#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_২১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৫৬.
শীতের মিষ্টি কোমল রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলে এসে সূচনার সিল্কি কালো চুলগুলোর মাঝে বিচরণ করছে; যার দরুণ চুলগুলো রোদের সংস্পর্শে এসে ঝিকমিক করছিল। মুখে কালম পুরে কামড়াতে কামড়াতে ক্যামিস্ট্রি বইতে চোখ বুলাচ্ছিল সে। আজকাল তার সময় কাটে বইতে মুখ ডুবিয়ে। পারিপার্শ্বিক কোনো কিছু এখন আর তাকে টানে না। একের পর এক সমস্যা তাকে যেন ভেতর থেকে শক্ত করে তুলেছে। যা হয় হোক, এখন আর সে কোনো বিপদের তোয়াক্কা করে না। সলিউশন হিসেবে ব্যস্ততাকে বেছে নিয়েছে। আর ব্যস্ততা বলতে তার শুধু পড়াশোনাই রয়েছে।
সাথী চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করে,’এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়া হচ্ছে?’
সূচনা স্মিত হেসে ইশারা দিয়ে রসায়ন বইটি দেখিয়ে দিলো।
সূচনার বেডে বসে সাথী বিমুখ হয়ে বলল,’মনটা ভালো নেই গো।’
সূচনা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। সাথী বলে,’বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে খুব। যেতে বলছে।’
খাতার ভাঁজে সূচনা লিখে,’এতে মন খারাপ করার কী আছে?’
লেখাটি পড়ে সাথী বলল,’বলেছিলাম না অফিসের একটা ছেলেকে ভালো লাগে? ঐ ছেলেটির সাথে ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু এখন কিছুদিন যাবৎ কেমন যেন এড়িয়ে চলে। আকারে, ইঙ্গিতে বুঝালাম বিয়ের কথা। সেও আকারে ইঙ্গিতে বুঝাল, তার পরিবার নাকি মেনে নেবে না এই সেই! অথচ প্রথমদিকে এমন কেয়ার করেছে জানো, মনে হয়েছিল মানুষটা আমায় কত্ত ভালোবাসে!’
সূচনার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মানুষ যে কেমন নাটকবাজ হয় তা তো সে নিজেও জানে। সে সাথীর হাতের ওপর হাত বুলিয়ে খাতায় লিখল,’যে তোমায় এড়িয়ে চলে, তুমিও তাকে এড়িয়ে চলো। জীবন কারো জন্যই থেমে থাকবে না। হন্যে হয়ে তার পেছনে ছোটার প্রয়োজন নেই,যার কাছে তুমি বিরক্তিকর। এরচেয়ে ভালো পরিবার যা বলে শোনো। পরিবার তো আর সন্তানের খারাপ চায় না। সব জেনে-বুঝে, পছন্দ হলে তারপর না হয় বিয়েতে রাজি হও। আপাতত যখন যেতে বলছে, তখন যাও।’
সাথী একটুখানি হেসে বলল,’দেখি।’
‘সুখী তো পরীক্ষা শেষ করে চলে গেল বাড়িতে। তুমি আবার একেবারে চলে যেও না।’
‘আরে না! আমি আবার আসব তো। সুখীর সাথে আমার কথা হয়েছিল পরশুদিন। কিছুদিন পর ঘুরতে আসবে বলেছে। আচ্ছা তুমি এখন পড়ো, আমি বাইরে যাব একটু।’
উত্তরে সূচনা সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকায়।
__________
৫৭.
রাতের অন্ধকার আমেরিকাকে গ্রাস করতে পারেনি। চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি। ভূমিকার ভয় হয়, এই আলোতে তার মুখে বিষাদগুলো আবার স্পষ্ট না হয়ে ওঠে। আতঙ্কে তার মুখ ভার হয়ে রয়েছে। বুকের ভেতর থেকে ভারী নিঃশ্বাস উঠাবসা করছে। সে চাচ্ছে তার দেখার সমস্তটা ভুল হোক। অথবা স্বপ্ন হোক। খুব বাজে স্বপ্ন হোক! ঘুম থেকে উঠেই যেন সে বাস্তবের সংস্পর্শ পায়। আর তারপর রাসেলকে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। কোথাও যেতে দেবে না। কোথাও না!
ভূমিকার ভ্রম হয় ঠিকই, তবে স্বপ্নে নয়; বাস্তবেই। আসলে তার ভ্রমগুলো কল্পনায় বিচরণ করছিল। তার অবুঝ মন তিক্ত সত্য মানতে নারাজ। তাই তো সে মনকে শান্ত করতে নানান উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে কল্পনার রাজ্যে। মিসেস চৌধুরী যখন বাড়ির কাছে এসে বললেন,’রেস্ট নাও। কাল দেখা হচ্ছে।’ তখনই ভূমি বুঝতে পারে রাসেলকে অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখাটা ভ্রম ছিল না; বরঞ্চ এখন তার ভাবনাগুলো ছিল ভ্রম, কল্পনা। সে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে মিসেস চৌধুরীকে বিদায় জানায়। নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে থমকে যায়। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। মাথায় চক্কর দিচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে বুকের বাঁ পাশটায়। চাবি কোথায় রেখেছে মনে করতে পারছে না। হাতের ব্যাগ দেখে মনে হলো, এখানেই থাকতে পারে। ব্যাগ হাতড়ে চাবি খুঁজতে গিয়ে মনে হলো, তার আসলে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তিটুকুও নেই। চাবিটি দিয়ে সে দুর্বল হাতে দরজার লক খোলে। বেডরুমে গিয়ে ফ্রেশ না হয়েই আকাশমুখী হয়ে শুয়ে পড়ে। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা চোখের পানিগুলো যেন উপচে পড়তে চাচ্ছে। সে প্রাণপনে আটকাচ্ছে। স্বামীর পাশে অন্য কোনো মেয়েকে মানতে কষ্ট হলেও, সে বোঝাচ্ছে হতেই পারে মেয়েটি ওর পরিচিত। অথবা ওর কোনো বন্ধুর পরিচিত, কিংবা মেয়েটি কোনো বিপদে পড়েছে। সে নানান বাহানায় মনকে ভোলাতে চাচ্ছে। চোখের দেখার আড়ালেও অনেক সত্য আত্মগোপন করে থাকে। হয়তো এর পেছনেও অন্য কোনো কারণ রয়েছে। এই যুক্তি তার মন এবং মস্তিষ্ক উভয়ই মেনে নেয়। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। জামা পাল্টে পরিষ্কার হয়ে নেয়। সারাদিন বাইরে ছিল বলে রাতের জন্য কিছুই রান্না করা হয়নি। সে ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে। চাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দেয়। সব কাজ করতে করতেও তার মন শুধু রাসেলকে নিয়েই ভেবে চলেছিল, কখন সে আসবে। রান্নাবান্না শেষ করে সে বসে থাকে। ঘড়িতে তখন নয়টা বেজে বিশ মিনিট। সে টিভি দেখতে বসে। একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টায়, কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না।
টিভি অফ করে সে সোফায় মাথা হেলিয়ে শুয়ে থাকে। মিনিট তিনেক পরেই কলিংবেল বেজে ওঠে। ঝড়ের বেগে দৌঁড়ে যায় ভূমিকা। দ্রুত হাতে দরজা খুলে দেয়। এতক্ষণ বাদে তার সমস্ত শক্তি যেন ফিরে এসেছে। ভূমিকাকে দেখতে পেয়েই রাসেল তার ভুবনভুলানো হাসিটা দিয়ে বলে,’দরজার কাছেই বসে ছিলে মনে হচ্ছে।’
ভূমিকা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে। হাসিটা তার কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে নাকি কমিয়ে দিয়েছে তৎক্ষণাৎ সে বুঝতে পারে না। রাসেলের সঙ্গে সে ভেতরে আসে। ভূমিকে নিরব দেখে রাসেল জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে? মন খারাপ কেন? স্যরি একটু লেট হয়ে গেল।’ কান ধরেই শেষ লাইনটা বলেছে সে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্না এবার বিনা বাধায় উপচে পড়তে থাকে। ভূমিকা ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। নিরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় রাসেলও কিছুটা চমকে যায়। ভূমিকে স্পর্শ করতে তার হাত কাঁপছে। সে কাঁপান্বিত হাতে ভূমির চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে লক্ষী? কাঁদছ কেন তুমি?’
ভূমিকার বাঁধনহারা কান্নারা যেন কোনো বাঁধাই আজ মানবে না। সে রাসেলের শার্ট খামচে ধরে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,’আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি রাসেল।’
‘আমিও ভালোবাসি তো। কান্না থামাও প্লিজ! আর দেখো আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছি। ফ্রেশ হয়ে এসে এক সাথে খাব কেমন?’
ভূমিকা এবার রাসেলকে ছেড়ে দেয়। রাসেল ওয়াশরুমে চলে গেলে সে দু’চোখের পানি মুছে খাবারগুলো ডাইনিংরুমে নিয়ে যায়। সার্ভ করে রাসেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ফ্রেশ হয়ে এসে সে জানায়,’লক্ষী তুমি খাওয়া শুরু করো। আমি একটা ই-মেইল সেন্ড করে আসতেছি।’
‘না, একসাথেই খাব। তুমি কাজ শেষ করো। আমি অপেক্ষা করছি।’
‘আচ্ছা।’
রাসেল আবার রুমে ফিরে আসে। সে চোখের আড়াল হলেই ভূমিকার দম বন্ধ করা অনুভূতি হয়। সেও তখন রুমে চলে যায়। খাটের এক কোণায় বসে রাসেলকে দেখতে থাকে। আর রাসেল গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়। ভূমি আহ্লাদী স্বরে বলে,’নিজ হাতে খাব না। তুমি খাইয়ে দাও।’
রাসেল হাসে তার সুমিষ্ট হাসিটি। যত্ন সহকারে খাইয়ে দেয় ভূমিকে। সকল, দুঃখ-কষ্ট যেন কর্পূরের ন্যায় উবে গেছে। ভূমি সেই প্রসঙ্গটি তোলে না। রাসেল নিজে থেকে বলতে চাইলেই না হয় বলবে। হয়তো তেমন বলার মতোও কিছু ছিল না। না হলে, রাসেল নিশ্চয়ই তাকে জানাতো। খেতে খেতে ভূমি জিজ্ঞেস করে,’আজ কেমন ইনজয় করলে?’
‘দারুণ। তবে তোমায় খুব মিস করেছি।’
‘কচু করেছ।’
‘সত্যি।’
‘মিথ্যা। মিস করলে একবার হলেও ফোন করতে। করোনি। এমনকি আমার ফোনও রিসিভ করোনি।’
‘এজন্য স্যরি লক্ষী। আজ সব বন্ধুদের ফোন সুইচড অফ করে রাখার কথা ছিল। কিন্তু পরিবার চিন্তা করবে বলে সবাই ফোন সাইলেন্ট মুডে রেখে চিল করেছি।’
‘ভালো। কোথায় কোথায় ঘুরলে?’
‘অনেক জায়গায় ঘুরেছি। ছবি আছে। ঘুমানোর সময় দেখব কেমন?’
‘আচ্ছা। আর শোনো, আমি আজকে ঐ পাশের ফ্ল্যাটের আপুর সাথে বাইরে গেছিলাম। তোমায় জানানোর জন্য ফোন করেছিলাম। কিন্তু তুমি তো রিসিভ করোনি।’
রাসেল হেসে বলল,’সমস্যা নেই।’
সবকিছু আগের মতোই চলছিল স্বাভাবিক। অযথাই ভূমিকা রাসেলকে সন্দেহ করেছিল। সে কখনোই ভূমিকে ঠকাতে পারে না। নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস সে রাসেলকে করে। পরের হলিডে তে ভূমিকে নিয়ে বাড়িতে কাপল পার্টির আয়োজন করে রাসেল। ভূমির জন্য সে নিজ হাতে রান্না করে। সমস্ত আয়োজন শেষ করে দুজনে একত্রিত হয়। ঘরে নিভু নিভু লাল, নীল আলো জ্বলছে। সাউন্ড বক্সে চলছে রোমান্টিক সফট্ গান। এক অন্য রকম ভুবন মনে হচ্ছে তাদের এই ছোট্ট রুমটিকে। হাতে হাত রেখে দুজনে গানের তালে তালে নাচছিল। রাসেলের থুতনি এখন ভূমির কাঁধের ওপর। পেছন থেকে সে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ভূমির নিঃশ্বাস বন্ধ প্রায়। সে রাসেলের হাত আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,’আমাদের একটা ছোট্ট রাসেল কবে আসবে?’
রাসেল মুচকি মুচকি হাসে। বলে,’শুধু ছোট্ট রাসেল নয়, আমাদের ছোট্ট ভূমিও আসবে। শুধু একটু সময় দাও। গুছিয়ে নিই আগে সবকিছু। ফ্যামিলি প্ল্যানিং তো আগে সুষ্ঠুভাবে করতে হবে তাই না?’
ভূমি সলজ্জিতভাবে মুচকি হাসে। রাসেলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত রাসেলের গলায় রাখে। বাঁ হাত রাসেলের গালে রেখে ফিসফিস করে বলে,’ভালোবাসি।’
নিঃশ্বাস দুজনেরই ভারী হয়ে আসছে। ভূমিকা দু’পা কিঞ্চিৎ উঁচু করে রাসেলের ওষ্ঠদ্বয়ের নিকট নিজের চিকন ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নেয়। রাসেলের ফোনের টোন বেজে ওঠে তখন। ভূমিকা লজ্জা পেয়ে সরে যায়। রাসেল বিরক্তস্বরে বলে,’এটা কী হলো? সরলে কেন?’
মাথা নত করে লজ্জামিশ্রিত হেসে ভূমি বলল,’আগে ফোন রিসিভ করো। জরুরী কোনো ফোনও হতে পারে।’
‘ধ্যাত!’ বলে রাসেল ফোন তুলে নেয়। ততক্ষণে প্রথম কলটি কেটে গিয়েছে। দ্বিতীয় কলটি আসায় সাথে সাথে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কী বলে শোনা যাচ্ছে না। তবে এই নিভু আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাসেলের আতঙ্কিত চেহারা। ভূমিকা ভয় পেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
রাসেল এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। এমনকি কোনো কিছু না বলেই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কী ভেবে যেন সেও রাসেলের পিছু পিছু বেরিয়ে যায়, তাকে ফলো করে।
উত্তেজনায় রাসেল বাইক নিয়ে আসেনি। ট্যাক্সিতে এসেছে। ভূমি অন্য ট্যাক্সিতে বসেই দেখতে পেল, রাসেল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছে। ভূমি সেদিকে তাকায়। তাদের দুটি ট্যাক্সিই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল হাসপাতালের সামনে। তার কৌতুহল ক্রমাগত বাড়ছে। সে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাসপাতালের ভেতর প্রবেশ করে। খুব সাবধানে আগায়। রাসেলকে কোথাও খুঁজে পায় না। এত বড়ো হাসপাতালে সে কোথায় রাসেলকে খুঁজবে বুঝতে পারছে না। যদি রাসেলের মুখোমুখি হয়ে যায় তখন সে কী করবে। এভাবে সে রাসেলকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা না করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। একটা ট্যাক্সি ডেকে যখন উঠতে যাবে তখন পেছন থেকে হাত টেনে ধরে একটি মেয়ে। অকপটে ইংরেজিতে বলে,’তোমার সাথে আমার কথা আছে। ভালোই হলো তোমায় এখানে পেয়ে গেলাম।’
ভূমিকা পেছনে ফিরে লিন্ডাকে দেখতে পায়। তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। লিন্ডা নিজেই ভূমিকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে।
.
ভোরঃ ৪:৪০ মিনিট
রাসেল বাড়ি ফিরে দেখতে পায় সদর দরজা খোলা। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রয়েছে ভূমিকা। তার চোখ ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। চুলগুলোও হয়ে আছে এলোমেলো। রাসেল কিছু বলল না। ভূমিও না। কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকে ভূমিকা। তারপর উঠে যায় বেডরুমে। চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে রাসেল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা রাত সে নিজেও ঘুমায়নি। কয়েক পলক নিরবে তাকিয়ে থেকে ফোনের গ্যালারীতে যায় ভূমিকা। একটা ছবি রাসেলের সামনে ধরে জিজ্ঞেস করে,’এই মেয়ে কে?’
চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসে রাসেল। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। সে নিরব। ভূমিকা আবারও একই প্রশ্ন করে। রাসেল এবারও নিরব হয়েই থাকে। ভূমির ধৈর্যের বাঁধ শেষ। সে চিৎকার করে বলে,’চুপ করে আছো কেন এখন? কথা বলো না কেন?’
‘তুমি এই ছবি কোথায় পেলে?’
‘কোথায় পেয়েছি তা তো তোমার জানার প্রয়োজন নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছি এই মেয়েটা কে? কী হয় তোমার?’
রাসেল অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। রাসেলের নিরবতা আরও বেশি কষ্ট দেয় ভূমিকাকে। তাকে রাগিয়ে তোলে। তার ভেতর যেই কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে যাচ্ছে, রাসেল কি সেটা কোনোভাবে টের পাচ্ছে না? পাচ্ছে না। পেলে নিশ্চয়ই এভাবে চুপ থাকতে পারত না। ভূমিকা রেগে গিয়ে যা নয় তা বলে গালাগালি করতে থাকে। আর বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘বলো এই মেয়ে কে? কী সম্পর্ক ওর সাথে তোমার?’
রাসেলও বোধ হয় ধৈর্যহারা হয়ে বলে ফেলল,’আমার ভালোবাসা!’
থমকে যায় ভূমিকা। সে কি ঠিক শুনলো নাকি ভুল? কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মনে হলো কেউ তার শ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। রাসেল চিৎকার করে বলল,’ভালোবাসি আমি ওকে। সমস্যা তোমার কোনো?’
ভূমিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রাসেল নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। ভূমিকা শান্ত এবং সরলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’তাহলে আমি কে?’
রাসেল এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। ভূমিও নাছোড়বান্দার মতো একই প্রশ্ন করে চলেছে। এক পর্যায়ে রাসেল দ্বিতীয় রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে ভূমিকা। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আজ যেন বিশাল আকাশটাই তার মাথায় ভেঙে পড়েছে। কষ্ট এতটা নিদারুণও হয়? সত্যিই হয়? সে ঐ রুমের দরজা ধাক্কায় কান্না করতে করতে। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স আসে না। ভূমি কান্না করতে করতে বলে,’সব কি তবে অভিনয় ছিল রাসেল? এত নিঁখুত অভিনেতাও কেউ হয়? আমি তো তোমায় ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তাহলে আমার সাথে কেন এমন করছ বলো? তুমি বলে দাও, এসব মিথ্যে। রাসেল!’
সে কান্না করতে করতে দরজার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে থাকে। রাসেল বের হয় ঘণ্টা তিনেক পরে। ভূমিকে প্রায় দেখেইনি এমন ভান করে নিজেদের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। হাসপাতালে যেতে হবে আবার তার। ভূমি উদভ্রান্তের মতো ফিরে আসে। অসহায়ের মতো রাসেলের হাত চেপে ধরে বলে,’আমায় ছেড়ে যেও না রাসেল। আমায় বোঝার চেষ্টা করো একটু।’
রাসেল একদম শান্তকণ্ঠে বলল,’কান্নাকাটি করো না। ঠান্ডা হও একটু। আমায় হাসপাতালে যেতে হবে।’
রাসেলের এমন ভাবলেশহীন কথায় ভূমিকা আবার রেগে যায়। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,’ঠান্ডা হবো আমি? কান্নাকাটি করতে বারণ করছ? তুমি কি বুঝতে পারছ আমার অবস্থা? তুমি কি বুঝতে পারছ আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে? কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে বলো। কেন এত ভালোবাসার স্বপ্ন দেখালে। ভালো যদি না-ই বাসো তাহলে কেন আমায় বিয়ে করলে? এতদিন যা বলতে সব নাটক ছিল, মিথ্যে ছিল আমার এসব মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে রাসেল। বিশ্বাস করো,মরণ যন্ত্রণা কেমন হয় আমার জানা নেই; তবে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি সত্যিই মরে যাচ্ছি। আমি মানতে পারছি না, পারছি না রাসেল!’
ভূমি কান্নায় আরও ভেঙে পড়ে। রাসেল কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ভূমিকার হাত সরিয়ে দেয়। তারপর আর পিছু না তাকিয়েই চলে যায় বাড়ির বাইরে। এদিকে ভূমিকার গগনবিদারী চিৎকার, বুকফাটা আর্তনাদ, অসহনীয় কষ্ট আর বাধাহীন চোখের পানি এতদিনের পরিচিত মানুষটিকে স্বপ্প সময়ের জন্যও স্পর্শ করতে পারেনি। ভূমি রাসেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে। কণ্ঠনালী থেকে বেরিয়ে আসে,’আর কতটা ভালোবাসলে, তুমি আমায় ছেড়ে যেতে না বলো?’
চলবে….
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। জানি, সবার মনে এখন প্রশ্ন জাগছে এই মেয়ে কে; সেটা আমি পরের পর্বগুলোতে ক্লিয়ার করব। আর যারা বলছেন, রাসেল এমন কেন করল? তাদের উত্তরে শুধু বলব, প্লিজ গল্পের নামটা খেয়াল করুন।
ওহ হ্যাঁ, প্রায় অনেকেই প্রশ্ন করেন গল্প কেন দেরিতে দেই। তো, আপনারা কি জানেন না আমার পরীক্ষা চলছে?]