#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৩
সকাল আটটা।জায়েদ বসে আছে শশুড়ের বিছানার পাশে। সুরভি এসে নিঃশব্দে চায়ের কাপ রাখলো জায়েদের সামনে।সুরভির দিকে তাকিয়ে জায়েদের কপালে ভাঁজ পড়লো।সুরভির মুখে আমাবস্যার ছোঁয়া! তার কারণ অবশ্য জায়েদ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে।এখানে প্রবেশের সময় নিখিলের উচ্চ কন্ঠ শুনেছিল।সুরভি চলে যেতেই জায়েদ নীতুর বাবাকে বললো,”বাবা আজ একটা জরুরী কথা বলতে এসেছি।”
নীতুর বাবা উদগ্রীব হয়ে তাকালেন।পাশে মহিমা বেগম বসে আছেন। জায়েদ ফের বলে,”বাবা, নীতুকে বিয়ে দিতে চাই…এতদিন নীতুর বিয়ের জন্য আমি কোন জোরাজোরি না করলেও এবার করতে চাই।আমাদের নীতুকে যোগ্য মানুষটির হাতে তুলে দিতে চাই..!”
নীতুর বাবা সব শুনে ছলছল চোখে কেবল জামাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।মহিমা বেগমও যেন প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আমাদের সমাজে একটা মেয়ে যতই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট হোক তবুও সেই মেয়েটির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বাবা মা নিশ্চিন্ত হতে পারে না!
নীতুদের বাসা থেকে বের হতেই জায়েদ দেখলো নিখিল দাঁড়িয়ে আছে।অফিসে যাবে তাই রিকশার জন্য ওয়েট করছে।জায়েদ হেসে নিখিলের কাঁধে হাত রেখে বললো,”দাঁড়িয়ে না থেকে চলো হাঁটি নিখিল…..”
নিখিলের মন মেজাজ বিশেষ ভালো নেই।ইদানীং সুরভিকে বড় অসহ্য মনে হয়।নিখিল কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করলো।জায়েদ নির্বিঘ্নে একটা সিগারেট ধরালো, একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,”নিখিল আমাদের মানসিকতার এত অবনতির কারণ কি জানো?”
জায়েদের প্রশ্নে নিখিল কপাল কুঁচকে চাইলো।জায়েদ হেসে বললো,”না জানলে শোনো আমি বলছি…..আমরা যখন কোন অন্যায় দেখি তখন প্রতিবাদ করি না।মুখ বুঁজে, চোখে পট্টি লাগিয়ে কেবল দেখি আর সেই অন্যায়কারী যখন ভালো হতে চায় তখন তাকে আমরা কোন সুযোগ দেই না।আমরা তাকে বারবার মনে করিয়ে দেই সে অপরাধী! ”
নিখিল ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।জায়েদের কথা বুঝতে বিন্দু মাত্র সমস্যা হলো না।তাই বললো,”ভাইয়া সুরভিকে দেখলেই আমার মনে হয়,ওর জন্য কেবল ওর জন্য আমার বোন তার নিজের বাসায়ও ছিল বন্দীর মত!”
জায়েদ হাসলো,তারপর বললো…..”তুমিও কিন্তু প্রতিবাদ করনি।তাহলে সুরভি কেন একা দোষি হবে?…..নিখিল যে আপন ইচ্ছায় পোষ মানতে চায় তাকে অবহেলা করতে নেই!”…….বলে জায়েদ একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো।নিখিলের কি যেন হলো?অফিসের রাস্তা রেখে বাসার রাস্তায় পা বাড়ালো।বাসায় ঢুকতেই দেখলো সুরভি জানালার ধার ঘেঁষে বসে কাঁদছে।নিখিল নিঃশব্দে হেঁটে সুরভির খুব কাছে দাঁড়িয়ে বললো,”নীতুকে কেন সহ্য করতে পারতে না সুরভি?শুধু নীতুই কেন? ও কালো বলে?”
সুরভি আচমকা কথায় চমকে তাকালো। নিখিল ফের বললো,”বলো?আমার শান্ত বোনটা তোমার কি ক্ষতি করেছিলো?”
সুরভি কি বলবে ভেবে পেল না।নিখিলের বুকে আঁচড়ে পড়ে কেবল কাঁদতে লাগলো।নিখিলও কাঁদলো নিরবে। সুরভির বিড়বিড় করে বলে, “আমার ভুল হয়েছে।প্লিজ আর এমন হবে না।”
নিখিল ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,”আর কখনো এমন করো না সুরভি!তাহলে তোমাকে খুন করে ফেলতে দুবার ভাববো না!”
সুরভি ভয় মিশ্রিত কান্নায় নিখিলকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো….. নিখিল জানাল গ্রিল শক্ত করে ধরে কেবল ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো!
*************
চা-বাগানের সূর্যদয় যে এত সুন্দর তাজ আগে বুঝতে পারে নি।তাজ এখন দাঁড়িয়ে আছে চা-বাগানের এক টিলার উপর।দৃষ্টি সূর্যউদিত আকাশের দিকে!তাজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো আকাশ পানে।সেই আকাশের বুকে কমলা রঙা সূর্যের আলোয় একটি মুখশ্রী ভেসে উঠলো….. নীতু!তার কৃষ্ণবতী!মেয়েটি কি কখনো আর বুঝতে পারবে তাজ নিঃশব্দে শুধু তাকেই ভালোবাসে!সবাই মুভ অন করতে পারে না।তাজ তবুও চেষ্টা করে!শত চেষ্টায়ও নীতুর প্রশান্ত মুখটা ভেসে ওঠে! তাজ বিড়বিড় করে বলে ওঠে,” আমার কৃষ্ণবতী কি ভেবেছো ভুলে গেছি?না ভুলিনি তো!
তোমাকে ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?
তোমাকে ভালোবাসতে যেমন আমার মন একটুও ভুল করেনি….তেমন তোমাকে ভুলে যেতে দিতেও একটুও সাহায্য করেনি আমার মন!
কত বৃথা চেষ্টাই তো করলাম!তবুও কেন তোমার মুখটা চোখ থেকে সরে না?
কেন তুমি বদ্ধ কষ্ট হয়ে বুকের কোণে জমাট বেঁধে থাকো? কেন তোমার নামটিতে পৃথিবীর সকল শান্তি নিহিত? ভালোবাসি কৃষ্ণবতী,আজীবন ভালোবাসবো সবার অন্তরালে!কেউ না জানুক….তবুও কৃষ্ণবতীর প্রতি ভালোবাসাটুকু আমার থাকুক!একান্তই আমার থাকুক!তাতে কি খুব বেশি পাপ হবে ?তবে পাপই সই!না হলে আমার…. তবুও ভালো থাকো।”
তাজের চোখ ভার হয়ে আসে।সেই ভার হওয়া চোখে আরো একটি নাম ভেসে ওঠে, সেতু! তার দায়িত্ব!কেবলই দায়িত্ব!যেখানে ভালোবাসা কোন শব্দ নেই।সেতুর মুখটা ভেসে উঠতেই তাজ কল করে বসে সেতুকে!অনবরত রিং বেজে যাচ্ছে কেউ কল রিসিভ করছে না।তাজ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে! সেতুর জন্য তার মায়া হয়!
***********
নীতু চা করছিল।সদ্য ঘুমভাঙা চোখে একরাশ আচ্ছন্ন ভাব!চা খেয়ে সাথির কাছে যাবে তারপর আবার অফিসে। ঠিক তখনই মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তাজ নামটা ভেসে উঠতেই নীতুর কপাল কুঁচকে আসে!ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাজ বলে ওঠে, হ্যালে নীতু! কেমন আছো?”
অস্বস্তিতে নীতুর কন্ঠে রোধ হয়ে আসে!তাজ নামক মানুষটা কত সহজেই না স্বস্তি থেকে অস্বস্তিতে রুপান্তরিত হলো।নীতু মৃদু কন্ঠে বলে,”ভালো আছি।”
তাজ আবার বলে,”সেতুর কাছে ফোনটা একটু দিবে? অনেকগুলো কল করলাম ধরছেই না ফোন….”
নীতুর মনে হলো সকল অস্বস্তি ওই চায়ের কাপের ধোঁয়ার সাথে সুরসুর করে মিলিয়ে যাচ্ছে! নীতু হেসে বললো,”অবশ্যই! ”
সেতু এলোমেলো ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে আছে।দৃষ্টি বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনে। গুনে গুনে সাতবার কল করেছে তাজ!সেতু চেয়ে চেয়ে দেখেছে কিন্তু রিসিভ করতে ইচ্ছে হয়নি!তখনই নীতু এসে বললো,”নে ধর তোর কল!”
সেতু হাত বাড়িয়ে ফোন কানে ধরলো।নীতু চলে গেলো। ওপাশ থেকে তাজ বলে উঠলো, “কেমন আছো সেতু?এত কল দিচ্ছি ধরছো না কেন?”
সেতুর নির্বিকার উত্তর, “তো….? ”
তাজ বুঝতে পারলো সেতু ইচ্ছে করেই কল রিসিভ করেনি। তবুও বললো,”কেমন আছো বললে না যে?বমি করেছো সকাল থেকে”
“একদম ঢঙ করবেন না।এসব করে আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?এত টেক কেয়ার নামক ভালোবাসা দেখানোর মানে কি?”
তাজ মৃদুস্বরে বললো,”উহু!কোন ভালোবাসা আমি দেখাইনি কেননা আমি তো তোমাকে ভালোই বাসিনা! ঢঙ তখনই হত মনে এক আর মুখে এক কথা বলতাম! তুমি আমার স্ত্রী তোমার খোঁজ নেয়া আমার কর্তব্য!”
সেতুর মনে হলো তার কলিজাটা কেউ খুবলে খাবলে ছিঁড়ে ফেলবে! এমন কঠিন কথা কি সুন্দর অবলীলায় বলে গেলো মানুষটা! সেতু ফোঁস করে বলে,”কর্তব্য মাই ফুট! ভালোবাসবেন না আবার জোর গলায় স্ত্রী বলেন কোন সাহসে?”
“যে সাহসে তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে! আমি তোমাকে ভালো না বাসি।তুমি বাসো তো?তাতেই হবে। এমন অনেক সম্পর্কই আছে যেখানে কোন ভালোবাসা থাকেনা তবু তারা দিনের পর দিন এক ছাদের নিচে বসবাস করে।আমরা না হয় তাই করলাম সেতু?”
সেতু কঠিন স্বরে বলে,”আমি আপনাকে যেমন ভালোবাসি তেমন আপনাকে আমি চাইও না।শুনে রাখুন তাজ….ভালোবাসি তাই বলে কোন করুণা আমি নিবো না। ”
তাজ ব্যগ্র স্বরে বলে,”এমন কঠিন করে কথা বলছো কেন?”
“কারণ আমি বড় হয়েছি.”….. সেতুর কাটকাট উত্তর!
” এত দ্রুত বড় হতে নেই….বড় হলেই বাস্তবতা ভালো থাকতে দিবে না।”
“একদম সাহিত্য কপচাবেন না।ওসব আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়!”…. বিষাক্ত সাপিনীর মত বলে সেতু!
তাজ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,” চা-বাগানের সূর্যদয় খুব সুন্দর হয় সেতু?তুমি কি তা জানো?তোমাকে একদিন এখানে নিয়ে আসব….দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবে।”
সেতু বিরক্ত কন্ঠে বলে,”রাখছি।”
“আমি কি রাখতে বলেছি?তবে কেন করছো এমন?”
“কারণ আপনি জোর করে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন….আপনার কথা বলতে মোটেই ভালো লাগছে না!যা আমি বেশ বুঝতে পারছি।”
তাজ কিছুটা হেসে বলে,”সত্যিই তুমি বড় হয়ে যাচ্ছো!ফিরে চলো সেতু…!”
চলবে,
এতদিন পর দিয়েছি তাও বড় করে লিখতে পারিনি।তার জন্য সরি!সত্যি বলছি পুষিয়ে দিবো খুবই দ্রুত।।।।