বিরহের নাম তুমি পর্ব-৩২

0
360

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
৮৩.
শরীর ভালো নেই সুমির। সারা রাত জেগে পড়ার পর সকালে আর ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু তার ইচ্ছা, অনিচ্ছায় কিছুই যায় আসে না। বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছিল তো পড়াশোনার জন্যই। বেশ তো কাটছিল তার সময়টা। পড়াশোনা, পার্টটাইম জব, ছুটির দিনে রিয়ার সাথে আমেরিকা শহর ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার দীর্ঘদিনের রুটিন। সুমি দেখতে সুন্দরী। উচা-লম্বা, সুন্দর গায়ের গড়ন, ফরসা। শুধু বাংলাদেশ কেন, এদেশের মাটিতেও সে কম প্রপোজাল পায়নি। তবে বরাবরই সে এসব এড়িয়ে গেছে। তার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল পড়াশোনা। আর সে-ই সুমি কিনা শেষমেশ এমন একজনের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে, এমন একজনকে ভালোবেসেছে যে বিবাহিত ছিল! এ কথাটা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। এমনটা কি সত্যিই তার সঙ্গে হওয়া দরকার ছিল? কী হতো যদি সেদিন স্নোফলস্ না হতো? কী হতো যদি সেদিন রাসেলের সাথে দেখা না হতো? উত্তর, তাহলে সে ভালোবাসা নামক অনুভূতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারত। তার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ওয়েটারের ড্রেস পাল্টে এসে কর্ণারের একটা চেয়ারে বসে অতীত ঘাটছিল সুমি। ভাগ্যিস রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে তার বন্ধুত্বসুলভ একটা সম্পর্ক ছিল! নতুবা এই অসময়ে সে জব কোথায় খুঁজে পেত? ভুলটা তারই ছিল! এত অল্প সময়ে রাসেলকে এতটা বিশ্বাস করা তার উচিত হয়নি।

‘হেই সুমি! যাওনি এখনও? চলো তোমাকে ড্রপ করে দেই।’ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের নাম চার্লস। সুমিকে একা বসে থাকতে দেখেই প্রস্তাবটা দিলো সে। সুমি স্মিত হেসে বলল,’আমার একটু শপিংমলে যেতে হবে। তুমি যাও।’
‘তুমি চাইলে আমিও তোমার সাথে যেতে পারি। যেহেতু রাত হয়ে গেছে!’
‘সমস্যা নেই চার্লস। আমি একাই যেতে পারব।’
‘শিওর?’
‘ড্যাম শিওর।’ হেসে বলল সুমি।
‘দ্যান ওকে।’ বলে চার্লস রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। এক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এসে বলে,’একটা হেল্প করবে?’
‘কী?’
‘আমার গার্লফ্রেন্ড ক্যাটির কথা তো জানোই। ওর একটা ড্রেস পছন্দ হয়েছে। কাজের এত চাপ যে আমি শপিংমলে যেতেই পারছি না। তো তুমি যখন যাচ্ছই, তখন…’
চাকরীটা ফিরে পেতে চার্লস সাহায্য করেছে বলে সুমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তাই কৃতজ্ঞতার স্বরূপ দ্রুত বলল,’হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তুমি হোয়াটসএপে ড্রেসের ছবিটা পাঠিয়ে দাও।’
‘থ্যাঙ্কিউ সো মাচ সুমি।’
‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’
ড্রেসের টাকাটা সুমির কাছে দিয়ে চার্লস চলে যায়। সুমি বসে থাকে আরও কিছুক্ষণ। সে আসলে একা থাকতে চায়, যার দরুণ চার্লসকে মিথ্যা করে বলেছিল শপিংমলে যাবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে সত্যিই যেতে হবে। তবে এই মুহূর্তে শরীর ভীষণ ক্লান্ত। এনার্জি নেই একদম। কালকে রিয়াকে দিয়ে আনিয়ে নেবে বলে ঠিক করে। চার্লসকে একটা কিছু বুঝিয়ে দু’দিন পর দিলেও সমস্যা নেই।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে সুমি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রাসেলকে দেখতে পায়। চেহারার অবস্থা যাচ্ছে তাই! দেখে মায়া লাগে তার। পরক্ষণেই মনে পড়ে রাসেল তাকে মিথ্যে বলে ঠকিয়েছে। সাথে সাথে মন বিতৃষ্ণায় ছেঁয়ে যায়। দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চাইলে রাসেল পথ আটকে দাঁড়ায়। আকুতিভরা কণ্ঠে বলে,’সুমি প্লিজ! আমার কথাটা শোনো।’
‘রাস্তা ছাড়ো।’ গম্ভীরকণ্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সুমি।
‘আমার কথা তো শুনবে তুমি!’
‘কী কথা শুনব তোমার? আর কী শোনানোর বাকি আছে? নাটক করে মন ভরেনি?’
‘আমি মানছি তো আমার ভুল আছে। তোমাকে জানানো উচিত ছিল আমার।’
‘তাহলে জানাওনি কেন? ওহহো! তুমি বিবাহিত জানলে আমি তো আর তোমায় ভালোবাসতাম না। তোমার সাথে সম্পর্কেও জড়াতাম না। এজন্যই জানাওনি তাই না?’
অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলে রাসেল। তার মুখাবয়বই বলে দিচ্ছে সুমির কথাগুলো সত্য।

সুমি এবার বিরক্ত হয়ে বলল,’তুমি পথ ছাড়বে নাকি আমি পুলিশকে ডাকব?’
‘তুমি এমন কেন করছ?’
‘রাসেল আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। যেতে দাও আমায়। তোমাকে আমি একদম সহ্য করতে পারছি না।’
‘প্লিজ মাফ করে দাও! একটা সুযোগ দাও আমায়।’
সুমি কটমট করে তাকায়। রাসেলকে বলার মতো ভাষা নেই তার। বেশি কিছু বলতে গেলে সিনক্রিয়েট হয়ে যাবে। অবুঝের মতো এ কাজটা সুমি করবে না। তাই সে জোরে রাসেলের বুকে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সময় বিলম্ব না করে ট্রামে উঠে পড়ে।
__________
৮৪.
সূচনা, আদিলের পাশে মানুষজন গিজগিজ করছে। এদের বেশিরভাগই আদিলের বন্ধু-বান্ধব। বড়ো, লম্বা একটা টেবিল দখল করে ওরা বসেছে। কয়েকটা চেয়ার খালি রয়েছে। অর্থাৎ মানুষজন আসা আরও বাকি আছে। সূচনার নার্ভাস লাগছিল ভীষণ। এই আয়োজন, আড্ডা তাকে ঘিরেই। সূতরাং উপস্থিত সকলের দৃষ্টিও তার ওপরেই রয়েছে। শুরুতেই আদিলের সব বন্ধু-বান্ধবরা একদফা সূচনার তারিফ করেছে। কেন জানিনা সূচনা কয়েজন মেয়ে বান্ধবীদের চোখে তার জন্য ঈর্ষাও দেখেছে। কেন? সে বোবা বলে? এজন্য সে আদিলের যোগ্য নয়? সূচনা তবুও হাসার চেষ্টা করছে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। ওর বামপাশে বসেছে আদিল। সে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মশগুল। ডানপাশে বসেছে সুখী, তারপর সাথী, তারপর ফাতেমা। সুখী সাথীর সাথে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। ওদেরও এদিকে খুব একটা নজর নেই। ফাতেমা খালামনি ফোন চাপছে। খুব সম্ভবত তিনি ভূমিকার লেখা কোনো গল্প পড়ছেন। সময়, সুযোগ পেলেই তিনি ফোন নিয়ে বসে পড়েন ভূমিকার গল্প পড়ার জন্য। এ সময়টা সে রাতেই পায় শুধু। সারাদিন তো অফিসই থাকে। আর এখানে যেহেতু যে যার মতো রয়েছে, তাই গল্প পড়ার জন্য তার সুযোগও যথেষ্ট। সূচনার মুখোমুখি বসে রয়েছে আদিলের বন্ধু-বান্ধব। ছেলে-মেয়ে সকলেই। কারও চোখের দিকেই সূচনা তাকাতে পারছিল না। অস্থিরতায় দম আটকে আসছিল তার।

সে আর বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ায়। এবার কথা বলতে ব্যস্ত থাকাও সব বন্ধুদের নজর আসে সূচনার দিকে। আসলাম জিজ্ঞেস করে,’কোনো সমস্যা ভাবি?’
সূচনা হাসার চেষ্টা করে দু’দিকে মাথা নাড়াল। তারপর ফাতেমাকে ইশারায় কিছু বলল। এই ইশারা ফাতেমা, সুখী আর সাথী ছাড়া কেউ বোঝেনি। তার খারাপ লাগছিল বুঝতে পেরে ফাতেমা বলল,’আমি ওকে নিয়ে একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি। তোমরা সবাই আড্ডা দাও।’
সূচনা ফাতেমার সাথে সে স্থান ত্যাগ করতেই আদিল আড়চোখে একবার তাকায়। সূচনার চেয়ারে বসে খুব আস্তে করে সুখীকে জিজ্ঞেস করে,’ওর কী হয়েছে?’
সুখীও সাবধানী কণ্ঠে বলল,’এত মানুষের সামনে আপু নার্ভাস ফিল করছে। তাই খালামনিকে নিয়ে অন্যদিকে গেল।’
আদিল আর কিছু বলল না। সেও উঠে গেল, যেদিকটায় সূচনা আর ফাতেমা গেছে।

বিশেষ কোনো দিন না থাকায় রেস্টুরেন্টে আজ তেমন মানুষজন নেই ওরা ছাড়া। দূরের একেক টেবিলে কিছু টিনেজ বয়সের ছেলে-মেয়ে রয়েছে। খুব সম্ভবত ওরা বন্ধু হবে। কয়েকটা টেবিলে আবার কপোত-কপোতি। অর্থাৎ এদিকটায় সূচনাদের দিকে খেয়াল করার কেউ নেই। তার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে। ফাতেমা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,’কী পাগলি মেয়ে রে তুই! এটুকুতে বুঝি কান্না করা লাগে?’
সূচনা ইশারায় বলল,’আমার মনে হয় এই বিয়েতে রাজি হওয়া একদম উচিত হয়নি। আদিলের বন্ধু-বান্ধবরা বোধ হয় ভালো চোখে দেখছে না।’
‘এবার কিন্তু মার খাবি রে তুই। ওরা ভালো চোখে দেখলেই কি আর খারাপ চোখে দেখলেই কি? বলেছি না, এত অন্যদের কথা ভাবতে হবে না?’
এই সময়ে আদিলও এখানে এসে উপস্থিত হয়। জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
আদিলের উপস্থিতিতে সূচনা হকচকিয়ে ওঠে। অন্যদিক ঘুরে কান্না দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। এবার আদিল একই প্রশ্ন খালামনির উদ্দেশ্যে করে। ফাতেমা সূচনার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল,’ও কিছু না! এত মানুষ তো এখানে। তাই একটু নার্ভাস আরকি।’
উলটোপাশ ঘুরে দাঁড়ানো সূচনার দিকে তাকায় আদিল। লম্বা শ্বাস নিয়ে খালামনিকে বলে,’আমি ওর কথা কিছু বুঝিনি। তবে আপনার শেষ কথাটা শুনে যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আপনি যান খালামনি, আমি ওকে নিয়ে আসছি।’

খালামনি বিনাবাক্য ব্যয়ে সেখান থেকে চলে যেতেই আদিল ডাকে,’সূচনা।’
সূচনা তাকায় না। সে পূণরায় ডাকে,’সূচনা! এদিকে তাকাও।’
এবারও মেয়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আদিল নিজেই সূচনার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। মাথা নত করে রেখেছে সূচনা। দু’হাতের আজলায় সূচনার স্নিগ্ধ, সুন্দর মুখটি সে তুলে নেয়। সূচনা তবুও দৃষ্টি নত করে রাখে। আদিল আবেশ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’তাকাবে না?’
আর না তাকিয়ে উপায় ছিল না সূচনার। সে টলমলে দৃষ্টি মেলে তাকায় আদিলের মুখের দিকে। মানুষটা কী সুন্দর! কী সুন্দর গভীর তার চোখের ভাষা। এই প্রথম সে সামনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় কোনো পুরুষের চোখে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছে। তাকিয়ে থাকতে পারে না সূচনা। দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা বড্ড কঠিন।

আদিল কিছু বলল না। শুধু শক্ত করে সূচনাকে জরিয়ে ধরে। কয়েক মিনিট সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বলে,’কারও কিছু বলা না বলায় আমার কিছুই যায় আসে না। আমি শুধু জানি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি শুধু জানি, পৃথিবীর বুকে আমিও একজন ভাগ্যবান স্বামী হব। প্লিজ! তুমি নিজেকে কখনো ছোটো মনে করো না। তুমি আমার রানী। আমার ভালোবাসা।’
এক দলা খুশি সূচনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। সেই সাথে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা পানি। আদিল শক্ত করে ওর হাতটা ধরে সবাই যেখানে আছে, সেখানে চলে যায়। চেয়ারে বসার পরও হাত ছাড়ে না। যেভাবে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, সেভাবেই ধরে রেখেছে এখনও। সত্যি বলতে এখন আর কারও বাঁকা দৃষ্টি সূচনা তোয়াক্কা করছে না। এমন হচ্ছে কেন? মানুষটার ভরসার হাতখানা সূচনার হাত ধরে রেখেছে বলে? সে আড়চোখে তাকায় একবার আদিলের দিকে। মনে মনে ভাবে, জয়ের মতো করে এই মানুষটিকে কি সে কখনো ভালোবাসতে পারবে?

মিনিট দশেক পরে শোহেব, ভূমিকা আর শিশির এসে পৌঁছায় রেস্টুরেন্টে। আসলাম শিশিরের পিঠে জোরে চাপড় দিয়ে বলে,’কীরে শালা! আসতে এতক্ষণ লাগে?’
‘আরে বলিস না আর! জ্যামে পড়েছিলাম।’
শোহেব আর ভূমিকা চেয়ার টেনে পাশাপাশি বসে। শিশির বসে আসলামের পাশে। শোহেব খাবারের মেনু কার্ড নেড়েচেড়ে বলে,’সবাই শুধু কফি নিয়ে বসে আছো কেন? এখনও খাবার অর্ডার করোনি।’
‘আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ বলল আদিল।
‘আর বলিস না রে ভাই! মেয়ে মানুষের তো সাজগোজই শেষ হয় না। দুই ঘণ্টা তো মনে হয় কার যেন বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।’ কথাটা শোহেব ভূমিকে পিঞ্চ মেরেই বলল। ভূমি রাগে গমগম করে বলে উঠল,’একদম ফালতু কথা বলবেন না। আদিল জানে, আমি সাজগোজ কেমন করি আর নাকি করি না।’
দুজনকে থামিয়ে শিশির বলল,’ভাইয়া, আপু থামো প্লিজ!’
‘হু, হু তোর আপুকে বল মেয়ে মানুষের এত ঝাঝ ভালো নয়।’
‘মেয়ে মানুষ আর ছেলে মানুষ কী? মানুষ তো মানুষই। আমি না এখানে কারও সাথে ঝগড়া করতে আসিনি, নয়তো ঠিকই এ কথার উত্তরটা সুদে-আসলে বুঝিয়ে দিতাম।’
‘ওহ হ্যাঁ! হায় হায়, আমি তো ভুলেই গেছিলাম আপনি একজন লেখিকা। এমা! আমার তো বুঝে-শুনে কথা বলা উচিত ছিল।’
শোহেবের কথার ধরণে বাকিরা আর না হেসে পারল না। ভূমিকা, ‘বিরক্তিকর!’ বলে চুপ করে রইল।
আদিল বলল,’আচ্ছা হয়েছে। এখন সবাই থাম। আর আপু, আপনি কিছু মনে করবেন না,প্লিজ! শোহেব ভাইয়াটা এমনই। খুব রসিক।’
‘হু! রস একদম বেয়ে বেয়ে পড়তেছে।’ বিড়বিড় করে বলল ভূমি। শোহেবও মুখটা ভূমির কানের দিকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে ওর মতো করেই বিড়বিড় করে বলল,’খাবেন নাকি?’
ভূমি কটমট করে তাকাতেই শোহেব দাম্ভিকতার হাসি হাসে। ভূমিকে ক্ষেপিয়ে সে বেশ মজা পাচ্ছে।

সূচনার ধরে রাখা হাতের ওপর আঙুল দিয়ে স্লাইড করে আদিল। সূচনা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও আদিল ছাড়ে না। সকলের দৃষ্টির অগোচরে কী ফাইজলামি শুরু করেছে! ভারী বদ তো এই ছেলে। সূচনার মুখভঙ্গি দেখে আদিল মিটমিট করে হাসে।
ভূমিকার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,’আপনার কাজিনের না আসার কথা আপু? এখনও তো আসলো না।’
‘দাঁড়াও ফোন দিয়ে দেখছি।’ বলল ভূমি। ফোন দিয়ে কথা বলার পর আদিলকে জানালো,’এসে পড়েছে। নিচে আছে।’
দু’মিনিটের মাথায় জারিফ প্রীতিকে নিয়ে ওপরে আসে। জারিফ এখনও পা বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে হাঁটে। খুব শীঘ্রই যাবে বাইরের দেশে চিকিৎসার জন্য। দুজনে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসার পরে ভূমি সকলের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়। জারিফ সরাসরি একবার তাকায় সূচনার দিকে। অনেক অনেক দিন পরে আজ সূচনার সাথে তার দেখা হয়েছে। শেষ দেখা হয়েছিল কবে? হাসপাতালে? ঠিক মনে পড়ছে না। তবে সূচনাকে হাসতে দেখে তার ভালো লাগছে। সে সূচনাকে জিজ্ঞেস করে,’ভালো আছিস?’
সূচনা হেসে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। এবার যে যার পছন্দমতো খাবার অর্ডার দিয়ে গল্পগুজব করে একসাথে। আদিল জারিফকে জিজ্ঞেস করে,’ভাইয়া বিয়ে করছেন কবে?’
জারিফ প্রীতির দিকে একবার তাকিয়ে বলে,’ম্যামের দয়া হয় তো এখনই করে ফেলি।’
প্রীতি জারিফের বাহুতে কিল দিয়ে বলে,’মিথ্যুক! আমি তো বলিই। তুমিই তো শোনো না।’
ওদের খুনসুটিতে উপস্থিত সকলে হাসে। জারিফ এবার সিরিয়াস হয়ে বলে,’দেখি। খুব শীঘ্রই এবার বিয়েটা করে ফেলব। আপাতত ঘরোয়াভাবেই করব। এরপর অপারেশন করে ফিরে এসে অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে আছে।’
কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে শিশির বলল,’ভাই ঘরোয়াভাবে করেন সমস্যা নাই। কিন্তু আমাদের মতো অভাগাদের ট্রিট দেওয়া থেকে বঞ্চিত কইরেন না।’
এবার সকলে সমস্বরে হেসে ফেলে। জারিফ হেসে বলে,’নিশ্চয়ই।’
‘আচ্ছা খাবার আসতে আসতে আসলাম আর শিশির একটা গান শোনা আমাদের।’ বলল আদিল। তখন সাথী বলে উঠল,’সাথে ভূমি আপুও প্লিজ! ঐদিন লাইভে আপুর গান শুনেছিলাম। সরাসরি কখনো শুনিনি। খুব ইচ্ছে শোনার।’
ভূমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,’না, না! ঐদিন এমনিতেই একটু গেয়েছিলাম। আমি তো তখন জানতামই না আদিল যে লাইভ করেছে।’
‘এই হলো মেয়ে মানুষের এক সমস্যা! কিছু একটা পারলে, এমন ভাব ধরবে বাবারে বাবা! না,না পারি না। বলব না। শরম করে আরও কত কী! মানে হাজারবার হাত-পা ধরে তোষামোদ করবে তারপর মহারাণীরা আপোষ মানবে।’ কথাগুলো বলল শোহেব। ভূমি রেগেমেগে বলল,’ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না?’
‘ঝগড়া করতে যাব কেন বেহুদা? আমি মেয়ে নাকি? অযথা ঝগড়া করা মেয়েদের স্বভাব। আমি শুধু সত্যিটা বলেছি।’
‘নিকুচি করেছি আপনার সত্যের।’

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের কথোপকথনের জন্য তারা সকলের দৃষ্টিতে পড়ে যায়। সূচনার পরিচিতরা ছাড়া বাকি সবাই শোহেবকে আগে থেকেই চেনে। তার সম্পর্কেও সবাই অবগত। কিন্তু কোনো মেয়ের সাথে তো এমন করতে দেখেনি কেউ। আদিল উপায়হীন হয়ে বলল,’আমি সূচনাকে একটা গান ডেডিকেটেড করতে চাই।’
ঝগড়া থেমে পরিস্থিতি একদম শান্ত হয়ে গেল। বন্ধুরা সব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। আদিলও মোটামুটি বেশ ভালোই গান করে। তবে তার গান কালেভাদ্রে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল বন্ধুদের। নতুবা জোর করে কখনোই তাকে দিয়ে গান গাওয়ানো যায়নি। আর আজ সে কিনা এতগুলো মানুষের সামনে গান গাইবে, তাও সূচনার জন্য? অবশ্য ভালোবাসলে মানুষ কী-ই না করে! এ তো শুধুমাত্র গান। সকলে একসঙ্গে বলে উঠল,’শুরু কর দোস্ত।’

সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে আদিলের গান শোনার জন্য। সূচনা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নত করে বসে রয়েছে। আদিল সূচনার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে গান শুরু করে,

‘এ জীবনে যারে চেয়েছি,
আজ আমি তারে পেয়েছি,
তুমি আমার, সেই তুমি আমার;
তোমারে খুঁজে পেয়েছি।’
_________
৮৫.
ঠান্ডা আবহাওয়ায় কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে রয়েছে সুমি। রাত থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। তিরতির করে বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। রিয়া কি জানালা বন্ধ করেনি? আজ এত ঠান্ডাই বা কেন লাগছে? ঘুম ঘুম ভাবটা পুরোপুরি কাটতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। রাসেলের কথা মনে পড়ে। বেপরোয়া হয়ে পড়ে সে। মন চায় ছুটে যেতে। কিন্তু না! সে যাবে না। উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকাতেই সে থমকে যায়। স্নোফলস্ হচ্ছে। তাও এই অসময়ে? সে দৌঁড়ে যায় জানালার কাছে। হ্যাঁ, সত্যিই তো।

মন ভালো হওয়ার সাথে সাথে রাসেলের সাথে দেখা হওয়ার দিনটির কথা মনে পড়ে যায়। একরাশ মন খারাপ আবার এসে ভর করে তার মনে। সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আবার বিছানায় ফিরে আসে। রিয়া সুমিকে বলে,’রাসেল এসেছে।’
সুমি লাফিয়ে ওঠে অজান্তেই। জিজ্ঞেস করল,’কোথায়?’
‘নিচেই। ম্যাসেজ করেছে আমায়। তোর ফোন নাকি বন্ধ?’
‘হুম।’
‘তোকে যেতে বলল।’
‘যাব না।’
‘সুমি।’
‘হু?’
‘ভালোবাসিস?’
‘জানিনা।’ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বলল সুমি।
‘জানিস তুই।’
‘কী করব আমি?’
‘তোর মন যেটায় সায় দেয়।’

সুমি বসে থাকে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে। তারপর আলমারির কেবিনেট থেকে কফি রঙের কোট’টি পরে সে দৌঁড়ে নিচে নামে। দেখতে পায় ভারী তুষারপাতের মাঝেও রাসেল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছুটে যায় সুমি। ঝাপিয়ে পড়ে রাসেলের বুকে। জাপটে ধরে বলে,’তুমি খুব খারাপ রাসেল খুব খারাপ! আমি তোমায় ছাড়া কেন থাকতে পারছি না? কেন আমার দম আটকে আসে বলতে পারো? কেন আমি তোমায় এত ভালোবাসি? তুমি কি যাদুকর?’
রাসেল কিছু বলল না। ক্রন্দনরত সুমিকে সে শুধু শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,আর কোনো ভুল সে করবে না। যে কঠিন মিথ্যেটা সে ভূমির নামে বলেছে, সেটা কিছুতেই কখনো সুমির সামনে আসতে দেবে না। শুধু ভালোবেসে আগলে রাখবে নিজের সাথে। নিজের মাঝে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here