#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_২২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
৫৮.
হাসপাতালের বেডে শুয়ে রয়েছে সুমি। গতকাল এক্সিডেন্টের দরুণ এখন তাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। সে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখতে পায় রাসেলকে। রাসেল পরম যত্নে সুমির হাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসি উপহার দেয় সুমি।
‘এখন কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করে রাসেল।
সুমি মৃদুস্বরে বলল,’ভালো।’
‘কাল রাতে কেন বেরিয়েছে বলো তো?’
‘রুমে খাবার ছিল না।’
‘আমায় ফোন করতে পারতে।’
‘সারাদিন কাজ করে কত ব্যস্ত থাকো তুমি! তাই বিরক্ত করতে চাইনি।’
‘একদম উদ্ধার করেছ আমায়!’
‘তুমি কি রাগ করেছ?’
‘না তো! অনেক খুশি হয়েছি। খুশিতে এখন আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।’
সুমি হেসে ফেলে। বলে,’তাই? তাহলে নাচো একটু।’
‘তুমি কখনো আমার কষ্ট বুঝবে না।’
‘ভালোবাসা তো বুঝি।’
রাসেল চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর সুমি জিজ্ঞেস করে,’আমায় হাসপাতাল থেকে কবে রিলিজ করবে?’
‘কেন?’
‘কেন মানে? তুমি জানো না আমি এখানে পার্ট টাইম জব করি? কাজে না গেলে চাকরী থাকবে না আমার।’
‘দরকার নেই তোমার কোনো চাকরী করার। আমি আগেও তোমায় বারণ করেছিলাম। তুমি শোনোনি। এখন তো এক্সিডেন্ট করেছ। এবার আর আমি তোমার কোনো কথাই শুনব না।’
‘পাগলামি করছ কেন? বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠানো হয়, তাতে আমার থাকা-খাওয়া, পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়। কতগুলো করে টাকা সেমিস্টার ফি দিতে হয়। আমাকে আমার জন্য হলেও জবটা করতে হবে।’
রাসেল এবার সুমির চুলের মাঝে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’কেন সুমি? আমাকে কি ভরসা করা যায় না?’
‘যাকে ভালোবাসি তাকে ভরসা কেন করতে পারব না? এত বড়ো আমেরিকা শহরে আমার বেষ্টফ্রেন্ডের পর তুমিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যাকে আমি ভরসা করতে পারি।’
‘তাহলে চিন্তা করছ কেন? আমি তোমার সব খরচ চালাব।’
‘না। তুমি নিজে এখানে থাকো সেই খরচ তো আছেই। আবার বাড়িতেও টাকা পাঠাও। এখন আবার আমার খরচ? কোনো দরকার নেই।’
‘চুপ! আমি যখন বলেছি দরকার আছে, মানে দরকার আছে। আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোমার বান্ধবী রিয়াকে ওদের ফোন করে জানিয়ে দিতে বলব যে, তুমি আর ঐ কাজটা করছ না।’
‘তাহলে আমি কী করব শুনি?’
‘আপাতত নিজের খেয়াল রাখতে হবে। সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। আর পড়াশোনা করবে ব্যস!’
‘তাহলে আমি তোমার বাসায় গিয়েই উঠি, কী বলো?’
রাসেল একটু থমকায়। তৎপর মুখে হাসি টেনে বলে,’হ্যাঁ, অবশ্যই। সময় হোক। এখন তুমি একটু রেস্ট নাও তো। ঘুমাও।’
‘তুমি যাবে না কিন্তু।’
‘আচ্ছা আমি যাব না।’
সুমি ঘুমানোর পর রাসেল কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। ঘুম পরিপূর্ণ হয়নি বলে মাথা ব্যথা করছে। ভূমির কথাও তার হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়। এদিকে সে সুমিকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সুমিকে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়িতে গেলেই ভূমির মুখোমুখি হতে হবে। তাই সে বাড়িতে না গিয়ে অফিসে চলে যায়। অফিসেও তার মন ঠিক টিকছিল না। একদিকে ভূমি তো অন্যদিকে সুমি। যদি সুমি সব জানতে পেরে যায়! তাহলে হয়তো ওদের দুজনের সম্পর্কটা আর থাকবে না। আর সে তো চায় না সুমিকে হারাতে। অন্যদিকে ভূমি যদি বাংলাদেশে খবরটা জানায় তাহলে বিষয়টা আত্মীয়স্বজনের মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে। সে চেয়েছিল ধীরে-সুস্থে, সময়, সুযোগ বুঝে ভূমিকে ছেড়ে দেবে। আর আগে যদি সে সুমিকে, তার ভালোবাসাকে পেয়ে যেত তাহলে তো ভুলেও সে ভূমিকে এখানে আনতো না। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে না তো সবকিছু?
এসব ভাবতে ভাবতে তার আরও মাথা ব্যথা বেড়ে যায়। এই মুহূর্তে না ঘুমালে কিছুতেই চলবে না। তাই সে বাধ্য হয়েই বাড়িতে ফিরে যায়। কলিংবেল না বাজিয়ে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়েই দরজা খুলে ভেতরে যায়। ড্রয়িংরুমের সবকিছু এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কাচের জিনিসগুলো ভেঙে কাচের টুকরা চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে রাসেল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ভূমি সব কিছু ভাঙচুর করেছে। সে সাবধানে পা ফেলে বেডরুমে যায়। ভূমিকা উপুর হয়ে শুয়ে রয়েছে। মুখের এক সাইড দেখা যাচ্ছে। কৃষ্ণবর্ণ মুখটির গালে আঠালো হয়ে রয়েছে চোখের পানি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটার মুখের ঐ এক সাইডেই যেন তার সমস্ত দুঃখ প্রকাশ পেয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পরখ করে সে ভূমিকে। শাড়ির আঁচল গড়িয়ে পড়েছে ফ্লোরে। শাড়ির আঁচল লক্ষ্য করে নিচে তাকাতেই দেখতে পায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে ফ্লোরে। রাসেল চমকে এগিয়ে যায়। শাড়ির আঁচলটি তুলতেই ভূমির রক্তমাখা হাতটি দেখতে পায়। তিনটা গভীর দাগ হাতে স্পষ্ট। বিছানার ওপরেই রাখা ধারালো ব্লেড। ভূমির বাহু ঝাঁকিয়ে রাসেল ডাকতে থাকে,’ভূমি? এই ভূমি?’
ভূমির কোনো সাড়াশব্দ নেই। রাসেল হাতের পালস্ চেক করে। নাকের কাছে হাত নিয়ে নিঃশ্বাস চেক করে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অতিরিক্ত ব্লিডিং এর কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছে। রাসেল কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না। চোখে-মুখে পানির ছিটা দেওয়ার পরও জ্ঞান ফিরছে না। রাসেল ঘাবড়ে যায়। বেশি বেশি পানি নিয়ে মুখে ছিটায়। অবশেষে ভূমির জ্ঞান ফিরে। সে রাসেলকে দেখে অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়। কিন্তু যখনই সব মনে পড়ে যায় তখনই তার হাসিটা মিলিয়ে যায়। রাসেল ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আসে। ভূমির পাশে বসে হাতের রক্ত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ব্যান্ডেজ করতে করতে জিজ্ঞেস করে,’এগুলো কী ধরণের পাগলামি ভূমি? তুমি একটা ম্যাচিউরড মেয়ে। এসব পাগলামি কি তোমায় মানায়?’
‘ঘরে বউকে রেখেও যদি বাইরে তুমি পরকিয়া করতে পারো এবং এটায় যদি তোমায় মানায় তাহলে আমায় এইটুকু পাগলামিতে মানাবে না?’
রাসেল এক পলক ভূমির দিকে তাকিয়ে বলে,’বারবার পরকিয়া কেন বলছ? আমি ভালোবাসি ওকে।’
‘আর আমাকে?’
রাসেল চুপ করে থাকে। ভূমি পূণরায় জিজ্ঞেস করে,’আর আমাকে?’
‘ভালোবাসতাম!’
তীরের ফলা যেন ভূমির বুকটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিলো চোখের পলকেই। হাত ছিটকে সরিয়ে নেয় রাসেলের হাত থেকে। চোখে পানি টলমল করছে। মুহূর্তে চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তেও শুরু করে। সে বলে,’ভালোবাসতাম বলে কোনো শব্দ হয় না রাসেল। হয়তো ভালোবাসি হবে নয়তো কখনোই ভালোবাসিনি হবে।’
রাসেল ফাস্টএইড বক্স নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভূমি পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। শীতলকণ্ঠে বলে,’তুমি আমায় ভালোবাসো না বললেই পারতে। আমি নিজেই সরে যেতাম। বিয়ের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ককে অবহেলায় পায়ে ঠেলে দিয়ে কেন পরকিয়ার মতো জঘন্য সম্পর্কে জড়ালে?’
‘পরকিয়া হতে যাবে কেন? বললাম তো আমি ভালোবাসি ওকে।’
রাসেলের আবারও অকপটে বলা ‘আমি ভালোবাসি ওকে’ কথাটি একদম তীরের মতো বিঁধে ভূমিকার বক্ষে। নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের স্বামীর মুখে শুনতে হচ্ছে সে অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসে। ভূমিকা শ্লেষোক্তি করে বলে,’বিয়ের পরে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোকে তুমি পরকিয়া বলতে চাচ্ছ না?’
‘না, চাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ব্যতীত খারাপ কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘রাসেল, তুমি কি জানো; তুমি একজন নিঁখুত অভিনেতা?’
রাসেল নিশ্চুপ। ভূমি বলল,’সেই মেয়ে যদি তোমার ভালোবাসা হয়ে থাকে তাহলে আমি কে তোমার? মোহ? ক্ষণিকের ভালোলাগা?’
রাসেল এবার অতি সহজেই বলে ফেলল,’অনেকটা সেরকমই। ওকে দেখার পর আমি বুঝেছি ভালোবাসার সত্যিকারের অনুভূতিটা কেমন হয়। যেটা তোমায় দেখে আমি কখনো মনে হয়নি।’
এ কথা শোনার পর রাসেলের হাতটি ছেড়ে দেয়। ভূমিকা হাসে। কষ্টের হাসি!
_________
৫৯.
‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?’
ফাতেমার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে গানটি শুনছে সূচনা। সমস্ত আবেগ, সুর যেন ফাতেমা গানটিতে ঠেলে দিয়েছে। গান শেষ হলে সূচনা হাত তালি দেয়। ফাতেমা লজ্জা পেয়ে বলে,’কী যে করিস না!’
সূচনা হাতের ইশারায় বলে,’অনেক সুন্দর হয়েছে।’
ফাতেমা সলজ্জিত হাসে। একটুপর আবার মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলে, ‘সুখী আর সাথীকে খুব মিস করছি। তোর ইন্টার শেষ হলে তুইও তো চলে যাবি। শুধু আমিই রয়ে যাব। তোরা চলেই যদি যাবি তাহলে এসেছিলি কেন বল তো?’
সূচনা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। এর প্রত্যুত্তরে তার সত্যিই কিছু বলার নেই। তবে এ কথাও সত্য ইন্টার শেষ হলে সে গ্রামে ফিরে যাবে। বাবা-মায়ের সাথে থাকবে। নামি-দামি কলেজ, ভার্সিটিতে না পড়লেও ভালো স্টুডেন্ট হওয়া যায়। ভালো রেজাল্ট করা যায়। ঢাকা-শহরে এসে সে ভিন্নরূপী মানুষ দেখেছে; যা তার ভালো মানুষ দেখার তুলনায় খুবই বেশি। মানুষ চিনেছে, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে সে। ঢাকা শহরের যান-জট, অলিগলিও এখন আর তাকে টানে সে। তার গ্রামের মেঠো পথ, বৃষ্টির দিনে পিছলে যাওয়ার ভয়ে থাকা সেই পিচ্ছিল রাস্তাটিকেও সে এখন মিস করে। প্রয়োজনে দু’বেলা ডাল-ভাত খাবে তবুও সে বাবা-মায়ের সাথেই থাকবে। আর সে দূরে থাকবে না। এখন শুধু অপেক্ষা ফাইনাল পরীক্ষার।
সূচনাকে ভাবুক হয়ে বসে থাকতে দেখে মৃদু ধাক্কা মারে ফাতেমা। জিজ্ঞেস করে,’কী ভাবছিস?’
সূচনা মৃদু হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘কিছু না।’
সে সময়ে সাথী ফোন করে ফাতেমাকে। কী কথা বলল তা সূচনা শুনতে পায়নি। ফোন রাখার পর ফাতেমা বলল,’তোর বড়ো বোন সাথীর হোয়াটসএপে ফোন দিয়ে তোকে চেয়েছে। কিন্তু ও তো এখন এখানে নেই। তাই ফোন দিয়ে আমায় জানালো। তুই আমার ফোন দিয়ে কথা বল। নাম্বার সেভ করে নে ধর।’
সূচনা ফোনটি হাতে তুলে নেয়। অনেকদিনই হবে ভূমির সাথে ওর তেমন কথা হয় না। আজ কেমন যেন একটু ভয় ভয় হচ্ছিল। আপু ভালো আছে তো?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। সকলে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন।]