কাননবালা পর্বঃ৩৫

0
800

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৫

সময় রাত নয়টা।আকাশী রঙের দেয়ালটায় ঝুলানো ঘড়িতে ঢং করে আওয়াজ করে জানান দেয় ।অভীক চমকে ওঠে তাকায়। ছোট্ট একটা কামরা, একটা টেবিল, চারটে চেয়ার আর একটা লম্বা বেঞ্চ রাখা।তাতে কিছু মানুষ বসে আছে।কথা হচ্ছে,উচ্চ স্বরে হাসির শব্দ শোনাও যাচ্ছে কিন্তু কোন কিছুই অভীককে স্পর্শ করছে না! অভীক এখনো নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করতে পারে নি।তার হাত পা কাঁপছে ঠকঠক করে।কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে! বুকের ভিতর ক্ষণে ক্ষণে ধিম ধিম করছে! চোখের চাহনি দিগ্বিদিক! অভীক ফ্যাকাশে স্বরে বলে,”বড়ো পানি খাবো।”
অনীক শব্দ করে হেসে ফেলে।পানির বোতলটা হাতে দিতেই বোতলের অবশিষ্ট পানিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে!অনীক বিরক্তসূচক দৃষ্টিতে তাকায়, এখন পর্যন্ত অভীকের কয়েকবার পানি খাওয়া হয়ে গেছে!মুখের বর্ণ ছাইরঙা।অনীক কন্ঠে একরাশ বিরক্তি মিশিয়ে বলে, “তোকে দেখে মনে হচ্ছে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে।এমন করছিস কেন ছোটো?”
অভীক উত্তর দেয় না।ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।সবকিছু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! জায়েদ হেসে এগিয়ে এসে অভীকের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,”অভীক তোমার সমস্যা হলে বরং বিয়েটা ক্যানসেল করি?”

” একদমই না…!”….অভীক আৎকে উঠে বলে।
অনীক, জায়েদ ঠোঁট টিপে হেসে দেয়। এমনকি নীতুও মৃদু হেসে দেয়। অভীক সেদিকে তাকিয়ে থাকে রিক্ত চোখে।ছোট্ট কামড়াটির এক কোণে একটা জানালা।নীতু জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে উদ্বেগ ও সঙ্কোচবিহীন দৃষ্টিতে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে ঈষৎ হাসি। অভীক সেদিকে তাকিয়ে থাকে।অভীকের ইচ্ছে করে নীতুকে জিজ্ঞেস করতে,”এই মেয়ে সত্যি সত্যি কি তুই আমার বউ হবি?লাল টুকটুকে বউ!”
অভীক বলতে পারে না।চোখের পলকও ফেলেনা। একদৃষ্টিতে দেখে তার কাননবালাকে! কিছুক্ষণ পর অভীক শান্ত কন্ঠে বলে,বড়ো, মা কই?মায়ের সাথে কথা বলবো।”
অনীক ভিডিও কল দিলে অভীক ফোন নিয়ে বারান্দায় যায়। রুশিয়া বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মমতা নিয়ে। অভীক ফিসফিস করে বলে,”মা আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি!”
রুশিয়া বেগম হাসেন।পশ্রয়ের হাসি।মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় অভীকের কোন আবদার পূরণ করলেই অভীক এভাবেই বলতো।অভীকের দিকে তাকিয়ে দেখেন মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।কান্না আটকে রাখলে অভীকের মুখ এমন দেখায়।রুশিয়া বেগম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন,”কি হয়েছে বাবা?”
অভীক ঝরঝর করে কেঁদে দেয়।ছোট্ট বাচ্চাদের মত কান্না থামিয়ে বলে,”আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে মা!এমন সারপ্রাইজ কেউ দেয়?যদি হার্টফেল করে মরে যেতাম, তবে নীতুকে কি পেতাম বলো?”
রুশিয়া হাসবে না কি কাঁদবে ভেবে পায় না।
“তুমি এলে না কেন মা?”

“যেখানে নীতুর বাবা মা উপস্থিত নেই সেখানে আমি থাকি কি করে?মেয়েটার মন খারাপ হতো না?বিয়েটা করে ফেল বাবা।নীতু তোর হলেই আমি শান্তি পাই।”

অভীক ভয় ভয় কন্ঠে বলে,”মা নীতুকে আমি ভালো রাখতে পারবো তো?”

রুশিয়া বেগম ছেলের প্রশ্নে অপলক চেয়ে থাকেন।কতটা ভালোবাসলে এমন প্রশ্ন করা যায় তিনি ভেবে পান না!

কাজি চলে আসতেই বিয়ে পড়ানো শুরু হয়।অভীকের মনে অজানা উত্তেজনা! ভালোবাসার মানুষটিকে চিরদিনের জন্য আপন করে পাবার চাপা খুশি ঝিকঝিক করছে! নীতু মাথায় আঁচল টেনে বসে।অভীক সেদিকে তাকিয়ে থমকায়।সাজ বিহীন মুখশ্রী!তবুও কি মায়া।কপালে ছোট ছোট চুলগুলো ছড়িয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি নত!অভীকের ইচ্ছে করে নীতুকে ছুঁয়ে দিতে!বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।আজ সত্যিই তাদের বিয়ে। নীতু এতক্ষণ লজ্জা না পেলেও এখন ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।তার উপর অভীক লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
নীতু মোটেই এভাবে বিয়ে করতে চাইনি।মা বাবা ছাড়া! কিন্তু যখন রুশিয়া বেগম আর মা ফোন করে বললো,তারা আগে চায় বিয়েটা হোক তারপর সবাইকে জানিয়ে প্রোগ্রাম করবে।তখনই নীতু বুঝেছে মা ভয় পাচ্ছে। যে মেয়েটির বিয়ে হতে গিয়ে বারবার বিয়ে ভেঙে যায়।তার জন্য চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। নীতু তবুও রাজি ছিলো না।বিয়েটা করতে মন সায় দিচ্ছিল না।অনেক ভেবেছে নীতু।কোন কূল কিনারা পাচ্ছিল না!তাজের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে! সেতুর মুখটা মনে পড়তেই শেষে ভাবনা থামিয়ে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে!অভীকের সাথে নীতুর নিজেকে জড়াতে ভয় কাজ করছিল।সত্যি ভালোবাসে তো?কিন্তু আজ বিকেলে অভীকের সাথে কথা বলতেই মনে হলো।মাঝে মাঝে কিছুটা বেপরোয়া হতে হয়। অনীক আর জায়েদ গতকালই ঢাকা এসে সবকিছু ঠিক করে রেখেছিল।তারা অভীককে সারপ্রাইজ দিতে চায়!নীতু আর নিষেধ করেনি।

অভীক খসখস করে সাইন করে দিলো।নীতুর হাতটা কেঁপে উঠলো। চোখে বর্ষার জল জমলো।বাবার মুখটা মনে পড়তে ফুপিয়ে উঠলো।জায়েদ এসে পাশে দাঁড়ালো।স্নেহপূর্ণ হাত রাখলো মাথায়। নীতু অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,”দাদাভাই!”
জায়েদ ভেজা কন্ঠে বললো,”ভরসা রাখ নীতু। তোর দাদাভাই তোর পাশে আছে,থাকবে।তুই কি জানিস আজ মা ভীষণ খুশি হবে,বাবা শান্তিতে ঘুমাবে ঘুমের ঔষধ ছাড়াই,তোর দাদাভাইর বুকে শান্তির বাতাস বইবে!”

নীতু আর কিচ্ছু বললো না।সাইন করে দিলো।নীতুর মাথায় তখনও জায়েদের ভরসার হাতখানা রাখা।কাজি কবুল বলতে বললেই অভীক নীতুর বাম হাতটা শক্ত করে নিজের মুঠোয় নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে,”কবুল, কবুল, কবুল!”
নীতু জল পুকুর চোখে অভীকের দিকে চাইলো।ডাগর ডাগর সে চাহনি অভীককে ভিতর থেকে খুন করে ফেললো যেনো!নীতু থেমে থেমে তিন কবুল বললো। অভীকের মনে হলো সাত আসমানের সকল রহমত তার হৃদয়কে ছুঁয়ে দিল মাত্র! বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,”আমার বউ!আমার একান্ত ব্যক্তি গত কাননবালা!”

বিয়েটা হয়ে যেতেই অভীকের ইচ্ছে করছে নীতুকে একবার জরিয়ে ধরতে।বুকের ভিতর ঝাপটে ধরে মনের সকল ছটফটানি বন্ধ করতে কিন্তু নীতু তো তার দিকে তাকাচ্ছেই না।অভীক নিজের খুশি আটকে রাখতে পারলো না জায়েদ আর অনীককে জরিয়ে ধরে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো।জায়েদ রসিকতা করে বললো,”এত ধন্যবাদে চিড়ে ভিজবে না ভাই।বিয়ে হয়েছে শুধু, এখনো সামাজিক স্বীকৃতী পাও নি।তাই দুজন দূরে দূরে।আগে প্রোগ্রাম তারপর বউ তোমার।এখন শুধু চোখে দেখেই চিড়ে ভেজাতে হবে।”
অভীক মুখ গোমড়া করে বললো,”আমার সাথে অন্যায় হচ্ছে! ”
অনীক সে কথা শুনে হেসে ফেললো। নীতু লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে দিশা পেলো না।সেদিকে তাকিয়ে অভীক মুচকি হাসলো।নীতু আনমনে তাকাতেই অভীক চোখ টিপ মারলো।নীতুর মুখ হা হয়ে গেলো।বিয়ে হলো পাঁচ মিনিটও হয়নি এখনই অসভ্যতামি করছে। কি আশ্চর্য!

গাড়ি চলছে মিরপুরের দিকে।অনীক, জায়েদ এতক্ষণ কথা বললেও এখন তারা ঘুমাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত তারা।নীতু গাড়ির কাঁচ গলে রাতের শহর দেখছে।আর অভীক দেখছে নীতুকে। কৃষ্ণবতীর মুখ জুড়ে কি ভীষণ মায়া! অভীকের বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে! পাশে বসা এই মেয়েটি তার বউ!ভাবতেই অন্যরকম প্রশান্তিতে মন ছেয়ে যায়। অভীক কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে নীতুর কানের কাছে বলে,”আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের বিয়ে হয়ে গেছ!”
নীতু কেঁপে উঠলো! কিছু বললো না আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কেবল হাসলো। অভীক ছটফট করে বললো,”তোমার মনে হচ্ছে না আমাদের সাথে অন্যায় হচ্ছে? বিয়ের পর দূরে রাখার মানে কি?যত্তসব! ”
নীতুর ভীষণ হাসি পেলো।কিন্তু হাসলো না।পাশাপাশি অবাকও হলো। অভীক তাকে তুমি করে বলছে।নীতুর মনের কথা যেন বুঝে ফেললো অভীক। অভীক হাতের আঙুলে নীতুর আঙুল লক করে ফেললো।ফিসফিসিয়ে বললো,”আপনাকে ‘আপনি’বলতে যতটা ভালো লাগে তার থেকে সহস্রগুণ ‘তুমি’ বললে বুকের মাঝে শান্তি লাগে!”
নীতু পুনরায় কেঁপে উঠলো! এই লোক পাগল! মস্ত বড় পাগল!

*****
অভীক সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারলো না।নিজেকে সদ্য প্রেমে পড়া যুবক মনে হচ্ছে! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোবাসার উত্তাল ঢেউ! কেবলই মনে হচ্ছে, সে জিতে গেছে!পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর মেয়েটিকে সে পেয়ে গেছে! অনীককে ঘুমাতে দিল না।একটু একটু পর পর তার ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করছে,”বড়ো,নীতু এখন কি করছে?”
শেষে অনীক চিল্লায়ে উঠে বলে,”আল্লাহর দোহাই লাগে ঘুমাতে দে…..তোর বউ কি করছে তা আমি জানি না।সত্যি জানি না!”

আর নীতু? তার কি ঘুম হয়েছিলো? হ্যা নীতু পরম শান্তিতে ঘুমিয়েছে।অনেকদিন পর নির্ভার ঘুম দিয়েছে! সেতু, সাথি অবাক হয়ে দেখলো আজ নীতুর মুখে কেমন অজানা শান্তি বিরাজ করছে!
ফজরের আজান পড়তেই নীতুর ঘুম ভেঙে যায়।নামাজ পড়ে উঠতেই অভীকের ফোন কল নীতুকে আশ্চর্য করে। রিসিভ করে সালাম দিতেই অভীক ব্যগ্র কন্ঠে বলে,”একটু ছাদে আসবে নীতু…প্লিজ! ”
নীতু কি বলবে ভেবে পেলো না।কতক্ষণ পর আসছি বলে কল কেটে দেয়। চাদর পেচিয়ে ধীর পায়ে ছাদে উঠে।শেষ রাতের ঠান্ডায় শরীর ঝিম হয়ে আসে।ঠোঁট দুটো তির তির করে কাঁপতে থাকে।
অভীক হুডি জ্যাকেট পড়ে ছাদে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটির অপেক্ষা করছে। সময় যেন থমকে গেছে।ছটফটিয়ে পায়চারী করছে অভীক।হাতের তালু ঘসছে।মনে হচ্ছে কতদিন হলো নীতুকে দেখেনি।বুকের ভিতর যন্ত্রণা হচ্ছে! এ কেমন অসুখ?একটা মেয়ে কখন তাকে এতটা কাবু করে ফেললো?
ঠিক তখনই নীতু এসে দাঁড়ায় ছাদের দরজায়,ঠান্ডায় কাঁপছে অনবরত! অভীকের কলিজায় যেন পানি আসে।বুকের যন্ত্রণা থেমে যায়!উল্কার বেগে এসে নীতুকে জরিয়ে ধরে বুকের মাঝে!এতটা শক্ত করে ধরে যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আকস্মিক জরিয়ে ধরায় নীতুর শরীর জুড়ে শিহরণ তুলে পৌরষালী উত্তপ্ত ছোঁয়া! তীব্র শীতলতায় যেন এক টুকরো ওমের ছোঁয়া! নীতুর পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে! প্রথম কোনো পুরুষের ছোঁয়া!আর পুরুষটি তার বর।বৈধতার ছোঁয়া! নীতু নিজের ভার সামলাতে পারে না।কাঁপতে থাকা শরীর ছেড়ে দেয় অভীকের বুকে! অভীক বুঝতে পারে নীতু কাঁপছে।আরো একটু শক্ত করে ধরে রাখে বুকের মাঝে। সকল অস্থিরতা কমে যায়!হুট করেই অভীকের সব কিছু অন্যরকম মনে হয়! এই পৃথিবীর বাতাসেও যেন জান্নাতের খুশবু!
অভীক এত শক্ত করে ধরেছে নীতুর দম বন্ধ হয়ে আসে। বিড়বিড় করে বলে,”আমাকে ছাড়ুন! দম আটকে আসছে।”

অভীক হাতের বাঁধন আলগা করে,পুরোপুরি ছেড়ে দেয় না।নীতু সরে যেতে চায়।অভীক বাঁধা দেয়।শীতের ভোরে আধো আলো আধো কুয়াশায় নীতু চেয়ে থাকে অভীকের চোখে।কি শীতল চাহনি! নীতু চোখ নামিয়ে ফেলে।অভীক এক হাতে নীতুকে আগলে রেখে আর একহাতে নীতর গাল স্পর্শ করে।

নীতুর সাড়া অঙ্গে মরণ কাঁপন ওঠে! অভীক মোহাবিষ্ট ঘোরলাগা উন্মাদ কন্ঠে বলে,”ভালোবাসি নীতু!ভীষণ ভালোবাসি! বিশ্বাস করো.. এতটা ভালোবেসে কখন ফেললাম আমি?নিজেও জানি না!শুধু জানি ভালোবাসি! ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতটা ভালোবাসার পর আর ভালোবাসা যায় না!নিজস্বত্তাকে বিকিয়ে ভালোবাসা নাকি অভিশাপ? তাই সই! তবুও ভালোবাসি আমার কাননবালা!”

নীতুর দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসে।অভীকের উত্তপ্ত কথার ছোঁয়া সাড়া মুখে আঁচড় কাঁটছে।অস্থিরতায় গাঁট হয়ে যায় মন!নীতু ভালোবাসে না এই মানুষটাকে তবুও কেমন অতল মায়া কাজ করে।অভীকের ছলছল চোখের চাহনি নীতুর হৃদয়ে বর্শার তীব্র আঘাত হানে।এ কেমন উত্তাল টান নীতু জানে না।শুধু জানে এমন করে ভালোবাসলে নীতু না ভালো বেসে থাকতে পারবে তো?

নীতুর অস্থিরতা দেখে অভীক মৃদু হাসে।এরপর আলতো করে নীতুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় অভীক। নীতু পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। অভীক নীতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”ভয় পেও না।তোমাকে যে আমি পেয়েছি এটা এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না।তাই আমার আচরণ হয়তো তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।জোর নেই কোন….দিনশেষে তুমি আমার, এটাই আমার প্রশান্তি! ”

নীতু হুট করে দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে দেয়। অভীক পুরোই ভ্যাবাচেকা! নীতু মুখ ঢেকেই বলে,”চুপ করুন আপনি। এতটা ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই আমি। এতটা ভালোবাসবেন না!সহ্য হবে না আমার কপালে!কোন কৃষ্ণবতী এতটা ভালোবাসা পায় না!”

অভীক হাসে। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে।আকাশ ফর্সা হচ্ছে,কমলা রঙ ছড়িয়ে সূর্য মামা উঠছে।কয়েকটা পাখি উড়ে এসে বসে ছাদের রেলিং-এ। অভীক নীতুর মুখটা তালুবন্দী করে বলে,”আমি তোমার সুন্দর হৃদয়কে ভালোবাসি, কোন সুশ্রী রূপকে নয়!……”
পেলব সূর্যের আলো তির্যকভাবে নীতুর মুখে একপাশে পড়ছে।তেলতেলে কৃষ্ণ মুখশ্রী কমলা আলোয় চকচক করছে,পদ্মদিঘীর মত ডাগর ডাগর চোখ দুটো বর্ষায় টইটম্বুর, ঘন পাপড়িগুলো পিট পিট করছে,ঠোঁটের কোণে ঈষৎ অভিমান! নীতুর এমন মায়াময় রুপ দেখে অভীকের বুকে ভাঙচুর হয়! কে বলে এই নারী সুন্দর নয়?তবে সুন্দর কি তারা জানেই না!
অভীক হাত ধরে নীতুকে নিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়ায়। চুলের খোঁপা আলতো হাতে খুলে দিয়ে নরম স্বরে বলে,” পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারীটি হলো আমার বউ!যাদের চোখে তুমি অসুন্দর, তারা যদি আমার চোখ দিয়ে দেখতো তবে তোমাকে কখনো অসুন্দর বলতে পারতো না।কেউ কি কখনো জানবে? আমি তোমাকে দেখে পুলকিত হই!তুমি আমার চোখে সুন্দর,ভীষণ সুন্দর, আকর্ষণীয়,আবেদনময়ী, মোহনীয়!এতটাই সুন্দর। বুঝেছো মিসেস তাশরীফ অভীক? ”

নীতুর লজ্জায় কানদুটো গরম হয়ে আসে!এমন কথা কেউ বলে?নীতুর লজ্জা রাঙা মুখ দেখে অভীক হো হো করে হেসে ফেললো! হুট করে অভীকের মনে হলো আসলেই পৃথিবীর সব কিছু সুন্দর! এই থালার মত সূর্যটা তাও সুন্দর! ঠিক তার নীতুর মত।

**********
কেটে গেলো কয়েকটা দিন। দুপুর বারোটা।আজ সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরম।শীতকালে এমন অসহ্য গরম সেতুর মেজাজ খারাপ করে!গায়ে পেঁচানো শালটা ব্যাগে ভরে ভালো করে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে! আবার ক্লাস একঘন্টা পরে। একটা ঘন্টা অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না।আবার হাঁটার শক্তিও পাচ্ছে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্যাম্পাস চত্বরে! সবকিছুই কেমন খাঁ খাঁ করছে!ঠিক সেতুর খাঁক হৃদয়টার মত। শরীরের ক্লান্তি আর মনের অশান্তি মিশে কান্নার ঢেউ আচঁড়ে পড়ে।ফুপিয়ে ওঠে সেতু।এত কষ্ট কেন চারপাশে?
মোবাইলটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ তুলছে।না দেখেও সেতু বুঝতে পারে তাজ কল করছে।সেতু রিসিভ করে না।মেরুদণ্ডহীন একটা মানুষের সাথে সেতুর কথা বলতে ইচ্ছে করে না! তাজের কৃত্রিম দায়িত্ব সেতুকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তাকে ভালোবাসে না এতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না সেতুর। সারাজীবন ভালো না বাসলেও হয়তো একসাথে থাকা যায় কিন্তু যে মানুষটার নিজস্ব কোন স্বকীয়তা নেই তার কাছে কিভাবে ভালো থাকবে সেতু? মা বললো তাই ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করলো অন্য কাউকে।আবার প্রাক্তন বললো, তাই বউকে মেনে নিচ্ছে!সেতু ছোট হতে পারে অবুঝ নয়।সেতু জানে তার প্রতি এই দায়িত্ব কেবল নীতু আপি বলেছে বলে করছে মানুষটা।কোন দায়িত্ববোধ থেকে নয়।আজ যদি আপি বলে, সেতুকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দিবে।যে মানুষটা নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।তার কাছে কি আশা নিয়ে ফিরবে সেতু? সেতু জানে আপি কখনো এমন কিছু বলবে না তবুও সেতু এটা মানতে পারে না তার স্বামী অন্য কারো কথায় স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছে!কোন ভালোবাসা বা দায়িত্ববোধ থেকে নয়!অপমানে মুখ লাল হয়ে আসে সেতুর! সেতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,”আমি কখনো আপনাকে ক্ষমা করবো না তাজ।কখনো না!”
ঠিক তখনই মেহেদী দৌড়ে এসে বসে তার পাশে।সেতু দ্রুত চোখের জল মুছে ফেলে।মেহেদী ব্যঙ্গ করে বলে,”সেতুমন্ত্রীর কি মন খারাপ? ”
ক্লাসের ভিতর সবার থেকে মেহেদীর সাথেই সেতুর বন্ধুত্ব ভালো। সেতু মেজাজ নিয়ে বলে,”মেদু মেজাজ খারাপ করিস না।”
মেহেদী ভালো করে তাকিয়ে দেখে সেতুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। তাই চিন্তিত স্বরে বলে,’প্রেসার ফল করেছে নাকি তোর?”

“জানি না।কিছু খেতে পারি না।মাথা ঘুরায়।তারউপরে পড়ার চাপ। আর ভালো লাগে না।”

মেহেদী বিরক্ত কন্ঠে বলে,”তোরা মেয়েরা হলিস খালি খাই খাই স্বভাবের।আরে হয় বিয়ে শাদী করে সংসার করবি নতুবা পড়বি তা না,বিয়ে করেছি,বাচ্চা হবে, আবার পড়ছিস….এত কিছু তোদের একসাথে লাগে কে?”

সেতু মিনমিন করে বলর,”আর তোরা হলিস স্বার্থপর!”
মেহেদীর বুকে কথাটা লাগে।তেঁতিয়ে উঠে বলে,”তোকে দেখেই মনে হচ্ছে তুই ক্ষুদার্ত। চল খাবি।”
সেতু বাঁধা দেয়। কিন্তু মেহেদী নাছোরবান্দা! সকালে আপি কতকিছু খায়িয়ে দিল কিন্তু কিছু পেটে রাখতে পারে নি।সব ফেলে দিয়েছে।এখন আবার একই কষ্ট!
সেতুর শত বারণ অমান্য করে মেহেদী মোল্লার রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়।এখানে কয়েকপ্রকার ভর্তা পাওয়া যায়।তাই দিয়ে ভাত অর্ডার করে।সাথে লেবু মাখানো পোড়া মরিচ দিয়ে। অনেকদিন পর সেতু পেট ভরে ভাত খেলো।প্রতি ভাতের লোকমায় মেহেদী একটা মরিচমাখা লেবু এগিয়ে দিলো।খাওয়া শেষে সেতু বললো,”ধন্যবাদ! ”
মেহেদী চেঁচিয়ে উঠে বলে,”তোর ধন্যবাদ তুই গুলে খা ছেমড়ি বদমাস।”
সেতু হেসে দেয়। মুহুর্তেই বমি এসে পড়ে।সাথে সাথে মেহেদী দৌড়ে মসলা পান নিয়ে আসে। সেতু তা খেতেই বমি কমে যায়। মেহেদী নিজের টোটকায় নিজেই কলার নাচিয়ে হাসে। সেতুর শরীর খারাপ বলে মেহেদী তার হোন্ডা করে সেতুকে বাসার সামনে নামিয়ে দেয়।সেতু বাই বলে চলে যেতে নিলে মেহেদী ডাক দেয়,”সেতু শোন।”

“বল।”….. সেতু দাঁড়িয়ে বলে।

” জীবনে সমস্যা আসবেই ভেঙে পড়বি না।কান্নাকাটি কোন সমাধান নয়। এখন যা!”
সেতুর চোখ ছলছল করে ওঠে।তা দেখে মেহেদীর বুক ধ্বক করে ওঠে।অজানা ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে মেহেদীর।সেতু চলে গেলে মেহেদী বিড়বিড় করে বলে,”ফর্সা মেয়েরা কাঁদলে তাদের ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে!এটা কি সেতু জানে?তাকে কেউ বলেছে?”
এসব ভাবতে ভাবতেই মেহেদী হোন্ডায় টান মারে।মেহেদী অনুভব করে তার চারদিকে কেমন উত্তপ্ত বিষের বাতাস!

চলবে,
খুলনা থেকে আসার পর শারিরীক ও মানসিক ভাবে আমি অসুস্থ। কি লিখছি নিজেও জানি না।আজকের পর্বের অনুভূতি জানাবেন।কে খুশি কে বেজার তাও বলতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here