#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৯
রাতের শেষ ভাগ।পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে।কেবল ঘুম নেই হসপিটালে কাৎরাতে থাকা মানুষগুলোর। তারা ঘুমাতে পারে না।অসুস্থতা তাদের ঘুমাতে দেয় না।
রুশিয়া বেগম আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।অভীক যে ঠিক নেই তা বেশ বুঝা যাচ্ছে! ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় ছেলেকে কল দেন রুশিয়া!অনীক কতদূর এলো জানা প্রয়োজন। অভীকের যে এখন বড্ড প্রয়োজন তার ভাইকে।
অভীক বসে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়! চোখ মুখে বিষাদের কালিমা।শার্টের বুকের কাছে এখনো লেগে আছে নীতুর রক্ত।তাজা তাজা ফোয়ারার মত রক্তে ভেসে গিয়েছিল অভীকের বুকটা!এখন অবশ্য শুকিয়ে গেছে।কেবল ছোপ ছোপ লাল রংয়ের দাগ বসে আছে।কি আশ্চর্য!শুকিয়ে আসা রক্ত থেকে কেমন অদ্ভুত ঘ্রাণ আসছে!নীতুর রক্ত বলেই কি?রক্তের কি আলাদা কোন ঘ্রাণ থাকে?ভেবে কোন উত্তর পায় না অভীক!
কেবল জানে যতদিন বেঁচে থাকবে এই রক্তের দাগ বুকের ভিতর স্থায়ী দাগ হয়ে বসে থাকবে!অভীকের বুক ভার হয়ে আসে!চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীতুর নিস্তেজ দেহ! উফফ!কি অসহ্য ভয়ংকর দৃশ্য! অভীক এলোমেলো দৃষ্টিতে হসপিটালের করিডোরে চোখ বুলায়।কেমন অশান্তি অশান্তি অনুভূতি চারপাশে!বাতাসে অক্সিজেনের অভাব! দমবন্ধ হয়ে আসে অভীকের।কেন তার চোখের সাসনেই নীতুর এমন পরিস্থিতি হলো?কেন?
নীতুকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসছিল অভীক গাড়িতে করে।মেয়েটা কেমন বাবুই পাখির মত বুকে মুখ গুজে নিস্তেজ হয়ে পরেছিল।নীতুর শাড়ি রক্তে একাকার!যে শাড়ির ভাঁজে, এলোমেলো কুঁচিতে অভীক নিজেকে হারিয়ে ফেলতো ক্ষণে ক্ষণে, শাড়ির ওই লুটানো আঁচলে সদা আভিজাত্য খুঁজে পেতো… সেই সব লুকানো অনুভূতি কেমন ভেসে যাচ্ছিল রক্তের নহরে!সাথে অভীকের অদৃশ্য মনটাও। অভীক ফোঁস করে দম ফেলে।পালিয়ে যেতে মনে চায়! কিন্ত কোথায় যাবে নীতুকে ছেড়ে।কোথাও কি এমন কোন জায়গা আছে? যেখানে গেলে এই মেয়েটাকে তার মনে পড়বে না!কোথাও নেই….
অভীক বিড়বিড় করে বলে, “ফিরে এসো নীতু।প্লিজ, ফিরে আসো আমার কাছে..আমার কাননবালা!আমি অপেক্ষা করছি দেখো….কষ্ট হচ্ছে আমার!হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে অবিরত, তুমি কি বুঝতে পারছো না?এতটা পাষন্ড তো তুমি নও!”
নীতুকে রক্ত দেয়া হচ্ছে।বর্তমানে আই সিউ তে আছে নীতু!খুবই ধীর গতিতে শ্বাস ফেলছে অক্সিজেনের মাধ্যমে। ডক্টররা আশংকিত। এত বড় মেজর এক্সিডেন্টের পর কোন মানুষের ফিরে আসা কেবল মিরেক্কলের ব্যাপার।তিনঘণ্টা ওটি শেষে নীতুকে আই সিউ তে রাখা হয়েছে।সেই সময় শুধু অভীক উপস্থিত ছিলো হসপিটালে।বনপেপারে সাইন করার সময় কেমন হাত কাঁপছিল অভীকের!মনে হচ্ছিল নিজ হাতে মৃত্যুদন্ড লিখছে।অভীক পাথরের মত বসে আছে।কান্নার শব্দে করিডোরের বাতাস বিরক্ত লাগছে।বেশি কাঁদছে সাথি আর সেতু।থেকে থেকে কাঁদছে!অভীক বিরক্ত চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে তাজের দিকে তাকালো।এই ছেলেটা অভীককে ভীষণ অবাক করেছে।কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছে ফ্লোরে পা ছরিয়ে।অনবরত নিঃশব্দে কাঁদছে। বারবার শরীর কেঁপে উঠছে তাজের।মাথা নত করে বসে আছে।
নীতুর বাবাকে সুরভির কাছে রেখে পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে হসপিটালে।এত দ্রুত কি করে আসলো অভীক বুঝতে পারছে না। জায়েদ কোন কারণ ছাড়াই হুড়োহুড়ি করছে।ভীষণ অস্থির কর্মকান্ড।বুঝা যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরেছে।মিলন গোমড়ামুখে তুতুনকে কোলে নিয়ে বসে আছে।মহিমা বেগম নামাজ পরছে।পাটিতে বসেই চোখের জল ফেলছে। নিখিল আই সিউ রুমের দিকে চেয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। নিখিল অপেক্ষা করছে নীতুর ফিরার।নীতুর জ্ঞান ফিরলেই নিখিল একটা কথা বলবে,….”নীতু তুই খুব ভুল ধারনা পুষে রেখেছিস এতদিন মনে।আমরা তোকে অগণিত ভালোবাসি।কেবল বলা হয়নি বলে তুই বুঝতে পারিস নি।”
ইতু ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো জায়েদের দিকে।ইতু ভীষণ শক্ত মেয়ে হয়েও আজ নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ভাইয়া তোমার সব কথা তো নীতু আপা শুনে।আজ কেন তাকে বলছো না?চোখ মেলে তাকাতে! তুমি না আপার দাদাভাই,তুমি বললেই আপা শুনবে।বলে দেখো না?”…..জায়েদ নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।ইতু জায়েদের কনুই পেঁচিয়ে ধরে কাঁদছে।হুট করে মিতু এসে জায়েদের বুকে মাথা গুজে কাঁদতে শুরু করলো।জায়েদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা কাউকে কোন সান্তনা দিল না।একসময় নিজেও নিরবে চোখের জল ফেলতে শুরু করলো। প্রতিটি ব্যক্তি অপেক্ষা করছে নতুন ভোরের!যে ভোরে কমলা রঙা রোদের মত নীতু খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে!
ঠিক সেই সময় এলোমেলো পা ফেলে উপস্থিত হলো রিশা। রিশা হাঁটছে আর পাশ থেকে একজন নার্স বলছে,”ম্যাম হসপিটালে সিগারেট পান করা নিষিদ্ধ! ”
রিশা খেঁকিয়ে বললো,”এই বালের আইন কোন শালায় করছে?”
নার্স মেয়েটা হতভম্ব। রিশা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো ডাস্টবিনে।নার্স মেয়েটা থমথমে মুখে চলে গেলো। রিশা বড় বড় পা ফেলে জায়েদের সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো।তারপর বললো,”বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?”
সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো রিশার কথা শুনে।মিতু চেঁচিয়ে উঠে বললো, “কিসব অলক্ষণে বলছো? মাথা ঠিক আছে?”
রিশা যেন মিতুর কথা শুনলোই না।ফের বললো,”বেঁচে আছে?”
জায়েদ রুক্ষ স্বরে বললো,”বেঁচে আছে।”
রিশা মারমুখী হয়ে বললো,”তবে মরাকান্না করছেন কেন সবাই?আমার ডার্লিং বেঁচে আছে,তবে কিসের এত কান্না?ডার্লিং আমার ফাইটার!এতটুকু কষ্ট ঠিক সয়ে নিবে।”
অভীক খুবই অবাক হলো রিশার আচরণে কিন্তু কিছুই বললো না। রিশা সবার কান্নারত মুখের দিকে একবার করে চোখ বুলালো।তারপর নিজের উরুতে হাত দিয়ে বাড়ি মেরে বললো,”শালা একে বলে বাঙালি।নেতা মরলে তার কবরে ফুলের তোড়া দিয়ে ভরিয়ে ফেলি আর বেঁচে থাকতে গালি গালাজ, নিন্দে মন্দ করতে ছাড়ি না!আরেব্বাস,নীতু ডার্লিং দেখি নেতার কপাল নিয়ে জন্মেছো!ভালো,খুব ভালো। ”
জায়েদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তারপর চলে গেলো রুমের এক কোণে।রিশার এই মানুষ গুলোর কান্না দেখে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল।ফ্লোরে বসা তাজকে দেখে রিশা সেদিকে এগিয়ে গেলো।তারপর মিচকা হাসি দিয়ে বললো,”আরে এ যে দেখছি, ডিজিটাল যুগের দেবদাস! পার্বতী,চন্দমুখী দুজনই তার চাই।একেই বলে ছেলেদের কপাল,ঘরে বউ রেখে প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে ভাববে।আর মেয়েরা করলে পরকিয়া হয়ে যায়!কেন রে ভাই? প্রেমিকাকে যদি এতই ভালোবাসিস তবে বিয়ে করলি কে? আর অপারগ হয়ে বিয়েই যদি করলি তবে মুক্ত করে দিচ্ছিস না কেন প্রাক্তনকে?কেন তাকে ধরে বেঁধে বারবার মনে করিয়ে দিস,ভালোবাসিস! প্রোপারলি বেঁধে রাখতে না পারলে প্রোপারলি ছেড়ে দিতে কেন পারিস না তোরা?প্রাক্তনকেও বাঁচতে দে।তা না খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরো কষ্টে বাড়িয়ে দিস তোরা।যেন সব ভুল একজনের।”
তাজ টকটকে লাল চোখে রিশার দিকে তাকিয়ে রইলো।হুট করে মনে হলো,নীতু যেন তার জন্যই এত কষ্ট পাচ্ছে। রিশা ঠিকই বলছে।মুক্ত করে দেয়া উচিত ছিল নীতুকে, যাতে উড়তে পারে খোলা আকাশে!
সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,”চুপ করো রিশাপু।আমরাও আপির জন্য কষ্ট পাচ্ছি। এরকম কথা বলো না।”
রিশা চেঁচিয়ে উঠে বললো, “মেয়েদের এই গদগদ ভাবই আমার পছন্দ নয়।আমি আজ বলছি আমার ডার্লিংয়ের কিছু হলে, প্রত্যেকটাকে জেলের ভাত খাওয়াবো শালা!ঢং দেখাস এখন তোরা?মেয়েটা যখন সব হারিয়ে শূন্য হয়ে গিয়েছিল তখন কই ছিলি।আর আজ যখন নিজের মত বাঁচতে চাচ্ছিল মেয়েটা তখনও তোরা তোদের মত ডিসিশন চাপিয়ে বেড়িয়েছিস সবাই!যেন মেয়েটারই সব দোষ!শালা হারামখোর!”
রিশার কথার তোড়ে কেউ কোন কথা বলতে পারলো না।রিশা ধপ করে এসে অভীকের পাশে বসলো।অভীক উরুতে হাতের ভর রেখ থুতনি বুকের কাছে গুজে রেখেছে।নীতুর কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত একদন্ডের শান্তি পাবে না।বার বার নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাচ্ছে!ঠিক তখনই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডক্টর এসে বললো,”রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। রোগীর শরীর ব্লাড গ্রহণ করছে না।হাত পা নীল হয়ে আসছে।অক্সিজেন দেওয়ার পরও নিঃশ্বাসের উঠানামা খুবই কম।এরকম চললে….. ”
ডাক্তার কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই রিশা খেঁক করে উঠে বললো,”বাকি কথা মুখেও আনবেন না ডক্টর। তাহলে আমার হাত উঠে যেতে পারে।বাপ মায়ে ডাক্তারি পড়াইছে রোগীর সেবা করার জন্য, এত লম্বা প্যাচাল পাড়ার জন্য না।যান আপনার রোগীর কাছে যান।এত লম্বা প্যাচাল পারলে ট্রিটমেন্ট করবেন কখন?”
ডাক্তার আহাম্মকের মত চেয়ে থেকে চলে গেলো।এই প্রথম অভীক ভেঙে পরলো।হু হু করে কেঁদে উঠলো।রুশিয়া বেগম দৌড়ে এসে ছেলেকে জরিয়ে ধরলেন।অভীক শেষ কেঁদেছিল বাবার মৃত্যুতে আর আজ কাঁদছে কৃষ্ণবতী কাননবালার জন্য! পরিণত পুরুষের কান্না হয় ভয়ংকর! তাদের কান্না দেখলে মনে একধরনের মায়ার উদয় হয়!এরা সহজে কাঁদে না।যখন কাঁদে তখন চারপাশে তোলপাড় শুরু হয়।
রিশা টেনশনে উত্তেজনায় আবার একটি সিগারেট ধরালো।রিশা জানে নীতুকে ফিরতেই হবে।একটা মানুষ পৃথিবীতে এসে শুধু দুঃখ পেয়ে যাবে তা তো হয় না।শুধু দুঃখ কারো জন্য বরাদ্দ থাকেনা।একসময় সুখ আসে।সে পর্যন্ত কেবল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।সৃষ্টিকর্তাও হেরে যাওয়া পছন্দ করেন না।দুঃখের ঘড়া পূর্ণ হলেই সুখ আসবে।নীতুকে সেই সুখ উপভোগ করতে হবে……
চলবে,
কি যে চাপের উপর লিখছি….. ভাই রে ভাই! পরিক্ষা আমার জীবন ঝালাপালা করে দিল!