#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩০
নীতুকে নিয়ে পুরো ডক্টর বোর্ড যেন যমদূতে টানাটানি করলো।তবুও জ্ঞান ফিরলো না। বডি রেসপন্স করছে না।
তিনটা দিন কেটে গেলো চরম উৎকন্ঠা আর হারানোর ভয় নিয়ে।পুরো পরিবার ঠায় বসে রইলো হসপিটালের করিডোরে। একমাত্র অনীক আর রিশা শক্ত রইলো। অনীক শত চেষ্টা করে সবাই খাওয়ালো।তা শুধু নামমাত্রই ছিলো।কিন্তু অভীক শুধু কাপের পর কাপ চা পান করে তিনটা দিন পার করলো।অভীকের কার্যকলাপে অনীক যারপরনাই অবাক হলো।বাবার মৃত্যুতে অভীক কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু এমন করে ভেঙে পরেনি। অনীক মনে মনে শুধু প্রার্থনা করতে থাকলো নীতুর জন্য, না হলে তার ভাইটা বেঁচে থেকেও মৃত্যুসম কষ্ট পাবে!
রিশার হম্বিতম্বিতে পুরো হসপিটালের নার্স, ডক্টর বিরক্ত! একটা মিনিট কাউকে সুস্থ থাকতে দিলো না।রিশার ব্যবহারে এমন কিছু একটা থাকে যার প্রেক্ষিতে কিছু বলা যায় না।
রাতের শেষ প্রহরে যখন আজানের ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠলো তখন একজন নার্স এসে বললো,”আপনাদের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে,সে এখন আউট অফ ডেঞ্জার! এখন অবজারভেশনে আছে সকাল দশটায় কেবিনে দিবো।”
মহিমা বেগম সাথে সাথে বলে উঠলেন,”আলহামদুলিল্লাহ! ”
সকলের চোখে খুশিতে পানি এসে গেলো।সেতু নিজের অজান্তেই তাজের হাত চেপে ধরলো।তাজ ফিসফিস করে বললো,”আমি জানতাম তুমি ফিরবে!তোমাকে যে ফিরতেই হতো নীতু!”
ঠিক সেই মুহুর্তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অভীক করিডোরের মেঝেতে শোকরানা সেজদায় লুটিয়ে পরলো।প্রতিটি ব্যক্তির চোখ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। সাথে সাথেই জায়েদ অনুভব করলো,নীতুর প্রাপ্ত সুখ খুবই সন্নিকটে!আর সেই সুখ দু’হাত ভরে এনে দেওয়ার মানুষটা এই অভীক ছাড়া আর কেউ নয়!”
অভীক যখন সেজদা শেষে দাঁড়ালো তখন চোখ দুটো ভেজা!কন্ঠ অবরুদ্ধ! ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে!মাথা ঝিমঝিম করছে।অনীক ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,”ভাই তুই ঠিক আছিস?”
অভীক বড়সড় দম ফেলে বললো,”বড়ো,তুমি এদিকটা সামলে নিও প্লিজ।আমি আসছি।”……বলে অভীক বড় বড় পা ফেলে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে অনীক ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো! ভালোবাসার মত আগ্রাসী কিছু কি আর আছে?….অনীক জানে না!
অভীক বাসায় ফিরলো ক্লান্ত শরীরে। রুশিয়া বেগমকে নীতু ভালো আছে সে কথা বলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।আধা ঘন্টা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলো।বারবার চোখের সামনে নীতুর রক্তাক্ত মুখটা ভেসে উঠলো! নিজের উপর প্রচন্ড রাগে ওয়াশরুমের দেয়ালে পর পর চারটা ঘুসি মারলো।চিৎকার করে বলে উঠলো, “সব আমার জন্য হয়েছে!সব……আমি আর কখনো তোমাকে জোর করবো না।তবুও তুমি ভালো থাকো নীতু!ভালো থাকো।”
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।টকটকে লাল চোখে মুহুর্তেই ঘুম নেমে আসলো।আধো ঘুমেই শুনতে পেলো মা খাওয়ার জন্য ডাকছে।অভীক তার সাড়া দিতে পারলো না।সমস্ত ইন্দ্রিয় মুহুর্তেই ক্লান্তির ভারে ঘুমিয়ে পড়লো!
*************
নীতুর ঘুম ভাঙলো দুপুর দুটোয়।কাঁচের জানালা গলে দুপুরী রোদ এসে চোখে মুখে পড়লো।নীতু চোখ কুঁচকে তাকালো! চোখের পলক ফেলতে গিয়ে অনুভব করলো চোখের পাতা নাড়াতেও ব্যথা লাগছে।একটু পরই অনুভব করলো সমস্ত শরীর বিষের মত ব্যথা!হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ।মাথায় ব্যান্ডেজ,শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিঁচের আঘাতে কাঁটা চেরার দাগ।হাতটা নাড়াতে গেলেই ক্যানোলার জায়গায় ব্যাথা পেয়ে উহ করে উঠলো।সাথে সাথে মহিমা বেগম দৌরে এসে মেয়ের পাশে বসলো।নীতু মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।ফাটা ঠোঁট নিয়ে সে হাসি বড় বিদঘুটে লাগলো দেখতে! মহিমা বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলো।কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে? ভেবে পেলেন না।এত ব্যথা নিয়ে কি করে হাসতে পারে।
নীতু মৃদু স্বরে বললো,”কেঁদো না তো মা!তোমার কান্না দেখতে ভালো লাগছে না।”
মহিমা বেগম সাথে সাথে চোখ মুছে ফেললেন। জায়েদ এসে মাথার কাছে বসলো।নীতুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।জায়েদের চোখে পানি।তা দেখে নীতু বললো,”তোমরা সবাই এভাবে কাঁদছো কেন?আমি তো সুস্থ এখন।”
জায়েদ কিছু বলতে পারলো না।উঠে চলে গেলো।মিতু ফোন বাড়িয়ে ধরতেই ফোনের স্ক্রিনে বাবার কান্না মাখা মুখ ভেসে উঠলো। বাবার মুখটি দেখার সাথে সাথেই নীতুর চোখে পানি এসে গেলো।ধীর কন্ঠে বললো,”বাবা!আমার বাবা!কেঁদো না।দেখো,আমি ভালো আছি।”
কান্নার কারণে নীতুর ঠোঁটের পাশের সেলাইতে টান লেগে রক্ত বের হতে শুরু করলো।মিতু দ্রুত ফোনটা কেটে দিলো।টিস্যু দিয়ে বোনের চোখ মুছে দিলো।ইতু এগিয়ে এসে নীতুর হাতের পিঠে চুমু খেলো।নীতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।এই মানুষ গুলো এত ভালোবাসে তাকে এক্সিডেন্ট না হলে জানতেই তো পারতো না।নিখিল এগিয়ে এলো না।ঠায় বসে রইলো অপর পাশের বেডে।নীতু চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো।তারপরও এগিয়ে এলো না।নীতু এবার ডাকলো,”ভাইয়া…”
নিখিল অশ্রুসজল চোখে তাকালো।এরপর এগিয়ে এসে ধমকে বললো,”বড় হয়েছিস এখনো রাস্তা পেরোতে শিখলিনা।তবে কিসের বড় হলি, বলতো?”
নীতু হাসলো ভাইয়ের কপট রাগ দেখে।নীতু চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,”সেতু কই?”
মহিমা বেগম বললেন,”জামাইয়ের সাথে নিচে গেছে।”
নীতু ওহ বলে চোখ বন্ধ করলো।চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে।ঘুমের ঔষধের কারণে হয়তো!নীতু শত চেষ্টা করে জেগে থাকতে পারলো না।গাঢ় নিগুঢ় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলো।ঘুম জড়ানো চোখেই একটা স্বপ্ন ভেসে উঠলো! মনখারাপ করে অভীক দাঁড়িয়ে আছে।আশ্চর্য!মানুষটার কিসের এত মনখারাপ?
নীতু জিজ্ঞেস করলো,”আপনার মন খারাপ কেন মি.অভীক?”
স্বপ্নের অভীক কোন জবাব দিল না।কেমন ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলো।আহা!নীতুর বড়ই মন খারাপ হলো।ইচ্ছে হলো চোখের জল মুছে দিতে।কিন্তু নীতুর তো হাতে ব্যথা!নীতুর এখন কি করা উচিত?….. কি করে চোখের জল মুছে দিবে?
************
তাজ আর সেতু পাশাপাশি বেঞ্চে বসে আছে।তাজের এক ডাকেই সেতু তার সাথে আসতে রাজি হয়েছে।এতে তাজ একটু বিস্মিতও হয়েছে।সেতুর হাতে একটা স্যান্ডউইচ আর পানির বোতল।তা ধরে চুপটি করে বসে আছে। তাজ সেতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”খাচ্ছো না কেন সেতু? দেখোছো শরীরের কি অবস্থা করেছো?নীতুর চিন্তায় এ কদিন তো কিছুই খাওনি।এবার খাও।”
সেতু নিরবে হাসলো। তা দেখে তাজ বললো,”হাসছো কেন?”
“আপনার কপট দায়িত্ব দেখে হাসি পাচ্ছে! ”
তাজ ভ্রু কুঁচকে বললো,”শোনো সেতু আমি লোক দেখানো কোন কাজ করিনা।এটা আশা করি তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।এখন কথা না বলে খাও।”
সেতু নিরবে স্যান্ডউইচটা খেলো কিন্তু পেটে রাখতে পারলো না।দৌড়ে ডাস্টবিনের কাছে গিয়ে গলগল করে বমি করে দিলো।তাজ কতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে পানির বোতল নিয়ে ছুটে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সেতু ঠিক হলো।ঢকঢক করে পানি খেলো। তাজ ধীর কন্ঠে বললো,”এভাবে চলে এলে কেন সেতু?”
“আমার থাকার কোন প্রয়োজন ছিল কি?”….. সেতুর কাটকাট জবাব।
” তুমি অসুস্থ সে কথাটা তো বলতে পারতে?”…..
“কেন আপনাকে বললে কি হতো?আপনি আমাকে মেনে নিতেন?”….. সেতু ধারালো কন্ঠে বলে।
তাজ ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,” ফিরে চলো সেতু।”
সেতু আগ্নেয়গিরির মত জ্বলে উঠে বলে,”খবরদার করুণা করবেন না।আপনার করুণার উপর এই সেতু বমি করে। বুঝেছেন?বলুন বুঝেছেন?”
তাজ কৈফিয়তের সুরে বলে,”বুঝেছি। কিন্তু করুণা করছি না।করুণা তো তোমার আমাকে করা উচিত।সেই করুণা করেই না হয় ফিরে চলো?”
সেতু হাসলো।তারপর বলল,”আপনি তো আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসেন নি।এসেছেন আপনার সন্তানের মাকে ফিরিয়ে নিতে।ঠিকাছে যান…..বাচ্চা হলে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিবো তবু আমি ফিরবো না।”
তাজ অস্থির কন্ঠে বলে,”এবার কিন্তু জেদ করছো সেতু।”
“জেদ করলে জেদই সই।আপনি দিনের পর দিন অবহেলা করবেন।তারপর আবার ফিরিয়ে নিতে আসবেন তাও বাধ্য হয়ে।তা তো হবে না।বাধ্যতা দিয়ে বশ করে কতদিন থাকবেন?যদি ভালোবাসায় বশ না হয় কেউ!”
তাজ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সেতু বলে,”আমি প্রেগন্যান্ট এ কথা নীতু আপি বলেছে আপনাকে?আর আমাকে ফিরিয়ে নিতে,তাও কি আপির বলা?তাই এসেছেন?”
“কেউ কিচ্ছু বলেনি।তুমি নীতুকে ভুল বুঝোনা প্লিজ! ”
সেতু শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,”পাগল আপনি।দুদিনের পরিচিত আপনার জন্য আমি আমার রক্তের বোনকে ভুল বুঝবো?এতটা না ভাবলেও পারতেন!শুনুন ভুল বুঝার হলে সেদিনই বুঝতাম যেদিন আমাতে বিলীন হলেন কিন্তু মুখে নিলেন অন্য কারো নাম!তবুও আমি থেকেছি, অপেক্ষা করেছি…..আজ বলছি জোর করবেন না।আমি ফিরবো না।মানিয়ে নেওয়ার বোঝা আপনার আর বইতে হবে না।”
তাজ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেতুর দিকে।সেতু সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে হনহন করে চলে গেলো।
গোল্লায় যাক তাজ আর তাজের সাথে সম্পর্ক!সেতু মনে মনে গালি দিতে দিতে হাঁটতে লাগলো।পেটের ভিতর খুদায় মোচড় দিতে লাগলো।বমির কথা মনে হতেই খুদার তাড়না কমে গেলো।
*********—
দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেলো।নীতু এখন কিছুটা সুস্থ। বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।সবাই সাথির ওখানে গেছে রেষ্ট নিতে।নীতুর কাছে কেবল রিশা।রিশার সাথে যখন দেখা হলো তখনই রিশা প্রথম যে কথা বললো তাহলো,”ডার্লিং ভেবেছিলাম বাচ্চাদের পোষাক কিনে তোমার সাথে হসপিটালে দেখা করতে আসবো,বাচ্চার কান্নার শব্দে চমকে চমকে উঠবো কিন্তু তুমি এটা কি করলে?নিজেই কাৎ হয় পড়লে।ভেরি ব্যাড!”
নীতু তখন হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না।
রিশা কমলার কোয়া ছড়িয়ে নীতুর মুখে পুরে দিয়ে বললো,”ফর্সা মালটা কে ডার্লিং?দেখতে তো ভীষণ হ্যান্ডসাম!একদম চকলেট বয়!”
“কার কথা বলছিস?”
“আরে অভী না কি যেন নাম?তোমার চিন্তায় কি না ভেঙে পরলো।এখন একদম লাপাত্তা! ”
তাইতো। হুট করেই নীতুর মনে হলো।নীতুর সাথে এখন পর্যন্ত অভীক দেখা করতে আসেনি।অফিসের সবাই এলো।রোজ দু বেলা অনীক,আন্টি এসে দেখে যায় কিন্তু অভীক আসে না।অথচ নীতু শুনেছে অভীক তার জন্য গোটা তিনটা দিন অপেক্ষা করেছে তবে এখন কেন এলো না?তখনই নীতুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অভীকের উদ্বিগ্ন মুখশ্রী। জ্ঞান হারানো ঠিক আগ মুহুর্তে যখন নীতুর চোখ বুজে আসছিল তখন অভীকের ওই ঘোলাটে চোখে বেদনা মিশ্রিত হাহাকার,হারানো ভয়,অসহায়ত্ব দেখতে পেয়েছে নীতু।এমনটা শুধু খুব কাছের প্রিয়জনের জন্য হয়!তবে কি নীতু?অভীকের প্রিয়জন!খুব কাছের কেউ?নীতু সেদিন অভীকের চোখে করুণা নয় বরং একরাশ মায়া দেখতে পেয়েছিল।ভালোবাসা নামক যে জমিনটা চৈত্রের ফাঁকা মাঠের মত খাঁ খাঁ করছিল হুট করেই সেখানে ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।নীতু চমকে গেলো!সর্বনাশ!নতুন ঝড়ের আগমনী বার্তায় নীতু কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করলো।
চলবে,