কাননবালা পর্বঃ৪১

0
863

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৪১

ভোরের মিহি বাতাসে নীতুর চুল উড়ছে।শরীরে ভর করেছে অন্যরকম আচ্ছন্নতা!নীতু চোখ বন্ধ করে।বুক ভরে শ্বাস নেয়। পাখি ডাকা ভোরে দু একটা পাখি ডেকে ওঠে। নীতু চোখ মেলে তাকায়। কি আশ্চর্য! নীতুর চক্ষু জলে টইটম্বুর। পলক ফেলবার অপেক্ষা করছে যেন।পলক ফেলতেই চোখের স্বচ্ছ জলটুকু গড়িয়ে পড়ে গালের দু’পাশে!

কালো রঙের একটা সুতি শাড়ি পরে নীতু বসে আছে আম গাছের নীচের বসনির উপরে।ঘুমজড়ানো এলোমেলো চুলে ভীষণ রুক্ষতা!চোখে জল,আর ঠোঁটের কোণে তীব্র ব্যথার ছাপ!
নীতুর খুব ভোরে হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো।তারপর থেকে এখানে বসে আছে।
নীতু দিগ্বিদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।মরিচ বাতি গুলো এখনো জ্বলছে।সাজানো গুছানো বাড়িটা খুবই নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমাচ্ছে বলেই হয়তো।নীতু গুটিশুটি করে বসে। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে।এই বাড়িটাতে তার কতগুলো বসন্ত কেঁটে গেলো।বসন্ত গুলো মোটেই রঙিন ছিলো না।বড়ই কুৎসিত! কত তাচ্ছিল্য, অবহেলা,উপহাস, মন ভাঙার কান্নার সাক্ষী এই বাড়িটা।এত এত আলো সেই সব অসহ্য স্মৃতি গুলো রাঙায়িত করতে পারে না। বরং আলোর ওপাশের অন্ধকার টুকু আরো খানিকটা গাঢ় হয়!

আজ সন্ধ্যায় নীতুর গাঁয়ে হলুদ।কাল এই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই নীতুর মিশ্র অনুভূতি হয়।কত টুকু কষ্ট বা কতটুকু সুখ সেই অনুভুতিতে মিশ্রিত নীতু জানে না।তবে এতটুকু জানে কেউ একজন তাকে বধূ সাজে বরণের জন্য অপেক্ষা করছে!ভীষণ আগ্রাসী অপেক্ষা!

নীতু অনুভব করে কেউ একজন তার পাশে এসে বসেছে।নীতু তাকায়। তাজকে বসে থাকতে দেখে বিন্দু মাত্র বিচলিত বোধ করে না।বরং আগের মতই বসে থাকে দৃষ্টি বিস্তর আকাশে মেলে।
তাজ নিজেও জানে না সে এখানে কেন বসেছে? নীতুকে একা বসে থাকতে দেখে চলে আসা সঠিক হয়েছে কিনা তাও বুঝতে পারছে না?
নীতু অনেকটা সময় পর বলে,”কতখানি সময় পার হয়ে গেলো অথচ আমরা দু’জন দু’জনকে বলার জন্য কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না।কিন্তু একটাসময় আমাদের কথা ফুরাতো না।সবকিছু কেমন দ্রুত বদলে যায়, তাই না তাজ?”

“জানি না।”

“এবার আপনারও পরিবর্তন হওয়া উচিত তাজ।অধিকার সব কিছু বদলে দেয়। ”

তাজ কিছু বলে না।বুকের ভিতর পাহাড় সম ব্যথা অনুভব হয় কেবল। নীতু উঠে পড়ে। তাজ মাথা তুলে তাকায়। তাকিয়েই রয়।নীতুকে ভীষণ সুখী সুখী দেখাচ্ছে। তাজের বড়ই আফসোস হয়।এই আফসোস যে আজন্ম তাকে বইতে হবে ভাবতেই নিঃশ্বাসটুকুও যেন বিষাক্ত লাগে! নীতু নিঃশব্দে চলে যেতে শুরু করে।তাজ পুনরায় তাকিয়ে রয়।মেয়েটার হাঁটার তালেও কেমন সুখী সুখী ভাব। তাজ ডাক দেয়, “নীতু…?”

নীতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পিছন ফিরে তাকায়। তাজ অপলক চোখে শেষবারের মত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে।এরপর কি এমন করে দেখতে পাবে সে?কাজল কালো মেয়েটির কি মায়াবী শান্ত মুখ!পদ্মদিঘির মত গভীর নেত্র,তৈলাক্ত মুখ,এলোমেলো চুল।হাঁটার ছন্দে কেমন আভিজাত্য ফুটে উঠেছে।তাজ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“থাকা আর না থাকার ভীরে,আমার জন্য না থাকাটুকুই বরাদ্দ করেছিল সৃষ্টিকর্তা!তাই না নীতু?”

নীতু গাঢ় চাহনিতে তাজকে দেখে।নীতুর ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে,”অর্ধমৃত আমিকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দেওয়ার পরে এই প্রশ্নটুকু করা কতটুকু বেমানান তাজ? ” কিন্তু নীতু বলে না।আলতো স্বরে কেবল বলে,”হয়তো!”
তারপর ধীর পায়ে চলে যায় বাড়ির ভিতর।

***********

বিয়ে বাড়ির সবাই ব্যস্ত।সব মেয়েদের গায়ে হলুদ শাড়ি,ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি পরা। নীতু স্টেজে বসে আছে।হলুদ আর বাসন্তী রঙের মিশ্রণে জামদানী পরেছে।হাতে, কানে, গলায় কৃত্রিম ফুল।মেহেদি রাঙা হাত, পায়ে আলতা। ভারী সাজে নীতুকে মোহনীয় লাগছে। সবাই একে একে হলুদ ছোঁয়ায়।মিষ্টিমুখ করায়। নীতুর কৃষ্ণ মুখশ্রী আজ বড়ই হাস্যজ্জ্বল!সেদিকে তাকিয়ে ইতু বলে,”ভাইয়া আপাকে এত খুশি আগে কখনো দেখেছো?”
জায়েদ মাথা নাড়িয়ে না জানায়।সত্যিই আজ নীতুকে বড়ই সুন্দর দেখাচ্ছে।তার উপর বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে হাসি হাসি মুখখানা।
নিখিল বড়ই ব্যস্ত।হলুদের দাওয়াতে যারা এসেছে তাদের তদারকি করছে।দম ফেলবার ফুরসৎ নেই যেন।জায়েদ স্টেজে ওঠে।আঙুলের ডগায় হলুদ নিয়ে নীতুর কপালে ছুঁইয়ে বলে,”ভীষণ সুখী হ।দোয়া করি।”
নীতুর চোখে জল এসে পরে।টিস্যু দিয়ে চোখ চেপে ধরে। জায়েদ মাথায় হাত বুলিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে।তারও যে চোখে পানি এসে গেছে!

রিশাকে জোর করেও কেউ শাড়ি পরাতে পারে নি।সবার সাধাসাধিতে একটা কালো জিন্স আর লাল ফতুয়ার উপর হলুদ ওড়না পেঁচিয়েছে। রিশা হেলতে দুলতে স্টেজে উঠে। নীতুর পাশে ধপ করে বসে বলে,”তোমাকে কি সুন্দর লাগছে ডার্লিং!বড় হিংসে হচ্ছে তোমার জামাইকে!” নীতু হাসে।রিশা নীতুকে হলুদ ছুঁইয়ে একটা মিষ্টি নিজে মুখে পুরে বলে,”সত্যি বলছি….এত সেজেগুজে ওরকম হ্যান্ডসাম বর পেলে আমিও বিয়ে করে নিতাম।বালের পানসে জীবন আর ভালো লাগে না ডার্লিং!”
নীতু ধমকে বলে,”মুখ সামলা রিশু!”

“আরে ডার্লিং,কাল থেকে তো তোমার সবকিছুই বেসামাল থাকবে আজ আমি বেসামাল হলেই দোষ? ”

নীতু কপাল চাপড়ায়। রিশা আর একটা আপেল মুখে পুরে পুনরায় হেলতে দুলতে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে।

একটুপরই নীতুর কাজিনরা মিলে নাচ পরিবেশন করে।ফোলা পেট নিয়ে সেতুও হালকা তালে নাচ করে।মেহেদি,মিলন আর জায়েদ উড়াধুরা নাচ করে সবাইকে হাসিয়ে ছাড়ে।

হলুদ অনুষ্ঠান শেষের পর্যায়।সবাই খাওয়া দাওয়া করে বসে আছে।নীতু তখনও স্টেজে।তাজ এক কোণে একটা চেয়ারে বসে মোবাইল টিপছে।এসব অনুষ্ঠানে তার মন নেই। নীতুর হাসিমুখ যখনই দেখছে তখনই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব শেষ করে দিতে।

মেহেদির হাতে হলুদের বাটি। মুখে বিরক্তির ছাপ।তাকে ছোট খাটো পেয়ে সবাই কাজ করাচ্ছে। এখানেই যত বিরক্তি।তার বন্ধুটির তো কোন খবরই নেই।সে স্বামীর প্রেমশোকে দিওয়ানা!এখন তার উপর দায়িত্ব পরেছে স্টেজের সরঞ্জাম সরানোর।নিচ তলা থেকে রিশা মোবাইলে কারো সাথে চিল্লাতে চিল্লাতে কথা বলতে বলতে আসছে।মিউজিকের শব্দে কিছুই ঠিক মত শুনতে পাচ্ছিল না।ঠিক তখনই ধাক্কা। আর সমস্ত হলুদ মেহেদির সাদা পাঞ্জাবিতে।রিশা জিহ্বায় কামড় দেয়। মেহেদি এমন করে রিশার দিকে তাকায় যেন এখনই খেয়ে ফেলবে।মেহেদির ভয়ার্ত কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে রিশা না চাইতেও হেসে ফেলে।রিশাকে মনে মনে বিশ্রী গালি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায় মেহেদি।এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করার মুড নেই এখন তার।হুহ!

অনেক মেহমানই চলে গেছে।তারা সরাসরি বিয়েতে আসবে।এখন যারা আছে তারা সবাই কাছের আত্মীয়। সবাই বসে গল্প করছিল।ক্লান্তি সবার চোখে মুখে তবুও ঘুম নেই।বিয়ে বাড়ির আমেজ যেন সবাইকে মুখরিত করে রেখেছে। নীতু সাজ পোশাক খুলতে যতবারই চেয়েছে ততবারই রিশা বাঁধা দিচ্ছে। ‘আর একটু’ বলে বসিয়ে রেখেছে।
সবাই ছাদে বসা।ঠিক তখনই মেহেদি এক বালতি রঙ মেশানো পানি নিয়ে আসে।এক মগ পানি সরাসরি রিশার গায়ে ঢেলে দেয়। রিশা আগুনচোখে তাকায়। মেহেদি দাঁত কেলিয়ে হাসে।পুনরায় রঙ পানি মারতে গেলে রিশা সরে দাঁড়ায়। যার ফলাফল, সেতু রঙে মেখে একাকার। সেতু চিৎকার করে বলে,”মেদুর বাচ্চা তোর খবর আছে।”

মুহুর্তেই মেহেদি কানে ধরে ওঠবস শুরু করে বলে,”মাফ কর সেতুমন্ত্রী। বুঝতে পারিনি।ডাইনি মেয়েটা সরে যাওয়াতে সব হয়েছে।সব ওর দোষ।আমায় ক্ষমা কর!”

নীতু হতভম্ব চাহনিতে চেয়ে আছে।মুখের আকৃতি হা হয়ে আছে।নীতু বিশ্বাস করতে পারছে না।এই মানুষ গুলা কি কোন জঙ্গলের জঙ্গলী নাকি? যে যেখান থেকে পারছে একজন আর একজনকে রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে। দাদাভাই, মিলন,মেহেদি,নিখিল, সুরভি,ইতু সহ বাকি কাজিনরা রঙ মেখে ভূত সেজে বসে আছে।যেন প্রতিযোগিতা চলছে,কে কাকে রঙ মাখবে।মুহুর্তের মধ্যে কি ঘটে গেলো নীতু নিজেই বুঝতে পারলো না।

নীতুর হাতে টান পড়তেই খেয়াল করে রিশা তাকে চোরের মত টেনে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।আশ্চর্য! এদের সবার হলো টা কি? রাত বারোটায় সবাই রঙ খেলছে,রিশা তাকে ধরে টানছে!
নিচে নামতেই নীতু বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।বুকের ভিতর বন্দী পাখির ডানা ঝাপটানোর মত উথাল পাথাল উচাটন! নীতু ঢোক গিলে।নীতুর মনে হচ্ছে তার চোখ দুটো যেন ঝলসেই যাবে!এত রুপ কি কোন পুরুষের হয়?হয় না তো।তবে এই মানুষটারই কেন হতে হলো?
পাশে দাঁড়িয়ে রিশা মিটমিট করে হাসছে।রিশা কি বুঝতে পারছে? রঙ মাখা মুখে তার হাসি ভূতের হাসির মত লাগছে?

*******

আয়নার সামনে বসে সেতু নিজের গাল, গলা থেকে রঙ ওঠানোর চেষ্টা করছে ঘষে ঘষে । আর বিড়বিড় করে গালাগাল দিচ্ছে মেহেদিকে। কড়কড়ে সবুজ রঙ উঠছে না তো উল্টো গাল লাল হয়ে গেছে। সেতুর চোখে পানি এসে পড়ে।কাল আপির বিয়েতে নির্ঘাত তাকে ভূতের মত লাগবে।
ঠিক তখনই তাজ এসে তার পাশে চেয়ার টেনে বসে।সেতুকে মুখোমুখি বসিয়ে দেয়। সেতু ফুঁপিয়ে ওঠে। তাজ হালকা হাসে।হাতে ধরা তেলের বাটিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে তেল ভর্তি বাটিতে হাত ডুবায়।এরপর আলতো হাতে সেতুর গাল ম্যাসাজ করা শুরু করে।সেতু কিছুটা অবাক হয়। তাজ ম্যাসাজ করতে করতেই বলে,”বন্ধু কে গালাগাল দিচ্ছো?এটা কি ভালো হচ্ছে? বিয়ে বাড়িতে এসব একটু আধটু তো হয়ই।”

“দিবো না কি করবো?আমার তো ইচ্ছে করছে মেদুকে মেরে ফেলতে।দেখছেন মুখের কি অবস্থা করেছে?বদ একটা!”

“সত্যিই মেহেদি কাজটা ঠিক করেনি।তোমাকে একদম রঙ মেখে শাঁকচুন্নি বানিয়ে ফেললো!”

সেতু চোখ কটমটিয়ে তাকায়। তাজ কপট অভিনয় করে বলে,”আমাকে চোখ রাঙিয়ে কি লাভ সেতু?আমিই তো উপকার করছি।বরং তোমার বদমায়েশ বন্ধুকে কিচ্ছু বলো?”

“একদম আমার বন্ধুকে বদমায়েশ বলবেন না।তাহলে খারাপ হবে কিন্তু! ”

তাজ কন্ঠে বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,”এই না তুমি গালাগাল করছিলে? আমি বলাতেই দোষ!”

সেতু চোখ বন্ধ করে ফেলে।তার সমস্ত শরীর তার সাথে প্রতারণা করছে।এমনকি বিচ্ছু মনটাও।তাজ কথা বলতে বলতে সেতুর গলা তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে শুরু করেছে ততক্ষণে। তাজের এক একটা স্পর্শ সেতুকে ভিতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সেতু চোখ মেলে তাকায়। চোখ দুটো টকটকে লাল!বহুকষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলে,”যা আমার তা কেবলই আমার।তা হোক কোন জিনিস বা মানুষ।আর আমার কাছের মানুষকে আমি বকবো, মারবো , কাঁটবো আবার ভালোবাসবো।কিন্তু অন্য কারো একটু নখের স্পর্শও সহ্য করবো না! আমার বন্ধুকে বকার রাইট কেবল আমার।আমি আমার জিনিসে কারো বিন্দুমাত্র ভাগ সহ্য করতে পারি না।”

তাজ অবাক হয়।সেতুর কন্ঠে বিদ্রুপ নাকি আক্ষেপ বুঝার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই তাজ উঠে দাঁড়ায়। সেতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”মুখটা এবার ধুয়ে আসো দেখবে রঙ উঠে গেছে।”

তাজ চলে যেতে নেয়।সেতু তাজের হাতটা ধরে পথরোধ করে।তাজ তাকিয়ে বলে,”কিছু বলবে?”

“আপনি কখনোই আমার ছিলেন না তাজ।তাই আমার কোন আক্ষেপ নেই!প্রিয় মানুষটি আমার না হওয়ার কি যন্ত্রণা তা আপনার থেকে আর কে ভালো বুঝবে? ”

তাজ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।সেতুর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,” আমি তোমার না হয়েও তোমার হয়েই রয়ে গেলাম সেতু!এখানেই বুঝি সবচেয়ে বড় আফসোস তোমার আমার!”….. বলে ধীর পায়ে বারান্দায় চলে যায় তাজ। সেতু ক্ষণকাল চেয়ে থেকে ওয়াশরুমে চলে যায়। সেতু বুঝতে পারে তার চোখ ভারী হয়ে আসছে!বুকের ভিতর নোনাজলের অবাধ্য ঢেউ আচঁড়ে পড়ছে!

********

অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসছে। পাঞ্জাবির এক পকেটে হাত পুরে আয়েশী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তার বউয়ের বিস্মিত রুপ দেখছে।
ক্ষণকাল পরে অভীক কয়েক পা হেঁটে নীতুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”আমাকে আমার বউয়ের এত পছন্দ যে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে!”

নীতু অনুভব করে তার হাত পা কাঁপছে। শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিকে দেখে যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে তা কি বুঝতে পারছে মানুষটা? লম্বা গড়ন,প্রশস্ত বুক,আঁটসাঁট শুভ্র পাঞ্জাবি সব কিছু মিলিয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে নীতুর হাত পা কাঁপারই কথা।

অভীক আদেশের স্বরে বলে,”আমার দিকে তাকাও কাননবউ।আমি একটু তোমাকে দেখি।”
নীতু তাকায় না।লজ্জায় নত হয় আরো খানিকটা মস্তক! অভীক হাসে। হলুদ জামদানী আর হলুদের সাজে নীতুকে দেখে অভীকের বুকের ভিতর ধ্রিম ধ্রিম শব্দ তুলে!অভীক পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে।

এত রাতে অভীকের উপস্থিতি তার উপর লজ্জা, অস্বস্তি মিলেমিশে নীতুর হাঁসফাঁস লাগে। কপাল,নাক ঘেমে টেমে একাকার! অভীক ফাঁকা ঢোক গিলে আদুরে স্বরে বলে,
“তোমার নাক ঘামছে হলুদপরী! ”

নীতু চমকে তাকায়। মন,মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলে হলুদপরী ডাকটা।যেন এক ঝাঁক খুশির আলোড়ন!অবাধ্য সুখের হৈ হুল্লোড়!
পাশ থেকে রিশা খুঁক খুঁক করে কেঁশে ওঠে বলে,”এত রোমান্স কই থাইকা আসে?ভাইরে ভাই! ”

নীতু সরে দাঁড়ায়। রিশা ফের বলে,”বস আপনার বউ আপনার কাছে দিয়ে গেলাম।সময় মত আবার ফেরত দিয়া যাইয়েন।”

নীতু অবাক স্বরে বলে,”কোথায় যাচ্ছি আমি?”

অভীক নীতুর হাত ধরে বলে,”আমি না বলো আমরা।আমরা এখন হলুদ নাইট সেলিব্রেট করতে যাচ্ছি। ”

নীতু ততক্ষণে খেয়াল করে অভীকের পিছনে একটা স্কুটি দাঁড় করানো।স্কুটির এর সামনের আর পিছনের অংশ রঙ বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো।নীতুর চোখ ছলছল করে ওঠে।ভেজা চোখে একবার অভীক আর একবার রিশার দিকে তাকায়। রিশা আর অভীক দুজনেই একসাথে বলে ওঠে, “সারপ্রাইজ! ” নীতু ছলছল চোখে হেসে ওঠে।
অভীক বলে,”শাড়ি পরে চালাতে পারবে তো?”

নীতু বাচ্চাদের মত উচ্ছাসী কন্ঠে বলে,”আপনাকে রিশু বলেছে তাই না?”

অভীক আলতো হেসে মাথা দুলায়।নীতুর খুশি মুখটার জন্যই তো এতকিছু! নীতু খুশিতে রিশাকে জরিয়ে ধরে বলে,”তুই এত ভালো কেন রিশু?”

“আমি একদমই ভালো না ডার্লিং…তবে তোমার জন্য ভালো খারাপ দুটোই হতে পারি!”

নীতু হেসে রিশার ববকাট চুল এলোমেলো করে দেয়। ড্যামকেয়ার মেয়েটার চোখ মুখ হেসে ওঠে ঝলমলে রোদের মত!
শাড়ি পরা নীতু স্কুটিতে উঠে বসে।চাবি ঘুরিয়ে গিয়ারে চাপ মারে আলতা পরা পায়ে।পায়ের নুপুর খানি ঝনঝন করে ওঠে মুহুর্তেই।হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি পরে আলতো হাতে পিকাপ ঘুরিয়ে অভীককে উঠতে ইশারা দেয় নীতু। নীতুর মুখে যেন চাঁদের হাসি লেপ্টে রয়েছে। নীতুর স্কুটিতে ওঠা থেকে ইশারা দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অভীক ভীষণ মুগ্ধ হয়ে দেখলো ।মেয়েটার বসার ধরনটাও কেমন এট্রাকটিভ! অভীক স্কুটির পিছনে উঠে বসে। রিশা বড়সড় শিস মেরে নীতুকে দেখিয়ে বলে,” বস জিতছেন কিন্তু! ”

“আই এগ্রি সুইটহার্ট! ” অভীক ফিচলে হেসে বলে।

রিশা বুকে হাত দিয়ে উফফ! করে ওঠে। নীতু স্কুটিতে টান মারে। রিশা তাকিয়ে থাকে। কি সুন্দর মুহুর্ত। হলুদ সাজে বউ স্কুটি চালাচ্ছে আর তার সহযাত্রী হিসেবে আছে প্রিয় মানুষটা!এর থেকে সুন্দর কিছু কি আর হয়? হয় না তো!

রিশা হাসি মুখে পিছনে ঘুরতেই মেহেদির সাথে দূর্ভাগ্যবশত দেখা হয়ে যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে রিশা দশাসই একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় মেহেদির পেট বরাবর।মেহেদি অতি বিস্ময়ে ব্যথানাশক চিৎকার দিতেও ভুলে যায়।রিশা তার ববকাট চুলগুলো পিছনে ঠেলে এক আঙুল শাসিয়ে বলে,”চুনোপুঁটি, চুনোপুঁটির মত থাকো।রিশার সাথে লাগতে এসো না।বুঝেছো বেইব?”

বলে রিশা হনহন করে চলে যায়। কতবড় সাহস? রিশাকে রঙ পানি মাখায়!মেরে নকশা চেইঞ্জ করে দিলেই বুঝবে রিশা কি চিজ!

মেহেদি তখন অতি বিস্ময়ে পেটচেপে হা করে তাকিয়ে আছে হিংস্র বাঘিনীর চলার পানে!

*********

নীতু অভীকের এত সুন্দর মুহুর্ত একটা ব্যক্তি খুব মনোযোগ সহকারে দেখলো।বারান্দার গ্রীল ভেদ করে ব্যথিত চোখ দুটো কেবল ব্যস্ত ছিল নীতুর আরক্ত মুখখানির উপর!এত লজ্জা! এত হাসি শুধু ভালোবাসার মানুষটির সম্মুখীন হলেই পায় মেয়েরা।তবে কি নীতু অভীককে ভালোবাসে?
তাজ শক্ত হাতে বারান্দার গ্রীল চেপে ধরে।বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “বেঈমান!স্বার্থপর!কখনো ভালোবাসনি আমাকে, তাই না? ভালোবাস নি।এক ফোঁটাও না।ভালোবাসলে এত দ্রুত পুরোপুরি অন্যের হতে না।আমি তো পারিনি! একটুও পারিনি!তোমাকে, তোমার প্রতি ভালোবাসা আজও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় কৃষ্ণবতী!শুধু কেউ জানলো না,কেউ বুঝলো না!এমনকি তুমিও না!”

তাজের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।বুকের ভিতর বিষের জ্বলন!চোখে ভাসছে অভীকের পরম ভালোবাসায় নীতুর কাঁধে হাত রাখা আর সেই স্পর্শে নীতুর আরক্ত মুখের লাজুক হাসির দৃশ্যটুকু।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাজ ফিরে তাকায়। সেতুকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাজ ভেজা চোখে হাসে।ফিসফিস করে বলে,”আজকে তোমার খুশির দিন সেতু। নীতু কখনো আমাকে ভালোবাসেনি। তোমার বর তোমারই আছে।একদম বহাল তবিয়তে! ”

সেতু ঘাবড়ে গেলেও তাজকে বুঝতে দিল না।তাজের বিহেভ উন্মাদের মত লাগছে। তাজ পুনরায় ফিসফিস করে বলে,” সেতু…এই সেতু? নীতু আমার না!নীতু আমাকে ভালোবাসে না। এগুলো কেন মানতে পারি না আমি। বলো তো?স্বার্থপরটাকে কেন ভুলতে পারছি না? কেন পারছি না?”

সেতু এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তাজের হাত দুটো ধরে অনুরোধের স্বরে বলে উঠলো,”আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি শান্ত হন।আমার বোনের সুখে নজর লেগে যাবে যে।আমি আপনার পায়ে পড়ি।আমার আপি, আপনার কৃষ্ণবতী যে বহুদিন পর সুখের মুখ দেখেছে!সেই সুখে আপনার চোখের জল অভিশাপ হয়ে দাঁড়াক আমি চাই না। আমার আপিকে স্বার্থপর বইলেন না তাজ। আজ যে কৃষ্ণ মুখে হাসি দেখছেন সে মুখ দীর্ঘ সাতাশ বছর বড়ই দুঃখ বয়েছে।আজ যে মেয়েটির চোখ লজ্জায় আরক্ত সেই চোখ লোকের উপহাসে কেঁদেছে! আজ যাকে সুখে ভাসতে দেখছেন সে একসময় নিজের কৃষ্ণ মুখশ্রী লুকিয়ে রাখতো।আজ তাকে উড়তে দিন তাজ!নিজের ভালোবাসা ভালো থাকাও যে বড়ই সুখের!”

তাজ এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সেতুর কোমড় জড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।সেতু নিজেও কাঁদছে।ফোলা পেট নিয়ে বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো নিজেও। তাজ উন্মাদের মত কাঁদছে।বিড়বিড় করে বলছে,”আমি কাউকে ক্ষমা করবো না সেতু।কাউকে না।পরিবার, সমাজ,নীতু কাউকে ক্ষমা করবো না।কেউ আমায় বুঝলো না।”

সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।শক্ত হাতে ধরে তাজের মাথা নিজের কোলে রেখে বললো,”আপনি স্বাভাবিক হন তাজ।আমার যে বড্ড ভয় করছে!”

তাজ সেতুর হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। চোখে এক সমুদ্র জল আর বুকে তীব্র দহন নিয়ে বলে,”আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না সেতু।তোমার মত করে আমাকে কেউ বুঝবে না! তুমি চলে গেলে কে আমার কষ্টে এমন করে কাঁদবে?কথা দিচ্ছি সেতু, ভালোবাসতে না পারি ভীষণ যত্নে রাখবো তোমায়।একটুও কষ্ট পেতে দিবো না।শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না।এত পত্যাখ্যান সইবো কি করে বলতো?”

তাজের বলা কথায় সেতু কিছু বলতে পারে না।কি বলার আছে তার? নিজেকে ভেঙে চূড়ে যে আশ্রয় চাইছে তাকে কোন সাহসে ফিরাবে সেতু? নিজের দোলাচল ভাবনায় নিজেই কিছু বুঝতে পারে না!
তাজ তখনও কাঁদছে।সেতু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।রঙ বেরঙের মরিচ বাতির আলোয় বারান্দার মেঝে,দেয়াল ঝলমল করছে। দুটো স্বত্বা আজ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে!সেতু অনুভব করে তাজের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হচ্ছে। সেতু সুপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ভেজা কন্ঠে মৃদু স্বরে গান গেয়ে ওঠে,

তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দদূষণ, তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে, একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই
কথার ওপর কেবল কথা সেলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান

তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর!

কাঁদতে কাঁদতেই কিছুক্ষণ যেতেই তাজ ঘুমিয়ে পড়ে। ঠান্ডা মেঝেতে সেতুর কোমড় ধরে আসলেও সেতু একচুল নড়ে না।সেতু তাজের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”কেন আপিকেই এতটা ভালোবাসলেন তাজ?কেন?”
ঘুমন্ত তাজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।তাজের এলোমেলো চুল সরিয়ে প্রশস্ত কপালে সেতু ঠোঁট ছোঁয়ায়। মুহুর্তেই শরীর কাঁপিয়ে কান্নার বাঁধ ভাঙে! চোখের কোলে বাঁধভাঙা জোয়ার।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটির দিকে তাকিয়ে সেতু বিড়বিড় করে বলে,”ভালোবাসায় কেন এত তীব্র কষ্ট? কেন অ-ভালোবাসাকেই আমরা তীব্র ভালোবেসে ফেলি?হু?”

*********-

গন্তব্যহীন পথে ছুটছে স্কুটি।এত রাতে যে কয়টা যানবাহন বা মানুষ আছে রাস্তায় তারা অবাক নয়নে দেখছে স্কুটিতে আরোহীন যুগলবন্দীকে!কেউবা মুগ্ধ হচ্ছে,কেউবা অবাক!

নীতু ভিতরে ভিতরে অস্থির হলেও উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। যতবারই নীতু লুকিং গ্লাসে তাকাচ্ছে ততবারই দেখছে অভীক তার দিকে অসভ্যের মত তাকিয়ে আছে।নীতুর মনে হচ্ছে সে এখনই এক্সিডেন্ট মেক্সিডেন্ট করে একাকার করে ফেলবে!এত প্রখরতা কেন মানুষটার চোখে?

নীতু চোখ গরম করে তাকায় লুকিং গ্লাসে।তাতে অভীকের চাহনি আরো গাঢ় হয়।অন্তরের অন্তস্থল পড়ে ফেলতে চায় যেন মানুষটা! কয়েক সেকেন্ডের তাকানো-তেই নীতু অভীকের চোখে নীরব হিল্লোলের সমাহার দেখতে পায়। নীতু দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”কোথায় যাবো?”

অভীক উত্তর দেয় না।এক, দুই করে কেঁটে যায় আরো কয়েক মিনিট।নীতুও আর প্রশ্ন করে না।দুজনেই যেন দু’জনকে ভীষণ গাঢ় ভাবে অনুভব করছে। শাঁই শাঁই করে ছুটছে স্কুটি। নীতুর শাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, চুল উড়ছে,ঠোঁট কাঁপছে।অভীকের পৌরষালী তীব্র ঘ্রাণে চারপাশ ম-ম করছে।

অভীক নীতুর ড্রাইভিং-এ ভীষণ খুশি। মনে মনে ঠিক করে ফেললো ঢাকায় ফিরেই বউকে একটা স্কুটি গিফট দিবে। অভীক লুকিং গ্লাসে নীতুর দিকে তাকায়। নীতুর চোখ পিটপিট করছে।এত তীব্র বাতাসেও মেয়েটার কপাল ঘামছে।অভীক ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে।আকাশের দিকে তাকাতেই থালার মত মস্ত বড় চাঁদ দেখতে পায়।অভীকের মনে হচ্ছে চারপাশের বিস্তর নির্জনতা তাকে ফিসফিস করে বলছে,”এত গাধা কেমনে হলি অভীক?এভাবে পাগলের মত ভালোবাসতে নেই!ভালোবাসার জ্বরে পুড়ে মরবি তো শেষে!”

অভীক এত কথার ধার ধারে না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কৌটা বের করে দু’হাতে বেশ খানিক হলুদ মেখে নেয়।কৌটাটা ফের পকেটে পুরে নীতুর কোমড়ের দিকে তাকায়। তীব্র বাতাসে শাড়ির আঁচল সরে কোমড়ের খানিকটা অংশ উন্মুক্ত। অভীক ফাঁকা ঢোক গিলে। একবার আয়নায় নীতুর মুখটা দেখে নিয়ে হলুদ মাখা হাত দুটি নীতুর কোমড় গলে মেদহীন পেট স্পর্শ করে।

মুহুর্তেই নীতু কেঁপে ওঠে। শরীর জুড়ে বরফ গলা শীতল শিহরণ!পিকাপে হাতের ব্যালেন্স এলোমেলো হয়ে যায়।তীব্র গতিতে হার্ড ব্রেক করে ঝড়ের গতিতে পিছন ফিরে তাকায়।
অভীক হাসছে।চোখে মুখে অন্যরকম আসক্তি! পেটের কাছটা ভেজা লাগতেই নীতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অভীকের দিকে তাকায়। অভীক হলুদ মাখানো হাতে নীতুর পেট,কোমড় আলতো হাতে স্লাইড করে। নীতু চোখ বন্ধ করে ফেলে। অভীক নীতুর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে মাদক মেশানো কন্ঠে ফিসফিস করে বলে,”শুভ হলুদ কাননবউ!”

নীতু চমকে তাকায়। দু’জোড়া চোখ ভীষণ কাছাকাছি। দুজনেই দুজনের চোখের ভেতরের নিরব ভাষা পড়ছে। দু’জনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার!
অভীক অবাক চোখে নীতুর চোখের ভেতর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়েই রয়।নীতুর চোখ ছলছল করছে।পদ্মদিঘী চোখে স্বচ্ছ জলে টইটম্বুর! অভীকের বুকের কোণে হুট করেই তীব্র ছটফট শুরু হয়।ওই নোনাজলে ভরপুর স্বচ্ছ জলের দিঘিতে ডুব দিতে ইচ্ছে করে ভীষণ! ওই কাঁপা কাঁপা পেলব ঠোঁটের কোণে আজন্ম লালিত তৃষ্ণা মিটাতে ইচ্ছে করে! ভীষণ করে ইচ্ছে করে কালো মেয়েটার কালো কাক চক্ষু জলে ডুব দিতে!ভীষণ!

************

রুপসা ব্রীজের উপর স্কুটিটা দাঁড় করানো।নীতু দাঁড়িয়ে আছে ব্রীজের রেলিং ঘেসে।নীতুর পিঠের কাছে অভীকের বুক।দুজনেই তাকিয়ে আছে নদীর জলে।চাঁদের আলোয় নদীর জল চিকচিক করছে। অভীক হালকা হাতে নীতুর চুলের খোঁপা খুলে দেয় , ঝরঝর করে লম্বা চুল গুলো কোমড় স্পর্শ করে।অভীক তীব্র নেশায় নীতুর চুলে নাক ডুবায়। নীতু শিউরে ওঠে। অভীক নীতুর চুলের ঘ্রাণ নেয়। ফিসফিস করে বলে,”নীতু তোমাকে একটু কম ভালোবাসলেই বুঝি ভালো হতো। এত তীব্র ভাবে কখন ভালোবেসে ফেললাম আমি? নিজেকে বড় শূন্য শূন্য লাগে।তোমাকে ভালোবেসে শূন্য আমি কাননবউ!আমার শূন্যতাটুকু তুমি আঁচল ভরে কুড়িয়ে নিও!”

নীতু কিছু বলতে পারে না।চোখ ভিজে আসতে থাকে কেবল নোনা জলে। অভীক যেন এক ঘোর নেশায় আসক্ত। আলতো হাতে নীতুর খোলা চুল সরিয়ে দেয় একপাশে।মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীতুর উন্মুক্ত পিঠ।নীতু চোখ বন্ধ করে ফেলে।বন্ধ চোখের কোল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।
অভীক নীতুর উন্মুক্ত গ্রীবায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। একবার, দু’বার, তিনবার! নীতু ফুঁপিয়ে ওঠে।অভীক পুনরায় ফিসফিস করে বলে,”ভালোবাসি কাননবউ!”
নীতু নিজেকে আর সামলাতে পারে না।অভীক নামক পুরুষটার তীব্র ভালোবাসায় নিজেকে বড় শূন্য শূন্য লাগে।বুকের ভিতর কেমন ঝুপ ঝুপিয়ে পাথর পড়ার শব্দ!তীব্র সুখের আলোড়নে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। পরক্ষণেই নীতু দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে।

অভীক নীতুকে নিজের দিকে ফিরায়।নীতু তখনও কাঁদছে।অভীক আদুরে স্বরে বলে,”কাঁদছো হলুদপরী? ”

নীতু মাথা নাড়িয়ে না বলে। অভীক চোখা স্বরে বলে, “তাকাও নীতু।মাথা নত করে রাখা আমার পছন্দ নয়।কেন কাঁদছো বলতো?আমি কি অনাধিকার চর্চা করে ফেলেছি?”

নীতু চমকে অভীকের মুখের দিকে তাকায়। নীতু কি করে বুঝাবে সে কেন কাঁদছে? এত ভালোবাসার কি আদৌও যোগ্য সে?সেই ভেবেই তো এত কান্না আসছে। শুভ্র রঙের মানুষটার পাশে যে নীতুর নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। বড় আক্ষেপ হয়!তাজকে না পাওয়ার পর তো এমন মনে হয়নি।কিন্তু অভীক নামক পুরুষটার তীব্র ভালোবাসা নিজেকে বাধ্য করে এসব ভাবতে।নিজেকে যে মানুষটার পাশে বড্ড বেমানান লাগে! নীতু তা কি করে বলবে?

নীতুর মনে মনে বলা কথা যেন কোন জাদুবলে বুঝে ফেললো অভীক। মুহুর্তেই রাগে থমথমে হয়ে গেলো মুখ। রাগে কিড়মিড় করে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “এই যে এত ভালোবাসি তা চোখে পড়ে না? চোখে পড়ে কেবল গায়ের রঙটা,তাই না?আর কত ভাবে বুঝালে তুমি বুঝবে নীতু? ভালোবাসি তোমাকে।তোমার গোটা টাকেই ভালোবাসি।একবার ভালোবেসে ফেললে সেখানে আর কিচ্ছু মেটার করে না। ”

নীতু বাচ্চাদের মত তীব্র অভিমানে বলে বসে,”আপনিই আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।আমি কালো বলে। মনে আছে?”

অভীক রাগ মিশ্রিত অসহায় কন্ঠে বলে,”তখন তো তোমায় ভালোবাসি নি নীতু!যদি বুঝতাম তোমাকে আমার চাই,ভালোবেসে চাই! তবে কি ফিরিয়ে দিতাম?দিতাম না তো।তবে কেন কেঁদে আমাকে কষ্ট দাও?

শেষের প্রশ্নটা অভীক ধমকে বলে।নীতু চেয়ে থাকে অভীকের রাগত মুখের দিকে।অভীক দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে তীব্র অভিমানে।এত ভালোবাসার পরও মেয়েটার অবুঝপনায় তার কষ্ট হয়।ভীষণ কষ্ট হয়!

নীতু নিজের চোখের জল মুছে অভীকের অভিমানে ফিরিয়ে নেয়া মুখটা নিজের দিকে ফিরায়।দু’পা খানিকটা উঁচু করে দু’হাতে অভীকের গাল স্পর্শ করে অভীকের কপালে চুমু দিয়ে মিষ্টি স্বরে বলে,”সরি।”

অভীক নীতুর রাগ ভাঙানো দেখে মুগ্ধ হয়।আলতো করে হেসে ফেলে। নীতু লজ্জায় নদীর দিক মুখ করে দাঁড়ায়। পিছন থেকে অভীক নীতুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।

“আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসবো বউ।ভীষণ আদর করবো।রাগ হলে ভীষণ ঝগড়া করবো।কখনো বা কামড়ে দিবো।আবার ভালোবাসবো। নীতু….আমাদের মতের অমিল হবে,কখনো বা দুজনেই ব্যস্ত থাকবো তবুও বিশ্বাস কমবে না এতটুকু। হয়তো বিরক্ত হবো, ঝগড়া হবে তবুও বিচ্ছেদ হবে না আমাদের।মৃত্যু ছাড়া বিচ্ছেদ শব্দটা আজ থেকে ভুলে যাবো দু’জনেই! ”

নীতুর চোখ আবার ভিজে ওঠে।তীব্র সুখের জলে। নীতু ছলছল চোখে হাসি মিশ্রিত কন্ঠে বিড়বিড় করে রুপসা নদীর পানে বলে ওঠে, ” শুনছো নদী?আমার সুখের সাক্ষী কিন্তু তুমি রইলে।একসময় এই কৃষ্ণবতী তোমার বুকে নিজের দুঃখ ভাসিয়ে দিয়ে তোমার কাছে সুখ ধার চেয়ে নিয়েছিলো।আজ তোমার সুখ তোমায় ফিরিয়ে দিলাম।নদী তোমার সাথে আমার লেনাদেনা চুকে গেলো। এবার তবে একটু হাসো তো নদী!আমার সুখে হাসো!অনেক তো বইলে পরের দুঃখ। আমায় তুমি দোয়া করে দাও নদী।এই শুভ্র মনের মানুষটা এই জনমে-পরজনমেও যেন আমার হয়েই থাকে!”

এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়। একসময় নীতু বলে,” ফিরতে হবে তো চলুন।”

“আর একটু থাকি?তোমার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।” আদুরে স্বরে নীতুকে আরো খানিকটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে বলে অভীক।

নীতু জোর করে অভীকের দিকে ঘার কাত করে বলে,”আপনি বড্ড বেসামাল অভীক!”

অভীক মাথা দুলিয়ে নীতুর গালে টুক করে একটা চুমু দিয়ে বলে,
” ‘আমায় বরং সামলে নিও
একটু হলেও আগলে নিও,
ভীষণ একলা লাগা দুপুরটুকু মুঠো ভরে কুড়িয়ে নিও!’ ”

নীতু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে,”এই অবাধ্য, বেসামাল প্রেমিক বরকে কি করে সামলাতে হয় আমি জানি না অভীক।আপনি কি একটু আমায় শিখিয়ে দিবেন?আমার যে বড্ড নাজেহাল অবস্থা! ”

অভীক নীতুর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে কপাল ঠেসে চেয়ে থাকে। এই এক জনমে কি দু’জনের দু’জনকে দেখার সাধ আদৌও মিটবে?কে জানে!

চলবে,
আর এক পর্ব হয়তো আছে।উর্ধ্বে হলে দুই পর্ব। এতদিন গল্প কেন দেই নি হয়তো সবাই জানতে চান?উত্তরে বলবো প্রিয় মানুষটার অসুস্থতার খবর আমাকে পুরো বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।লেখার কোন শক্তিই ছিল না। আলহামদুলিল্লাহ এখন আগের থেকে বেটার আছে তবুও ভীষণ চিন্তায় হয় আমার। এত চিন্তা নিয়ে কি লেখা যায়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here