#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_১৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৫১.
হাসপাতালের করিডোরে এলেমেলো অবস্থায় বসে রয়েছে প্রীতি। ওর আহাজারি করে করা কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। সাজগোজ সব নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। তার মনের ভেতর এই মুহূর্তে কেমন ঝড় চলছে তা তো বাহিরটা দেখেই অবলোকন করা যাচ্ছে। হাসপাতালে বেশি মানুষজন ডাক্তাররা এলাউ করছে না। অন্য রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। প্রীতির চিৎকার করে কান্না করাতে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে তাদের। প্রীতি তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলছে,’কী থেকে কী হয়ে গেল আম্মু? এটা কি হওয়ারই ছিল? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না মা গো! আমার জারিফ সুস্থ হয়ে যাবে বলো? কখন ও কথা বলবে? আমি ওর কাছে যাব।’
মেয়েকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে বলেন,’একটু শান্ত হও মামনী। জারিফ সুস্থ হয়ে যাবে।’
অন্যদিকে প্রীতির চেয়েও করুণ অবস্থা এখন জারিফের মায়ের। তার একমাত্র ছেলের প্রাণের আশঙ্কায় সে অস্থির, হতবিহ্বল হয়ে আছেন। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসে সূচনা। ওকে দেখামাত্র চাচি এবং তার পরিবার ক্ষিপ্ত হয়ে তাকান। যা নয় তাই বলে অপমান করেন। তবে প্রীতির পরিবারও সেখানে উপস্থিত থাকায় বিষয়টাকে নিয়ে তেমন ঘাটায় না কেউ। চাচা কোনো রকমে সেখানকার পরিস্থিতি তখন সামলে নেয়। তার নিজেরই মনের অবস্থা ভালো নয় এই মুহূর্তে। চাচি এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার বললেন,’ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলো। ওর জন্যই যত ঝামেলা হচ্ছে। আমার ছেলে আজ মৃত্যুর মুখে শুধুমাত্র ওর জন্যই। ওকে চলে যেতে বলো এখনই।’
কারো আর ঘটা করে বলা লাগেনি। বাবা-মাকে নিয়ে সূচনা নিজেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, তার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকেও ওরা কথা শুনিয়েছে। বাবার মুখটা একদম মলিন। মায়ের মুখ থমথমে হয়ে আছে। সম্ভবত তিনি সূচনাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। তবে সূচনার মানসিক অবস্থার জন্য বলতেও পারছেন না। রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। এত রাতে বাবা-মায়ের গ্রামে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার সূচনা মাকে হোস্টেলে এক রাত থাকতে দিতে পারলেও বাবাকে থাকতে দিতে পারবে না। কারণ ওটা লেডিস হোস্টেল। আর বাকহীন বাবাকে সে সারা রাত রাস্তায় বসিয়ে রেখে নিজে আরামে থাকতে পারবে না। বাবা-মাকে নিয়ে আপাতত সে একটা খোলা জায়গায় বসে। এবার মা আর কিছু না বলে বোধ থাকতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন,’সত্যি করে বল তো জারিফের সাথে তোর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? যদি না-ই থাকে তাইলল তুই ক্যান আসিস নাই ওর বিয়েতে? আর তোর জন্য ওর এত দরদ-ই বা ক্যান?’
সূচনা ভাবলেশহীনভাবে তাকায়। বিয়েতে না যাওয়ার কারণ তার আছে। কিন্তু জারিফের তার প্রতি এত উতলা হওয়ার কোনো কারণ জানা নেই। সে তার মাকে সব বুঝিয়ে বলে যতটুকু সে জানে। সূচনার আকার, ইঙ্গিত, ইশারাকৃত সকল কথাই বাবা-মায়ের বোধগম্য। মাকে এবার কিছুটা চিন্তিত দেখাল। তিনি তৎক্ষণাৎ এ ব্যাপারে কোনো কথা না বলে অন্য কথা বললেন,’তোরে ঢাকা-শহরে পড়তে দেওয়াই আমার ভুল হইছে। গ্রামের মেয়ে গ্রামেই পড়তি। সেটাই ভালো ছিল।’
সূচনা মনমরা হয়ে বসে থাকে। জারিফের এক্সিডেন্টটিকে মানতে কষ্ট হচ্ছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রীতির এলোমেলো কান্নারত অবস্থা। আজ রাতটা ওদের দুজনের অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। অনেক বেশি স্পেশাল এবং অনেক বেশি সুন্দর হতে পারত। কিন্তু হয়নি! এখন বাকিদের মতো তার নিজের কাছেও মনে হচ্ছে আসলে দোষটা তারই। কেন তার প্রতি জারিফের এত মায়া?
সূচনা খেয়াল করে তার বাবা শীতে কাঁপছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তখন নুসরাতের কথা মনে পড়ে যায়। আজ রাতটা ওদের বাড়িতে থাকা যায়। নুসরাতের বাবা-মা খুব ভালো মানুষ। তারা নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি করবে না। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইশারায় বলল,’চলো।’
‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলেন মা।
সূচনা ইশারায় বোঝাল, তার বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যাবে। মা আপত্তি করলেন না। তার সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এত রাতে রাস্তায় থাকতে সত্যিই মনে মনে তার ভয় হচ্ছিল।
_____
৫২.
লিন্ডা বেশ বন্ধুত্বসুলভ-ভাবেই কথাবার্তা বলছে ভূমিকার সাথে। আমেরিকা, নিজের পরিবার সবকিছু নিয়েই গল্প করছে। এতকিছুর মাঝেও ভূমিকা লিন্ডার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না। মেয়েটা কি আসলেই ভালো? নাকি মনে মনে অন্য কিছু চলছে? এরকম কুটনৈতিক চিন্তা-ভাবনা মন থেকে দূর করতে চাচ্ছে ভূমি। কিন্তু মনের ভেতর একবার সন্দেহ ঢুকে গেলে তা বের করাও দুঃসাধ্য। লিন্ডার মতো সেও চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকার। এক ঘণ্টার কাছাকাছি হয়ে গেছে লিন্ডা বাড়িতে এসেছে। অথচ রাসেলের এখনো বাড়িতে ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই; যেখানে প্রতিদিন সে আরও আগেই বাড়িতে আসে। লিন্ডা বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,’আজ তবে উঠি। তুমি কিন্তু অবশ্যই একদিন আমার বাড়িতে বেড়াতে আসবে।’
ভূমি হেসে বলল,’হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে আজ ডিনার করে গেলেই পারতে।’
‘আজ নয়, অন্য একদিন। বাই।’
‘বাই।’
লিন্ডা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ড্রয়িংরুমে পায়চারি করতে থাকে ভূমি। ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাসেল কোনো কল বা ম্যাসেজ করেছে কী-না। তাকে নিরাশ হতে হয়। একবার নিজেই ফোন করতে চায়। কিন্তু সারপ্রাইজ তো আর থাকবে না তাই ফোন রেখে দেয়। অপেক্ষা করতে থাকে কখন রাসেল ফোন করবে। অপেক্ষা করতে করতে এক সময়ে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। আর তখনই কাঙ্ক্ষিত কলটি আসে। ভূমি পড়িমরি করে কল রিসিভ করে বলে,’হ্যালো, হ্যাঁ, বলো।’
‘ঘুমাচ্ছিলে তুমি?’ রাসেলের কণ্ঠে চিন্তার উদ্রেক। ভূমি হাই তুলে বলল,’হুম। চোখ লেগে এসেছিল।’
‘আ’ম সো স্যরি ভূমি। অফিসের কাজে আজ অনেক লেট হয়ে গেছে। তোমায় যে কল করে জানাবো সেই সুযোগটাও পাইনি। স্নোফলস্ হচ্ছে বাইরে। তাই অফিসেই আটকে গেছি। আজ আর বাড়ি ফিরতে পারব না। তুমি ভালো করে দরজা লক করো ভেতর থেকে। কেউ আসলে দরজা খুলবে না।’
ভূমির মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। মনে হচ্ছে এখনই সব ভেঙেচূড়ে কান্না শুরু করে দেবে। আজই এমনটা হতে হলো? আজ রাসেলের জন্মদিন, আজই অফিসের সমস্ত কাজ জমা হলো। আজই স্নোফলস্ হচ্ছে। মানে কেন? সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। ভূমিকে নিরব থাকতে দেখে রাসেল জিজ্ঞেস করল,’শুনেছ আমি কী বলেছি?’
ভূমি ছোটো করে উত্তর করল,’হু।’
তারপর খট করে কলটা কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করে। ফোনের ম্যাসেজ রিংটোন বেজে ওঠে তখন। রাসেলের ম্যাসেজ,’ভয় পেয়ো না লক্ষী। আর মন খারাপ কোরো না। আমি সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসব।’
ভূমি কোনে রিপ্লাই করল না। চুপচাপ রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সাজানো রুম দেখে তার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। সব সারপ্রাইজ, ইচ্ছে সব বৃথা গেল সব!
_________
৫৩.
নুসরাতদের বাড়িতে এক রাত থেকে পরেরদিন সকালে সবাই মিলে হাসপাতালে যায় জারিফকে দেখতে। সূচনাকে দেখা মাত্রই পূনরায় রাতের ব্যবহার করেন চাচি। অপরাধীর মতো মাথা নত করে থাকে সূচনা। মা চাচাকে জিজ্ঞেস করেন,’জারিফ এখন কেমন আছে ভাইজান?’
‘জারিফের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’ মনমরা হয়ে উত্তর দিলেন চাচা। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন,’আমরা গ্রামে ফিরে যাইতেছি। জারিফের খোঁজ-খবর ফোনে একটু জানাইয়েন।’
চাচা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। থেকে যাওয়ার জন্য কোনো অনুরোধ করেননি। এতে অশান্তি বাড়বে বৈ কমবে না। সূচনা বাবা-মাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে বাইরে যায়। চাচি তখন চাপাস্বরে কঠিনভাবে স্বামীকে বলেন,’ঐ হতচ্ছাড়ি আবার কেন এসেছে এখানে? ওকে তুমি বারণ করে দেবে, আর যেন না আসে।’
‘তোমার সমস্যা কী? সূচনার দোষ কোথায় এখানে? ও কি জারিফকে বলেছিল ওকে গিয়ে নিয়ে আসতে? পান থেকে চুন খসলেই তুমি সূচনার ওপর দোষারোপ করো।’
‘তুমি এখনো ঐ মেয়ের সাফাই গেয়ে যাচ্ছ? তোমার ছেলে মৃত্যুশয্যায়, তোমার একটুও চিন্তা হচ্ছে না?’ কথাটি বলতে বলতে চাচি কেঁদে ফেললেন। চাচা কী বলবে বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করে থাকে। ওদিকে তখন সূচনাও ফিরে আসে। চাচা তখন ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে যায়। জিজ্ঞেস করে,’সকালে কিছু খেয়েছিস?’
নুসরাতের মা অনেক জোড়াজুড়ি করার পরও সে সকালে খায়নি। তবে চাচাকে মিথ্যে করে বলল খেয়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে থেকে চাচা বললেন,’মা, একটা কথা বলি। রাগ করিস না। জানিসই তো তোর ওপর জারিফের মায়ের কত রাগ। তুই বিয়েতে আসিসনি, তাই তোকে আনতে গিয়েই জারিফের এক্সিডেন্ট হয়। এখন তো ওর মায়ের আরও বেশি চক্ষুশূল হয়ে গেছিস তুই। যতবার তুই এখানে আসবি তোকে অপমান করবে, কথা শোনাবে। রাগারাগি করবে। তারচেয়ে বলি কি, তুই আর এখানে আসিস না। আমি ফোনে তোকে জারিফের খবর জানাবো।’
চাচা খুব সুন্দর করে বললেও কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হয় সূচনার। এখন আরও বেশি করে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। তবে সে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে চাচার কথায় সম্মতি জানায়। সময় আর বিলম্ব না করে হোস্টেলে ফিরে আসে। তিনদিন পরে কলেজে একটা পরীক্ষা রয়েছে। এতদিন শুধু জয়ের চিন্তায় সে মরিয়া হয়ে ছিল। এবার জারিফের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষী ভাবার চিন্তাভাবনা যোগ হয়েছে। পড়াশোনায় মন বসছে না। সময় তো আর থেমে থাকে না। সে তার নিজস্ব গতিতেই চলে। একটা দিন এভাবেই কেটে যায়। জারিফের কোনো খবর আর আসেনি। সে নিজে থেকে চাচার ফোনে টেক্সট করেছিল। তারও কোনো প্রত্যুত্তর আসেনি। হয়তো চাচা এখন ব্যস্ত নয়তো জারিফের শোকে রয়েছে তাই খেয়ালই করেনি।
মন কিছুটা ঠান্ডা করতে সে সাথীর ফোন দিয়ে ভূমির সাথে কন্টাক্ট করেছিল রাতে। ইমোতে দুজনে টেক্সটের মাধ্যমে কথা বলেছে। রাসেল সেদিন রাতে বাড়িতে না আসায় এমনিতেই ভূমির মন-মেজাজ ভালো ছিল না। পরবর্তীতে জারিফের এক্সিডেন্টের কথা শুনে আরও বেশি বিমর্ষ হয়ে পড়ে। বিদেশ-বিভূয়ে থাকার দরুণ সে আপনজনদের বিপদে-আপদেও পাশে থাকতে পারছে না। চাচার সাথে অবশ্য বার দুয়েক ফোনে কথা হয়েছিল। সে সূচনাকে বুঝিয়ে বলে,’তুই মন খারাপ করবি না একদম। এখানে তো তোর কোনো দোষ নেই।’
সূচনাও জানে আপাত দৃষ্টিতে তার কোনো দোষ নেই, তবে সবার মুখে এসব কথা শুনে এর প্রভাব তার মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন চাচা কলেজে আসেন। কলেজ থেকে বের হয়ে চাচাকে দেখেই ছুটে আসে সূচনা। তার চোখেমুখে শুধু প্রশ্নের ছড়াছড়ি। চাচা সূচনার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন। সূচনার ভালো লাগে। অন্তত এই মানুষটা তাকে ভুল বোঝেনি। আগের মতোই তিনি সূচনাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। তিনি স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করেন,’ভালো আছিস তুই?’
সূচনা মাথা ঝাঁকায়। যদিও সে এ ক’টা দিন শুধু চিন্তার মধ্যেই ছিল। তিনি পূণরায় জিজ্ঞেস করলেন,’পরীক্ষা ছিল নাকি আজ তোর? কেমন দিলি?’
এবারও সূচনা মাথা ঝাঁকাল। চাচা এবার কোনো রকম ভনিতা করা ছাড়াই বললেন,’গত পরশু রাতে জারিফের জ্ঞান ফিরেছে। তবে এখনো কথা বলতে পারে না। ডাক্তার বলেছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। জারিফ সুস্থ হয়ে যাবে।’
জারিফ সুস্থ হয়ে যাবে শুনে আনন্দে পুলকিত হয় সূচনা। আনন্দিত হাসিটা প্রদান করে চাচাকে। চাচা এবার মলিনমুখে বললেন,’তবে জারিফ আর সাধারণ মানুষের মতো হাঁটতে পারবে না। ওর পায়ের হাঁড় ভেঙে গেছে। এত বড়ো এক্সিডেন্টের পর অপারেশনও করতে হয়েছে। তাই এখন পায়ের অপারেশন করা সম্ভব নয়। আর পা সম্পূর্ণ ঠিক করতে হলে বাইরের দেশে নিয়ে যেতে হবে। ব্যয়-বহুল হবে চিকিৎসার খরচ।’
সূচনার আনন্দে কিছুটা যেন ভাঁটা পড়ল। জারিফ আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না! চাচা বললেন,’ও পুরোপুরি সুস্থ হোক। তারপর বাইরের দেশে নিয়ে যাব।’
সূচনা আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে আল্লাহ্’কে বলল,’তুমি জারিফ ভাইয়াকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দাও আল্লাহ্।’
____
৫৪.
এক্সিডেন্টের পর থেকে সারাদিনই প্রীতি হাসপাতালে থাকে। জারিফকে ছেড়ে সে কোথাও যায় না। এতদিন খাওয়া-দাওয়ারও কোনো ঠিক ছিল না। জারিফের জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখন সে ঠিকমতো খাচ্ছে। মেয়ের এই পাগলামিগুলো লিমিটের বাইরে মনে হচ্ছিল তার বাবা-মায়ের; যখন জানতে পারল জারিফ স্বাভাবিকভাবে আর হাঁটা-চলা করতে পারবে না। তারা বাড়িতে গিয়ে শলাপরামর্শ করে। প্রীতিকে বাড়িতে আসতে বললে সে সাফ সাফ বলে দেয়,’আমি এখন যেতে পারব না আম্মু। এখানে এখন আন্টি আর আমি ছাড়া কেউ নেই।’
মায়ের দ্বিতীয় কোনো কথা আর সে শোনেনি। ফোন রেখে দিয়েছে। এক্সিডেন্টের পর থেকে মা ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে, যা প্রীতির একদমই সহ্য হয় না।
উপায়ন্তরহীন হয়ে প্রীতির বাবা-মা-ই হাসপাতালে আসেন। প্রীতিকে বলেন,’একটু বাইরে আয়।’
সে কথা না বাড়িয়ে বাবা-মায়ের সাথে বাইরে আসে। মা চাপাস্বরে বলেন,’বাড়ি চল।’
‘বাড়িতে যাব না আগেই তো বলেছি।’
‘শোন, নিজের জীবনটা ইচ্ছে করে নষ্ট করিস না।’
‘নিজের জীবন নষ্ট করছি মানে?’
‘জারিফ আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না, এটা জানিস তুই?’
‘সব-ই জানি। আঙ্কেল আমার থেকে কিছু লুকায়নি।’
‘সব জেনে-বুঝে তাহলে এখানে পড়ে আছিস কেন? একটা ল্যাংড়া ছেলেকে বিয়ে করবি তুই?’
প্রীতির মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে। কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছে না বলে, দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার বাবা বললেন,’বাইরে চিকিৎসা করালেও কখনো হাঁটতে পারবে নাকি তারও তো কোনো গ্যারান্টি নেই। এমনও তো হতে পারে, জারিফ যেন পুরোপুরিভাবে মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে না পড়ে, এজন্য ডাক্তার এটা বলে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়েছে। নয়তো এমন কী হয়েছে যে, এ দেশে পা ঠিক করা যাবে না!
প্রীতি এবার আর চুপ থাকতে পারল না। খুব শান্তস্বরেই বলল,’আব্বু, আম্মু জারিফ প্রাণে বেঁচে আছে এতেই আমি খুশি। আগের মতো হাঁটা ব্যতীত সব-ই তো আগের মতো করতে পারবে। ওর একটা খুঁতের জন্য এখন আমি ওকে ছেড়ে দেবো? আমি তোমাদের মেয়ে। তোমরা আমার ভালোটাই চাও, আমি জানি। তবে বিশ্বাস করো জারিফকে ছাড়া আমার অন্য ভালো কিছু লাগবে না। আমার শুধু জারিফকেই লাগবে। আজকে তো ওর জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। তখন তোমরা কী করতে ভাবো তো? যা হোক, এখন যদি জারিফ আর কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে না-ও পারে তাতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি জারিফকেই বিয়ে করব।’
এ কথা বলে সে হাসপাতালে ফিরে আসে। বাবা-মা বাকহীন হয়ে প্রীতির যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রীতি ভেতরে এসে ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করে বলে,’আমি কি একটু জারিফের কাছে যেতে পারি? প্লিজ!’ প্রীতির মুখ থমথমে হয়ে আছে। গলার স্বর কথা বলার সময়ে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল এক্ষুণী বোধ হয় কেঁদে ফেলবে। ওর আকুতিভরা অনুরোধ ডাক্তার ফেলে দিতে পারলেন না। অনুমতি দিলেন ভেতরে যাওয়ার। সে নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে। জারিফ ঘুমিয়ে আছে। সে টুলের ওপর বসে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তার গাল গড়িয়ে পড়তে থাকে নোনাজল। কোমলহাতে আলতো করে জারিফের চুলে হাত বুলিয়ে দেয় সে। জারিফের হাতের ওপর হাত রাখে। ক্রন্দনরত স্বরে স্বগতোক্তি করে বলে,’আমার জীবনের একমাত্র পূর্ণতা শুধুই তুমি জারিফ।’
জারিফ কাঁপা কাঁপা হাতে প্রীতির হাত স্পর্শ করে। প্রীতি তৎক্ষণাৎ চোখের পানি মুছে বলে,’তুমি ঘুমাওনি? ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার এখন ঘুমের প্রয়োজন।’
জারিফ আড়চোখে তাকায় প্রীতির দিকে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। এই পর্বটা গত কয়েকদিনে একটু একটু করে লিখেছি। তাই আজ পোস্ট করে দিলাম।?]