো, এই লেহেঙ্গা ট্রাই করো, এই জুয়েলারি ট্রাই করো, ঐ জুয়েলারি ট্রাই করো। মানে বেচারির অবস্থা একদম যা তা। অন্যদিকে সূচনাও তার অস্বস্তির কথা কাউকে কিছু বলতে পারছিল না। শাশুড়ি মা তো দোকানেই বলে বসেছেন,’আমার একটা মাত্র ছেলের বউ। কোনো কিছুর কমতি রাখব না একদম।’
এ কথার পরে তো আর কিছু বলারই থাকে না।
শপিং শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফেরে সবাই। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। তাই সূচনার সাথে বাকি সবাইও কমবেশি ক্লান্ত। বাড়িতে ফিরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে সূচনা। ব্যথায় শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। সে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। গায়ে হলুদ আর বিয়ের মাঝখানে মাত্র একটাদিন সময় রয়েছে। সবকিছুর জন্য এত তাড়াহুড়া মানা গেলেও, বিয়ের ক্ষেত্রে কি এত তাড়াহুড়ো মানা যায়? সূচনা কোথায় ভেবেছিল, পরীক্ষা শেষ হলে প্রতিদিন দুপুর বারোটা অব্দি ঘুমাবে, রাত করে মুভি দেখবে। একেকদিন একেক জায়গায় ঘুরতে যাবে। অথচ তার সব প্ল্যানিং এখন ভেস্তে গেল। মনে মনে রাগ হলেও সে কাউকে কিছুই বুঝতে দেয় না। কারণ তার বিয়েতে সবাই অনেক বেশি খুশি। তাই সে চায় না তার কারণে কেউ বিন্দুমাত্রও কষ্ট পাক।
‘সূচনা ঘুমাইছিস?’ মায়ের কণ্ঠে সূচনা মাথা উঁচু করে দরজার দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে। মা এগিয়ে এসে শরবতের গ্লাস নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,’লেবুর শরবত খা। ক্লান্তি চলে যাবে।’
সূচনা চুপচাপ উঠে বসে শরবতটুকু পান করে। মা কেমন করে যেন তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে মায়ের আবার কী হলো? তিনি সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না দু’দিন বাদে আমার সূচনার বিয়ে হবে। মনে হয়, এইতো কিছুদিন আগেই তোকে কত্ত ছোটো দেখলাম। ফোকলা দাঁতে কেমন করে ভুবনভুলানো হাসতি, ছোটো ছোটো দাঁত দিয়ে আমাদের কামড়াতি। তোর আদুরে ছোটো দুই হাতে, গালে-মুখে আমি কত চুমু খেতাম। এখন সেই ছোট্ট মেয়েটারই নাকি বিয়ে? দেখতে দেখতে এত বড়ো হয়ে গেলি?’ মায়ের গলা ধরে আসছে। চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রুকণা। সূচনাও আবেগপূর্ণ হয়ে পড়ে। দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হু হু করে এবার কেঁদে ওঠে মা। কন্যা বিদায় যে বাবা-মায়ের জন্য কতটা কষ্টকর সেটা শুধু তারাই বুঝবে যাদের নিজের মেয়ে রয়েছে। এ কষ্টের কথা ভাবলেই যেন শরীর হিম হয়ে আসে। অথচ দু’দিন বাদে সত্যি সত্যি সূচনাকে তাদের বিদায় দিতে হবে। এটাই যে নিয়ম!
.
একই কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদ এবং বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে বলে সূচনার পরিবার অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছে। নতুবা এত অল্প সময়ে তাদের পক্ষে বিয়ের আয়োজন করা সম্ভব হতো না। গায়ে হলুদের আগের দিন সূচনা পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে শুধু। ভূমিকা দুপুরে একবার শুধু জোর করে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর আর কেউই ওর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়নি। সবাই বাড়ির টুকটাক কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় সূচনার ঘুম পরিপূর্ণ হয়। সে হাই তুলতে তুলতে ঘরের বাইরে আসে। তার নিজস্ব আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউই আসেনি। অন্যান্য চাচারাও নয়। সূচনার ভারী মন খারাপ লাগে হঠাৎ করে তার ভাইয়ের জন্য। ভাই কি জানে কাল যে সূচনার গায়ে হলুদ? আর জানলেই বা কী! সে যে কখনো আসবে না এটাও সূচনা ভালো করেই জানে। ভাই থাকতেও ভাইয়ের আদর-যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসা থেকে তারা দুটি বোন বঞ্চিত। শেষ বয়সে বাবা-মায়ের ঠাই হয়ে থাকার কথা ছিল। অথচ, এখনই কোনো খোঁজ-খবর নেয় না।
সূচনাকে দেখতে পেয়ে সুখী সোফা থেকে উঠে গিয়ে সূচনাকে টেনে আনে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’তারপর বলো কেমন এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে মনে?’
সূচনা মলিন হাসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু। সুখী হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হলো?’
এবার সূচনা শব্দ করে কান্না করে। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই কান্নার গতি যেন আরও বেড়েই চলছে। সবাই এসে সূচনাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে।
রাত প্রায় বারোটার দিকে আদিলের ম্যাসেজ আসে সূচনার ফোনে। ‘ছাদে আসো।’
এদিকে বাড়ির সবাই তাকে জেকে ধরে বসেছে। সবার মধ্য থেকে কী করে উঠে যাবে? ওর ইতিউতি করে তাকানো চোরাদৃষ্টি ধরে ফেলে ভূমিকা। সূচনার পাশেই বসেছিল বিধায় খোঁচা মেরে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
সূচনা ম্যাসেজটা ভূমিকাকে দেখায়। কয়েক সেকেন্ড পর সবার সামনেই ভূমি বলে,’সূচনা ছাদে আয় তো। কিছু কথা আছে।’
সুখী আর সাথী বলে,’আমরাও যাব।’
‘না। সূচনার সাথে আমার একা কিছু কথা আছে। তোরা বোস।’
এরপর সূচনাকে নিয়ে ভূমিকে সিঁড়ির কাছে এসে বলে,’আমি আর যাব না। তুই যা। আমি এখানেই আছি।’
ছোটো বোন যাচ্ছে হবু বরের সাথে দেখা করতে। আর বড়ো বোন পাহারা দিচ্ছে। হায়রে জীবন!
সূচনা ছাদে গিয়ে দেখে আদিল সেখানে পায়চারি করছে। সে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই আদিল বলে,’তোমায় সুন্দর লাগছে।’
সূচনা অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। আদিল তখন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে স্বর্ণের একটা সুন্দর চেইন লকেটসহ ওর গলায় পড়িয়ে দেয়। সামনে এসে মনভরে কিছুক্ষণ সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ওর দু’গালে হাত রাখে। আঙুল দিয়ে গালে স্লাইড করে বলে,’যেদিন বিয়ের জন্য শপিং করতে গেলাম, সেদিন এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। সকলের অগোচরে কিনলেও তোমায় দেওয়ার আর সুযোগ হয়নি। তাই ভাবলাম আজ রাতে দেই। কেমন লেগেছে তোমার?’
প্রত্যুত্তরে সূচনা প্রসন্নতার হাসি হাসে। আদিল জড়িয়ে ধরে সূচনাকে। বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,’জীবনে প্রথম কাউকে এত ভালোবেসেছি সূচনা। মা আর নুসরাতের পর তুমিই তৃতীয় মেয়ে যে আমার জীবনের সর্বস্বজুড়ে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মা-বোন কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয় জানো? সবসময় মনে হয়, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও! আমি মনেপ্রাণে চাই, এমন দিন যেন আমার মৃত্যুর পরও না আসে। তুমি বিহীন আমি নিজেকে ভাবতে পারি না। তোমার কাছে বিয়ের আগে একটাই অনুরোধ, প্লিজ কখনো আমায় ছেড়ে যেও না।’
সূচনার বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। জয় আর আদিলের মাঝে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দোটানা থেকে বহু আগেই সে বেরিয়ে এসেছে। যতটুকু দ্বিধা তবুও তার মনের এক কোণে এতদিন স্থায়ী ছিল সেটাও আজ আদিলের কথা শোনার পর থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে ভরসার প্রতিশ্রুতি দিতে আদিলের পিঠে হাত রাখে। ভরসা পেয়ে আদিলের চোখেও বুঝি এক ফোটা পানি জড়ো হয়। এ পানি আনন্দের! ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার।
.
রাত গড়িয়ে সেই বিশেষ দিনটি আসে। যে দিনটির জন্য চাতকপাখির মতো অপেক্ষা করেছিল আদিল। সে তো তার বন্ধুবান্ধব, কাজিন, পরিবার, রিলেটিভ সবাইকে নিয়ে অনেক আগেই চলে এসেছে। সূচনা এখনো পার্লারে। ওর সাথে ভূমিকা, নুসরাত, ফাতেমা, সুখী আর সাথীও রয়েছে। আজকে সাথীও অনেক বেশি এক্সাইটেড। কারণ ওদের বিয়েতে ওর বয়ফ্রেন্ডও আমন্ত্রিত। সাজগোজ শেষ হলে সূচনাকে নিয়ে ওরা সবাই কমিউনিটি সেন্টারে ফিরে। আদিল উত্তেজিত হয়ে বলে,’হায়রে আল্লাহ্! আমার হলুদ পরী এসে পড়েছে।’
ওর বন্ধু আর কাজিনরা ওকে ধরে বসিয়ে বলে,’আরে, ব্যাটা বোস! এত লাফাইস না।’
শোহেব ওদের কথার প্রতিবাদ করে বলে,’ওর বিয়েতে ও লাফাবে না তো কি আমরা লাফাব? ওর বউ দেখে ও লাফাক, নাচুক যা খুশি করুক। তোমরা চুপ করে বসো।’
শিশির পিঞ্চ মেরে বলে,’তুমি যে তোমার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি লাফাবে ঐটা আমরা জানি।’
‘এক্সাক্টলি। আমি তো পারলে আমার বউকে কোলে তুলে নিয়ে নাচব।’
কথার মাঝে আদিল উঠে দাঁড়িয়েছে। সূচনার সামনে গিয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে। সুখী মুখ ভেংচি মেরে বলে,’ওভাবে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে রয়েছেন কেন দুলাভাই?’
‘কী করব শালীকা? এতগুলা পরী। কারে রেখে কারে দেখি বলো তো?’
‘তোর কাউরে দেখা লাগবে না। সামনে থেকে সর। আমরা এখন ভাবির সাথে ছবি তুলব।’ আদিলকে ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে বলল নুসরাত। আদিল অসহায়ের মতো ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমার বিয়েতে আমারই কোনো দাম নেই। কী একটা অবস্থা বল তো!’
বন্ধুরা এবার সমস্বরে হেসে ওঠে। আদিলের ফোন আসায় তখন সে সেখান থেকে বাইরে যায়। বাকিরাও এবার সুযোগ পেয়ে সূচনার সাথে সেলফি তোলা শুরু করে। কিছুক্ষণ বাদে আদিল আবার ফিরে এসে বলে,’এই তোরা সর! আমার বউয়ের সাথে আমায় ছবি তুলতে দে।’
সবাই সরে দাঁড়ায়। সূচনা লাজুক হেসে সামনে তাকানোর পর তার হাসি মিলিয়ে যায়। আদিলের পাশে নীল পাঞ্জাবি পরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়। সূচনার মতো তারও চোখে-মুখে অজস্র বিস্ময়। আদিল জয়কে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমার বিয়েতে বেস্ট ফটোগ্রাফারকে তুলে এনেছি। নে ভাই, ছবি তোলা শুরু কর।’ এই বলে সে সূচনার কাছে গিয়ে টেনে সূচনাকে কাছে আনে। এবং ফট করে একটা চুমুও খেয়ে ফেলে গালে। অন্যদিকে সূচনা তখনো বিস্ময়ে পাথর হয়ে রয়েছে। আজ সে জেনেই ছাড়বে কী কারণে জয় এমন উধাও হয়ে গিয়েছিল? জয় এই দৃশ্য দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। সূচনাকে তার সহ্য হচ্ছে না।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]