#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৪৪ পর্ব
জীবনের পরিস্থিতি গুলো মানুষকে গড়ে নেয় তার মতো করে। হেরা নিজের পড়াশোনা, নিজের সংসার সব সামলে নিচ্ছে। নওশাদের উৎসাহ তাকে শক্তি দেয় সব কিছুতে। পারুলকে দিয়ে বীথি যে কষ্ট ওর জীবনে দিয়েছে সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে নওশাদের আর নিশালের ভালোবাসা। নিশালকে সে নিজেও অনেক ভালোবাসে। একটা সময় যখন প্রথম বিয়ের পর এই বাসায় এসেছিল নিশালেকে দেখার আগে সে অনেক ভয়ে ভয়ে ছিল ছেলেটা ওকে হয়তো মনে নিতে পারবে না ভেবে। কিন্তু এই নিশাল ওকে এতটা সন্মান, ভালোবাসা দিয়েছে যার কল্পনাও সে করেনি। আজ তার মনে হয় তার জীবনে নওশাদের পর পরম পাওয়া হলো নিশাল।
বীথির সঙ্গে ঐ ঘটনার পর নিশাল বীথির সঙ্গে কোন যোগাযোগ করে না। হঠাৎ হঠাৎ ওর খুব খারাপ লাগে কারন বীথির নিশালের প্রতি ভালোবাসা টাতে তো কোন খাদ ছিল না। বীথির সঙ্গে সম্পর্ক টা নিশালের রাখলে তো সমস্যা নেই। একদিন এই কথাটা সে নওশাদের সামনেও তুলেছিল। নওশাদ কিছুক্ষণ খুব গম্ভীর হয়ে থেকে বলল, হেরা বেইমানি কখনো দূরের মানুষ করে না বেইমানি করে সব সময় কাছের মানুষ। আর কাছের মানুষদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারিনা। তাদের এরকম আচরণের কোন ক্ষমাও করতে পারি না। তুমি আশাকরি আমাকে এরকম কোন অনুরোধ করবে না যা আমি রাখতে পারব না।
সেদিনের পর থেকে হেরা বীথির প্রসঙ্গ আর তুলে না।
আজ প্রায় সাত আট মাস হয়েছে বীথি এই ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন। তবে যুথীর সঙ্গে নিশালের যোগাযোগ আছে। ছুটিতে আসলে নিশাল যায় যুথীকে দেখতে নিশালও যথাসম্ভব যোগাযোগ রাখে যুথীর সঙ্গে। যুথী ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয় নিশালের নওশাদের। মাঝে যুথীর অসুস্থ শ্বাশুড়ি মারা গেছে হেরা আর নওশাদ গিয়েছিল তখন। নওশাদ যত ব্যস্তই থাকুক আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ, বেদনায় পাশে থাকার চেষ্টা করে। আগে পারতো না । কিন্তু গীতি মারা যাওয়ার পর সে নিজেই সব দ্বায়িত্ব পালন করে।
যুথীর বাসায় হেরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বীথির, হেরাই নিজের থেকে খোঁজ খবর নিলো। নিশালের কথা বলল। সামনে নিশালের পরীক্ষা সেটাও বলল। হেরার মায়া লাগে নিজের ভুলে কত সুন্দর একটা সম্পর্ক নষ্ট করলো বীথি।
সেদিনই হেরা নওশাদকে বলেছিল বীথির কথা তখনই নওশাদ বলেছে দরকার নেই দূরত্বই ওর উপযুক্ত শাস্তি। তারপর হেরা আর কখনো এই প্রসঙ্গ তুলে নাই।
নাহিন, এলিন বীথি পারুলকে দিয়ে যে জঘন্য কাজ করিয়েছে জানার পর হেরার সঙ্গে অনেক রাগ হয়েছে। বারবার বলেছে , বৌমনি তোমাকে অনেক আগেই বলেছিলাম বীথিকে শিক্ষা দেই একটা, তখন রাজি হলে না । তখন আমাদের কথা শুনলে তাহলে এত বড় দূর্ঘটনা টা ঘটতো না তোমার সঙ্গে।
হেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না ।
বীথি আর নিশালের যা সম্পর্ক সে জন্যেই হেরা নাহিন, এলিনদের ওসব শিক্ষা দেয়ার বুদ্ধিতে যায় নাই। পরে উল্টো পাল্টা কিছু ঘটলে নিশালের সঙ্গে ওর সুন্দর সম্পর্ক টার কি হতো। এটা তো সত্য ওর আর নিশালের সম্পর্ক টা একটা নাজুক সম্পর্ক এই সম্পর্কের মধ্যে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি তাই হেরা কোন রিস্ক নেয়নি কখনো।
হয়তো সে জন্যেই আজ ওদের সম্পর্কটা সুন্দর, সহজ।
তবে হেরা ইদানিং খুব ফীল করে এলিন, নাহিন যদি এই বাসায় না থাকতো তাহলে ওর অনেক কষ্ট হতো। এখানে আসার কিছুদিন পর ওরা এই বাসায় এসেছে ওদের সঙ্গে থেকে কত কিছু শিখেছে । সত্যি বলতে গেলে ওরা ওকে বাহিরের জগতের সঙ্গে মিশতে সহজ করে দিয়েছে। ভার্সিটিতে ওরাই তো ওর সঙ্গে থেকে সবার সঙ্গে মেলামেশা করাটা স্বাভাবিক করে তুলেছে। তা না হলে ও কত গুটিয়ে থাকতো।
এত বড় বাসায় সারাদিন ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে ওর ভালো লাগে। নওশাদ যখন দেশের বাহিরে যায় সব সময় তো আর ও যেতে পারে না ক্লাস থাকে পরীক্ষা থাকে সেই সময়টা এই দুই বোনের সঙ্গে থাকলে ওর খারাপ লাগে না।
কিন্তু প্রায় সময় যখন ওর মনে হয় ওদের বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে চলে এলেই তো ওরা চলে যাবে নিজের বাসায়, তখন ওর খুব খারাপ লাগবে।
মাঝখানে ওরা দুই বোন শোয়েবের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিল । হেরাকেও সঙ্গে নেয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করেছে কিন্তু হেরার ইচ্ছে করেনি।
শোয়েব ও বলল মামি আপনি যান সঙ্গে আমার ছোটবোন আর এই ভাগ্নিরা কতটুকু আর বুঝবে বলেন ?
হেরা হাসতে হাসতে বলেছে, ওদের থেকে আমার বুদ্ধি, স্মার্টনেস কম তাই আমার চেয়ে ওরা অনেক ভালো পরখ করতে পারবে।
মেয়ে পছন্দ হওয়ার পরেও কেন জানি আর বিয়েটা হলো না ওখানে। তারপর থেকে এলিন, নাহিন আক্ষেপ করে বলে তাদের মামা আসলে খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখানো হয় কিন্তু সব শেষে এসে মামা রিজেক্ট করে দেয়। কি যে চায় আল্লাহ্ জানে ?
দুপুরে খেয়ে হেরা আজ চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। গতকাল তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ বাসায় ছিল তাই রান্না করেছে। নওশাদের জন্য লাঞ্চ পাঠিয়েছে। তারপর শ্বশুরের সঙ্গে বসে লাঞ্চ করেছে। শ্বশুরের শরীর আজকাল খারাপ যাচ্ছে। হেরা খাওয়ার সময় কাছে থাকে । ইদানিং অল্পতেই ঠান্ডা লেগে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে উনার।
মাঝে নওশাদ গিয়েছিল ফিলিপাইন তখন একদিন রাতে শ্বশুর অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল ,হেরা দুই দেবর কে খবর দিলো সবাই ছুটে এলো তারপর বাসায় ই অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা করে ফারহান দুই দিন পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি।
আজকে হেরাকে খাওয়ার সময় বলল, বৌমা বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে তোমার শ্বাশুড়ি থাকলে বাড়িটা এত খালি লাগে না।
হেরা মাছের কাঁটা বেছে দিতে দিতে বলল, আব্বা আম্মার কথা মনে পড়ছে আপনার?
তার কথা তো সব সময়ই মনে পড়ে অনেক দজ্জাল মহিলা ছিলেন তাকে ভুলা যায় না।
আব্বা কি যে বলেন আম্মার গল্প শুনেছি মোটেও দজ্জাল ছিলেন না অসুস্থ থাকতেন আর দজ্জাল হলে আপনি এত মিস করতেন না ! হেরা হাসতে হাসতে বলল।
ঐ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থেকেই আমার সঙ্গে ঝগড়া করতো তুমি জানো না। আমি অনেক ভয় পেতাম।
হেরা হাসছে শ্বশুরের কথা শুনে।
তুমি তো তোমার শ্বাশুড়ি কে দেখোনি বাবু দেখতে ওর মায়ের মত।
জ্বী আব্বা ছবি দেখেছি আম্মার।
হেরা সব সময় শ্বশুর যখন শ্বাশুড়ির গল্প করেন সেটা খুব উপভোগ করে।
হঠাৎ আনারের মা এসে ঘরে ঢুকল । আম্মা কি করেন একলা একলা ?
কিছু না এমনি বসে আছি । আচ্ছা আনারের মা রানু কেমন কাজ করছে বলো ?
আম্মা আইলো তো মাত্র দেখাযাক কি কতটা করতে পারে।
পারুল যাওয়ার পর আনারের মায়ের উপর কাজের চাপ বেশি পড়ে গিয়েছিল। তাই গ্রামের বাড়ি থেকে একটা নতুন মেয়ে আনা হয়েছে। এই রানুর মা আগে এই বাসায় কাজ করেছে তার বাচ্চা রা ছোট তাই বেশিদিন থাকে নাই তখন ।
মেয়েটা কাজে ভালোই কিন্তু খুব টিভি পাগল। এটা নিয়ে আনারের মায়ের সঙ্গে মতের অমিল হচ্ছে।
আম্মা পারুলের সাহস বেশি আমি জানতাম কিন্তু এত সাহস হইব কোন দিন বুঝি নাই, আনারের মা হেরার পায়ের কাছে রাখা কাঠের ছোট টুলে বসে বলল !
পারুলের কথা বাদ দাও ঐ প্রসঙ্গ আবার আসছে কেন, ও সাহস কোথা থেকে পেয়েছে সেটা তো জানোই তুমি।
আম্মা একটা কথা কই কিছু মনে করিয়েন না !
কি কথা ?
আগের আম্মা মারা যাওয়ার পর বীথি খালাম্মার কি ইচ্ছা ছিল ঐদিন তো শুনলেন । স্যাররে জন্য পাগল হেয়ে গেছিল ! স্যার কোন দিন তার দিকে তাকায়ও নাই। আমি এই বাড়িতে আজ এত বছর সব দেখি তো । আপনে তো এখন সব শুনলেন আমি সব বুঝতাম, দেখতাম কিন্তু চুপ কইরা থাকতাম। ভাইয়ার জন্য খালাম্মা দিনের পর দিন এই বাসায় থাকতো না , খালাম্মা থাকতো স্যাররে দেখার জন্য। স্যার আম্মার জন্য মন খারাপ করে থাকতো খালাম্মা শুধু বলতো আর কত দিন এভাবে থাকব দুলাভাই?
স্যার রাতে আসলে একা খাইতে ই আরাম পাইতো কিন্তু খালাম্মা অপেক্ষা করতো স্যার খুব বিরক্ত হইতো। খাওয়ার সময় খালাম্মা আমাদের কাউরে টেবিলের কাছে থাকতে দিতো না আবার স্যার ডাকতো খাওয়া দিয়ে চলে যাও কেন আনারের মা ?
খালাম্মা কইতো আমাকে বলেন দুলাভাই কি লাগবে?
স্যার কইতো যার কাজ তাকে করতে দাও।
স্যার উনার এই গায়ে পড়া কথা বার্তা র জন্য খুব ত্যক্ত হইতো কিন্তু কিছু কইতো না ।
তুমি সব জানতে আমি জানি আনারের মা ।
কি করমু কন আম্মা চোখ কান বন্ধ কইরা তো হাঁটাচলা করা যায় না। তয় মুখ বন্ধ কইরা থাকা যায় ।
হেরা তাকিয়ে বলল, বাহ্ দারুন কথা বললে তো ,মুখ বন্ধ কইরা থাকা যায় !
আম্মা মুখ বন্ধ কইরা না থাকলে উপায় আছে কন ? তারা হইলো আত্মীয় মানুষ স্যারের।
তোমার একটা জিনিস আমার ভালো লেগেছে আনারের মা বীথি আপুর কথা তুমি আমাকে আগ বাড়িয়ে আগে বলোনি । তুমি চাইলেই আমি এই বাড়িতে আসার পরেই বলতে পারতে । বললেই বা কি হতো ?
আম্মা যে ঘটনা পার হইয়া গেছে আপনে আসার বহু আগে তা আপনেরে কইয়া আমার কি লাভ হইতো কন ?
সেটাই ,কথা টা ভালো লাগলো আনারের মা । এই বাড়িতে তুমি, আর এলিন, নাহিন ছিলে বলে আমি কত কিছু যে শিখতে পেরেছি জানো।
আম্মা আমি মুর্খ মানুষ আমি কি শিখামু আফনারে কন !
পৃথিবীতে কার কাছ থেকে কখন কি শিখা যায় এইটা কে জানে বলো ?
আনারের মা হাসছে হেরার কথা শুনে।
অনেক দিন পর নওশাদ রাতের বেলা হেরার সঙ্গে বারান্দায় এসে বসেছে। হেরার পরীক্ষা আর নওশাদ দেশের বাহিরে থাকার জন্য নিজেরা বসে যে একটু গল্প করবে সেটাও হয়ে উঠেনি।
হেরা বারান্দায় গোলাপের কিছু গাছ লাগিয়েছিল নওশাদ বিরক্ত হয়েছিল মনে মনে শুধু শুধু গাছ গুলো লাগিয়েছে ফুল টুল কিছুই হবে না। কিন্তু আজ বেশ কিছু দিন পর বারান্দায় এসে দেখে সত্যি ছাদ ভরে আছে গোলাপে। নওশাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
হেরা কফির মগ হাতে পাশে এসে বসতেই নওশাদ বলে উঠলো, তুমি তো দারুন কাজ করেছো ছাদটাকে তো সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছো ! গোলাপ গুলো দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।
হেরা হেসে বলল, আমি কিছুই করিনি যা করার নতুন মালি করেছে। লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে কাজটা করে। আসলে ফুল নিয়ে আমার ও খুব একটা আগ্রহ ছিল না কিন্তু লোকটা এত যত্ন নিয়ে সব করছে দেখেই ভালো লাগে। পিছনের লনের খুব সুন্দর ফুল ফুটেছে একবার গিয়ে দেখবেন।
আজ বাসা এত খালি কেন হেরা ?
দুই বোন ওদের নানু বাসায় গেছে ওখানে ওদের আত্মীয় স্বজনদের কোন গেট টুগেদার আছে। জানেন আজকে আমার কি মনে হচ্ছিল?
কি?
এই দুই বোন যদি এই বাসায় না থাকতো আমি সত্যি খুব একা হয়ে যেতাম।
আমি সেজন্যই তো ওরা থাকবে শুনে খুশি হয়ে ছিলাম। একটা নতুন পরিবেশে তুমি এসেছিলে সমবয়সী দুজন মানুষ থাকলে ভালো লাগবে ভেবেছিলাম এবং তোমরা দারুন আছো সেই থেকে।
ওদের কাছে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ ওরা আমাকে চলতে ফিরতে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ওরা যদি এ যুগের ওভার স্মার্ট মেয়েদের মত হতো, অস্থির মানসিকতার হতো তাহলে তো আমার বউকে সেরকমই বানিয়ে ফেলতো । তাহলে আমার কি অবস্থা হতো নওশাদ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল ?
হেরা হেসে দিলো সত্যি ই কি ওদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা নেই ? আপনি জানেন না ওরা কতটা অস্থির কিন্তু আমি মনে হয় বেশি বুঝদার তাই অস্থিরতা গুলো না নিয়ে ভালো বোধ গুলোই বেছে নিয়েছি ।
তাই কেমন অস্থির ওরা ?
বাদ দিন ! হেরা হেসে বলল।
নওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, শুনি না কেমন অস্থির ?
এই ধরুন ওরা বীথি আপুর বিষয়টা নিয়ে আমাকে আগে থেকেই খুব প্রেসার দিতো ভাইয়া কে বলো দাও বৌমনি, তুমি উত্তর দাও না কেন? এই করো তাহলে আচ্ছা জবাব দেয়া হবে এসব বলতো ।এটা অস্থিরতা নয় ? তারপর যখন যা খুশি করছে !
নওশাদ হাসলো শুধু তারপর বলল, তুমি তোমার মত থাকো তাহলেই হবে।
আমি আমার মতোই আছি।
আজ বাসায় ফিরে মনে হলো তুমি কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় ডুবে আছো হেরা ?
হেরা উঠে এসে নওশাদের ঘাড়ে জড়িয়ে ধরলো তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাইছি কিন্তু আমি চাই কথাটা আপাতত আমার আর আপনার মাঝেই থাকুক আপনি কারো কাছে বলবেন না ।
নওশাদ খুব অবাক হলো ! কি কথা হেরা ?
হেরা ফিসফিস করে বলল, আমার মনে হচ্ছে আমি কনসিভ করেছি ।
নওশাদ ঘাড় ঘুরিয়ে হেরার দিকে তাকালো , শিওর হেরা ?
আমার মন বলছে ।
মন বললে তো হবে না শরীর কি বলছে সেটা বুঝতে হবে ।
সব মিলিয়ে আমার ধারণা ঘটনা সত্যি ঘটেছে ।
চলো তাহলে ডাক্তারের কাছে যাই ।
আর কয়েকটা দিন যাক তারপর যাই । আপনি কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না।
কাউকে কিছু না জানানোর পিছনে কারণ কি হেরা ? তুমি কি আবার ভাবছো কেউ তোমার ক্ষতি করবে?
না সেরকম কিছু না ,আমার খুব ভয় হচ্ছে সবাই জানবে আবার যদি খারাপ কিছু হয় তখন আবার সবাই মন খারাপ করবে আমাকে স্বান্তনা দিবে আমার তখন অনেক কষ্ট হয়।
নওশাদ হেরাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, কিছু হবে না এবার । ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকবে । ঠিক আছে আমি কাউকে কিছু বলব না কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ তো নেয়া উচিত মিলার সঙ্গে কথা বলো ।
আমি ভাবির কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়ে ছিলাম কেমন সতর্কতা নিয়ে চলতে হবে । এই মাসটা সেভাবেই থাকি তারপর ডাক্তারের কাছে যাব।
ঠিক আছে।
নওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, আমার মনটা কোন কারণ ছাড়াই খুব খারাপ ছিল আজ তুমি এত খুশির একটা খবর দিলে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছে হেরা।
আমি সারাদিন বসে চিন্তা করলাম কাউকে বলব না এখন আমরা।
আচ্ছা তোমার কথাই মেনে নিলাম কেউ জানবে না।
হেরা নওশাদকে ছাড়া এই খবর আর কাউকে বলেনি। এমনকি এলিন, নাহিনকেও না। খুব সাবধানে হাঁটাচলা করছে। ক্লাস ছাড়া বাসার বাহিরে যাচ্ছে না। এমনকি সিঁড়ি পর্যন্ত উঠানামা কমিয়ে দিয়েছে। নাহিনরা দুই বোন সেমিষ্টার ফাইনাল দিয়ে ওদের বাবা-মা সহ দেশের বাহিরে ঘুরতে গিয়েছিল এসেই কোন আত্মীয়ের বিয়েতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই ওদের চোখে পড়েনি হেরার হঠাৎ করে সংকুচিত দৈনন্দিন জীবন।
শুধু আনারের মা একদিন বলেই ফেলল, আম্মা আপনার কি খবর আছে কিছু ?
হেরা আনারের মায়ের হাত ধরে বলল তুমি আমার জন্য দোয়া করো আর আমি চাইছি না কেউ জানুক এখুনি ।
আনারের মায়ের চোখের কোন ভিজে উঠলো আম্মা আমি আল্লাহর কাছে খুব দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন আপনার কোল তাড়াতাড়ি ভইরা দেয়। আল্লাহ আমার ডাক শুনছে আমি খুব খুশি। আপনে চিন্তা কইরেন না আমি কাউরে কমু না। আমি ঐদিন দেখলাম স্যার আপনারে ধইরা ধইরা সিঁড়ি দিয়া তুলে তখনই মনডা কইলো এই কথা। আল্লাহ ভরসা আম্মা চিন্তা কইরেন না সব ঠিক থাকব । কারো খারাপ নজর লাগব না।
হেরার চোখ ও ভিজে উঠেছে।
হেরার কনসিভ করার কথা শুনে নওশাদ যথেষ্ট চিন্তিত। গত এক মাস ধরে অনেক চিন্তা করে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কথাটা হেরাকে সে বলেনি । কিভাবে বললে হেরা সহজ ভাবে বুঝবে সেটাই চিন্তা করছে।
সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে তাকিয়ে দেখে হেরা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মুখ দেখেই বুঝেছে খুব টেনশনে আছে ।
নওশাদ উঠে মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করলো খারাপ লাগছে তোমার?
শরীর ঠিক আছে কিন্তু মনটা খারাপ লাগছে ।
কেন?
আজ সকালে যখন আপনি চলে গেলেন তখনই এত একা লাগা শুরু হলো তারপর থেকে কিছুই ভালো লাগছিলো না।
এখন তো আমি সঙ্গে আছি তাহলে কেন খারাপ লাগছে তোমার?
না ভাবছি আপনি দেশের বাহিরে গেলে কিভাবে থাকব ? এই নয় মাসে আপনি বাহিরে তো অবশ্যই যাবেন কাজ তো ফেলে রাখতে পারবেন না তাই না তাহলে ?
নওশাদ হেরাকে কাছে টেনে বলেছে আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু তারপর থেকে নওশাদ খুব টেনশন করছে কারণ এলিন, নাহিনের বাবার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে ওরাও ওদের বাসায় চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে । হেরা এই নাজুক শারীরিক মানসিক অবস্থায় সারাদিন বাসায় থাকবে কিভাবে একা !
বুবুকে এই মুহূর্তে দেশেও আনা যাবে না কারণ দুলাভাই পায়ে ব্যথা পেয়েছে বুবু এখন কিভাবে আসবে ? সব কিছু চিন্তা করে নওশাদ অস্থির কয়েকদিন থেকে।
কয়েকদিন হয়েছে সবাই জেনেছে খবর টা। নিশালকে বলা হয়েছে, ওর এখন পরীক্ষা চলছে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে ওকে চলে আসতে হবে বাসায়।
সব মিলিয়ে নওশাদ ডিসিশন নিয়েছে হেরাকে বুবুর কাছে ফ্লোরিডায় রেখে আসবে। ওর আর নিশালের ভিসা করাই আছে । সে একা হেরার খেয়াল রাখতে পারবে না। ইদানিং তার কাজের চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা খালি একটা বাসায় রেখে সারাদিন অফিসে কিংবা কখনও কখনও ঢাকার বাহিরে, দেশের বাহিরে টেনশন ফ্রি হয়ে থাকতে পারবে না সে। হেরার ও মানুষের মাঝে থাকলে ভালো লাগবে। তাই সবচেয়ে ভালো হয় বুবুর ওখানে গিয়ে থাকলে। বুবুও বলল, তুই শুধু নিয়ে আয় ওকে বাকি দ্বায়িত্ব আমার।
শুধু এই দীর্ঘ সময় ফ্লাইটে জার্নি করার উপযোগী সময় এলেই নওশাদ হেরাকে নিয়ে বুবুর কাছে দিয়ে আসবে। নিশালের পরীক্ষা শেষ থাকবে ততদিনে, তখন নিশালও যেতে পারবে তার মামনির সঙ্গে।
কিন্তু এই কথাটা হেরাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ওকে মন থেকে রাজি করাতে হবে। সে জানে সে বললেই হেরা কোন কথা বলবে না যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে কিন্তু নওশাদ চায় হেরা মন থেকে রাজি হোক। কোন রকম কষ্ট মনে নিয়ে হেরা ওর সঙ্গে এই দীর্ঘ সময়ের দূরত্ব টা মেনে নিক এটা সে চায় না ।সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় সে রাজি হোক এটাই সে চায়।
হেরাকে বোঝানোর আগে নিজেকেই বোঝাতে তার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে।
দিন গুলো কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল তাই না? একটা সময় সে মেয়েটিকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তীব্র দ্বিধায় ভুগেছে আজ সেই মানুষটাকে কিছুদিনের জন্য নিজের থেকে দূরে করতে কত কষ্ট হচ্ছে । মনে হচ্ছে চারপাশ টা সত্যিই অনেক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দিন গুলো ওর কাটবে কিভাবে?
বাসায় ফিরে খালি ঘরে কিভাবে সে থাকবে? বাসাটা আগের মত চুপচাপ হয়ে যাবে। অফিস থেকে ফিরে হেরার হাসি মুখটা দেখে স্বস্তি পাওয়া একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল গত দুটো বছরে, কিন্তু কয়েক মাসের জন্য দূরে থাকাটা এখন এত কষ্টের এত যন্ত্রণার হবে নওশাদ ভেবেই শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে হাসি মুখে কাজটা করতে হবে । হেরার জন্য ওদের অনাগত সন্তানের ভালোর জন্য।
( চলবে)