বিরহের নাম তুমি পর্ব-৩৯

0
440

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
১০৭.
সুখীর মেজাজ প্রচণ্ড রকম খারাপ। আগামীকাল শুক্রবার। বন্ধের দিন। কোথায় একটু আরাম করে ঘুমাবে; তা নয় তাকে কোচিং-এ পরীক্ষা দিতে হবে। আর এজন্য আজ তাকে রাত জেগে পড়তেও হবে। সে রাগে বিড়বিড় করতে করতে একা একাই বলে,’স্যার-ম্যামরা আমাদের কী পেয়েছে আমি বুঝিনা! রোবট মনে হয় নাকি আমাদের? যখন তখন একটা করে পরীক্ষা নাকের ডগায় ঝুলিয়েই রাখবে। আজব কিসিমের মানুষজন!’

সাথী আর ফাতেমা শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করছিল। সুখীর বিড়বিড় করে বলা কথা শুনতে পেয়ে সাথী বলে,’মন না চাইলে পরীক্ষা দিস না। এত প্যারা খাচ্ছিস কেন?’
‘ইশ! আসছে আরেকজন আমাকে উপদেশ দিতে। আমার শ্বশুরবাড়ি নাকি যে সবকিছু আমার মনমর্জি মতো চলবে?’
‘তোর যা ইচ্ছে তুই কর তো!’
‘হ্যাঁ, এখন তো এসব বলবেই। একজন ফেসবুকে গল্প পড়ছে, তুমি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চ্যাটিং করছ, সূচনা আপু হবু শ্বশুরবাড়ি আর ভূমি আপু শোহেব ভাইয়ার সাথে ডেটে। শালার আমারই পড়াময় কপাল!’ শেষ কথাটা বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলল সুখী।

সাথী এবং ফাতেমা দুজনই শোয়া থেকে উঠে বসে। দুজনের মুখে বিস্ময়ের শেষ নেই। ওদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুখী নিজেই ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,’কী হলো? ওভাবে দুজনে তাকিয়ে আছ যে? গিলেটিলে খেয়ে ফেলবে নাকি?’
‘ভূমি শোহেবের সাথে ডেট করছে তোকে কে বলল?’ বিস্মিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ফাতেমা।
সুখী এবার ফিক করে হেসে বলে,’কেউ বলেনি। একদিন আমি দেখেছি দুজনে রেস্টুরেন্টে গেছে। এরপর আরো একদিন দেখেছি। আজও যখন এখনো আসেনি তাহলে দেখো গিয়ে নিশ্চয়ই ডেট করছে।’
‘যাহ্! না জেনে আউল-ফাউল কথা বলিস না।’ ফোঁড়ন কাটল ফাতেমা। সাথী তাকে কনুই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,’আউল-ফাউল বলছ কেন? দুজনের যদি একটা ইয়ে-ফিয়ে হয়ে যায় তাহলে কিন্তু দারুণ হবে। ওদেরকে কী সুন্দর মানায়!’

ভূমির প্রবেশ ঘটে তখন ঘরে। তিনজনকে একত্রিত দেখে একবার তাকায় সে। ভ্যানিটিব্যাগ টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে প্রশ্ন করে,’তিনজনে কী শলাপরামর্শ চলছে?’
ফাতেমা একটু গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করে,’তুই শোহেবের সঙ্গে ডেটে গেছিলি?’
ভূমির চক্ষু যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার জোগার। সে অবাক হয়ে বলে,’ডেটে কেন যাব?’
‘তাহলে আসতে এত দেরি হলো যে?’
‘আমার আজ ওভারটাইম হয়েছে। নয়তো তো তোমার সাথেই আসতাম। তবে হ্যাঁ, দুপুরে অফিসের সাথে যেই রেস্টুরেন্ট সেখানে লাঞ্চ করেছিলাম একসাথে।’
সাথী খুশিতে গদগদ হয়ে উঠে গিয়ে ভূমির গলা জড়িয়ে ধরে। আনন্দিত হয়ে বলে,’তার মানে তো তোমরা ডেট করছ!’
ভূমি সাথীর হাত সরিয়ে নেয়। কড়াকণ্ঠে বলে,’ইট ওয়াজ নট অ্যা ডেট!’

সাথী, সুখী দুজনের আনন্দেই ভাটা পড়ে। তারা তো দুজনকে নিয়ে অলরেডি মনের ভেতর কল্পনা জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভূমি যা কাঠখোট্টা স্বভাবের! কিচ্ছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। ওদের কারও সঙ্গে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ভূমি ফ্রেশ হতে চলে যায়। তখন ফাতেমা বলে,’আগে দুজনের মতিগতি জানতে হবে বুঝেছিস? অবশ্য শোহেবের ভাবসাব দেখে তো আমার সন্দেহ লাগে ও ভূমিকে পছন্দ করে। কিন্তু ভূমিকে নিয়েই আমার যা ভয়!’
‘আমারও!’ সুখী এবং সাথী দুজনই আচানক একসাথে এক কথা বলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হেসে ফেলে।

ভূমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,’সূচনা কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?’
‘নুসরাত আপু এসে তাদের বাসায় নিয়ে গেছে।’ বলল সুখী।
ভূমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সুখীর পাশে বসে। তিনজনের উদ্দেশ্যেই জিজ্ঞেস করে,’জয় আর সূচনার মাঝে কি রিলেশন ছিল?’
‘রিলেশন বলতে তেমন কিছুই না। তবে সূচনা জয়কে ভালোবাসত। জয়ের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। দেখিওনি কখনো।’ বলল ফাতেমা।
‘তাহলে সূচনা এমন পাগলামি করছে কেন? তাও একটা বিধর্মী ছেলের জন্য। আবার ছেলেটা নাকি কিছু না বলে-কয়েই উধাও হয়ে গেছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সুখী উত্তরে বলল,’আপুর সাথে যখন জয় ভাইয়ার পরিচয় হয়েছিল তখন তো আপু জানত না, ভাইয়া যে হিন্দু। আর যখন জেনেছিল তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।’
‘দেরি তো কী হয়েছে? যেটা সত্য সেটা তো মেনে নিতেই হতো তাই না? ওর আরও আগেই এ সম্পর্ক থেকে বের হওয়া উচিত ছিল।’
‘সূচনা ঢাকায় এসে কিন্তু ভালো ছিল না জানো? তোমার চাচি এমনকি জারিফ ভাইয়াও প্রথমে সূচনাকে দেখতে পারত না। সবাই অনেক খারাপ ব্যবহার করত। অনেক মারধোরও করত। তুমি ঢাকায় থাকাকালীন তোমার শ্বশুরবাড়িও যেত না, তোমার শাশুড়ি রাগারাগি করে বলে। ঐ সময়টাতে একমাত্র জয়-ই ছিল যে সূচনাকে আগলে রেখেছিল। সময় দিয়েছিল। আর এমন হলে যেকোনো মেয়েই তো দুর্বল হবে স্বাভাবিক। আমি যতদূর জানি, সূচনা এর আগে কখনো কাউকে ভালোবাসেনি। তাই ওর সময় লাগছে এই না হওয়া সম্পর্কটা থেকে বের হতে।’ কথাগুলো বলল সাথী।
ভূমিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে,’বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ওরও তো একটু বোঝা উচিত। আদিল ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ছেলেটা যখন এসব জানবে তখন কত কষ্টই না পাবে!’
ফাতেমা বলল,’কষ্টের কি আছে? মানুষের কি অতীত থাকে না? আর এমনও তো নয় যে, সূচনা আদিলকে চিট করছে। বরং ওর একটু সময় লাগছে। সূচনা অনেক বেশি ইমোশোনাল। তাই তার কাছে সবটা এত সহজ লাগছে না, যতটা আমাদের কাছে লাগছে। আর আদিলকে যে ও বুঝবে সেই সময়টা কাটায় ওরা দুজন? আদিলের সাথে ওর সময় কাটানো উচিত একটু বেশি বলে আমি মনে করি। এতে করে দুজনই দুজনকে বুঝতে পারবে। একজনকে ভুলতে হলে অন্যজনের সময় অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরী। তুই আদিলকে বলবি ওর কাজের ফাঁকে আর সূচনার পড়ার ফাঁকে আড্ডা দিতে। দেখা করতে। তাহলেই দেখবি আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এক লাফে যদি গাছে উঠতে যাস তাহলে হিতে বিপরীত ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমরা যদি সূচনাকে দোষারোপ করতে থাকি বারবার ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি তাহলে ওর মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সবার প্রতি ও তিক্ত হয়ে উঠবে। সবচেয়ে ভালো যেটা হবে তা হচ্ছে আদিলের ওকে সময় দেওয়া।’
‘আমিও ভাবছি এ ব্যাপারে আদিলের সঙ্গে একটু কথা বলব।’
‘এটাই ভালো হবে। বুঝিয়ে বল। পারলে সূচনার অতীতটাও জানিয়ে রাখিস।’
‘নাহ্। সূচনাকেই বলব বলতে। আমি বলব না।’
______
১০৮.
হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে বারবার ঘুরাঘুরি করছে আদিল। প্যাকেটসহ হাত তার পিঠের দিকে লুকানো। যার কারণে ড্রয়িংরুমে বসে থাকা মা, নুসরাত কিংবা সূচনা কারোরই নজরে পড়ছে না। কিন্তু ওর বারবার ঘুরাঘুরি, পায়চারি দৃষ্টি এড়ায় না উপস্থিত তিন রমণীর। এমনকি লুকিয়ে রাখা প্যাকেটটিও মায়ের দৃষ্টিও এড়িয়ে যেতে পারে না। সে মনে মনে হাসে। এরপর তাড়া দিয়ে বলে,’নুসরাত আমার সাথে আয় তো। সূচনার জন্য একটা জিনিস আছে। নিয়ে যা।’

নুসরাত বুঝতে পারল না। সূচনার জন্য আনা জিনিস তো সূচনাকে সাথে নিয়েই দেওয়া যায়। এজন্য ওকে কেন ডাকা হচ্ছে?
‘কী হলো? আয়।’ পূণরায় তাড়া দিলেন তিনি। নুসরাত সূচনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে মায়ের সাথে তার ঘরে যায়। আড়াল থেকে ওদের কথোপকথন কান পেতে শুনছিল আদিল। মা, বোন প্রস্থান করতেই সেও ঝড়ের বেগে সূচনার সামনে এসে উপস্থিত হয় এবং তুফানের বেগে তাকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। এই পুরো ঘটনায় হতবাক হয়ে যায় সূচনা। আদিল হড়বড় করে বলে,’আমার মা আর বোনের সঙ্গে এত গপ্পসপ্প কীসের? এই অসহায় মাসুম লম্বা বাচ্চাটাকে তোমার চোখে পড়ে না? বশ করতেছ নাকি ওদের?’

সূচনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ করে এই ছেলের আবার কী হলো? তার বিস্ময়কর দৃষ্টিকে কঠোরভাবে উপেক্ষা করল আদিল। হাত ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে নিজে বসে ফ্লোরে। হাতের প্যাকেটটি সূচনার কোলের ওপর রেখে বলে,’এটা তোমার জন্য। প্যাকেট খোলো।’

সূচনা নিশ্চুপ থেকে প্যাকেটটি খোলে। কলাপাতা রঙের সুন্দর একটা শিফন শাড়ি বেরিয়ে আসে। শাড়িটা এতটাই সুন্দর যে সূচনার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। আদিল জিজ্ঞেস করে,’পছন্দ হয়েছে?’
সূচনা ইশারায় জিজ্ঞেস করে,’আপনি পছন্দ করে কিনেছেন?’
সূচনার ইশারাকৃত কথাবার্তা এখন মোটামুটি ভালোই বোঝে আদিল। তাই ওর এ কথাটা বুঝতেও অসুবিধা হয় না। সে সুন্দর করে হেসে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। সূচনা পূণরায় ইশারায় বলে,’অনেক সুন্দর হয়েছে।’
‘তোমার পছন্দ হয়েছে মানে আমার কেনা সার্থক হয়েছে। এবার আমায় একটু খুশি করে দাও।’

সূচনা ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকায়। আদিল ওর ভয়ের কারণ বুঝতে পেরে শব্দ করে হাসে। হেসে হেসে বলে,’অন্যকিছুৃ মিন করিনি আমি। শুধু কালকে এই শাড়িটা পরে ঘুরতে যাবে। তাহলেই আমি খুশি।’
সূচনা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানায়। সে শাড়ি পরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে না। বাড়িতে কোনো রকমভাবে শাড়ি সামলাতে পারলেও বাইরে ভীষণই ঝামেলাকর মনে হয়। কখন হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে অথবা শাড়ির কুঁচি খুলে যাবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু আদিলও তো নাছোড়বান্দা। সে আকুতি-মিনতি করে বলে,’প্লিজ না কোরো না! অনেক শখ করে শাড়িটা তোমার জন্য কিনেছি। কিচ্ছু হবে না বিশ্বাস করো। আমি তো থাকব সাথে। আপু আবার তোমার রুমমেটরাও থাকবে। নুসরাতও থাকবে। কোনো সমস্যা হবে না। প্লিজ পরো! লক্ষী আমার, ময়না আমার, টিয়া আমার, ফিউচার বাবুর মা আমার।’
সূচনা হেসে ফেলে। অনিচ্ছাতেও সায় দেয় ওর কথাতে। অর্থাৎ কাল সে শাড়ি পরে বের হবে।
__________
১০৯.
শুক্রবারের সকালটি আজ অন্যরকম সুন্দর। ভোর সুন্দর, পরিবেশ সুন্দর, প্রকৃতি সুন্দর। শোহেবের বিশ্বাস এখন যদি সে একটা তেলাপোকাকে দেখে তবে সেটাকেও তার সুন্দর মনে হবে। তার মন আনন্দে বাকবাকুম করছে। ভূমির সাথে অনেকটা সময় কাটানোর লোভে আর তর সইছে না তার। কখন সময় হবে। কখন দেখা হবে। আজকে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড ছিল শোহেব। সে-ই আদিলকে ভুজংভাজাং বুঝিয়েছে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। প্রথমে বলেছিল ছেলেদের গ্যাং যাবে ঘুরতে। এরপর ইনিয়েবিনিয়ে বলেছে তাইলে মেয়েদেরকেও নেওয়া যায়। অন্যদিকে সূচনার সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে আদিলেরও নেহাৎ-ই কম নয়; বরঞ্চ অনেক বেশি। তাই সেও বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায়।

শোহেবকে পরিপাটি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসতে দেখে সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’আজ তো অফডে। কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ঘুরতে যাচ্ছি মা।’
‘ঐ মেয়ের সাথে?’
শোহেব হেসে ফেলে। বলে,’শুধু ঐ মেয়ে না। আরো অনেকে মিলেই যাব।’
‘তাই তো আজ এত খুশি। তো বউকে নিয়ে একা একাই ঘুরবি? মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাবি না?’
‘করাব তো। আমাদের মাঝে ভাবটা আরেকটু গভীর হোক। তারপর।’
সুলতানা বেগম হেসে বলেন,’অল দ্য বেস্ট।’
‘লাভ ইউ মা।’ মায়ের গালে গাল ঘষে বলল শোহেব। তিনিও ছেলের গালে হাত বুলিয়ে বললেন,’লাভ ইউ টু মাই সন।’
‘বাহ্! বাহ্! মা-ছেলের কত ভালোবাসা। আর আমার? আমার কপালে বকাঝকা ছাড়া কিচ্ছু নেই। সত্যিই, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমায় তোমরা কুড়িয়ে পেয়েছ।’ রুম থেকে বের হতে হতে বলল শিশির।

ওর অভিমান দেখে শোহেব আর মা দুজনেই হাসে। সুলতানা বেগম ওকে আরেকটু রাগাতে বলেন,’মনে হওয়ার কী আছে? তোকে তো আমরা সত্যি সত্যিই কুড়িয়ে পেয়েছি।’
শোহেব এগিয়ে গিয়ে শিশিরের কাঁধ জড়িয়ে বলে,’আমার ভাইকে নিয়ে মজা করবে না মা।’
শিশির হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,’হয়েছে। এখন আর তোমার ঢং করা লাগবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো।’
‘এই যা! আমি তো তোরই সাপোর্ট করলাম।’
শিশির কিছু শুনল না। আগে আগে বের হয়ে গেল। শোহেব মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,’কেন যে শুধু শুধু ওকে রাগাও!’
এরপর নিজেও শিশিরকে অনুসরণ করে বাড়ি থেকে বের হলো।
_________
১১০.
মেয়েদের গ্রুপ আজ শাড়ি পরেছে। সুখী বাদে অবশ্য কেউই শাড়ি পরতে চায়নি। সুখীর এখন সবকিছুতেই আনন্দ। ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে কোচিং-এর পরীক্ষাও দিতে যায়নি। অন্যদিকে সূচনা সকলকে জোর করে বাধ্য করিয়েছে শাড়ি পরার জন্য। শোহেবের বুকের ভেতর ধিরিম ধিরিম আওয়াজ হচ্ছে। ভূমির দিকে এক পলকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভূমি সেটা খেয়াল করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শোহেব কি আর হার মানার ছেলে? সে উলটো গিয়ে ভূমির পাশে দাঁড়ায়। আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকে। ভূমি বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে,’ওভাবে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছেন কেন?’
শোহেবও ভূমিকে অনুরূপ কপি করে বলে,’আপনি এমনভাবে সুন্দর করে শাড়ি পরে, চোখে কাজল দিয়ে সামনে আসবেন। আর আমি তাকালেই দোষ?’
‘এজন্য তাকিয়ে থাকা লাগবে?’
‘আপনিও তো তাকিয়েছেন। আমি কিছু বলেছি?’
‘আশ্চর্য! আমি কখন তাকালাম?’
‘না তাকালে দেখলেন কী করে আমি যে তাকিয়েছি? ওহ আচ্ছা আপনি তাকালে কিছু না। আর আমি তাকালেই দোষ।’
‘আপনার চোখে সমস্যা। আপনার ক্যারেক্টারেও সমস্যা।’
‘যাব ভূমি মুঝে দিখতা হে, তাব রাসলীলা হে; অর মে দেখু তো শালা ক্যারেক্টার ঢিলা হে!’
ভূমি কিছু না বলে শুধু কটমট করে তাকিয়ে থাকে শোহেবের দিকে।

আজ সবাই রিকশা করে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাবে। এজন্য শোহেব তার গাড়িটা আনেনি। তার খুব ইচ্ছে ছিল ভূমির সঙ্গে এক রিকশায় ঘুরতে যাবে। কিন্তু ভূমির সামনে নির্লজ্জ হতে পারলেও সকলের সামনে নির্লজ্জের মতো কথাটি বলতে পারেনি। তাতে কী-ই বা আসে যায়? ওদেরকে এক করতে তো সুখী, সাথী, ফাতেমার দল আছেই। সুখী নুসরাতের সঙ্গে গিয়ে এক রিকশায় বসে পড়ে। ফাতেমা বসে সাথীর সাথে। আদিল যে সূচনার সঙ্গে বসবে এতে তো কোনো সন্দেহই নেই। অসহায় ভূমি ভাবতে থাকে কার সাথে বসবে। সে সময়ে শিশির একটা রিকশায় উঠে বলে,’আপু আমার সাথে আসো।’
শোহেব ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে,’তুই এত স্বার্থপর কেন শিশির? সবসময় সব জায়গায় তো আসলাম তোর সাথে যায়। এখন তুই ওকে ভুলে গেলি? এত স্বার্থপর তুই? এত? বেচারার মন খারাপ হবে না? দেখ তো এখনই ছেলেটার মুখের রং পাল্টে গেছে। না,না বড়ো ভাই হয়ে আমি তো এই অন্যায় মানব না।’

শিশির এবং আসলাম দুজনই হা করে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আসলাম। সে তো এসবের কিছু ভাবেইনি। তবে তাকে কিছু বলারও সুযোগ দিলো না শোহেব। ঢেলেঢুলে শিশিরের রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে নিজে অন্য একটা রিকশায় উঠল। তারপর ভূমিকে বলল,’শিশিরের আপু আপনি আমার সাথে আসুন। ওদের বন্ধুত্বের মাঝে থার্ড পার্সন হওয়ার কোনো দরকার নেই। আসুন, আসুন।’
অগত্যা ভূমিকে তার সাথেই এক রিকশায় যেতে হয়। শোহেবের অতি চালাকি প্রায় সকলেই বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসে।

সূচনা চুল খোঁপা করে এসেছে আদিলের ভয়ে। আদিলও বারবার সুযোগ বুঝে ওর দিকে তাকাচ্ছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,’চুল খুলে দাও।’
সাথে সাথে সূচনা দু’দিকে মাথা নাড়ে।আদিল হাসে। হেসে হেসে বলে,’আরে পাবলিক প্লেসে তো কিছু করব না। এত ভয় পেলে চলে?’
তবুও সূচনা নারাজ। আদিল আর জোর করে না। জিজ্ঞেস করে,’কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছ?’

সূচনা ভ্রুঁ কুচকে তাকায়। আদিল কোন শব্দের কথা বলছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। আদিল ফের জিজ্ঞেস করে,’শুনতে পাচ্ছ না?’
‘বুঝতে পারছি না।’ ইশারায় বোঝাল সূচনা। তখন আচমকা একটা কাজ করে বসে আদিল। সূচনার মাথা টেনে নিয়ে আসে নিজের বুকের ওপর। বলে,’এবার শুনতে পাচ্ছ?’
সূচনা কান পেতে শুনতে পারে আদিলের হৃদস্পন্দনের শব্দ। তবে সে খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যে, সে নড়াচড়া করতেই ভুলে গেছে। বরফের মতো স্থির হয়ে বসে রয়েছে। আদিলের ইচ্ছে করছে সূচনাকে এভাবেই বুকের মাঝে সারাজীবন জড়িয়ে রাখতে। সে আবেশভরা কণ্ঠে বলে,’প্রতিটা হৃদস্পন্দন কী বলছে জানো? ভালোবাসি সূচনা, ভালোবাসি সূচনা বলছে।’

সূচনা এবার সরে বসে। চোখমুখ থমথমে ভারী হয়ে রয়েছে। আদিলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। আদিল ভয়ে ভয়ে জানতে চায়,’তুমি কি রাগ করেছ? রাগ করো না প্লিজ! স্যরি।’
সূচনা কোনো রেসপন্স না করে কাঠের পুতুলের মতো সোজা হয়ে বসে থাকে।

কিছুক্ষণ বাদে সবাই মিলে নদীর পাড়ে উপস্থিত হয়। বড়ো বড়ো সিঁড়ির কয়েকটা সিঁড়ি তারা দখল করে বসে। ওরা ছাড়াও আরো অনেক মানুষ রয়েছে এখানে। সূচনার রাগ ভাঙাতে বেলীফুলের মালা কিনতে যায় আদিল। নদীর পাশেই ফুলের দোকানটা। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় শোহেবকে। আদিল পিঞ্চ মেরে বলে,’এহেম! এহেম! এখানে কেন?’
‘হেহে! তুমি যে কারণে, আমিও একই কারণে।’
আদিল প্রত্যুত্তর না করে ফুল কেনে। ফিরে আসার পথে শোহেবকে বলে,’ভাইয়া একটা হেল্প করবেন?’
‘কী?’
‘ফুলটা আপনি সূচনাকে দেবেন।’
‘কী! কেন?’
‘রাগ করে আছে তো। নাও নিতে পারে আমি দিলে।’
শোহেব চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বলে,’ভালো আইডিয়া। এক কাজ করো তাহলে। তুমিও তাহলে এই ফুলের মালাটা ভূমিকে দিও। আমি দিতে গেলে ঝগড়া লেগে যাবে আমি শিওর।’
আদিল হেসে বলে,’ঠিক আছে।’

দুজনই মালা অদলবদল করে নিয়ে যায়। বাকিদের কেউ ছবি তুলছিল। কেউ বাদাম খাচ্ছিল। এর মাঝে শিশির, আসলাম, সুখী আর নুসরাত চারজনের বেশ ভাব জমে গেছে। আসলাম নুসরাতের ছবি তুলে দিচ্ছে। আর শিশির সুখীর ছবি তুলে দিচ্ছে। অন্যদিকে সূচনা, ভূমিকা, সাথী আর ফাতেমা সিঁড়িতে বসে বাদাম খাচ্ছিল। আদিল ওপর থেকেই ভূমিকে ডাকে। ভূমি ওপরে যাওয়ার পর শোহেব এসে সূচনার পাশে বসে বলে,’খোঁপা খালি রেখেছ কেন? এদিকে আসো। খোঁপায় ফুল গুঁজে দেই।’

সূচনা বাঁধা দেয় না। সাথী খোঁচা মেরে বলে,’শালিকার জন্য কত্ত ভালোবাসা!’
‘অনেক।’ বলে শোহেব আহম্মক হয়ে যায়। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,’এসব ভুলেও ভূমির সামনে বোলো না। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে তাহলে আমার সাথে।’

ভূমি আদিলের কাছে গিয়ে বলে,’কী হলো?’
‘সবসময় একটা কমতি নিয়ে কেন ঘুরো বলো তো?’
ভূমি বুঝতে না পেরে বলল,’বুঝলাম না।’
‘সেদিন শাড়ি পরলে অথচ চোখে কাজল দাও নাই। আজ চোখে কাজল দিয়েছ, কিন্তু খোঁপায় কোনো ফুল নেই। জানো খোঁপাটাকে কত অসহায় অসহায় লাগছে?’
ভূমি হেসে বলে,’তাই? তাহলে ভুল আনলে না কেন?’
‘এনেছি তো!’ এই বলে সে তার কালো পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেলীফুলের মালাটা বের করে ভূমির খোঁপায় পরিয়ে দেয়। দূর থেকে দৃশ্যটা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল আগুন্তুক। সে আর সহ্য করতে না পেরে রেগেমেগে এগিয়ে আসে।

ভূমিকার হাসি মিলিয়ে যায় আগুন্তুকটিকে দেখে। আগুন্তুকটি একটি মেয়ে। সাথে রয়েছে তার হাজবেন্ড আর বাচ্চা। মেয়েটি আর কেউ নয়; রাসেলের বোন রিদি। সে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভূমির দিকে। বেশ জোরে জোরেই বলে,’এটাই তবে সেই ছেলে? যার জন্য আমার ভাইকে ঠকিয়েছ?’

রিদির কথার টোনে বাকিরাও এদিকে তাকায়। সবাই সবার স্থান ছেড়ে এগিয়ে আসে। ভূমি কিছু বুঝতে না পেরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিদি বলে,’তোমায় আমি অনেক ভালো একটা মেয়ে ভাবতাম। কিন্তু তুমি এত জঘন্য আর খারাপ তা জানতাম না। আমার ভাই ঠিকই বলেছিল। তুমি আসলেই একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে।’
ভূমির মাথায় যেন বজ্রপাত হচ্ছিল। রাসেল তার নামে এসব বলেছে বাড়িতে? ভূমি খারাপ? চরিত্রহীন? নিজের সকল দোষ সে ভূমির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে?

রিদির এসব কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় আদিলের। এমনিতে সে খুব শান্তস্বভাবের ছেলে। কিন্তু কাছের মানুষকে নিয়ে কেউ কোনো খারাপ মন্তব্য করলে সে একদম সহ্য করতে পারে না। যেমন, এখন তার রিদির কথাগুলোও সহ্য হয়নি। সে ধমকেরসুরে বলে,’মুখ সামলে কথা বলবেন। কে আপনি? এসব কথা বলার সাহস কোথায় পেয়েছেন?’
রিদি ব্যাঙ্গ করে হেসে বলে,’আমি কে তা না হয় আপনার গার্লফ্রেন্ডকেই জিজ্ঞেস করে নেবেন। তবে একটা ছোট্ট এডভাইস দিচ্ছি, এসব চরিত্রহীন মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। নয়তো আপনার জীবনটাও নষ্ট করে দেবে। যেভাবে আমার ভাইয়ের জীবনটা নষ্ট করেছে।’
‘আপনাকে আমি বলেছি মুখ সামলে কথা বলতে। আপনি না জেনেশুনে এতগুলো কথা কেন বললেন? আর একবার যদি আপনি কোনো বাজে কথা বলেন, তাহলে আপনি যে একটা মেয়ে আমি সেটা ভুলে যাব।’ আগের চেয়েও দ্বিগুণ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বলল আদিল। রিদিও রেগে বলে,’কী করবেন আপনি? গায়ে হাত তুলবেন?’
‘প্রয়োজনে তাই করব। আমার তো এখনই ইচ্ছে করছে আপনার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।’

ভূমির চোখে অশ্রু টলমল করছিল। রাসেলের প্রতি ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠছিল বারবার। সে কাঁদে না। আদিলকে শান্ত হতে বলে। শোহেব এসে আদিলকে একপাশে সরিয়ে নেয়। ভূমি রিদিকে বলে,’আমি জানি না, তোমার ভাই তোমাদেরকে কী বলেছে। তবে এতটুকু বলছি শোনো, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার না তোমার আছে; আর না তোমার বাপ-ভাইয়ের। আমার সঙ্গে তোমার ভাই যা করেছে তা আমি মেনে নিয়েছি। আমায় চরিত্রহীন তকমা লাগাতে আসলে তোমার গোষ্ঠীসহ আমি ধ্বংস করে দেবো। চুপ ছিলাম, চুপ আছি তার মানে এই নয় যে কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার। আমি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতাম। চাইলে এখনো অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু করব না। কারণ কি জানো? আমার আত্মসম্মান এত নগণ্য নয় যে, নিজেকে প্রমাণ করতে ক্ষমতা জাহির করতে যাব। তোমাকে আমি নিজের বোনের মতোই ভালোবাসতাম। এখনো বাসি, তাই এতগুলো কথা আমায় বলার পরেও তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি। আর যাকে জড়িয়ে তুমি আমায় এতগুলো কথা বললে সে আমার ছোটো ভাইয়ের মতো। সূচনার হবু হাজবেন্ড। আশা করছি, এরপরের বার কাউকে কিছু বলার আগে শোনা কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করে নেবে।’

ভূমির কথা শেষ হলে সে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। আকস্মিক এই ঘটনার জন্য সকলের ফুরফুরে মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে যায়। সেই সঙ্গে রাসেলের প্রতি সকলের চাপা ক্রোধ আরো বেড়ে ওঠে। একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এমন হীন কাজ করতে পারে?

সূচনা মনমরা হয়ে বসে আছে আদিলের পাশে। সে বোনের চোখে শুধু ঘৃণাই নয় বরং কষ্টও দেখেছে। যে মানুষটাকে তার বোন সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে সে-ই কিনা তার পরিবারের কাছে ভূমিকে চরিত্রহীনা বানিয়েছে! ভূমির অন্তর্ভেদী কষ্টটা আর কেউ টের না পেলেও সূচনা খুব ভালো করেই টের পেয়েছে। ঘৃণায়, ক্রোধে ইচ্ছে করছে রাসেলকে নিজের হাতে খুন করে ফেলতে। ওমন অ*মানুষের সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না।

আদিল রেগে চুপচাপ বসে আছে। তার রাগ এখনো কমেনি। ভূমিকে নিয়ে এতগুলো খারাপ কথা সে হজম করতে পারছে না। অন্যদিকে সবার মতো তারও সব রাগ গিয়ে পড়ছে রাসেলের ওপর। রাসেলকে কুটিকুটি করে কেটে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। সূচনা এবং আদিল দুজনের অন্যমনস্কতার দরুণ কেউই কারও দিকে খেয়াল রাখেনি। যার ফলে অসাবধানতাবশত সূচনার শাড়ির আঁচল রিকশার চাকার সাথে পেঁচিয়ে যায়। এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই সূচনা রিকশা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সে। রিকশাওয়ালা রিকশা থামায়। আদিলসহ সকলে দৌঁড়ে যায় সূচনার কাছে। সূচনার রক্তাক্ত শরীর বুকে জড়িয়ে নেয় আদিল। আরো বেশি ব্যথা অনুভব করে সূচনা। তার শাড়ির আঁচলটি এখনো রিকশার চাকার সাথে পেঁচানো। ব্লাউজসহ আঁচল অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। শোহেব কোনো রকমভাবে শাড়ির আঁচলটুকু ছিঁড়ে ফেলে। একটা সিএনজি নিয়ে সূচনাকে আদিল, ভূমি আর শোহেব দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে আসে। বাকিরা আসে রিকশাতে করেই।

রাসেলের কষ্ট ভু্লে গিয়ে ভূমি এখন সূচনার জন্য কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ে। শোহেব বারবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। বাকিরাও এসে হাসপাতালে উপস্থিত হয়। সকলের চোখেমুখে ভীতি। কী থেকে কী হয়ে গেল। আজকের দিনটা সবচেয়ে সুন্দর দিন হওয়ার কথা ছিল। আর আজকেই কিনা! যতক্ষণ না কোনো আপডেট পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ কেউ কোনো শান্তি পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানায় হাত-পা কিছু ভাঙেনি। তবে মাথায়, কোমরে, হাতে-পায়ে কেটে,ছুলে গেছে। অনেকখানি ক্ষত হয়েছে। মাথায় কেটে যাওয়ার কারণে সূচনার চুল ফেলে দিতে হয়েছে।

ভূমি কান্নারত কণ্ঠে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ওর কিছু হবে না তো? সুস্থ হয়ে যাবে তো ও?’
‘হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে।’
ডাক্তার চলে যাওয়ার পরও ভূমি কাঁদতে থাকে। মানতে পারছে না এসব। সূচনা বিপদমুক্ত জানার পরে ফাতেমা বাড়িতে ওর বাবা-মাকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলে। তবে কী হয়েছে সেসব ফোনে বলে না আগেই।

সূচনার ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। চোখ আর ঠোঁটের কাছে খানিকটা ক্ষত। ফুলে কালচে হয়ে আছে। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের পলকেই আজকের দিনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা ঘটে গেল। এক মুহূর্তেই সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল। বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন। আদিল অপরাধীর মতো করে সামনে যায়। কান্না করে তার চোখমুখ ফুলে আছে। সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় সূচনার কাছে। চোখের কোণে এখনো পানি টলমল করছে। সে সূচনার হাত ধরে কান্না করে মাফ চেয়ে বলে,’আমারই ভুল ছিল। তোমায় শাড়ি পরার জন্য জোর করা আমার উচিত হয়নি। আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা। আমি কথা দিয়েও তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সূচনা। তোমাকে এভাবে আমি দেখতে চাইনি। আমায় তুমি ছেড়ে যাবে না তো? ক্ষমা করে দেবে বলো?’

আদিলকে এভাবে দেখে সূচনার ভীষণ মায়া হয়। ইচ্ছে করে ঐ কান্নারত মুখটা একটু আদুরে হাতে ছুঁয়ে দিতে। তবে সে পারছে না হাত উঠানোর সামর্থ্য নেই এখন তার। আদিল কাঁদতে কাঁদতে সূচনার কাঁধের দিকে ঝুঁকে যায়। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে সূচনা। আদিল মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় সূচনার চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়ছে। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? ব্যথা লাগছে?’

সূচনা কোনো রেসপন্স না করে এক পলকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে আদিলের কপালে তার ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা উষ্ণ ছোঁয়া ছুঁইয়ে দেয়। আদিল খুশিতে, বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here