বিরহের নাম তুমি পর্ব-৩১

0
439

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________
৮০.
রাতের অন্ধকার ঠিক একটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি। রাসেল দাঁড়িয়ে আছে সুমির বাড়ির সামনে। এই পর্যন্ত কতগুলো ফোন করেছে তার হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সুমি ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। এই অবহেলাটুকু রাসেল সহ্য করতে পারছে না। উপায় না পেয়ে সে সুমির বান্ধবী রিয়াকে ফোন করে। তিনবার রিং হওয়ার পর রিয়া ফোন রিসিভ করে বলে,’জি ভাইয়া, বলেন।’
‘তুমি কি ব্যস্ত?’
‘একটু। কাজে আছি তো। সমস্যা নেই, আপনি বলেন।’
‘বলবনে পরে। তুমি তাহলে কাজ করো।’
‘সিরিয়াস কিছু?’
‘সেরকমই। আর শোনো, বাড়িতে এসে একটু ফোন দিও তো। সুমি ফোন বন্ধ করে রেখেছে।’
‘আচ্ছা।’ বলে রিয়া ফোন রেখে দিলো।

আরও ঘণ্টাখানেক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রাসেল নিজের বাসায় চলে আসে। দরজা খুলতেই যেন গরম হাওয়া ভেসে আসলো। চারদিক নিরব, নিস্তব্ধ। এমনটা নয় যে, সে আগে একা থাকেনি। ভূমি আসার আগেও সে এই বাড়িতে একাই ছিল। কিন্তু ভূমি আসার পরে বাড়িটাতে প্রাণস্পন্দন ছিল। বাড়িতে ফিরলে বাড়িটা ফাঁকা লাগত না। অনেকদিনের অভ্যেস হয়ে গেছিল বলে, এখনও সেই অভ্যাসটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার মধ্যে সুমির অবহেলা। সবকিছুই এখন তার বিষাদময় লাগছে, অসহ্য লাগছে। রাতে ঘুমও ভালো হলো না। চোখগুলো ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। রাতে আজেবাজে স্বপ্নও দেখেছে অনেক। সকাল হতেই সে সুমির বাড়ির সামনে চলে যায়। ফোন এখনও বন্ধ। রিয়াকে ফোন করতে যাবে, তখন রিয়া নিজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাসেল অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’সুমি কি বাসায়?’

রিয়া গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। বিরসমুখে বলল,’না। আগের জবটা নিয়েছে।’
‘জব নিয়েছে? ওর না আজ পরীক্ষা?’
‘হ্যাঁ। পরীক্ষার পর কাজে যাবে।’
‘ওর সাথে একটু কথা বলিয়ে দেবে প্লিজ?’
‘কেন বলুন তো? কেন চাচ্ছেন ওর সাথে কথা বলতে? এরকম একটা নাটক করার আগে এসব মনে ছিল না?’
রাসেল অপরাধীর মতো করে বলল,’আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই সুমিকে অনেক ভালোবাসি।’
‘আমার বিশ্বাস করা না করায় কী আসে যায় বলুন তো? সুমি সাফ সাফ আমায় বলে দিয়েছে, ও আর ব্যাক করবে না। আর আমাকেও বলে দিয়েছে আপনার সাথে যেন কোনো রকম যোগাযোগ না করি।’
রাসেলকে আর কিছু বলতে না দিয়েই রিয়া চলে গেল নিজের কাজে। কতক্ষণ সেখানেই রাসেল অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার অনুভূতিটা যে কী রকম তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এলোমেলো অবস্থাতেই সে অফিসের উদ্দশ্যে রওনা হয়।
______
৮১.
‘সূচনার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে শুনেছিস?’ রাতে খেতে বসে কথাটা তুললেন চাচা। জারিফ তখন ভাতের লোকমা মুখে তুলছিল। বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে জবাব দিলো,’না তো!’
‘গতকাল হয়েছে। আমায় ফোন দিয়েছিল। ব্যস্ত ছিলাম, তাই যেতে পারিনি।’
‘ছেলে কে? চেনো তুমি?’
‘না। সূচনার বান্ধবীর ভাই হয় শুনলাম। ছেলে ভালো। বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। এখন প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো বেতনের একটা চাকরী করছে। দেখতে, শুনতেও নাকি মাশ-আল্লাহ্।’
এবার খেতে খেতে তাচ্ছিল্যরসুরে চাচি বললেন,’ভালোই তো দেখি টোপ ফেলেছে! বান্ধবীর ভাইকে পটিয়ে নিল।’
এ কথা শুনে চাচা গম্ভীরকণ্ঠে বললেন,’না জেনে আজেবাজে কথা বলবে না। সূচনা কেমন চেনো না তুমি? ও তো বিয়েতে রাজিই হচ্ছিল না।’
‘ছেলেই কি ওকে দেখে পছন্দ করেছে?’ জিজ্ঞেস করল জারিফ। উত্তরে চাচা বললেন,’হ্যাঁ। পছন্দ করেছে আর কি, ছেলে তো সূচনা বলতে অজ্ঞান।’
জারিফ চুপ করে থাকে। এ কথার প্রত্যুত্তরে তার কিছু বলার নেই। তবে কথা বললেন চাচি। তিনি বললেন,’এক মেয়ের অঘটন ঘটিয়ে শান্তি হয়নি। এখন আরেক মেয়ের অঘটন ঘটাবে বলে বিয়ে দিচ্ছে। আরে শুধু পরীর মতো সুন্দর হলেই হবে? যেই ছেলে বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, ভালো বেতনের চাকরী করে ওদের অবস্থা কি আর যেনতেন? দেখবে দু’দিন পর ওর কপালেও একই শনি আছে।’

‘আশ্চর্য মা! তোমার মন-মানসিকতা এত নিচু কেন? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল। দোয়া করার কথা ছিল। তা না করে উলটা-পালটা কথা বলছ! আর শোনো, সবাই এক না। কার ভাগ্যে কী আছে তা তো আমরা জানিনা। এজন্য সবাইকে এক ভাবব? পারলে মাইন্ডটাকে একটু ফ্রেশ করো।’ কথাগুলো বলেই খাবার রেখে উঠে যায় জারিফ। পেছন থেকে চাচি চেঁচিয়ে বলেন,’ঐ মেয়েকে কিছু বললেই তোমাদের বাপ-ছেলের এত লেগে যায় কেন বুঝলাম না। আমি তো ভুল কিছু বলিনি।’
‘তুমি কথা বলোই গায়ে লাগার মতো।’ বললেন চাচা। চাচি মুখ ঝামটা মেরে বসে রইলেন। চাচারও আর খাওয়া হলো না। সেও খাবার রেখে হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেলেন।
______
৮২.
শুভ্র রঙের পাঁচ তলা ফ্ল্যাটটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শিশিরদের প্রাইভেট কার। গাড়িটি ওর নিজের নয়; বড়ো ভাই শোহেবের। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে আঙুলগুলো হারমোনিয়াম বাজানোর মতো করে নেড়েচেড়ে শোহেব প্রশ্ন করে,’আমাদের তো টিসএসসিতে যাওয়ার কথা। এখানে কেন গাড়ি থামাতে বললি?’
‘ভূমি আপুকে পিক করে নিয়ে যাব তাই।’
শোহেব ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,’কাকে?’
শিশির ফোন চাপছিল। পূণরায় ভাইয়ের প্রশ্নটি শুনে সে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,’ভূমি আপু।’
‘আমি যতদূর জানি, আমাদের বাবা-মায়ের কোনো মেয়ে নেই।’

শিশির নিজের ভাই সম্পর্কে জানে। একগুঁয়ে, রগচটা, ঠোঁটকাটা স্বভাবের সে। তাই এমন কথায় সে অবাক হলো না। বরং আগের তুলনায় আরও শান্তকণ্ঠে বলল,’সূচনার বড়ো বোন।’
‘সূচনাটা কে?’
‘আদিলের হবু বউ। তোমায় বলেছিলাম না ওদের এঙ্গেজমেন্টের কথা?’
‘ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। আমরা তো ওদের জন্যই টিসএসসিতে যাচ্ছি তাই না?’
‘হ্যাঁ। এঙ্গেজমেন্ট তো ঘরোয়াভাবে হয়েছে। তাই এখন আমাদের ট্রিট দিচ্ছে।’
‘বুঝতে পেরেছি। তাহলে তোর ভূমি আপু কেন যায়নি এখনও?’
‘আপু জব করে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে লেট হয়েছে। তাই আমি বলেছি, বাকিরা যেন আগেই চলে যায়। আমি যাওয়ার সময়ে ভূমি আপুকে নিয়ে যাব।’
‘দয়ার সাগর!’ বাঁকা হেসে বলল শোহেব। শিশিরও হালকা হেসে প্রসংশারসুরে বলল,’সি ইজ সো মাচ ইন্টেলিজেন্ট ব্রো!’
‘ওহ তাই? তা কীসের জন্য শুনি?’
‘আপু অনেক ভালো লেখে। তার বইও বের হবে শুনেছি। আর গানের গলা তো জাস্ট ওয়াও! না শুনলে বিশ্বাসই করবে না।’
‘ব্যস! এইটুকুই?’
শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। শোহেব বলে,’এইটুকুর জন্যই তুই তাকে ইন্টেলিজেন্টের তকমা লাগিয়ে দিলি?’
‘তুমি এভাবে কেন কথা বলছ, বলো তো ভাইয়া?’
‘যাদের সময়-জ্ঞান বলতে কিছু নেই তাদের বুদ্ধিমত্তার এত তারিফ করাটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। দেখি ফোন দে তোর আপুকে। বল আমরা নিচে অপেক্ষা করছি।’

শিশির কথা না বাড়িয়ে ফোন দিতে যাবে তখনই ভূমিকে আসতে দেখা যায়। ‘ঐতো আপু আসছে।’ বলল শিশির। সে ভূমির উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতেই ভূমি এসে গাড়ির পেছনের সিটে বসে। শোহেব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভূমির উদ্দেশ্যে বলল,’আপনার সম্পর্কে এতক্ষণ বেশ প্রশংসা শুনলাম শিশিরের কাছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনার এতসব গুণ কোনো কাজে আসবে না।’
ভূমিকা অবাক হয়ে শিশিরের দিকে তাকায়। শিশিরও পেছনে তাকিয়ে ইশারায় বলে,’পাগল একটা!’
শোহেব গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করে,’কেন জানেন?’
ভূমি কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শোহেব গাড়ির লুকিং গ্লাসটা এবার ভূমির মুখ বরাবর ঠিক করে রাখে। তখনই আয়নায় ভেসে ওঠে কাজলবর্ণ দুটো আঁখি। গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ হওয়া সত্ত্বেও চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল এবং গর্ত খুব সহজেই চোখে পড়ছে। রাতে বোধ হয় ঠিকমতো ঘুমায় না। সে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই বলল,’আপনার সময়-জ্ঞান খুব কম। সময় মেইনটেইন করার চেষ্টা করবেন মিস…কী যেন নাম?’
ভূমিকা এবার হাত-ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে কাঁটা কাঁটা গলায় বলল,’ভূমিকা! আমার সময়-জ্ঞান পর্যাপ্ত রয়েছে। আপনারাই সময়ের আগে চলে এসেছেন। এমনিতে আমি রেডিই ছিলাম। যখন এসেছেন, তখনই যদি ফোন করতেন তাহলে আরও আগেই যেতে পারতাম আমরা।’
ভূমির কাঁটা কাঁটা উত্তর শুনে শোহেব একবার লুকিং গ্লাসে ভূমিকে দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’ঝাঁঝের রাণী!’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here