তবু সুর ফিরে আসে পর্ব-৩৪

0
1630

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৩৪ পর্ব

হেরা বিমোহিত হয়ে নতুন এক জগৎ দেখছে ! কত রঙ্গ বেরঙের কাপড় পড়ে কত শত তরুণ মুখ। তাদের এক একজনের মুখে একেক অভিব্যক্তি। দল বেঁধে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও দুই তিন জন মিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও আবার জুটি বসে নিজেদের মধ্যে গল্পে মগ্ন। যাদের ক্লাস আছে তারা ক্লাসে ব্যস্ত। আজ হেরাদের জন্য ছিল রিফ্রেশ পার্টি । গান বাজছে । পুরো ক্যাম্পাস টা মনে হচ্ছে আনন্দে ভরা। হেরার খুব ভালো লাগছে সব কিছু দেখে।
হেরার দুজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওদের বাসা ঢাকার বাহিরে এখানে বাসা ভাড়া করে আরো মেয়েদের সঙ্গে থাকবে।
হেরার বেশি ভালো লাগছে এলিনের বান্ধবী দের ওরা খুব হাসিখুশি আর দাপুটে । ছেলেদের বকা দিচ্ছে, ধমক দিচ্ছে। হেরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ওদের।
মোবাইলে রিং হতেই তাকিয়ে দেখে ন‌ওশাদের ফোন ।
হ্যালো।
কি করছো ?
এলিনের সঙ্গে ক্যাফেতে বসে আছি ।
কেমন লাগছে ভার্সিটি ?
ভালো।
ভয় কমেছে আমার কাঠবিড়ালীর ?
হুম ,হাসলো হেরা ।
খেয়েছো কিছু ?
কফি খেয়েছি ।
বাসায় গিয়ে আমাকে ফোন দিও।
ঠিক আছে।
রাখলাম সাবধানে থেকো।
হুঁ।
হেরা ফোন রেখে আবার এলিনের পাশে এসে বসলো। বৌমনি আমার আজ আর ক্লাস নেই চলো একটু শপিং করব ।
তুমি যাও আমি বাসায় ফিরব ।
আরে চলো তো ভালো লাগবে তোমার ।
তোমার ভাইয়াকে বলি নাই এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না।
ইস তুমি এত ভেবো না তো খুব মজা হবে দেখো । বেশিক্ষণ লাগবে না একটা সাদা ওড়না কিনব পছন্দ করাই আছে যাব আর আসব ।
ঠিক আছে চলো। কিন্তু বেশি সময় লাগাতে পারবে না কিন্তু।
হেরা ন‌ওশাদ কে এস‌এম‌এস পাঠিয়ে এলিন,নাহিন আর ওদের ফ্রেন্ডদের সঙ্গে শপিং চলে গেল। আজকে হেরার অনুরোধে ওকে দুইবোন বৌমনিই ডাকলো সবার সামনে এবং হেরার আসল পরিচয়েই পরিচিত করলো।

এলিন গিয়ে তো ছিল একটা সাদা ওড়না কিনতে প্রায় দুই ঘণ্টা ও আর ওর ফ্রেন্ড রা ঘুরাঘুরি করলো এই দোকান সেই দোকান । তারপর হাবিজাবি এক গাদা জিনিস কিনলো । কেউ বয় ফ্রেন্ডের জন্য গিফট কিনলো। কেউ ছোটবোনের জন্মদিনের গিফট । তবে ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হেরা এই প্রথম ন‌ওশাদের জন্য একটা শার্ট পছন্দ করে কিনে ফেলল। নাহিন ওকে খুব সাহায্য করল ,সেই নিয়ে গেল ভালো ব্র্যান্ডের শার্ট কিনতে। হেরা এই প্রথম ন‌ওশাদ কে কিছু একটা উপহার দিবে ও খুব এক্সাইটেড। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটা শার্ট সে কিনেছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে উনার পছন্দের কাছে পৌঁছবে তো শার্ট টা?
বাসায় ফিরতে ওদের দুপুর পার হয়ে গেল।
এক দিনেই হেরা অনেক ক্লান্ত এসেই বিছানায় এলিয়ে পড়লো।
ন‌ওশাদ বাসায় ফিরে ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল যখন, তখন রাত প্রায় আটটা!
কি ব্যাপার ড্রেস চেঞ্জ না করেই ঘুমাচ্ছো যে ?
খুব ক্লান্ত লাগছে।
প্রথম দিন ভার্সিটিতে গিয়েই ,নাকি শপিং করে ?
শপিং মলে হেঁটে হেঁটে। ওরা কেনাকাটার চেয়ে বেশি ঘুরে । আমি ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
ন‌ওশাদ হেরার কপালে হাত রাখলো। মেয়েরা তো এই কাজ‌ই করে যতনা শপিং করে তারচেয়ে দ্বিগুণ ঘুরে। খেয়েছিলে কিছু নাকি শুধু ঘুরেছো ?
খেয়েছি । আজ একটা দারুন জিনিস খেয়েছি !
কি ফুচকা ? মেয়েদের তো দারুন জিনিস মানেই ফুচকা ।
না ভেলপুরি ! দারুন ঝাল টক খুব মজার।
এটা কি জিনিস ?
আপনি খাননি কখনো ?
না । কোথায় পাওয়া যায় ?
রাস্তার পাশে মামা রা বানায় ! আমি এই প্রথম খেলাম । আপনি সত্যি খাননি ?
আমি রাস্তার পাশে থেকে কিছু খাই না হেরা ! আই মীন খাওয়ার সুযোগ হয় না এখন। স্টুডেন্ট লাইফে খেয়েছি । কিন্তু তখন ভেলপুরি নামের কিছু খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না !
একদিন চলেন আমি আর আপনি খাব । হেরা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ন‌ওশাদের দিকে ।
ঠিক আছে খাব যাও। এখন উঠো ড্রেস চেঞ্জ করো ডিনার করি ।
হেরা গোসল করে বের হয়ে দেখে ন‌ওশাদ ফোনে কথা বলছে।
কথা শুনেই বুঝেছে রেজোয়ান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে।
পাঁচ সাত মিনিট পর ন‌ওশাদ কথা শেষ করতেই হেরা শার্টের বক্সটা নিজের পিছনে লুকিয়ে ন‌ওশাদের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
চোখ বন্ধ করুন তো ।
কেন?
আমি বলছি তাই ।
ঠিক আছে করলাম ।
না চিটিং করলে হবে না প্রোপার বন্ধ করে রাখতে হবে ।
ঠিক আছে। এই যে বন্ধ করলাম।
হেরা এক হাত দিয়ে ন‌ওশাদের চোখ ধরলো । তারপর বক্সটা ন‌ওশাদের হাতে তুলে দিলো।
এখন খুলুন।
কি এতে ?
আপনার জন্য এই প্রথম একটা গিফট কিনলাম। ন‌ওশাদ অবাক হয়ে দেখে হেরা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে ওকে দেখছে।
বক্স থেকে বের করলো একটা হালকা আইস ব্লু কালারের পার্ক এভিনিউ ফরমাল শার্ট । শার্টটা হাতে নিয়ে ন‌ওশাদ হাসছে । আজকে কিনেছো ?
হুঁ।
পছন্দ হয়নি তাই না ? আমি কি আর বুঝি আপনার পছন্দ কেমন নাহিন আমাকে একটা বড় দোকানে নিয়ে গেল সেখান থেকে পছন্দ করলাম। শুধু মাপটা আনারের মা কে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ও আপনার শার্ট দেখে বলল।
ন‌ওশাদ হো হো করে হাসছে , এত হুলুস্থুল করতে হলো !
পছন্দ হয়নি তাই না ? হেরা মুখটা অন্ধকার করে ফেললো।
এই মেয়ে মুখ কালো করছো কেন আমি কি বলেছি পছন্দ হয়নি ? খুব সুন্দর হয়েছে । কালারটা খুব সোবার ।
হাসছেন তো আপনি !
ন‌ওশাদ হেরার ঘাড়ে হাত রাখলো ,হাসছি দোকান থেকে আনানের মা কে ফোন দিয়ে শার্টের মাপ জেনেছো সেই জন্য ।
হ্যা ওকে বললাম আলমারি থেকে শার্ট বের করে কলারের কাছে কি লিখা আছে বলো । ও বলতেই পারছে না তারপর আনারের মা শার্ট আব্বার কাছে নিয়ে গেল আব্বা দেখে বলল ।
এক শার্টের জন্য কত মানুষ কষ্ট করলো সেই শার্ট ভালো না হয়ে কোথায় যাবে ! আমার খুব পছন্দ হয়েছে হেরা থ্যাংকস। ন‌ওশাদ শার্ট টা খুলে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলল।
দেখো অনেক ভালো লাগছে , আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ন‌ওশাদ বলল।
হেরা তাকিয়ে দেখছে ন‌ওশাদকে সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে শার্ট টা পড়ে।
আপনি তো মাসাআল্লাহ সব সময়ই সুন্দর , হ্যান্ডসাম !
তাই বুঝি ?
এমন ভাবে বলছেন যেন কেউ আগে বলেনি আপনাকে !
তুমি তো এই প্রথম বললে সে জন্যই শুনতে ভালো লাগছে ।
আমি প্রথম দিন থেকেই আপনাকে যখন দেখি মুগ্ধ হয়েই দেখি ।
আমি মাঝ বয়সী একজন মানুষ কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই ।
আপনি সবকিছু দিয়ে মুগ্ধ করেন , আপনার ব্যক্তিত্ব দিয়ে, ভালোমানুষী দিয়ে, আপনার ক্ষমতা দিয়ে , আপনার রূপ দিয়ে । আপনার সবকিছুতেই মুগ্ধতা আমার ! আর আমি তো শুনেছি কত সেলিব্রিটি থেকে নামীদামী রমনীরা মি: আজমী আপনার সবকিছু তেই মুগ্ধ হয়ে থাকে হেরা মুচকি হেসে বলল।
তাই তোমাকে সুমনা বলল আর তুমিও বিশ্বাস করে বসে আছো ! চুল পাকা দাঁড়ি পাকা বুড়ো আমি আমার জন্য ওরা কেউ পাগল না বুঝলে ওরা পাগল স্ট্যাটাস, পজিশন , ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট এসবের জন্য। তাই আজ আমি কালকে অন্য কারো জন্য হবে পাগল । ন‌ওশাদ গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে বলল , ম্যাডাম ভারী মানিব্যাগ দেখলে ওদের কাছে লাইট নিভিয়ে দিলে সব পুরুষ মানুষ ই এক।
ছিঃ কি বলছেন এসব আপনি !
হুম ঠিক কথাই বলেছি তুমি তো জানো না সুন্দর সুন্দর মুখের আড়ালে কত রূপ একেক জনের। বাদ দাও ওসব কথা , এখন বলো
তোমার ভার্সিটির প্রথম দিন কেমন গেল সেটা বলো ।
ভালো ।
ফ্রেন্ড হয়েছে ?
না প্রথম দিনেই কি ফ্রেন্ড হয়ে যায় নাকি ?
হুঁ হ‌ওয়ার তো কথা ।
আমার হয়নি । আসলে আমি খুব একটা তাড়াতাড়ি বন্ধু বানাতে পারি না ।
কারণ তুমি খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকো তাই। বন্ধু বানাতে হয় মন খুলে ।
কমফোর্ট জোন যেখানে সেখানেই আমার বন্ধুত্ব। আর আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু মনে হয় কাকে জানেন ?
কাকে ?
হেরা পেছন থেকে ন‌ওশাদ কে জড়িয়ে ধরলো , আপনাকে । আপনার সঙ্গে সব বলতে, ঘুরতে , আপনার আশেপাশে থাকতে খুব ভালো লাগে।
সত্যি ! থ্যাংকস তোমার বন্ধু হতে পেরে ভালো লাগছে। এখন চলো ডিনার করি হেরা । তোমার ক্লাস কবে থেকে?
আগামীকাল থেকে।
ও নিশাল ফোন দিয়েছিল আগামী সপ্তাহে আসবে।
তাই !
ও আসলে আমরা ঘুরতে যাব । ওর এবার লম্বা ছুটি থাকবে । আমি পুরো সময়টা আমার ছেলের সঙ্গে কাটাব ! খুব এনজয় করবো আমরা কেমন।
জ্বি।

হেরার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে । সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা টা করছে। এত রিল্যাক্স ভাবে আগে কোন দিন পড়াশোনা সে করতে পারেনি। ছোট থেকেই স্কুলে, কলেজে যাওয়ার আগে বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে তারপর যেতে হতো তাকে। পড়াশোনা করার আগে মামিদের সব কাজ করে দিতে হতো। আর এখন শুধু পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। ন‌ওশাদ তাকে পড়তে খুব উৎসাহ দেয়। হেরার সিরিয়াস পড়াশোনা দেখে এলিন, নাহিন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে এত পড়ার কি আছে বৌমনি ! পরীক্ষার মাস খানেক আগে একটু পড়লেই হয় !
আমি তোমাদের মত সামলাতে পারব না তাই আগে থেকেই নেড়েচেড়ে দেখছি কি হয় ! আর সামনের মাসে হয়তো কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি তখন অনেক বড় গ্যাপ হয়ে যাবে তাই একটু পড়ছি।
ন‌ওশাদ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে পড়া বন্ধ করে দেয়। ন‌ওশাদ বাসায় ফিরে এলে মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে। তখন পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না সে। ন‌ওশাদ ন্যাশনাল জিওগ্রাফী দেখলে সেও পাশে বসে দেখে। খেলা দেখলে সে তাই দেখে। ন‌ওশাদের সঙ্গে টিভি দেখতে তার খুব ভালো লাগে কারণ ঐ সময়টা ন‌ওশাদ ওর হাত ধরে বসে থাকে । কখনো কখনো ওর গালে ধরে টানাটানি করে কখনো ঘাড়ে সুরসুরি দিবে, চুল ধরে টানবে । এসব কিছু করবে কিন্তু চোখ থাকবে টিভিতে । টিভি দেখবে আর খুনসুটি তে ব্যস্ত থাকবে। হেরা ন‌ওশাদের সামনে বিরক্ত প্রকাশ করলেও আসলে তার খুব ভালো লাগে সেই মুহুর্ত টা।
সকালে ন‌ওশাদ বের হ‌ওয়ার আগেই তাকে ক্লাসের জন্য বের হয়ে যেতে হয় । ন‌ওশাদ আগের মত একা ব্রেকফাস্ট করে এটা খুব খারাপ লাগে তার। যদিও ন‌ওশাদ‌ই তাকে টেনেটুনে উঠায় ঘুম থেকে।

নিশালের পরীক্ষা শেষ হ‌ওয়ায় সে বাসায় আসছে আজ । ওর জন্য দারুন এক সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে হেরা । নিশালের পরীক্ষা যখন চলছিল তখন ওর জন্মদিন ছিল আজ ওর জন্মদিন সেলিব্রেট করার প্ল্যান করেছে হেরা । ওকে সাহায্য করেছে এলিন, নাহিন দুই বোন।
সব আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়েছে । নিশালের পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। পুরো ড্রয়িং রুম আর লিভিং রুম ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে । নিশালের পছন্দের কেক আনা হয়েছে।
যুথী, বীথি দুই বোনকে হেরা নিজে ফোন দিয়ে আসতে বলেছে। ওরাও ওদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে।
হেরা নিজে সব কিছু ছুটাছুটি করে করছে। ন‌ওশাদ হেরাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ওর কাছে এসে একবার বলল, তুমি এত কিছু কিভাবে করলে হেরা ?
আমি কি এত কিছু জানি না বুঝি আমাকে হেল্প করেছে এলিন, নাহিন। ওরা কত কিছু জানে !
তবে প্ল্যান তো তোমার ছিল । গীতি যাওয়ার পর এভাবে নিশালের বার্থডে করা হয়নি। ও বার্থডে র সময় কলেজে থাকে তাই করার সুযোগ হয়নি।
আপনি ফোন দিয়ে দেখুন কত দূর এসেছে গাড়ি?
আর দশ মিনিট লাগবে কাছাকাছি চলে এসেছে শোয়েবের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার ।
নিশাল বাসায় ঢুকে পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। বাসা ভর্তি লোকজন ওর বার্থডে পার্টি করার জন্য এসেছে। ও লজ্জাই পেয়ে গেল ।
পাপা এসব কি তোমার আইডিয়া ?
না বাবা সব তোমার মামনির আইডিয়া । দুই দিন থেকে সব করছে মামনি আর তার সঙ্গীরা ।
মামনি তুমি তো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলে এত বড় ছেলের বার্থডে এভাবে কেউ করে ?
তোমার ভালো লাগছে না নিশাল ?
সেটা বলিনি মামনি এত বেলুন , কনফেত্তি উড়িয়ে বার্থডে করার বয়স আছে আমার ।
ওরে বাবা কত বড় হয়ে গেছে ছেলে কয়দিন পর বিয়ে করিয়ে দিতে হবে , কথাটা বলেই নাদিয়া হেসে দিল।
বড় ভাবি তোমার ছেলের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করো , মিলা হাসতে হাসতে বলল।
ছোট চাচী পাপা সত্যি সত্যি আমাকে কলেজ থেকে আসলে পরেই বিয়ে করিয়ে দিবে বলেছে । সবাই নিশালের কথা শুনে হেসে দিল।
বীথি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল নিশালের কাছে এগিয়ে এসে বলল, বিয়ের জন্য এই ফ্যামিলির ছেলে গুলো একদম এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুঝলে মিলা ।
সবাই বীথির কথা শুনে হাসছে কিন্তু নিশাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলল । ও বীথির সেই কথা গুলো ভুলতে পারে না যেসব কথা বন্ধ দরজার ভেতরে পাপাকে বলেছে খালামনি। ওর খারাপ লাগছে এই ভেবে এসব কথা মামনি শুনলে কি ভাবতো ?
ন‌ওশাদ হতাশ দৃষ্টিতে বীথির দিকে তাকিয়ে রইল।
নিশাল ওর সব কাজিনদের নিয়ে কেক কাটলো। সবাই ওর পুরো মুখে কেকের ক্রীম লাগিয়ে দিল।
হেরা নিশালের কাছে এগিয়ে এলো , নিশাল রুমে চলে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো ।
হ্যাঁ যাচ্ছি।
মামনি !
জ্বি।
থ্যাংকস খুব ভালো লাগছে এসেই সবার সঙ্গে এনজয় করছি তুমি এত কষ্ট করলে ।
কষ্টের কিছু নেই তোমার ভালো লেগেছে এটাই বড় কথা । হেরা নিশালের মাথায় হাত রাখলো।
অনেক দিন এই বাসায় সবার সঙ্গে এত হৈচৈ করা হয় না মামনি।
এখন থেকে সুযোগ পেলে হৈচৈ করবো আমরা নিশাল। দেখো তোমার পাপা কত আনন্দে আছে।
হ্যাঁ। সব তোমার জন্য মামনি।
তুমি আনন্দে আছো তাই পাপাও আনন্দে আছে নিশাল।
তোমার জন্য পাপা অনেক টিশার্ট, গেন্জি এনেছে তোমার রুমে রেখেছি ।
ঠিক আছে।নিশাল নিজের রুমে চলে গেল ।

নাদিয়া, মিলা ,‌যুথী,বীথি এক সঙ্গে বসে গল্প করছে।‌হেরা ছোটাছুটি করে সবার খাওয়া দাওয়া বাচ্চাদের ডিমান্ড পূরন করছে ।
বড় ভাবি পুরো সংসারটা নিজের করে নিয়েছে দেখে ভালোই লাগছে তাই না , মিলা বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল।
বিয়ের পর সংসার থেকে কি দূরে থাকা যায় মিলা ! ভাইয়াকে দেখেছো , আগের ভাইয়া আর এখনের ভাইয়ার মধ্যে কত তফাত । এখন দেখেই বোঝা যায় ভাইয়া কত হ্যাপি।
তাই নাকি নাদিয়া? আমার তো দেখে আগের মতই লাগছে, বীথি বলল।
কি বলো বীথি, ভাইয়া ভাবী কে নিয়ে সিলেট থেকে হানিমুন ও করে এসেছে। নয় দিন ছিল ।
কবে নাদিয়া জানি না তো ? অবাক হয়ে বীথি তাকালো ।
গত মাসে, ভাইয়ার একটা রিসোর্ট আছে না সিলেটে ওখানে গিয়েছিল। নাদিয়া গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আরমান ভাইয়াকে ফোন দিয়েছে কি একটা দরকারে কিন্তু ভাইয়া ফোন ধরে না বারবার ফোন দিচ্ছে ভাইয়া রিসিভ করে না, ও তো টেনশনে পড়ে গেল তারপর রিসোর্টের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার কে কল করেছে ঐ লোক বলল, স্যার আর ম্যাডাম কটেজেই আছে কিন্তু ঐ এলাকায় কারো যাওয়া নিষেধ । একদম কোন রকম ডিস্টার্ব নেস ছাড়াই হানিমুন করে এসেছে দুজন। ঐ নয়দিন অফিসের কারো ভাইয়াকে কল করা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল।
ও আমরা এসব জানব কিভাবে আর দরকার‌ও নেই জানার বুঝলে , বুড়ো বয়সে বিয়ে করেছে ফুর্তি করে বেড়াতে হবে না এখন ,যুথী বলল।
ভাইয়া তো ভাবি আর নিশাল‌ কে নিয়ে আগামী মাসে আমেরিকা যাবে ভিসাও হয়ে গেছে শুনলাম। আব্বাকে ও নিবে আব্বার ভিসা হয়নি এখনও ।
মিলা দুলাভাই এর মনে এখন অনেক রং কি বলব আর।
যুথী আপা সব হলো টাকার খেলা । ভাইয়া হলেন বিলিয়নিয়ার মানুষ ওনার জন্য যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া কোন ব্যাপার না। আমার খুব হিংসে হয় বড় ভাবিকে ভাইয়ার মত মানুষ কে পেয়েছে । যেমন আছে টাকা সেরকম খাঁটি একটা মানুষ! কয়টা মেয়ে এরকম মানুষকে স্বামী হিসেবে পায় বলো ?
এটা ভালো বলেছো মিলা , নাদিয়া বলল।
ভাইয়া অসাধারণ একজন মানুষ! কোন দিন দেখিনি আমাদের সঙ্গে তো দূরের কথা ভাইদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে। তবে খারাপ কিছু কে কখনো পশ্রয় দেয় না আবার।
মেঝ ভাবি তুমি তো দেখোনি একটু আগে ফারাজ কে খাওয়াচ্ছি দূর থেকে দেখি ভাইয়া হঠাৎ ভাবির গাল টেনে দিলো । কি সুইট না !
সত্যি !
ভাইয়া এমন বিহেইভ করে যেন ভাবী একটা বাচ্চা মেয়ে বলেই হাসছে মিলা !
বাচ্চা মেয়ে ই তো বাইশ বছর বয়স আর ভাইয়ার ছিচল্লিশ । ভাইয়ার কাছে তো বাচ্চা বয়সীই।
হুম। তাকিয়ে দেখো ভাবি যেখানে ভাইয়া ভাবির কাছাকাছি থাকবে ।
কি বলো খেয়াল করিনি তো !
দেখো একটু খেয়াল করে।
হ্যাঁ তাই তো !
বীথি বলল, ঢং বুঝলে সব । বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে পুরুষ মানুষ এমন আহ্লাদ ই করে ব‌উ এর সঙ্গে।
আমার কিন্তু ভালোই লাগে বীথি দুজনকে দেখে , নাদিয়া বলল।
যুথী বলল, দুই নাম্বার ব‌উ কে সব পুরুষ মানুষ এমন মাথায় করে রাখে ।
তাই নাকি যুথী আপা, ইস আমি যদি ফারহানের দুই নাম্বার ব‌উ হতাম !
মিলার কথা শুনে নাদিয়া আর যুথী হাসছে ।

বীথি ন‌ওশাদ আর হেরার সিলেট ট্যুরের খবর জানতে পারেনি কারণ পারুল তখন ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। মনে মনে খুব বিরক্ত হলো পারুলের উপর। অনেকক্ষণ থেকেই সে দূর থেকে ন‌ওশাদকে দেখছে। হেরার সঙ্গে কখনো কথা বলছে , ভাইদের সঙ্গে গল্প হাসাহাসি করছে । উঠে গিয়ে বাচ্চাদের চকলেট দিচ্ছে কখনো। একবার হেরার মুখে ও একটা চকলেট তুলে দিলো । নিশাল‌ও গিয়ে কিছু একটা বলল ওদের কাছে , তিনজন হাসছে এক সঙ্গে। আবার ফ্যামিলি ফটো তুলছে ঢং করে করে।
অসহ্য লাগছে দেখে বীথির ।
শোয়েবের ছোটবোন এসেছে তার কোলে আট নয় মাসের একটা ছেলে । সেই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে ন‌ওশাদ । ছোট বাচ্চাদের তার এত ভালো লাগে আশপাশে ছোট বাচ্চা দেখলে সে ওদের নিয়ে খেলতে পছন্দ করে।
নিশাল পাপার কাছে দাঁড়ালো এই গুল্লু বেবিটা কে পাপা ?
শোয়েবের ছোট বোন রাখির ছেলে । সবার কাছে যায় আবার হাসে দেখো খুব সুইট !
অনেক কিউট তো কোলে নিব একটু ?
পারবে তুমি ?
পারব । নিশাল বেবিটাকে কোলে নিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে।
নাদিয়া হাত ইশারায় নিশালকে কাছে ডাকলো ।
জ্বি চাচী।
বাচ্চা টা কে , সুন্দর তো ?
চাচী শোয়েব ভাইয়ার বোনের ।
রাখির ?
জ্বি !
তোমার কোলে বেবিটাকে খুব মানিয়েছে নিশাল। কয়দিন পর তোমার ভাই বোন হবে তখন এভাবে খেলতে পারবে, মিলা বলল।
জ্বি চাচী আমার তো ভাবতেই ভালো লাগে বাসায় একটা ছোট বাবু দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমি ওর পিছনে পিছনে ছুটছি। অনেক মজা হবে।
নাদিয়া বলল, তোমার পাপা আর মামনি কে বলো তোমার ভালো লাগার কথা টা।
জ্বি বলতে হবে ।
ন‌ওশাদ পাশ থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে চমকে গেল! নিশাল তার ভাই বোন হবে এই কথা ভাবে ? আশ্চর্য!
হেরা ওদের কাছে আসতেই নাদিয়া বলল,ভাবি তোমার বাবু হলে আর চিন্তা নেই নিশাল‌ই রাখতে পারবে দেখো কত সুন্দর করে কোলে নিয়ে বসে আছে রাখির ছেলেকে !
হেরা নাদিয়ার কথায় কি বলবে বুঝতে পারছে না ।
ভাবি তাড়াতাড়ি বাবু নিয়ে নাও একটা, নিশাল আরো বড় হয়ে গেলে বেখাপ্পা লাগবে ।
ওসব নিয়ে পরে গল্প করব খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তোমরা এসো খেতে।
সবাই খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল । বীথি হঠাৎ হেরার পাশে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলল, তোমার বাচ্চা হবে আর আমাদের নিশালের কপাল পুড়বে ।বোকা ছেলেটা, এটা বুঝে না ও যাদের ভাই বোন ভাববে ও গুলো যে কালসাপ হয়ে ওকেই কামড়াবে !
হেরা বীথির কথা শুনে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালো‌ বীথি হেরার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
হেরা তাকিয়ে আছে বীথির দিকে কেন যেন কথাটা ওর বুকের ভেতরে গিয়ে লাগলো । ওর চোখ পানিতে ভরে যাচ্ছে। হেরা খুব চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকাতে । অন‌্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো সে। ন‌ওশাদ খেয়াল করেনি কিন্তু নিশাল খেয়াল করলো হেরা চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে শাড়ির আঁচল দিয়ে তারপর ওখান থেকে বাথরুমে ঢুকে গেল তাড়াহুড়ো করে ।

চোখে মুখে পানি দিয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলো হেরা। সবাই খাচ্ছে ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ।
নিশাল কাছে এসে দাঁড়ালো , কি হয়েছে তোমার মামনি ?
কোথায় , কিছু না তো ?
হঠাৎ মনে হলো আমার ।
না আমি ঠিক আছি। তুমি খেয়েছো ঠিক ভাবে ?
হুঁ।
হেরা বীথির দিকে তাকিয়ে আছে । কি সুন্দর অন্যদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে খাচ্ছে! একটু আগে যে কথাটা উনি বললেন হেরার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে কথাটা । ওর বারবার মনে হচ্ছে উনি এরকম করেন কেন ওর সঙ্গে ? এত রাগ কেন উনার হেরার উপর?
সবার খাওয়া শেষ হতেই এলিন হেরাকে গান গাওয়ার জন্য জোর করা শুরু করলো।
প্লিজ এলিন সবার সামনে লজ্জায় ফেলো না ।
না বৌমনি তোমাকে গাইতেই হবে ।
নিশাল এলিনের কথা শুনে সেও রিকোয়েস্ট করা শুরু করলো। হেরার মনটা খুব খারাপ ওর এখানে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে তার মধ্যে গান গলা দিয়ে আসবেই না।
ওদের কথা শুনে ঘর ভর্তি সবাই হেরার গান শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলো । হেরা ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে । ন‌ওশাদ‌ও চোখ ইশারায় গাইতে বলল‌!
কারাওকি স্পিকার নিয়ে এলো নিশাল । হেরাকে দেখিয়ে দিল কিভাবে কি করবে । হেরা প্রচন্ড মন খারাপ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে গাইতে শুরু করলো কিশোর কুমারের বিখ্যাত গান ” এই তো হেথায়, কুঞ্জ ছায়ায় / স্বপ্ন মধুর মোহে / এই জীবনে যেকটি দিন পাবো/ তোমায় আমায় হেসে খেলে/ কাটিয়ে দিব দোহে / স্বপ্ন মধুর মোহে ….
হেরা গান গাইছে ন‌ওশাদ উঠে বাহিরে এসে দাঁড়ালো । এখান থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গান। এই গানটা গীতি যাওয়ার কিছুদিন আগে ও শুনিয়েছিল গীতিকে । গানটা ওকে ছয় বছর আগের একটা রাতের কথা মনে করিয়ে দিলো । বুকের কোথায় যেন চিনচিনে একটা কষ্ট হচ্ছে আবার। সৃত্মি গুলো তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় ।‌ কেন সুখের স্মৃতি গুলো একটা সময় কষ্ট দেয় ! গীতির সঙ্গে কাটানো সুখের সময় গুলো আজ ছয় বছর ওর বুকের রক্ত ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। আজ‌ও এই গানটা শুনে সেই রক্ত ক্ষরণ টের পাচ্ছে সে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পাচ্ছে খুব দরদ দিয়ে হেরা গাইছে,
অভিসারের অভিলাষে/ র‌ইবে তুমি আমার পাশে/জীবন মোদের যাবে ভরে/ রঙের সমারহে/স্বপ্ন মধুর মোহে….

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here